বনানী বাবলি : “জল পড়ে পাতা নড়ে”! তারপর? তারপর যতদূর মনে পড়ছে এর পর রবির সাথে পরিচয় “আমাদের ছোট নদী” ছড়ায়, কোনো এক অজানা নদীর সাবলীল শিশুতোষ ছন্দের কারুকাজ দিয়ে। জানি না কোন সে নদী কবির মানসপটে আঁকা ছিলো যার ছায়া এসে জেগে উঠে এই ছোট নদীতে। তারপর ভোলা যায় কি মাকে নিয়ে মনকাড়া সেই যে “লুকোচুরি” ছড়া?
“আমি যদি দুষ্টুমি ক’রে
চাঁপার গাছে চাঁপা হয়ে ফুটি,
ভোরের বেলা মা গো, ডালের ’পরে
কচি পাতায় করি লুটোপুটি,
তবে তুমি আমার কাছে হারো,
তখন কি মা চিনতে আমায় পারো”
অথবা “বীরপুরুষ” কবিতায় খোকার কাল্পনিক ডাকাতের আক্রমণ থেকে মাকে রক্ষা করা? কী ছন্দ, কী অসীম বিজয় আনন্দের স্ফুরণে মন ছুঁয়ে যায়… মায়ের প্রতি ভালোবাসার অপার আকুলতার পরশ দিয়ে যায় দোলায় দোলায় (প্রসঙ্গত মাত্র তেরো বছর বয়সে রবি মাতৃহারা)।
“মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে
মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।
তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে
দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে”
এরপর কী করে তিনি আমাদের কিশোর মনের এতো কাছে চলে এলেন ঠিক জানি না। “কাবুলিওয়ালা” গল্পে সমাজের শ্রেনীভেদকে উপেক্ষা করে বর্ণনায় এসেছে যে স্নেহ ভালোবাসার পাত্র যত দূর দূরান্তে থাকুক না কেনো সে মন কেড়ে নেয় অজান্তে অন্য এক শিশুতে। এই স্নেহ জায়গা জুড়ে নিতে পারে অনায়াসে ধর্ম- বর্ণ- ভাষার উর্ধে উঠে অন্য কোনো এক ‘মিনির’ মাঝে। গল্পের রহমত শিশু কন্যা মিনির কাছে আসতেন শুধু নিজের মেয়েটির ছায়া দেখতে পাবেন তাই। পিতৃস্নেহের এক অপরূপ মায়া মিশে আছে এই ছোট গল্পে। যে কাবুলিওয়ালা পাওনাদারের প্রতিটি পয়সাকে আদায় করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে, সেই কাবুলিওয়ালা রহমত তাঁর একমুঠো স্নেহের ছোঁয়া রেখে যেতেন মিনির কাছে একটু আখরোট বা পেস্তা বাদামের মাধ্যমে। ভালোবাসার এই সূক্ষ রসায়নগুলি রবির গল্পের এক অসাধারণ চিত্রপট। এই উজ্জ্বল দৃষ্টান্তগুলি বারে বারে ফিরে আসে বিভিন্ন গল্পে, বিভিন্ন ছন্দের আবহে।
মন উচাটন হওয়া দুঃখীর ব্যথায় ব্যথিত হয়ে এই গল্পের শেষের দৃশ্যপটে তিনি ব্যক্ত করেছেন “দেখিলাম, কাগজের উপর একটি ছোটো হাতের ছাপ। ফটোগ্রাফ নহে, তেলের ছবি নহে, হাতে খানিকটা ভুষা মাখাইয়া কাগজের উপরে তাহার চিহ্ন ধরিয়া লইয়াছে। কন্যার এই স্মরণচিহ্নটুকু বুকের কাছে লইয়া রহমত প্রতিবছর কলিকাতার রাস্তায় মেওয়া বেচিতে আসে – যেন সেই সুকোমল ক্ষুদ্র শিশুহস্তটুকুর স্পর্শখানি তাহার বিরাট বিরহী বক্ষের মধ্যে সুধাসঞ্চার করিয়া রাখে। দেখিয়া আমার চোখ ছল ছল করিয়া আসিল। তখন, সে যে একজন কাবুলি মেওয়াওয়ালা আর আমি যে একজন বাঙালি সম্ভ্রান্তবংশীয়, তাহা ভুলিয়া গেলাম – তখন বুঝিতে পারিলাম, সেও যে আমিও সে, সেও পিতা আমিও পিতা।” সমতার এক সহজাত সত্যের উপাখ্যানকে নিঙড়ে পাঠকের কাছে তুলে আনা হয়েছে বেদনা বিধুর হয়ে।
আর স্কুলের পাঠ্যের সেই যে “ছুটি” গল্পের ১৩ বছরের দূরন্ত বালক ফটিক? মামা বিশ্বম্ভর বাবুর সাথে কলিকাতায় ফটিককে নিয়ে যাওয়া হলো যদি একটু পড়াশুনা করে মানুষ হতে পারে। কিন্তু ভালোবাসার অভাবে এই অবুঝ বালকটির মানসিক অবস্থা কী হয়েছিল সেই বর্ণনা পড়ে চোখের জলকে ধরে রাখতে কী কেউ পেরেছিলাম? কী অসাধারণ মমতার রং তুলিতে রবি এই ফটিক চরিত্রটি এঁকেছিলেন। শিশু ও কিশোরের মধ্যবর্তী যে বয়সটুকু কত গুরুত্বপূর্ণ সেটা বুঝতে পারে কয় জন অভিভাবক? এই গল্পে এই প্রশ্নটাও অবধারিতভাবে চলে এসেছে। গল্পের শেষে ফটিকের অন্তিম শয়নের বর্ণনা তিনি দিয়েছেন “মৃত্যু” শব্দটি উল্লেখ না করে… “ফটিক আস্তে আস্তে পাশ ফিরিয়া কাহাকেও লক্ষ্য না করিয়া মৃদুস্বরে কহিল, “মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।” জলের মাছকে ডাঙায় আনলে কী হয় এই কষ্টের তীব্র আখ্যান শুধু ফটিকের জন্যই যেনো শুধু আঁকা।
এরপর ধরা যাক পোস্টমাস্টার গল্পের গরিব বালিকা রতনের এক অবিচ্ছিন্ন অলিখিত মায়ার বন্ধনে জড়িয়ে যাওয়া ক্ষনিকের অতিথি উলাপুর গ্রামে চাকুরী নিয়ে আসা পোস্টমাস্টারের সাথে। তিনি শহুরে নাগরিক। পোস্টমাস্টারও আচানক জ্বর, মা-ভাই-বোন বিবর্জিত গ্রাম্য জীবনকে সহজভাবে নিতে পারেন নাই। অন্যদিকে এই অবুঝ গ্রাম্য বালিকা সেই দাদাবাবুর চাকুরী ছেড়ে শহরে প্রত্যাবর্তন – অকস্মাৎ বালিকার এক মুঠো নীল আকাশের মাঝে কালো মেঘের ঘনঘোরে ভ্রান্তিতে হারিয়ে যায়। এই আকস্মিক চলে যাওয়া সে মনকে কিছুতেই বুঝাতে পারে নাই যে দাদাবাবু সমস্ত স্নেহের বন্ধন ছিন্ন করেই নৌকায় উঠে চললেন শেষ বারের মতোই। কিন্তু সেই অনাথ রতনের মনে উদয় হয়েছিলো দাদাবাবু হয়তো আবার ফিরে আসবে।
গল্পের শেষে রবির অনবদ্য প্রাণকাড়া সেই উপসংহারে রতনের আবেগের বর্ণনা মনকে বারে বারে একটি প্রশ্নতেই আটকে রাখে “বোধ করি তাহার মনে ক্ষীণ আশা জাগিতেছিলো, দাদাবাবু যদি ফিরিয়া আসে – সেই বন্ধনে পড়িয়া কিছুতেই দূরে যাইতে পারিতেছিল না।… ভ্রান্তি কিছুতেই ঘোচে না, যুক্তিশাস্ত্রের বিধান বহু বিলম্বে মাথায় প্রবেশ করে, প্রবল প্রমানকেও অবিশ্বাস করিয়া মিথ্যা আশাকে দুই বাহুপাশে বাঁধিয়া বুকের ভিতরে প্রাণপণে জড়াইয়া ধরা যায়, অবশেষে একদিন সমস্ত নাড়ী কাটিয়া হৃদয়ের রক্ত শুষিয়া সে পলায়ন করে, তখন চেতনা হয় এবং দ্বিতীয় ভ্রান্তিপাশে পড়িবার জন্য চিত্ত ব্যাকুল হইয়া উঠে।”
কী অব্যর্থ রবির অন্তরদৃষ্টি। এই ভ্রান্তি, এই আশার কুহকিনী শুধুই রতনের জন্য নয়। এই মায়ার বিচ্ছেদ, এই ভ্রান্তি আশা নিয়েই মানুষের জীবন। আমাদের জীবনে প্রিয়জনের আসা যাওয়ার ক্ষনিকের মুহূর্তগুলি বড়োই মায়ার খেলা। প্রিয়জনকে বিদায় দিতে গিয়ে হৃদয় ভেঙে যায় তবুও থাকি আশায় আবার হয়তো দেখা হবে সহসা। গল্পের শেষে এক উদাস ব্যথার দীর্ঘ নিঃশ্বাসে মন বার বার বলে উঠে উলাপুর গ্রামে গিয়ে রতনের দুইচোখের জলকে যদি একটু মুছে দেওয়া যেতো। কত সহজে তিনি চির বিচ্ছেদের গল্পটি এই অনাথিনী রতন চরিত্রে তুলে এনেছিলেন।
হৈমন্তী গল্পের মাতৃহীনা বালিকা হৈমন্তী সংসারের প্রতিটি গৃহস্থালী কাজে দুর্বল, বিশেষ করে পূজা সাজাইবার আদেশে অজ্ঞতার পরিচয় দেয় “মা, বলিয়া দাও কী করিতে হইবে” বলে । মহিলামহলের ভৎসনা তার হৃদয়ে বাজতো কাটার আঘাতের মতো। হৈমর পিতা ধর্ম দর্শনের কথা, দেবার্চনার কথা কখনো চিন্তা করেন নাই। কন্যাকে নানা বিষয়ের অসংখ্য বই পড়িয়েছেন কিন্তু ওই একটি বিষয়ে কোনো জ্ঞান দেন নাই। গল্পে বিবাহের ঘটক বনমালীবাবুর ধর্ম বিষয়ের এক প্রশ্নে সেই বাবা গৌরীশঙ্কর বলেছিলেন, “আমি যাহা বুঝি না তাহা শিখাইতে গেলে কেবল কপটতা শেখানো হবে।”
হৈমন্তী শ্বশুরবাড়িতে ঋষিপ্রতিম বাবার অপমানে চিরদিনের স্নিগ্ধ হাসি হারানোর ব্যথিত চিত্র দেখতে পাই। পশ্চিমের হিমালয় পাহাড়ে শৈশবে বেড়ে উঠা এই হৈমন্তীর জীবন যেনো বিবাহ নামক সামাজিক রীতির চির বিচ্ছেদের গল্প, এক পিতা ও কন্যার। গল্পের প্রধান চরিত্র হৈমন্তীকে তার স্বামী শিশির নামেই ডেকেছিলো, যে শিশির ভোরবেলায় এসেই ফুরিয়ে যায় ক্ষণিকে, অনাদরে। অনেক রবীন্দ্র গবেষকেরা ধারণা করেন যে হয়তো কবির জ্যেষ্ঠ কন্যা বেলার (মাধুরীলতা দেবী) শ্বশুরালয়ের কষ্টের জীবনের ছায়াটুকু হৈমন্তী গল্পে এসেছিলো। বেলাকে কবিগুরু কখনো কখনো বেলী নামেও ডাকতেন। রবির পত্র সাহিত্যে ‘বেলী’ নামের উল্লেখ দেখা যায়। কবি পুত্র রথীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,পথে প্রিয় কন্যার মৃত্যুর সংবাদ পাওয়ার পর বাড়িতে এসে রবি কাউকে বুঝতে দেন নাই যে কী শোকে, কী অপমানে, কী অসহ্য বেদনার মধ্য দিয়ে তিনি সন্তানকে হারিয়েছেন।
এরপর প্রকৃতি যে মানুষের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ সেটা ভুলি কী করে? গাছের প্রতি শিশুদের মমত্ব জন্মাতে সাহায্য করে যখন রবি ঠাকুরের ‘বলাই’ গল্পের সাথে পরিচয় হয়। এই গল্প শিশুমনকে কৌতূহলী করে তুলে নুতন কিশলয়কে, প্রকৃতির সবুজ সম্ভারকে আহ্বান জানানোর মাধ্যমে। এখানে সেখানে অবহেলায় নুতন কুঁড়ির আবির্ভাবে বলাইয়ের ছিলো আনন্দ। মাতৃহীন বলাইয়ের সাথে এই অংকুরগুলির সখ্য গল্পের মূল প্রতিপাদ্য ছিলো। পাড়ার ছেলেরা যখন অকারণে গাছের ডাল ভেঙে ফেলতো কিংবা পথের দুই ধারের গাছগুলিকে ছড়ি দিয়ে আঘাত করতে করতে যেতো তখন বলাইয়ের এই ছোটো ছোটো গাছেদের জন্য কষ্টে বুক বিদীর্ণ হতো। শিশুরা কত নাম না জানা ফুল ও গাছের সাথে পরিচিতি হয় এই গল্পে। যেমন কন্টিকারি গাছের নীল ফুল, কালোমেঘের লতা, অনন্তমূল ইত্যাদির বর্ণনা পাওয়া যায় এই গল্পে। কবির শৈশবের জীবনাবলীতেও এই প্রকৃতিকে ভালোবাসার চিত্রগুলি আমরা দেখতে পাই।
শুধু কি প্রকৃতি? তিনি পশু পাখির প্রতিও দেখিয়েছেন মায়া। সুভা গল্পের বাকশক্তিহীন বালিকা সুভার সাথে এই অবলাপ্রাণীদের ভালোবাসার মৈত্রী উদ্ভাসিত হয়। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর শান্তিনিকেতনের ছাত্র ছাত্রীদের সাথেও পশুপাখিদের একটি বন্ধন গড়ে উঠুক। চেয়েছিলেন শিশুদের সাথে এই প্রাণীকুলের প্রতি গড়ে উঠুক তাদের উদার দৃষ্টি। যেটার নিদর্শন আমরা পাই ‘বাইশে শ্রাবণ’, নির্মল কুমারী মহলানবীশের লেখায় কিংবা শান্তিনিকেতন ব্রম্ম্যচর্যাশ্রমের প্রথম কার্য্যপ্রণালীতে (২৭ শে কার্তিক ১৩০৯)। তিনি খাঁচায় পাখি না রেখে প্রতিদিন উন্মুক্ত এলাকায় আহার দিয়ে তাদের সাথে মিতালীতে বিশ্বাসী ছিলেন।
কবিগুরুর দরদী দৃষ্টি মানবকুল ছাড়িয়ে সকল প্রাণীতেই ভালোবাসার রং ছড়ানো ছিলো সাহিত্যে ও ব্যক্তিগত জীবনে। শিশু কিশোরদের গল্পে ছড়ায় মায়াডোরের জিয়নকাঠি ছুঁইয়ে গেলেন রবি। তাঁর এই বর্ণিল আলোকধারার বিচ্ছুরণের আলোকরশ্মিতে যেনো বারে বারে স্নিগ্ধস্নাত হয়ে উঠে বাংলার কিশলয়, শত ঝড় ঝঞ্জায়। সাহিত্যের সর্ব শাখায় অবাধ বিচরণের মাধ্যমে এবং জীবনদর্শনের প্রতিফলনের ছোঁয়ায় এক মহাকাল ছাড়িয়ে অন্য মহাকালকেও অতিক্রম করে চিরন্তন বাণীর মতো বাংলা সাহিত্যভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে গেছেন আমাদের রবি, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
বনানী বাবলি