শারমীন শরীফ : ইতিরাণী রায় বাংলা ১৩৩৩ সালে কার্তিক মাসের এক রবিবার বিক্রমপুরে টঙ্গীবাড়ি থানার নয়ানন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম মুকুন্দকুমার চৌধুরী। তিনি পেশায় পোস্টমাস্টার ছিলেন। মায়ের নাম রাজুবালা দেবী। পাঁচ ভাই ছয় বোনের মধ্যে তিনি অষ্টম।
ইতিরানী খুব ছোটবেলায় বিক্রমপুর থেকে নারায়ণগঞ্জে চলে আসেন বাবার চাকরির সুবাদে। তাঁর শিক্ষার শুরু হয় নারায়ণগঞ্জের পাদ্রী স্কুল থেকে। এখানে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার পর ইতি রাণী নারায়ণগঞ্জের মরগান স্কুলে ভর্তি হন। মর্গ্যান স্কুল থেকেই তিনি ১৯৪৪ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং ১৯৪৬ সালে তোলারাম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন।
স্কুলে পড়াকালীন সময়ে ইতিরানী রায় বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে পড়েন। ইতিরাণী রায়ের সেজদাদা নির্মল কুমার চৌধুরী ছিলেন ফরওয়ার্ড ব্লকের একজন সক্রিয় কর্মী। এই দাদা অনেকবার জেল খেটেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া হয়েছে দ্বীপান্তরের আদেশ হয়েছে। সেজ’দার ছোটখাটো আদেশ পালন করতে করতে এক পর্যায়ে তাঁর মনের মধ্যেও দেশপ্রেম কাজ করতে থাকে। সেজদার আদেশগুলো ছিল পার্টির চিঠি এবং বিভিন্ন তথ্য রাজনৈতিক নেতাদের কাছে পৌঁছে দেয়া। সেসময় তাঁদের বাড়িতে প্রয়োজনে অনেক রাজনৈতিক নেতারা আশ্রয় নিতেন। ইতি রাণীর দায়িত্ব ছিল তাদের দেখাশোনা করবার। ১৯৪২-৪৩ সালের দিকে নেতাজি সুভাষ বসু যখন পলাতক অবস্থায় নারায়ণগঞ্জ এসে আমলা পাড়ার ‘ভুটকৈলাস’ নামক বাড়িতে আশ্রয় নেন তখন ইতিরানী নিয়মিত তাঁর জন্য খাবার নিয়ে যেতেন। এছাড়াও যে সকল রাজনৈতিক নেতা জেলে থাকতেন, ইতিরানী তাদের পরিবারের সাথে দেখা করে খবরা খবর সংগ্রহ এবং খাবার জেলখানায় দিয়ে আসতেন। অনেক রাজনৈতিক চিঠি পত্র লিফলেট তাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য তাঁকে জেলখানায় যেতে হতো। মাঝে মাঝে ইতি রাণী রাজবন্দিদের জন্য খাবার নিয়ে যেতেন। রাজবন্দিদের জন্য খাবার নেয়ার পাশাপাশি জেল রক্ষীদের জন্য নানা ধরনের খাবার নিয়ে যেতেন তাদের খুশি রাখবার জন্য যাতে ইতিরানের জেলে ঢুকতে কোন সমস্যা না হয়। সকলকে খুশি রেখে এভাবে তিনি জেলখানায় প্রবেশের পথটা প্রশস্ত করে নিতেন।
একটি ঘটনার কথা ইতি রাণীর মনে অনেক দাগ কেটেছিল। তাঁর সেজদার বিরুদ্ধে যখন হুলিয়া চলছে তখন তাঁর মা মারা যান। পুলিশ সাথে সাথে খবর পেয়ে যায়। যেহেতু তারা ব্রাহ্মণ ছিলেন পুলিশের ধারণা ছিল মাকে দাহ করার জন্য অবশ্যই তিনি উপস্থিত থাকবেন। তাই শ্মশানঘাটে আগে থেকেই সাদা পোশাকের পুলিশ ঘেরাও করে দাঁড়িয়েছিল। এদিকে তারঁ ভাইকে ময়ের মৃত্যু সংবাদ পৌঁছানোর সাথে সাথেই সহসাথীরা তাঁর বাড়ি আসার জন্য বিলের কচুরিপানা সরিয়ে রাস্তা করে রাখে। তিনি ঐদিন রাস্তা দিয়ে বাড়ি এসে বাড়িতেই মাকে দাহ করার ব্যবস্থা করেন। সরাসরি বড় রাস্তা ধরে না আসার কারণে পুলিশ তাকে ধরতে পারেনি। এদিকে মাকে দাহ করেই তিনি আবার বিলের মাঝখান দিয়ে লুকিয়ে চলে যান। দাহর সম্পন্ন হতেই সারা বাড়ি পুলিশ ঘিরে ফেলে এবং বাড়ি রেইড করে। কিন্তু ততক্ষণে দাদা বাড়ি ছেড়ে নিরাপদে পালিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু বাড়িতে কিছু অস্ত্র ফেলে গিয়েছিলেন। ইতিরাণী তাৎক্ষণিক বুদ্ধি করে বোনের বাচ্চার কাঁথা ধোয়ার কথা বলে কাঁথার মধ্যে অস্ত্র মুড়িয়ে পুকুর ঘাটে চলে যান। ফলে বাড়ি তল্লাশি করে পুলিশ তাঁর দাদাকে তো পায়নি এমনকি অস্ত্রও পায়নি। ইতি রানীর এই তাৎক্ষণিক বুদ্ধিতে সে যাত্রায় তাঁর দাদা অস্ত্র মামলা থেকে রেহাই পান। সেসময় ইতিরাণীর রাজনীতিতে সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ খুব কম ছিল। তাই তিনি রাজনীতির সাথে সরাসরিভাবে সম্পৃক্ত হতে পারেননি কিন্তু পিছন থেকে যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করা সম্ভব হয়েছে তিনি চেষ্টা করেছেন।
ইতি রানীর কর্মজীবন শিক্ষকতা দিয়েই শুরু। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ মর্গ্যান স্কুলে শিক্ষাগতা করেন। ১৯৪৯ সালে তিনি ভাইদের সাথে কলকাতা চলে যান। সেখানে প্রায় ৪/৫ বছর টেলিফোন অপারেটর হিসেবে কাজ করেন। তাঁরপর ১৯৫২ সালে কলকাতায় যোগেশচন্দ্র রায়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর স্বামী দীর্ঘদিন নারায়ণগঞ্জ তোলারাম কলেজে অধ্যাপনার সাথে জড়িত ছিলেন। তাদের পাঁচ পুত্র এবং ২ কন্যা সন্তান রয়েছে।
১৯৫৩ সালে ইতি রাণী কলকাতা থেকে ফিরে এসে নারায়ণগঞ্জ আদর্শ বালিকা বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেন। ওই স্কুলে কয়েক বছর শিক্ষকতা করার পর তিনি আবার মর্গ্যান স্কুলে ফিরে যান। শিক্ষকতাঁর পাশাপাশি তিনি পড়াশোনাটাও চালিয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে তিনি ছেলে এবং মেয়ের সাথে প্রাইভেটে ডিগ্রী পাস করেন। দীর্ঘকাল মর্গ্যান স্কুলে শিক্ষকতার পর ১৯৯৩ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।