শারমীন শরীফ : বাংলাদেশের স্বাধীনতা এখন পর্যন্ত আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন। এই স্বাধীনতা অর্জন করতে গিয়ে যে পরিমাণ মানুষকে জীবন, মান-সম্মান বলিদান করতে হয়েছে তার দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে বিরল। বাঙাল জাতি স্বধিকার আন্দোলন ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করে, বিজয়ী হয়ে প্রমাণ করেছেন যে, তারা বীরের জাতি। তারা প্রমাণ করেছে যে ধানের দেশ গানের দেশই শুধু বাংলাদেশ নয়, এদেশে সংগ্রামের দেশ, রক্ত ঝরানো ইতিহাসের দেশ।
এদেশের সকল সংগ্রামে নারীরাও পুরুষের পাশাপাশি সংগ্রাম করেছেন, কারাবরণ করেছেন রাজপথে আন্দোলন করেছেন। এমনকি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সমরাস্ত্র গেরিলা যুদ্ধে করে নিজেদের সাহস ও দেশপ্রেমের নজির স্থাপন করেছেন।এই যুদ্ধে লাখ লাখ মা বোন নিজেদের ইজ্জত হারিয়েছেন। তাদের বীরাঙ্গনা নাম দিয়ে সমাজে তাদের সম্মানকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে কিন্তু যোদ্ধা বলা হয়নি তাঁদেরকে। মুক্তি সংগ্রামে পুরুষদের অংশগ্রহণের দলিল আছে সর্বত্র। কিন্তু যে সব নারীরা তাদের সহযোদ্ধা হয়ে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধকরেছিলেন তাদের নাম ইতিহাসের খুব কমই স্থান পেয়েছে।
আজ আমরা সংগ্রামী এক নারী ঊষা ব্যাপারির গল্প শুনবো। ১৯২০ সালের ৩১ শে অক্টোবর রাজবাড়ী শহরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা হারেস মুন্সি চার্চের ধর্মযাজক ছিলেন। বাবা ব্রিটিশ আমলে মেট্রিকুলেশন পাস করেন এবং মা এস মুন্সী গৃহিনী ছিলেন। তিন ভাই চার বোনের মধ্যে ঊষা সবার বড়। মা এবং বাবার উদার মানসিকতা হওয়ার কারণে বাড়িতে সাংস্কৃতিক পরিবেশ ছিল যে কারণে সব রকম মিউজিক ইন্সট্রুমেন্ট ছিল বাড়িতে। গান হতো, নাচ হতো, হতো নাটক অভিনয় বা কখনো সেতার বাজানো হতো।
তিনি শিক্ষা জীবন শুরু করেন ময়মনসিংহ মিশন স্কুলে। বাবার চাকরির সুবাদে সেখানে তিন বছর পড়াশোনা করেন তারপর কুমিল্লা ফয়জুন্নেসা স্কুলে তৃতীয় শ্রেণি থেকে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। এরপরে তার বাবা বদলি হয়ে সিরাজগঞ্জে চলে যান, সেখানে গিয়ে তিনি সালেহা ইসহাক সরকারী গার্লস স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন। সেই স্কুল থেকে ১৯৪৬ সালে মেট্রিক পাশ করেন। মেট্রিক পাশ করার পর পৈত্রিক নিবাস ফরিদপুরের মিশন স্কুলে শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত হন তিনি। ইতিমধ্যে পিতার প্রয়াণ হলে পরিবারে অভাব, অরাজকতার সৃষ্টি হয়। ছোট ভাইবোনদের সাহায্য করার কেউ ছিলনা তখন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন নার্সিং ট্রেনিং নেবেন। তার মায়ের এতে তেমন মত ছিল না কিন্তু মায়ের বাঁধা উপেক্ষা করে তিনি ১৯৫০ সালে সিনিয়র নার্সিং ট্রেনিং নিতে শুরু করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেই সময় বাঙালি মেয়েরা তেমন আসত না এই পেশায়। তার অনুসারী হয়ে মেজবোন শোভাও তার সাথে নার্সিং ট্রেনিং এ ভর্তি হন।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে অনেক ছাত্র ভর্তি হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ঊষা বেপারী তখন নার্সিং দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১২ নাম্বার ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। দুপুরে পুলিশের গুলিতে আহত ছাত্রদের দ্বারা হাসপাতালের ১২ নাম্বার ওয়ার্ড ভরে গেলে, বেডে জায়গা হচ্ছিল না বলে মেঝেতে বিছানা পেতে দেয়া হয়েছিল। পুলিশের তাড়া খেয়ে আরো ছাত্ররা লুকাতে এলো সেই ওয়ার্ডে, তিনি তাদের কাউকে বাথরুমে লুকিয়ে, কাউকে বা মিথ্যের রোগী সাজিয়ে রক্ষা করেন। পুলিশ খুঁজতে এলে তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে এই ওয়ার্ডে কোন ছাত্র নেই উর্দুতে একথা বলে পুলিশদের বিদায় করে দিয়েছিলেন।
একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সেদিন শীতের দুপুর হস্টেলে রোদে পিঠ দিয়ে বসে গল্প করছিলাম কয়েকজন। বর্তমানে যেখানে ক্যান্সার বিভাগ – সেখানে তখন ছিল নার্সদের হোস্টেল। মেডিকেল কলেজের বর্তমান ক্যাজুয়ালটি বিভাগ তখন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশ। মেডিকেল ছাত্রদের হোস্টেল ছিল পুলিশ ব্যারাকের মত এবং এর প্রবেশদ্বার ছিল বর্তমান শহীদ মিনারের পাশ দিয়ে। পুরনো নার্সিং হোস্টেল এবং মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের হোস্টেলের মাঝখানে কোন বাড়িঘর না থাকায় নার্সিং হোস্টেলের মাঠ থেকে বড় রাস্তা দেখা যেত। হঠাৎ গুলির শব্দ সেদিন। ছাত্রদের চিৎকার আর দৌড়াদৌড়ি আমাদের সচকিত করে দিল। স্লোগান শুনতে পেলাম ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। পেছন থেকে দেয়াল টুকে কয়েকজন ছাত্র হাপাতে হাঁপাতে বলল পাকিস্তানি বর্বররা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের উপর গুলি ছুঁড়ছে। আপনারা এগিয়ে যান হাসপাতালে যদি কিছু আহত ভাইদের বাঁচাতে পারেন। রাস্তায় তাকিয়ে দেখি কয়েকজন গুলি খেয়ে পড়ে আছে, আর স্থির থাকতে পারলাম না চিৎকার করে সবাইকে ডেকে হাসপাতালে চলে এলাম জরুরী বিভাগে। জরুরী বিভাগ তখন লোকে লোকারণ্য। আহত ছাত্রদের টেবিলে জায়গা হচ্ছে না, রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে। মাটিতে বসে ডাক্তারের নির্দেশ অনুযায়ী ব্যান্ডেজ বেঁধে ইনজেকশন ও প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র দিলাম। তখন সাহায্য করছিলেন মাওলানা তর্ক বাগিশ এর ছেলে ডাক্তার নুরুল আমিন, প্রফেসর ফজলে রাব্বি, বিদেশি প্রফেসর ডাক্তার নোভাক এবং ব্রিটিশ মেজর এলিনসন। মন প্রাণ দিয়ে সেদিন আমরা আহতদের সেবা করলাম। রাত্রিকালীন ডিউটি থাকায় রুমে ফিরে এসে রাতের জন্য প্রস্তুতি নিলাম। সেদিন আমাদের হাজিরা নিচ্ছিলেন এক মাদ্রাজি সিস্টার। তিনি আমাকে বললেন যে, আহত ছাত্রদের জন্য যে নতুন কক্ষ খোলা হয়েছে সেখানে আমাকে কাজ করতে হবে। নতুন কক্ষ হল ১২ নাম্বার ওয়ার্ডে, যেখানে সারাদিন আমি সেবা করেছি, গেলাম ১২ নাম্বার ওয়ার্ডে।’
মূলত ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রæয়ারিতে সংঘটিত ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী তিনি এবং অসংখ্য গুলিবিদ্ধ আহত ছাত্রদের সেবা তিনি সেদিন প্রদান করেছিলেন।
১৯৫৪ সালের নার্সিং কোর্স পাস করার পরে পোস্টিং হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং সেখানে একনাগারে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত কাজ করেন। এর মধ্যে ১৯৬৬ সালে ইস্ট পাকিস্তান সোশ্যাল খ্রিষ্টান সোসাইটির ফিল্ড অফিসার নিকোলাস নরেন ব্যাপারীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
পদোন্নতির মাধ্যমে জুনিয়র মেট্রোন হিসেবে তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বদলি হন এবং তিন বছর থাকার পর সেখান থেকে সিনিয়র মেট্রোন হিসাবে বদলি হন ফৌজদারহাট টি বি হাসপাতালে। সেখানে দায়িত্ব পালনকালে পোস্ট গ্রাজুয়েট কোর্স কলেজ অফ নার্সিং এডমিন এডমিনিস্ট্রেশন করতে ঢাকায় আসেন এবং তিন বছর ঢাকায় অবস্থান করেন। তিনি তখন ১১ দফা এবং স্বাধিকার আন্দোলনের পক্ষে কলেজ অফ নার্সিং থেকে মিছিলে নেতৃত্ব দেন। তাঁর এই কোর্স চলাকালীন শুরু হয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ।
১৯৭১ সালে মহাখালী টিভি হাসপাতালের কম্পাউন্ড এর ভেতরে বাসা করে থাকতেন তিনি। ২৫শে মার্চ গোলাগুলি শুরু হলে শিশু ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে চলে আসেন তিনি।
প্রতিদিন গোলাগুলি হতো তখন। তাকে অফিসিয়ালি ফৌজদারহাট হাসপাতালে জয়েন করতে বলা হলো কিন্তু তিনি বেঁকে বসলেন শিশু সন্তানের দোহাই দিয়ে। কিন্তু তার উপরে চাপ আসে কর্ম ক্ষেত্রে যোগদান করবার জন্য তখন উপায়ান্তু না দেখে শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে তিনি চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে চলে যান। তিনি ফৌজদারহাট হাসপাতালে কম্পাউন্ডে এসে দেখেন সেখানে কোন নার্সও নেই রোগীও নেই। চারিদিক থমথমে একটা ভৌতিক পরিবেশ। সে সময় তাঁর সরকারি কোয়ার্টারে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিতেন ও আহতদের সেবা করতেন। তাছাড়া হাসপাতালের গজ, মোমবাতি, ব্যান্ডেজ, তুলো, ওষুধ পত্র তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সরবরাহ করতেন। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল তাঁর আশ্রয়ে এসে ছয়টি রাইফেল লুকিয়ে রাখতে বললে তিনি ছালা দিয়ে মুড়িয়ে স্টীলের আলমারিতে তুলে রাখেন। পরে সময় সুযোগ বুঝে সে রাইফেল গুলো মুক্তিযোদ্ধারা এসে নিয়ে যায়। ক্যাডেট কলেজ ও টি বি হাসপাতালে বোম্বিং হলে সারারাত খাটের নিচে লুকিয়ে থেকে নানা কাকুতি মিনতি করে সকালে সুপারিনটেন্ট এর গাড়িতে, স্বামীর সন্তানসহ চট্টগ্রাম মেডিকেলে চলে আসেন। সেখানে অন্যান্য সহকর্মীদের সাথে হোস্টেলে থাকতে শুরু করেন। স্বাধীনতার পর বদলী হন বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সিনিয়র মেট্রোন হিসাবে। ১৯৮৬ সালের অক্টোবরের তিনি অবসর গ্রহণ করেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নার্সিং বন্দি কমিউনিস্ট নেত্রীদের সেবা শুশ্রূষা করার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। অসুস্থ অনেক বন্দীকে তখন রাজশাহী জেল থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে আসা হয়েছিল চিকিৎসার জন্য, এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন তরুলতা সেন ও কিংবদন্তি নেত্রী ইলা মিত্র। ধন্য তাঁর এই জীবন।
প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে তিনি নার্সদের নিয়ে প্রভাত ফেরীতে যেতেন খালি পায়ে হেটে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পড়ে। প্রাণের কি আকুতি না মিশে আছে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাবার এ আয়োজনে।
এক পুত্র সন্তানের জননী ঊষা ব্যাপারী। তিনি বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ কর্তৃক আয়োজিত সংগ্রামী নারীদের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে সংগ্রামী নারী হিসেবে সংবর্ধিত হন। এছাড়া বাংলাদেশ উদেশি শিল্প গোষ্ঠী কর্তৃক ভাষা সৈনিক হিসেবে সম্মাননা লাভ করেন এবং ক্রেস্ট প্রাপ্ত হন।
স্বাধীনতার পর অনেক বছর পেরিয়ে গেছে। যেসব মুক্তি সংগ্রমী নারীর সাহসী পদক্ষেপ সমাজের রাষ্ট্রের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে এগিয়ে এসেছে তাদের প্রতি বাঙালি জাতির অকৃত্রিম শ্রদ্ধা রয়েছে। কোন প্রতিদানের প্রত্যাশায় নারীরা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে করেননি। তবু তাদের সংগ্রামের ইতিহাসে তাঁদের নাম, বীরত্বের গল্প যদি লিখে রাখা যায় তবে আমাদের ঋণ কিছুটা লাঘব হবে।
শারমীন শরীফ : টরন্টো, কানাডা