শারমীন শরীফ : পাঁচ নং সেক্টরের লক্ষীপুর ক্যাম্পের মুক্তিযুদ্ধের প্রায় প্রতিটি গেরিলা অপারেশনে কাঁকন বিবির সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। মহব্বতপুর, কান্দাগাঁও, বসরাই টেংরাটিলা, বেটিরগাঁও, নুরপুর, দোয়ারাবাজার, টেবলাই, শিলাইপাড়ের যুদ্ধ, পূর্ববাংলার যুদ্ধ – এমন প্রায় কুড়িটির মতো সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন তিনি। তিনি সরাসরি অস্ত্র চালাননি তবে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য স্থান থেকে স্থানে গোলাবারুদ বয়ে বেড়িয়েছেন। কখনো পায়ে হেটে আবার কখনো বা কলাগাছের ভেলায় সহযোদ্ধাদের কাছে অস্ত্র পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। ঝোঁপঝাঁড়ের ভেতর দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সমান্তালে ছুটেছেন শ্ত্রæকে নির্মূল করবার জন্য।

পাকবাহিনীর ক্যাম্প ছিল জাওয়ার দক্ষিনদিয়ায়। ক্যাম্পটি ছিল একেবারে জঙ্গলের ভেতরে, কাঁকন বিবি একা গিয়ে সেই ক্যাম্পের অবস্থান জেনে আসেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের পুংখানুপুংখ ভাবে বুঝিয়ে দেন পাক বাহিনীর সকল খুঁটিনাটি এরপরে বড় একটি দল নিয়ে ছুটে যান পাকআর্মী ক্যাম্প আক্রমণ করার জন্য। পথে যেতে একটি নদী পড়ে সেটার কথা কাঁকন বিবির কারণে যোদ্ধারা আগেই জেনেছিলেন বলে তেমনি ভাবে প্রস্তুত ছিলেন। কলা গাছের কয়েকটি ভেলা বানিয়ে তিন জন করে সেই ভেলায় চড়ে নদী পাড়ি দিয়ে ওপারে পৌঁছান সবাই। এরপরে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে দু’দিক থেকে শত্রæ ক্যাম্প আক্রমণ করেন মুক্তিযোদ্ধারা এবং এইসব কিছুর মধ্যে কাঁকন বিবি উপস্থিত ছিলেন সহযোদ্ধাদের যেকোন রকমের সাহায্য করবার জন্য।

একটি গ্রæপ ছুটে যায় ব্রিজের কাছে, যেটি সিলেটের সাথে সুনামগঞ্জকে সংযুক্ত করেছে। মুক্তিযোদ্ধারা বোমা মেরে উড়িয়ে দেন সে ব্রিজ। খবর পেয়ে সিলেট থেকে ছুটে আসে পাক-বাহিনী কিন্তু ওই মূহুর্তে তাঁদের কিছুই করার থাকেনা ব্রিজ ভাঙ্গা বলে এবং ফিরে যায় তারা। এরপরে দু’দিক শুরু হয় মুক্তযোদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমণ এবং পাক-বাহিনীর সাথে সেই যুদ্ধ চলে দুইরাত ও একদিন। একসময় পাক-বাহিনীর গুলি শেষ হয়ে গেলে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সমর্পন করতে বাধ্য হয়। এদিন কথা বলতে গিয়ে কাঁকন বিবি নিজের মুখে বলেছেন, ‘জয়বাংলা স্লোগান দিতে দিতে আমরা ওদের ঘিরে ফেলি। আমাকে দেখে এক সৈন্য বলে, আগেই বলেছিলাম এই বেটি মুক্তিবাহিনীর।’

১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে টেংরাটিলায় পাক সেনাদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন তিনি। এই যুদ্ধে তার দেহে কয়েকটি গুলি বিদ্ধ হয়। শেষ জীবনেও উরুতে কয়েকটি গুলির চিহ্ন রয়ে গেয়েছিল। দেশ স্বাধীন হলে কাকন বিবি ফিরে গিয়েছিলেন ভাইদের কাছে কিন্তু সম্মানহানির ভয়ে ভাইরা তাঁকে গ্রহণ করেনি। পাঞ্জাবী জওয়ান স্বামীর কাছেও ফিরে যাবার উপায় ছিলনা। মুক্তিবেটি কাঁকন বিবির জীবনে শুরু হয় নতুন এক সংগ্রাম। স্বাধীনতার পর সহায়-সম্বলহীন কাকন বিবি একেবারে অসহায় হয়ে পড়েন। পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত করা ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের মধ্যে মাথা গোঁজার ঠাঁই পর্যন্ত কোথাও পাননি রণাঙ্গনের এই বীর সৈনিক। দোয়ারাবাজার উপজেলার লক্ষীপুর ইউনিয়নের ঝিরাগাঁও গ্রামে এক ব্যক্তির কুঁড়েঘরের বারান্দায় মেয়ে সখিনাসহ আশ্রয় নেন এবং বেঁচে থাকার জন্য ভিক্ষাবৃত্তি শুরু করেন। দোয়ারাবাজারের দিনমজুর আব্দুল করিম তাঁর হাঁস মুরগি রাখার ঘরটা ছেড়ে দিয়েছিলেন কাঁকন বিবি ও তাঁর কন্যার জন্য। এলাকায় তাঁকে ডাকা হত ‘খাইস্যা মুক্তি বেটি’ নামে। এর পরের প্রায় ২ যুগ তিনি ছিলেন সবার চোখের অন্তরালে। ১৯৯৬ সালে স্থানীয় সাংবাদিক কাঁকন বিবির উপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করলে বিষয়টি সকলের গোচরে আসে এবং দেশব্যাপী এই নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ উদ্যোগ নিয়ে কাঁকন বিবিকে ঢাকায় নিয়ে আসে এবং তাঁর জন্য একটি সংবর্ধনার আয়োজন করে। সেই থেকে আমৃত্যু তাঁকে মাসিক এক হাজার টাকা প্রদানের ব্যাবস্থা করে দেয়। ১৯৯৯ তে দৈনিক জনকন্ঠ আরেকটি সংবর্ধনার মাধ্যমে কাঁকন বিবিকে নগদ ২৫ হাজার টাকা প্রদান করে। পরবর্তীতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে এক একর খাস জমি প্রদান করেন। সিলেটের মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান তাকে ঐ জায়গার ওপরে একটি ছোট কুঁড়েঘর নির্মাণ করে দেন। এরপরের কয়েক বছর মোটামুটি ভাল কাটলেও পরবর্তীকালে অর্থাভাবে নিয়মিত চিকিৎসা করাতেও অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় তাকে।

১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী তাকে বীরপ্রতীক উপাধিতে ভূষিত করার ঘোষণা দেন কিন্তু আজও তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়নি।খাসিয়া পরিবারের মেয়ে কাঁকন বিবির আসল নাম ছিল কাঁকাত হেনিনচিতা। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ভারতের মেঘালয়ের নাইরয়া গ্রামে তার জন্ম এদেশে জন্মগ্রহণ না করেও এদেশকে ভালোবেসে যে নারী জীবনের সবচেয়ে কঠোর সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন তার প্রতিদান আমরা কতটুকু দিতে পেরেছি সেই হিসাব না হয় তোলা থাক। কিন্তু নারী হয়েও যে অসীম সাহসিকতা আর সংগ্রামের গল্প তিনি লিখে গেছেন এদেশের ইতিহাসে তা লেখা থাকবে যুগের পর যুগ। ২০১০ সালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় তাঁকে বীর প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করে সাময়িক সনদপত্র প্রদান করে। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মৌখিক ঘোষণার ২১ বছরেও খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কাকন বিবি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৩ সালের পর খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের কোন গেজেট হয়নি। খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটেড না হওয়ায় তিনি খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের অনুরূপ কোন সুযোগ-সুবিধা পান নি।

২৮ এপ্রিল ২০১৩, সিলেটে জনতা ব্যাংক লি. কর্তৃক প্রদত্ত এক সম্মাননা অনুষ্ঠানে অগ্নিকন্যা কাঁকন বিবি নিজের নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করার জন্য সরকারের নিকট দাবি জানান। তিনি বলেন, ‘আমি মারা গেলেও এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চিরদিন বেঁচে থাকবে’। সম্মাননা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রবাসে মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জনতা ব্যাংক লি. এর চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত। এর আগেও বিভিন্ন সময় তিনি নিজ গ্রামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছেন তিনি।

ব্রেন স্ট্রোক করে ২০১৭ সালের ২১ জুলাই ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন কাঁকন বিবি। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন তিনি। ২০১৮ সালের ২০ মার্চ গুরুতর অসুস্থাবস্থায় তিনি ওসমানী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ১০৩ বছর। ২০১৮ র ২১ মার্চ বুধবার রাত ১১টা ৫ মিনিটে এখানেই মৃত্যুবরণ করেন বীরাঙ্গনা এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।

বীর মুক্তিযোদ্ধা কাকন বিবি মহান মুক্তিযুদ্ধে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক নির্যাতিত ও ধর্ষিত লক্ষ লক্ষ সংগ্রামী নারীর এক জীবন্ত প্রতীক বা প্রামাণ্যচিত্র। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন, সম্ভ্রম হারিয়েছেন, আত্মীয়স্বজন, সহায়-সম্বল সব হারিয়েছেন এবং বিপদসংকুল পরিবেশের মধ্যেও দেশের প্রতি ভালবাসা বুকে আগলে রেখে জীবনের তোয়াক্কা না করে দেশকে স্বাধীন করেছেন; তাঁরা সর্বকালে, সর্বাবস্থায় জাতির শ্রেষ্ঠতর সন্তান। তাঁরা আমাদের অহংকার, গর্ব, চেতনা ও প্রেরণার আলো হয়ে কোটি কোটি বছর প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বেঁচে থাকবেন আমাদের ইতিহাসে, আমাদের অন্তরে।