সাজ্জাদ আলী : এক:
১৯৫৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন এল। শেখের ব্যাটা যুক্তফ্রন্টের টিকিটে গোপালগঞ্জ-কোটালীপাড়া আসন থেকে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী হলেন। সেটাই ছিলো তাঁর জীবনের প্রথম সংসদ নির্বাচন এবং ভোট চাওয়া। ওই আসনে শেখ সাহেবের প্রতিদ্ব›দ্বী ওয়াহিদুজ্জামান সাহেব। তিনি একাধারে ধনাঢ্য ও দৌর্দন্ড প্রতাপশালী ব্যক্তি। সেই সময়ে বলতে গেলে গোপালগঞ্জ শহরের চারভাগের একভাগ ভূসম্পত্তির মালিকানা ছিলো জামান পরিবারের। সর্বোপরি ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ দলীয় প্রার্থী তিনি। সরকারি ক্ষমতার দাপট, লঞ্চ, স্পীডবোট, সাইকেল, ভাড়াটে কর্মীদল, মাইক, গুন্ডাবাহিনী, সভা-সমাবেশ, পোষ্টার-লিফলেট ইত্যাদি সর্ব প্রকারের সামর্থ্য নিয়ে জামান সাহেব নির্বাচনী মাঠে সরব।
এদিকে মানুষের জন্য “দরদ” ঢেলে দেওয়া ছাড়া শেখের ব্যাটার খরচ করার মতো আর তেমন কিছুই নাই। সমগ্র গোপালগঞ্জ এলাকাটাই বিলাঞ্চল, সেই সময়ে এই মহাকুমায় কোনো গাড়ি চলার রাস্তা ছিল না। নৌপথ আর হাঁটাপথই চলাচলের উপায়। আওয়ামী লীগের কর্মীবাহিনী নিজেদের সাইকেল, ঘাটের নৌকা, পকেটের টাকা খরচ করে নীরবে দলীয় প্রার্থীর প্রচার কাজ চালাচ্ছে। শেখের ব্যাটা গাঁয়ের ভোটারদের আপনার মানুষ। তাঁর জয় যেন চাষাভুষারই জয়। জামান সাহেব ফিটফাট মানুষ, শহুরে “এলিট প্রার্থী” তিনি। আর শেখ সাহেব সাদামাটা, গরীবের প্রতিনিধি। তবে যে গাঁয়েই শেখ ভোট চাইতে যান, সেখানেই গণজোয়ার সৃষ্টি হয়। গ্রামের নারীরা পর্যন্ত পথের দুধারে দাঁড়িয়ে থাকতো তাঁকে এক নজর দেখার জন্য। গৃহস্থরা সামাজিক প্রথানুযায়ী কাঁশার পানদানে সামর্থ মত ৫/১০ টাকা শেখের ব্যাটার হাতে তুলে দিতেন ইলেকশনের খরচবাবদ। এমনই একটি ঘটনা শেখ সাহেব তাঁর নিজের জবানীতে বলেছেন,
খুবই গরীব বৃদ্ধ এক মহিলা কয়েক ঘন্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে, শুনেছে এই পথে আমি যাবো। আমাকে দেখে আমার হাত ধরে বললো, “বাবা আমার কুঁড়েঘরে তোমার একটু বসতে হবে।” আমি তার হাত ধরেই তার বাড়িতে যাই। অনেক লোক আমার সাথে, মাটিতে একটা পাটি বিছিয়ে আমাকে বসতে দিয়ে একবাটি দুধ, একটা পান ও চার আনা পয়সা আমার সামনে ধরলো। বললো, “খাও বাবা, আর পয়সা কয়টা তুমি নেও, আমার তো কিছুই নাই।” বৃদ্ধা আমার মাথায় মুখে হাত বুলিয়ে আরো বললো, “গরীবের দোয়া তোমার জন্য আছে বাবা।” যখন তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি, নীরবে আমার চক্ষু দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিলো। সেই দিনই আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, মানুষেরে ধোঁকা দিতে আমি পারবো না।
পাঠক বন্ধুরা, আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা বলছি। নৃশংস সেই কালো দিন ১৫ই আগষ্টে তাঁকে স্মরণে আনছি। “মুজিব” -একটি নাম, একটি প্রতিষ্ঠান, একজন বাঙ্গালির নাম, একটি আন্দোলনের নাম, মহাকাব্যের অমরগাঁথা একটি জাতির অভ্যুদ্বয়ের নাম। হাজার বছর ব্যাপ্ত ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম বাঙ্গালি তিনি, বাঙ্গালির হৃদয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন মহাকালের মহানায়ক রূপে।
দুই :
মুজিব যখন গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুলের ছাত্র তখনই তার মধ্যে নেতৃত্ব দেবার গুণাগুণ স্পষ্ট ছিলো। ১৯৩৮ সালের কথা, শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক তখন যুক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী, আর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শ্রমমন্ত্রী। তাঁরা দুজন সভা করতে এলেন গোপালগঞ্জে। সভা/সম্বর্ধনা শেষে সোহরাওয়ার্দী সাহেব মাতুব্বর গোছের লম্বা ছাত্রটিকে কাছে ডেকে স্নেহে তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। তার কাছে জানতে চাইলেন গোপালগজ্ঞ এলাকায় মুসলিম লীগের সংগঠন আছে কিনা? সেদিনের সংক্ষিপ্ত কথোপকথন শেষে শহীদ সাহেব ওই লম্বু ছাত্রটিকে তাঁর নোটবুক আর কলম বের করে দিয়ে নাম ঠিকানা লিখে দিতে বললেন। ছাত্রটি লিখলো, শেখ মুজিবুর রহমান, ব্যাংকপাড়া রোড, গোপালগঞ্জ। কিছুদিন বাদেই সোহরাওয়ার্দী সাহেবের চিঠি এলো। মুজিবকে তিনি কলকাতায় ডেকে পাঠিয়েয়েছেন। সোহরাওয়ার্দী-মুজিবের রাজনৈতিক গুরু-শিষ্য সম্পর্কের সেটাই সূচনা। প্রকৃত বিবেচনায় মুজিবের রাজনৈতিক জীবনের আরম্ভও সেই ক্ষণেই।
তিন:
সেই কিশোর বয়সেই মুজিবের কথা আর কাজের মিল ছিলো। সৎ সাহস, গরীবের প্রতি ভালবাসা, অত্যাচারীর বিরুদ্ধাচারণ ও সত্যের পক্ষাবলম্বের কারণে সরকারি আমলা থেকে চাষা-মজুর, এমনকি চোর-ডাকাতরা পর্যন্ত মুজিবকে সমীহ করতো। একবার গোপালগঞ্জ থেকে রাত ১০টা নাগাদ মুজিব নৌকাযোগে গ্রামের বাড়ি টুঙ্গিপাড়া অভিমুখে রওনা হয়েছেন। সাথে তৎকালীন মহাকুমা আওয়ামী মুসলিম লীগের কনভেনর কাজী আলতাফ হোসেন। এক মাল্লার নৌকাটি মধুমতি নদীর ভাটির টানে তরতর করে এগিয়ে চলছিল। নদীর একটি বাঁক অসম্ভব চওড়া। সে স্থানের একদিকে ফরিদপুর জেলা, আর একদিকে যশোর ও খুলনা জেলার বর্ডার। মাঝে মাঝেই এই বাঁকে নৌ-ডাকাতি হয়। বাকিটা মুজিবের জবানেই জানা যাক,
পানির দেশের মানুষ আমি নৌকায় ঘুমাতে কষ্ট হয় না। ক্লান্ত ছিলাম বলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কাজী সাহেব তখনও ঘুমান নাই। এমন সময় চার মাল্লার একটা ছিপ নৌকা আমাদের মাঝিকে জিজ্ঞাসা করলো, “নৌকা যাবে কোথায়?” মাঝি বললো টুঙ্গিপাড়া। নৌকায় কে? মাঝি আমার নাম বললো। ডাকাতরা মাঝিকে বৈঠা দিয়ে ভীষণভাবে আঘাত করে বললো, “শালা আগে বলতে পারো নাই যে শেখ সাহেব নৌকায়।” দ্রƒত বৈঠা বেয়ে পালালো ডাকতের দল। কাজী সাহেব তার ঘড়ি, টাকা, আংটি সব লুকিয়ে ফেলেছিলেন ভয়ে। মাঝির চিৎকারে জেগে উঠে জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যাপার কী? সে আমাকে পুরো গল্পটি বললো। কাজী সাহেব বললেন, ডাকাতরা আপনাকে শ্রদ্ধা করে, আপনার নাম করেই আজ বেঁচে গেলাম। না হলে আর উপায় ছিলো না। আমি বললাম, “বোধহয় ডাকাতরা আমাকে ওদের দলের একজন বলে ধরে নিয়েছে।” দুজনে খুবই হাসাহাসি করলাম।
চার:
খাজা নাজিমউদ্দিন তখন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল। গোপালগঞ্জের ডাকসাইটে মুসলিম লীগ নেতা ওয়াহিদুজ্জামান, খাজা সাহেবকে সম্বর্ধনা জানাতে গোপালগঞ্জে আমন্ত্রণ করে আনলেন। এই সমবর্ধনার খরচের টাকা তুলতে ওয়াহিদুজ্জামান সাহেবের মদদে গোপালগঞ্জ মহাকুমা প্রশাসন “জিন্নাহ ফান্ডের” নামে সাধারণ মানুষের থেকে বেপরোয়া চাঁদা তুলছিলো। মহাকুমায় তখন ৬ লক্ষ লোকের বাস। ঠিক হলো সবাই মাথা প্রতি এক টাকা করে চাঁদা দেবে। আর ব্যবসায়ীরা ও যাদের লাইসেন্স করা বন্দুক আছে তারা আরো বড় অঙ্কের টাকা দেবে। চারিদিকে জোরজুলুম শুরু হলো। থানা-পুলিশ চৌকিদার দফাদাররা নেমে পড়েছে চাঁদা আদায়ে। টাকা দিতে অপারগ বা অনিচ্ছুক দরিদ্রদের কারো গরু, কারো বদনা, থালা ঘটি বাটি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এই আদায়কৃত টাকা থেকে সম্বর্ধনার খরচ রেখে উদ্বৃত্ত টাকা তোড়া বানায়ে খাজা সাহেবকে উপহার দেওয়া হবে।
শেখ মুজিবুর তখন উঠতি যুবনেতা। সকল অনাচারের বিরুদ্ধাচারনকারী তিনি। মুজিব বেঁকে বসলেন। গরীবের টাকা কিছুতেই নাজিমুদ্দিন সাহেবকে গোপালগঞ্জ থেকে নিয়ে যেতে দেওয়া হবে না। মুসলিম লীগার এবং স্থানীয় প্রশাসনকে শেখের ব্যাটা ধামকি দিলেন। পরিস্কার বললেন যে, দরকার পড়লে সম্বর্ধনা সভা ভন্ডুল করে দেওয়া হবে, তবু গোপালগঞ্জ থেকে এক টাকাও বাইরে যাবে না। গোপালগঞ্জের মাটিতে এটুকু “হুমকি” বাস্তবায়নে মুজিবের সক্ষমতা সকলেরই জানা ছিলো। গণভিত্তিহীন মুসলিম লীগের লোকেরা ভীত হয়ে পড়লো, প্রশাসনের কর্তারা ব্যতিব্যস্ত। কী থেকে কী হয়ে আবার চাকরিটাই না যায়। অভ্যর্থনা সভার আগের রাতে ফরিদপুর জেলার ডিসি, এসপি ও গোপালগঞ্জের এসডিও সাহেব শেখের ব্যটার সাথে আপোষ বৈঠকে বসলেন। মুজিবের স্পষ্ট কথা, আমার জনগণ উপযুক্ত সম্মানে পকিস্তানের গভর্নর জেনারেলকে সম্বর্ধনা দেবে। কিন্তু উত্তোলিত চাঁদার টাকা খাজা সাহেবকে গোপালগঞ্জে একটি কলেজ করার জন্য দান করে যেতে হবে।
সেই দাবী মেনে নিয়েই খাজা নাজিমউদ্দিনের সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানটি হলো। আর তারপরেই গোপালগজ্ঞ শহরে প্রথম কলেজটি গড়ে উঠলো। যেহেতু “জিন্নাহ ফান্ডের” নামে টাকাটা উঠেছিলো, তাই কলেজের নামকরণ হয়েছিলো “কায়েদে আজম কলেজ”। স্বাধীনতার পরে কৃতজ্ঞ গোপালগঞ্জবাসী কলেজের নাম পরিবর্তন করে। “বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ” নামে গোপালগঞ্জের এই ল্যান্ডমার্কটি শেখের ব্যাটার আরো একটি কীর্তি জানান দিচ্ছে।
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)
তথ্যসূত্রঃ অসমাপ্ত আত্মজীবনীঃ শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রোজনামচাঃ শেখ মুজিবুর রহমান।