শারমীন শরীফ : আধুনিক বাঙালি বা বাংলাদেশীদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অথবা বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসার নমুনা হল বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস বা একুশে ফেব্রæয়ারীতে ঘটা করে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করা, ব্যাস এখানেই শেষ, এরপরে আর কিছু নেই। আমিও তার বাইরে নই। অন্যদেশে বসে, থিমের সাথে ম্যাচ করে শাড়ি পড়ে, কপালে লাল বা কালো টিপ পড়ে অন্যদের আয়োজন করা এই সকল অনুষ্ঠান গিয়ে বন্ধুদের সাথে হৈচৈ করে গাল ভরে ঝালমুড়ি আর চা খেয়ে বাসায় ফিরে ভাবি খুব একটা কাজ করে এলাম, সাথে কিছু ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে সবাইকে দেখাই আমিও এর অংশ ছিলাম। আমি এর কোনটাকেই খারাপ বলছি না বা সবাই এক কাতারে পড়েন বলেও দাবী করছি না। আমি যেটা বলতে চাচ্ছি সেটা হল অনেক মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে যে দেশটি আমরা পেয়েছি এবং যা নিয়ে বিশ্বের কাছে আমাদের এত গর্ব সেটার পিছনের গল্পটা আমরা তেমন মনোযোগ দিয়ে যেন জানতে চাই না, যা জানি তা সব কেমন যেন ভাসা ভাসা। অনেকে হয়ত আমার এ লেখা পরে হাসবেন বা বলবেন যে, ‘বাঙালি তো সেই মুক্তিযুদ্ধেই আটকে আছে, ওই এক বিষয় নিয়েই তো আমরা এখনো খাবি খাচ্ছি, তাহলে কি বলছে এই মহিলা’! কথা সত্যি এবং সেটা খারাপও কিছু নয় কিন্তু আমার কেন যেন মনে হয় আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধটা কিংবদন্তি নয় বরং ধীরে ধীরে রূপকথায় পরিণত হচ্ছে, “ওয়ান্স আপন আ টাইম, দেয়ার ওয়াজ আ ল্যান্ড কল বাংলাদেশ”, এবং মনে হয় এর একটাই কারণ, অসচেতনভাবে বিষয়টাকে আমরা হালকা করে ফেলেছি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো একে ব্যবহার করে নিজেদের ট্রাম্পকার্ড হিসেবে, সাধারণ মানুষ বেঁচে থাকার সংগ্রামে এতটাই ব্যাস্ত যে তাঁদের কিছুতেই কিছু যায় আসে না আর আমাদের মত এক বিশাল জনগোষ্ঠি যারা ভাল থাকার আশায় দেশ থেকে ভেগেছি, আমরা দূরে বসে নাটক দেখি এবং ফেসবুকে আমাদের গুরুত্ত¡পূর্ণ মতামত দেই। কষ্টে থাকা দেশের সাধারণ মানুষগুলো নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে, ‘এই জন্য দেশটা স্বাধীন করেছিলাম’? এদের কথা কেউ শোনেও না বা কেউ ভাবেও না যে, “কি করিলে কি হইতো বা কি হইতে পারিত বা ভবিষ্যতে কি হইবে!”

এত গুরুগম্ভীর কথা লিখে আমি নিজেও ভড়কে যাচ্ছি এই ভেবে যে আমি নিজেই বা কি জানি যে বিজ্ঞজনদের কার্যকলাপের সমালোচনা করছি? তবে ভাবছি যে একজন সচেতন মানুষ বা বাঙালি হিসেবে এখনো সময় আছে জানবার বা নিজে জানলে অন্যদেরকের তার অংশীদার করবার। একটা মজার বিষয় আমি নিরবে খেয়াল করেছি, যখনই মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কোনকিছু হয় তখন শুধু পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের কে সামনে নিয়ে আসা হয়, তাঁরা আলোচনা করেন, যুদ্ধের গল্প বলেন কিন্তু আমি এখনো দেখিনি কোন নারী মুক্তিযোদ্ধাদের লাইম লাইটে নিয়ে আসতে বা তাঁদেরকে এই দুঃখ, আনন্দের বা গর্বের অংশীদার করতে, কিন্তু কেন? আমাদের দেশের মুক্তি আন্দোলনে ধনী, গরীব, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, শহরের বা গ্রামের সব রকমের পুরুষ যুদ্ধে গিয়েছেন এবং এদের সংখ্যাই বেশি এবং নারীদের ক্ষেত্রে বিষয়টা এমন ব্যাপক নয়। শিক্ষিত শ্রেণির যে সকল নারীরা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন তাঁদের যুদ্ধের হাতিয়ার ছিল তাঁদের কণ্ঠ বা কলম। তাঁরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে বসে গান গেয়ে বা লেখার মাধ্যমে সবাইকে উৎসাহ বা প্রেরণা যুগিয়েছেন। এই শ্রেণীর কোন নারী যদিওবা সম্ভ্রম হারিয়েছেন কোন পাকসেনার কাছে, সম্মান হারানোর ভয়ে তাঁরা সেটা পুরোপুরি চেপে গিয়েছেন। বাকি রয়ে গেল আমাদের গ্রাম-গঞ্জের একেবারে একেবারে সাধারণ মা-বোনেরা। যারা হয়তো বা সরাসরি যুদ্ধে গিয়েছেন, রাইফেল হাতে যুদ্ধ করেছেন বা লুন্ঠিত হয়েছেন পাকসেনাদের হাতে। যারা বেঁচে আছেন, এঁদের কে কেউ কোথাও ডাকে না বা আমাদের সম্মানিত পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে কোন অনুষ্ঠানে এঁদেরকে কখনো বসতে দেখি না। এই সকল নারী মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নিয়ে কেউ যে ভাবেনি তা নয়, বরং এখনো কিছু সচেতন মানুষ রয়েছেন যারা নিরলসভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক চিত্রটির ছবি আঁকার চেষ্টায় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণেই আমরা অনেক অনেক নারী মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় এবং তাঁদের কাহিনী জানবার সুযোগ পেয়েছি। তাঁরা হয়ত বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছুটে বেড়িয়েছেন বা এখনো বেড়াচ্ছেন এইসকল তথ্য লিপিবদ্ধ করবার জন্য এবং আমি বলব এরাও কিছু কম যোদ্ধা নন! আমাদের মুক্তির জন্য যুদ্ধ কি শেষ হয়েছে? আমার মনে হয় হয়নি, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বদলেছে শুধু।

স¤প্রতি এক নারী মুক্তিযোদ্ধার বিষয়ে একটা লেখা আমার নজরে এল, ভাবলাম তাঁকে নিয়ে কিছু লিখি আর সেই কারণেই আমার এ দীর্ঘ ভূমিকা। যারা এই সকল হারিয়ে যাওয়া নারী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গবেষণা করছেন এবং লেখার মাধ্যমে আমাদের সম্মুখে তাঁদের পৌঁছে দিচ্ছেন তাঁদের কে লাল সালাম জানিয়ে আজ আমি কাঁকন বিবির গল্প বলব। কাঁকন বিবি খুব সাধারণ এক নারী, সুনামগঞ্জের সীমান্ত অঞ্চলে এক খাসিয়া পরিবারে তাঁর জন্ম। তাঁর বাবা ছিলেন একজন কৃষক। তিনভাই ও দুবোনের মধ্যে কাঁকন বিবি ছিলেন সবার ছোট। তিনি কৃষক পরিবারের মেয়ে হলেও অভাব অনটনের মধ্যে বড় হননি। বড় বোন থাকতেন সীমান্তের ওপারে এবং কাঁকন বিবির বেশিরভাগ সময় কাটত ওপারে তাঁর বড় বোনের বাড়িতে। কোন এক কারণে বড়বোন কাঁকন বিবিকে ধর্মান্তরিত করেন এবং নতুন নাম হয় নূরজাহান বেগম। এরপরে সুনামগঞ্জের শহীদ উদ্দীন নামে এক ব্যাবসাহীর সাথে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পরে কাঁকন বিবির প্রথম পুত্র সন্তান জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই মারা যায় এবং এরপরে তাঁর আরেক পুত্র সন্তানও জন্মের মাত্র দুই বছর পরে মারা যায়। এভাবে কাঁকন বিবির আরো পাঁচটি সন্তান জন্মের পরে মৃত্যু বরণ করে। তিনি আবারও গর্ভবতী হন এবং একমাত্র মেয়ে সখিনা পেটে থাকা অবস্থায় শহীদ উদ্দিন তাঁকে তালাক দেয়। শারীরিক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত গর্ভবতী কাঁকন বিবিকে পাঞ্জাবি সীমান্ত রক্ষী আব্দুল মজিদ খান বিয়ে করে ঘরে তোলেন এবং এর দু’বছর পরে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।

১৯৭১-এ বাঙালিরা যখন লড়ছে স্বাধীনতার জন্য তখন পাঞ্জাবিরা লড়ছিল পাকিস্তান রক্ষার জন্য। কাঁকন বিবির স্বামী তখন পাকিস্থান রক্ষার কাজে ব্যাস্ত হয়ে গিয়ে স্ত্রীকে ফেলে যুদ্ধে মনোনিবেশ করে। নিরন্ন অবস্থায় কাঁকন বিবি তখন স্বামীর খোঁজে বোগলা ক্যাম্পে আসেন। বোগলা ক্যাম্প ছিল সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার থানায়। ওই সময় কাঁকন বিবির পাঞ্জাবি স্বামী যুদ্ধের কারণে সিলেটে চলে যায় এবং কাঁকন বিবি একা হয়ে পড়েন। তিনি ক্যাম্প থেকে ক্যাম্পে স্বামীকে খুঁজতে শুরু করেন এবং দেখতে পান পাকসেনারা বাঙালি মেয়েদের প্রতি কি নির্মম অচ্যাচার চালাচ্ছে যেটা তাঁর মনে গভীর রেখাপাত করে। স্বামীকে খুঁজতে গিয়ে দোয়ারাবাজারের উত্তর ক্যাম্পে তিনি বন্দী হন পাকসেনাদের হাতে।
মুক্তিবাহিনীর চর সন্দেহে তাঁর উপরে চলে অকথ্য অত্যাচার। লোহার শিক গরম করে তাঁর শরীরের বিভিন্ন অংশে ঢুকিয়ে দেয়া হয়, যে ব্যাথা আর দাগ এখনো মিলায়নি। কাঁকন বিবি ভেবেছেন তাঁর বেঁচে থাকার দিন বুঝি শেষ হয়ে এল। এক পাক আর্মি মেজর ধারণা করেন যে তিনি বাঙালি নন, তাই তাঁকে সত্যি কথা বলার সুযোগ দেয়া হলে তিনি তাঁর স্বামীর নাম বলেন এবং সাথে এও জানান যে স্বামী একজন পাঞ্জাবী জোয়ান। জোয়ান আব্দুল মজিদ খান তখন ছিলেন সিলেটের আখালিয়া ক্যাম্পে। সেখানে ওয়ারলেস করে কাঁকন বিবির কথা সত্যতা যাচাই করা হয় এবং তিনি ওই ক্যাম্পে বসবাস শুরু করেন। কাঁকন বিবি যেহেতু বাংলায় কথা বলতে পারতেন পাক আর্মিরা সেটার সদ্যবহার করতে চায় এবং কাঁকন বিবিকে ভিক্ষুক সাজিয়ে গ্রামে পাঠায় মুক্তিযোদ্ধাদের খবর আনবার জন্য। কাঁকন বিবি রাজি হলে তাঁকে এক টুকরো কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলা হয় কোন পাক আর্মি ধরলে সে যেন কাগজটা দেখায় এবং কোন মুক্তি বাহিনীর হাতে পড়লে কাগজটা চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে।

কাঁকন বিবি মুক্তিবাহিনীর কাছে এসে সব কথা খুলে বলেন এবং মুক্তিযোদ্ধারা তখন তাঁকে উল্টো গোয়েন্দাগিরি করার জন্য সাহস যোগান এবং কাঁকন বিবিকে রাজি করতে সক্ষম হন। দাবার ছক উল্টে গেলে শুরু হয় পাকসেনাদের বিরুদ্ধে কাঁকন বিবির এক ভয়ঙ্কর অভিযান। কাঁকন বিবি পাকসেনাদের সকল অবস্থানের পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর দিতে থাকেন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। একসময় পাকবাহিনী কাঁকন বিবিকে সন্দেহ করতে শুরু করলে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে সরিয়ে দেয় পাঁচ নং সেক্টরের লক্ষীপুর ক্যাম্পে কমান্ডার মীর শওকত আলী ও ক্যাপ্টেন হেলাল উদ্দীনের তত্তাবধানে। সেখানে গিয়ে কাঁকন বিবি মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচর্যায় আত্মনিয়োগ করেন। যুদ্ধক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার ও অস্ত্র সরবরাহ হয়ে ওঠে তাঁর প্রধান কাজ। অগাস্ট মাসে পাকবাহিনী এই অঞ্চলে প্রবেশ করে। তাদেরকে আটকাতে গভীররাতে জর্ডিয়া ব্রিজ ধ্বংশ করার পরিকল্পনা করে মুক্তিযোদ্ধারা। এই অপারেশন সফল করার জন্য কলাগাছের ভেলায় করে বোমা, অস্ত্র ও অন্যান্য রসদ বহন করে একাই এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে কাঁকন বিবি জর্ডিয়া সেতুর কাছে পৌঁছে যান। তাঁর বিশেষ সিগন্যাল পেয়ে আরো তিন, চারজন মুক্তিযোদ্ধা অন্য পথে ব্রিজের কাছে পৌঁছে যান এবং মাইন বিষ্ফোরণের মাধ্যমে জর্ডিয়া ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে সক্ষম হন। মাইন বিষ্ফোরণের মাধ্যমে এই ব্রিজ ধ্বংসের বড় কৃতিত্ব কাঁকন বিবির। (চলবে)