মণিজিঞ্জির সান্যাল : কোনো এক ছুটির দিনে চা বাগানে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ-ই খেয়াল করলাম এক শীর্ণ যুবককে। চুপচাপ গালে হাত দিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে বসে ছিল। আমাকে খেয়াল করেনি সে। চেহারার মধ্যে অসম্ভব হতাশার ছাপ। পরিচয় করলাম নিজেই তার সঙ্গে। নাম অরুণ যে কখনো জীবনের নিজস্ব কোনো রং খুঁজে পায় না। বুকের হাড়গুলো স্পষ্ট বোঝা যায়। শরীর জুড়ে দারিদ্র্যের নির্মম উল্লাস। কালচে রং তামাটে হতে হতে আরও যেন কালচে হয়ে গেছে। বছরের পর বছর তীব্র রোদে পোড়া চা শ্রমিকদের জীবন যেন কত করুণ রসের গল্প হওয়ার জন্য একটি বিধি নির্দিষ্ট।
আসলে সবুজ ভালোবাসি বলেই সময় পেলে ছুটে যাই সবুজের প্রান্তরে। এতো সবুজ চারপাশ ঘিরে! মনটা তখন খুব ভাল হয়ে যায়, খুব হালকা লাগে নিজেকে। আসলে সবুজের সাথে মন ভাল থাকার একটা যোগসূত্র রয়েছে বৈকি। জীবনে কি আছে, কি নেই কিম্বা আশা প্রত্যাশা ভালোবাসা, সুখ – দুঃখ, এই যে জীবনের এতো রং, সব যেন এক লহমায় মিশে যায় সবুজের খুব কাছে এলে। এত কিছু ভাবার সময়ই হয়ে ওঠে না তখন। আপন মনেই কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসে “নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগল …”
চারপাশের এত সবুজের ছোঁয়া মনটাকে কেমন যেন ভাল করে দেয়। জীবনের চাওয়া পাওয়াগুলো বড্ড তুচ্ছ মনে হয় বিশেষ করে সবুজের কাছে থাকা এই মানুষগুলোকে দেখলে।
চা বাগান আমার বড্ড প্রিয়। চা বাগানে রবিবারের ছুটির দিনে এসে একা একাই ঘুরে বেড়াই, চা পাতাদের স্পর্শ করি, আদর করি, একা একাই কত কথা বলি। তখনও কি জানতাম যাদের ভালোবাসায় এই চা পাতাদের বেড়ে ওঠা, কিম্বা যাদের একান্ত যত্স ও স্নেহের স্পর্শে এই চা বাগানের এত জীবন্ত রূপ, তাদের জীবনের গল্প কতোটা হৃদয় বিদারক?
বিশেষ করে বন্ধ হয়ে যাওয়া এই চা শ্রমিকদের সঙ্গে যখন বেশ কিছুটা সময় কাটালাম, তাদের হাত ধরে যখন প্রবেশ করলাম তাদেরই অন্দরমহলে, তখন কে যেন হৃদয়ের দরজায় কড়া নাড়িয়ে মনে করিয়ে দিল “জীবনের আসল রূপ দেখেছ কি তুমি?”
হ্যাঁ সেই থেকে শুরু হলো জীবনকে অন্য আঙ্গিকে দেখতে শেখা। জীবন মানেই যে শুধু গাড়ি, বাড়ি, রেস্তোরাঁ আর মূল্যবান অলংকার নয়, জীবন মানেই যে বছরে দু বার বিদেশ ভ্রমণ নয়, জীবন মানেই যে শুধু আমি আমি করে আমিত্বে ভরা নয় …
তার বাইরেও জীবনের একটা নিজস্ব রূপ আছে, রং আছে, একটা বৈচিত্র্য আছে, আছে বাঁচার লড়াই। সংগ্রাম করে জীবনকে চালানোর এক গল্প। খুব কাছ থেকে দেখতে শুরু করলাম সেই ছবি অরুণের হাত ধরেই।
এর মধ্যেও অরুণরা ভাবতে পারে তবুও তো আমরা ভালো আছি। তার কথায় ‘তবুও আগের চেয়ে অনেকটাই ভালো আমাদের এই চা বাগান।’
অরুণ নিজেকে সান্ত¡না দেয় সেকথা আমি বুঝতে পারি। তার কাছ থেকে জানতে পারি এমন অনেক চা বাগান আছে যেখানে স্কুল আছে নামেই। হাতে গোনা ছেলে মেয়েই সেখানে পড়ার সুযোগ পায়। জনসংখ্যার অনুপাতে তা ধর্তব্যের মধ্যেই নয়। স্কুলে শিক্ষার মান দেখার কেউ নেই। মাত্র দু -একজন শিক্ষক দিয়েই চলে এক একটা স্কুল।
কিছু স্কুল এত দূরে যে যেতে আসতেই সময় চলে যায়। স্কুলের মাইনে, বইপত্র, খাতা কিনতে না পেরে নাছোড়বান্দা কেউ কেউ ঋণ করে লেখাপড়া শেখায় ছেলে মেয়েদের। স্বপ্ন দেখে তাদের ছেলে মেয়েরা অনেক বড় হয়ে এই অমানবিক জীবন যাপন থেকে অব্যাহতি পাবে, মুক্ত করবে তাদেরও। সুস্থ পরিবেশে ভালোভাবে জীবন কাটাতে পারবে। অরুণের ছেলেবেলাটা অনেক বেশি কঠিন ছিল। মা-বাবাকে প্রতিনিয়ত সহায়তা করতে গিয়ে তার লেখাপড়া হয়নি, ছোট বোনকে কিন্তু মা স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল। আদরের সেই বোন হঠাৎ কোথায় যেন হারিয়ে গেল। খুব মিষ্টি আর সুন্দরী ছিল বোনটি, চুলগুলো ছিল লালচে। সবাই মজা করে বলতো ‘কোন সাহেবের মেয়ে গো।’
অরুণের ভাল লাগত না এসব কথা শুনতে। ছোট্ট পুতুলের মত বোনকে অরুণও চোখে হারাতো। সেই মেয়েও একটু বড় হয়ে আজ কোথায় হারিয়ে গেল। বড্ড কষ্ট হয় তার।
অরুণ এখন চা গাছের সঙ্গে একা একাই কথা বলে। মা একদম চুপ। নিজেদের এই হতভাগা জীবনের কথা ভেবে একা একাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
ভালো লাগে না, মন বসে না অরুণের এখানে কিন্তু এই চা বাগান, চা পাতা, মা-বাবা সবাইকে ছেড়ে দূরে কোথায় পালিয়ে যাবে সে? লেখাপড়াও শেখেনি তেমন। দাদুর মুখে এই চা বাগানের গল্প শুনেছে সে। অনেক পুরনো চা বাগান এটা, বংশ পরম্পরায় ওরা এখানেই রয়ে গেছে এর পত্তন থেকেই। তাদের এই চা বাগান ব্রিটিশ ঐতিহ্যের ইতিহাস বহন করে। ছোট্ট অরুণকে বিখ্যাত সুগন্ধি দার্জিলিং চা পাতাদের গল্প শোনাতেন দাদু। যেমন চা গাছ নাকি বছরে একবার ঘুমোয়, সে সময় ওরা কিছু দেয় না কিন্তু ওদের তখন ভারি যতেœ রাখতে হয়। কখনো আবার দাদু বলতেন, এক- ই বাগানের একই গাছ একমাস হয়তো অসাধারণ গন্ধওয়ালা চা পাতা দিল। পরের মাসে তার সিকি ভাগও দিতে পারল না। জলবায়ু, উষ্ণতা অনেক কিছুর ওপরে নির্ভর করে এই চায়ের গন্ধ।
দুটি পাতা একটি কুঁড়ি তুললেই চা হয়ে যায় না, চা তোলা থেকে পানীয়যোগ্য হওয়ার পথে মিশে থাকে কতজনের পরিশ্রম ধাপে ধাপে। যারা শুধু পাতা তোলে কিংবা শুধু চা শ্রমিক নয়, কতজনের সে অবদান, না বলা গল্প জড়িয়ে থাকে তাদের চোখের ভাষায়, আর চা পাতার ঘ্রাণে।
চা গাছ রোপন, আগাছা পরিষ্কার, সার প্রয়োগ করা, গাছ ছাঁটা, কচি পাতা, চা পাতা শুকোনো, সেঁক, চা পাতা সংগ্রহ করতে এক একজনকে যথেষ্ট নৈপুণ্য ও দক্ষতা অর্জন করতে হয়। দুটি পাতা ও একটি কুঁড়ি একসঙ্গে ঠিকঠাক তুলতে না পারলে চায়ের উৎকর্ষ ও আমেজ অনেকটাই নষ্ট হয়ে যায়। অরুণ বসে বসে দাদুর গল্প শোনায়। শোনায় তার জীবনের কথা।
চা বাগানগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ছোট বোনটা তাও পড়াশোনা করত কিন্তু নিজের ভবিষ্যৎ জীবনের কথা ভাবলেই মনটা বিষন্ন হয়ে যায়। টুকরো টুকরো কত ছবি মনে পড়ে যায়। বাবার সাথে অরুণ যখন কাজে যেত, মা তখন পিঠে ছোট বোনকে বেঁধে নিয়ে কাজে যেত। গায়ের রং যাতে নষ্ট না হয় তাই মা বোনকে লম্বা লম্বা হাতা জামা পরিয়ে রাখত। শরীরটা একদম চাদরে মুড়িয়ে নিত। মাথাটা এমন ভাবে টুপি দিয়ে ঢেকে দিত যাতে মুখটা রোদের আড়ালে থাকে। একটু বড় হলে তাকে স্কুলে ভর্তি করা হয়েছিল। কাজে গিয়েও মা সারাক্ষণ চিন্তা করত বোনটাকে নিয়ে। টুকটুকে ফর্সা সুন্দর একটা পুতুল। সবাই চাইত কোলে নিতে। কেউ গাল টিপে দিত। মা যেমন মেয়ে বলতে পাগল, তেমনি মাকে ছাড়া মেয়েও কিছু জানত না, বুঝত না। সেই মেয়ে মাকে ছেড়ে কোথায় যে চলে গেল। শোকে দুঃখে পাথর হয়ে গেল মা। পাশাপাশি সমাজের মানুষগুলোর বিদ্রুপ ঠাট্টা। মায়ের মনটাকে বিষিয়ে দিয়েছিল একেবারে।
এক গল্প থেকে অরুণের আরো এক গল্প বলা … এভাবেই অনেক অনেক জীবনের গল্প একে একে ধরা পড়ে। একটা সমগ্র চা বাগানের আসল চিত্ররূপ, সভ্য পৃথিবীর থেকে যা অনেকটাই আলাদা।
অরুণের এক আত্মীয় থাকত রামঝোরা চা-বাগানে। আশঙ্কায় ছিল তারাও। ডুয়ার্সের চা বাগানগুলোর পরিস্থিতি অন্যরকম। আরোও কঠিন। ডুয়ার্সের চা যেমন দার্জিলিংয়ের চায়ের থেকে আলাদা, আলাদা তার সমস্যাও। আলিপুরদুয়ারে ওই চা বাগানে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল। কোন নোটিশ ছাড়াই চা বাগান ছেড়ে চলে গেছিল মালিকপক্ষ। আগের দিন রাতে বাগান ম্যানেজার বাগান ছেড়ে চলে গেছেন। সকাল থেকে বন্ধ চা বাগানের কাজ। কাজ হারানোর আশঙ্কায় অন্ধকারে ৯১৩ জন শ্রমিক। আগেও এই চা বাগান বন্ধ হয়েছিল। খুলে ছিল অনেক টালবাহানার পর। আবার তৈরি হয়েছে এই অচলাবস্থা।
সমস্যা শুরু হয়েছিল এক মহিলা চা শ্রমিকের ম্যানেজারের বাংলাতে কাজ নিয়ে। ম্যানেজারের বাংলাতে কাজ করতে রাজি হয়নি মহিলাটি। তার নিজের কাজ চা গাছে পাতা তুললেও মহিলাটির তোলা পাতা ওজন করে না বাগান কর্তৃপক্ষ। সুতরাং মজুরিও বন্ধ। ক্ষিপ্ত মহিলা চা শ্রমিকেরা বিকেলে ম্যানেজারকে ঘেরাও করে বিক্ষোভ দেখায়। অভিযোগ ম্যানেজারকে তারা হেনস্থা করেছে। ম্যানেজার বাগান ছেড়ে চলে যায়। এরকম নানা ছোটখাটো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এভাবেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল চা বাগানগুলো।
বাগরাকোট চা বাগানের অবস্থা আরও খারাপ। নানান দাবিতে সকাল থেকে শ্রমিকরা বিক্ষোভ দেখাতে থাকে। শ্রমিকদের এসব সমস্যা যথার্থই দীর্ঘদিনের। বহুবার কর্তৃপক্ষকে বলেও কোন লাভ হয়নি। দেশে শ্রমিকরা এক কাট্টা হয়ে বসে পড়েছে চা বাগানের গেটের সামনে। সামিল মহিলা শ্রমিকরাও।
চম্পা মোঙ্গরদের বক্তব্য ‘বাগানের অবস্থা খুব খারাপ। নিয়মিত বেতন নেই। পুরনো হাজিরা বাকি। বাকি গ্র্যাচুয়িটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড। তাই বাধ্য হয়েই এই অবস্থান বিক্ষোভে সামিল হয়েছি।’
চা বাগানের শ্রমিক নেতা রিজু তামাংয়ের বক্তব্য বাগানের এই অবস্থার জন্য মালিকরাই দায়ী। বাগানের শ্রমিক সংখ্যা ১৫০০০ থেকে কমে ৭০০ জন হয়ে গেছে। কাজ করে তারা তাদের প্রাপ্য পায়না। সব জায়গায় চিঠিপত্র দিয়েও কোন লাভ হয়নি। দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে বাগানের অবস্থা।
কাজ করেও ন্যায্য পাওনা না পেলে কাজ করে কি লাভ। মালিকপক্ষ নিজেদের মর্জিমতো বাগান চালাচ্ছে। শ্রমিকদের কথা একেবারের জন্যেও চিন্তা করছে না।
এরকম ভাবেই একের পর এক চা বাগানগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মালবাজারের সাইলিং চা বাগান, নাগরাকাটা হিলা চা বাগান। কর্মহীন কমপক্ষে ২৩০০ শ্রমিক। প্রতিদিনের মতো সকালে কাজে বেরিয়ে যায় বিনিতা থাপা, পল্লবী ছেত্রীরা। গিয়ে দেখে বাগানের গেটেই সাসপেনশন অফ ওয়ার্কের নোটিশ। বাগানের গেটেই অনর্থক বিক্ষোভ দেখায় তারা। বাগান বন্ধ করে ততক্ষণে পালিয়ে গেছে ম্যানেজার। প্রতিবছরই পুজোর পর কাজ হচ্ছে না এই অজুহাতে বাগান বন্ধ করে দেওয়া হয় কারণ এই সময়টি চা গাছের কাটিং করার সময়।
একের পর এক চা বাগান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অরুণের মতো আরো অনেক অরুণ আশঙ্কায় ভোগে ঐ বাগানগুলোর মতো যদি একদিন এই বাগানেও ওরকম অবস্থা হয়, কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে ওরা। ছোট বাচ্চাগুলো কি সুন্দর স্কুলে যায় হাসতে হাসতে। রবিবারের বিকেলের জন্যে অপেক্ষা করে লুসিয়া। কি সুন্দর ছোট্ট এই মেয়েটি। তার এই জীবনেই সে আনন্দে ভরপুর, সুখের পৃথিবীর ঠিকানা আলাদা করে তার জানা নেই। সুখ শব্দের আলাদা কোনো অর্থ থাকতে পারে হয়তো এটাই তার কাছে বিস্ময়। একমুখ সুন্দর হাসি লুসিয়ার, খেলে বেড়ায় সবুজের সাথে, নেচে বেড়ায় দুটি পাতা একটি কুঁড়ির কাছে।
হাসতে হাসতে প্রাণোচ্ছল ছোট্ট মেয়েটি রবিবারের এই বিশেষ ছুটির দিনটিতে সেজেগুজে মায়ের হাত ধরে সেই চা বাগানের ভেতরের পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যায় পাকা রাস্তায়। ঠিক তার উল্টোদিকে চায়ের ফ্যাক্টরি। রাস্তাটা দুটো ভাগে ভাগ হয়ে একটা গেছে ডানদিকে, অন্যটা বাঁ দিকে। বাঁ দিকের রাস্তা ধরে এগিয়ে ঢালুপথ। এঁকেবেঁকে নেমে গেছে রাস্তা। কোথায় শেষ হয়েছে কে জানে। তবুও একমুখ হাসি নিয়ে ছোট্ট মেয়ে লুসিয়া হেঁটে বেড়ায় এই পথে। কোনদিন চলে যায় বাঁদিকের ঢালুপথ দিয়ে শিব মন্দিরে। দুশো পঞ্চাশ বছরের পুরনো এই মন্দিরে পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় এক ঘন্টা। চারপাশ ফাঁকা, নিস্তব্ধ নির্জনে একা এই মন্দির।
কিন্তু এই সুখটুকুও হারাবার পথে। লুসিয়াদের মুখের হাসি কেড়ে নিতে যাচ্ছে এই চা বাগানের মালিক। বন্ধ হয়ে যাবে নাকি সত্যিই এই চা বাগান? আতঙ্কে মায়ের সঙ্গে সেও উপোস করে মন্দিরে যায় পুজো দিতে। লাল, হলুদ রঙে রঙিন মন্দিরের চারপাশ। ধাপে ধাপে সিঁড়ি, যদিও খুব পিচ্ছিল। মন্দিরের সামনে গেলেই মনে হয় চারপাশের পাহাড় যেন মন্দিরটাকে আগলে রেখেছে সযত্নে। খুব ঠান্ডা হাওয়া চারপাশ ঘিরে। মনটা ভালো হয়ে যায় এখানে এলে। ঘন্টার পর ঘন্টা মায়ের সাথে বসে থাকে লুসিয়া। এবারেও ব্যতিক্রম হয়নি। আশঙ্কা বাস্তব হয়। সত্যিই বন্ধ হয়ে গেল এই চা বাগানটিও। বন্ধ হয়ে যায় স্কুলও, ধীরে ধীরে স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং আর যা কিছু। ঘরের মজুদ খাবারও শেষের দিকে। রাতের ঘুম হারিয়ে যায়। চোখের তলায় কালি। শূন্য ভাঁড়ারে এক মুঠো চাল খুঁজে বেড়ায় মা। ছোট্ট হাসিখুশি প্রাণবন্ত লুসিয়া ক্রমেই নিস্তেজ, দুর্বল হয়ে পড়ে।
দু বছরের বেশি সময় হয়ে গেছে, বাগান ছেড়ে ভিনরাজ্যে কাজের খোঁজে যায় বীরু, তারপর আর তার কোনো খবর নেই। বীরুর বউ মিনু জানে না সে আদৌ বেঁচে আছে কিনা। বীরু শুধু একা নয়। বীরুর মতো আরও অনেক শ্রমিক এভাবে নিখোঁজ। এরকম কাজের খোঁজে বেরিয়ে। ডুয়ার্সের বন্ধ চা বাগানগুলো আসলে পরিণত হয়েছে মানব পাচারের স্বর্গোদ্যানে।
কাজের খোঁজে গিয়ে হারিয়ে যাওয়া শ্রমিকদের শিশুরা পাশের রাজ্যে ভুটানে। এখন তাদের নরম হাতে পাথর ভেঙে শক্ত কড়া বানিয়ে ফেলেছে। ক্ষিদের জ্বালা বিষম জ্বালা। শৈশব কখন যেন লুট হয়ে গেছে ডুয়ার্সের চা বাগানগুলোর শ্রমিক শিশুদের ।
মিনুর পিঠে বেঁধে রাখা শিশুটি জন্মের পর বাবার ছোঁওয়া পায়নি কখনও। কোনদিন পাবে সে আশাও ক্ষীণ। তবুও মিনু প্রতীক্ষা করে তার স্বামী ঠিক একদিন ফিরে আসবে। পড়ন্ত বিকেলে দূর থেকে যখন গাড়ির আওয়াজ শুনতে পায়, এক ছুটে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে, মনে মনে কল্পনা করে হয়তো ঐ গাড়িতেই সে ফিরে এসেছে। প্রাণপণে ডাকতে থাকে তার ভগবানকে, তার বিশ্বাস তার স্বামী একদিন এই পথেই ফিরে আসবে। আজও অপেক্ষা করে সে, হয়তো আজীবন সে এভাবেই অপেক্ষা করবে তার ভালোবাসার মানুষটির জন্য।
মণিজিঞ্জির সান্যাল : কথা সাহিত্যিক , শিলিগুড়ি, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত