ডঃ বাহারুল হক
রাত তিনটা। হঠাৎ ভ্যান্কুভার থেকে মেয়ের ফোন। কি ব্যপার মা? এত রাতে ফোন? ভ্যান্কুভারে তখন রাত বারোটা। মেয়ে বললো- “না, আব্বু। আমিতো এখনো ঘুমাইনি, তাই তোমাকে জাগিয়ে দিলাম। তোমারতো এয়ারপোর্টের দিকে রওয়ানা হতে হবে”? আমি বললাম- “ঠিক আছে মা; আমরা রেডি হচ্ছি। তুমি ঘুমাও”। রেডি হয়ে বাসা থেকে বের হলাম রাত চারটায়। গাড়ি চলছে টরন্টো পিয়ার্সন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের দিকে। আমার বাসা থেকে এয়ারপোর্ট দূরেই বলা যায়। গভীর রাত। শহরের মাতালরাও এখন ঘুমে। শুধু আমাদের মত খুব জরুরি কাজে কিছু মানুষের বের হওয়া ঘর থেকে। ফলে রাস্তায় গাড়ি কম। যানজট নাই। গাড়ি চলছে নিয়ম মেনে হাই স্পিডে। প্রায় পঞ্চাশ মিনিট লাগলো আমাদের এয়ারপোর্টে পৌঁছতে। আমরা আমেরিকান এয়ার লাইন্সের যাত্রী। আমাদের গন্তব্য আমেরিকার ডালাস। তবে এ যাত্রা আমাদের আমেরিকার শিকাগো। শিকাগোতে দুই ঘন্টা বিরতি। দুই ঘন্টা যাত্রা বিরতির পর আমরা উঠবো ডালাসগামী বিমানে। টরন্টোতে আমাদের ‘চেক-ইন’ সম্পন্ন করিয়ে দিয়ে ছেলে বাসায় চলে গেল। আমি আর আমার স্ত্রী ইমিগ্র্যাশন শেষ করে পৌঁছে গেলাম গেটে। মানুষ গিজ গিজ করছে ইমিগ্র্যাশন সেকশনে। বাপরে, প্রতিদিন কত লোক যে আমেরিকা যায় আর আসে! গেটে বসে থাকলাম অনেকক্ষণ। সকাল সাতটা ত্রিশ মিনিটে আমরা উঠে গেলাম শিকাগোগামী বিমানে। ছোট বিমান, এয়ারবাস কম্পানির তৈরী একশত চল্লিশ থেকে একশত সত্তর জন যাত্রী পরিবহনে সক্ষম শার্কলেট নামের বিশেষ বিমান। বিমান-এর আর কোন সিট ফাঁকা নাই। সব সিটে যাত্রী। দেখতে ভালই লাগলো। বিমানে বেশি সিট খালি থাকলে আমার কেন যেন ভালো লাগে না। বার বার মনে হয়- হায়, আমি বুঝি এমন একটা বিমানে উঠলাম যে বিমান মানুষের পছন্দের না। বিমানে সিট খালি এটা আবার আমার স্ত্রীর খুব পছন্দ। আমাদের সারিতে তিনটা সিট। আমরা দু’জন বসলাম দু’সিটে, তারপর একট সিট খালি। আমার স্ত্রীর ইচ্ছা সিটটা খালি থাকুক। কিন্তু তার সে ইচ্ছা পূরণ হয়নি। শেষ মুহূর্তে এসে হাজির হলেন সেই যাত্রী। একগাল হাসি দিয়ে বসে পড়লেন জানালার পাশের সিটটাতে। বিমান হাউজ ফুল। এবারতো উড়াল দিবার কথা। কিন্তু দিচ্ছে না। যাত্রীরা চরম বিরক্ত। ত্রিশ মিনিট দেরি করে বিমানটি আকাশে উড়লো। এভাবে উড়ালের মধ্যে আকাশে থাকতে হবে। দুই ঘন্টা পর বিমান আমেরিকার শিকাগো শহরের ও’হেয়ার ইন্টারন্যাশনাল বিমানবন্দরে গিয়ে মাটি ছোঁবে।
বত্রিশ হাজার ফুট উপরে উঠে বিমান উড়ছে নিচের ভ‚মির সমান্তরাল হয়ে। এখন সময় শুধু সময় কাটানোর। আমি এটা আগেই ভেবে রেখেছি। তাই ঘর থেকে বের হওয়ার সময় ব্যাগে ভরেছিলাম বাংলা কাগজসহ আরো কিছু কাগজ আর ম্যাগাজিন। এখন মোক্ষম সময় একটা একটা করে বের করে পড়ার। আমার স্ত্রী আবার কথা বলে সময় কাটানোর পক্ষে। তাই পাশের ভদ্র মহিলার সাথে যেছে কথা বলা শুরু করে দিল। কথায় কথায় জানলামÑ ভদ্র মহিলা সেন্টেনিয়াল কলেজের ইংলিশের শিক্ষক ছিলেন। এখন অবসরে আছেন। দুই মেয়ে থাকে শিকাগো। তাদের সাথে কিছুদিন থাকার উদ্দেশ্যে তার শিকাগো যাওয়া। তাদের কথা বলা বেশিক্ষণ চললো না। প্রাক্তন এই শিক্ষক কথা বাদ দিয়ে আমার মত পড়ায় মন দিলেন। আমার স্ত্রীর দুই পাশে দুই বেরসিক শিক্ষক যাদের আনন্দ শুধু পড়ায়। তিনি কী আর করবেন! মাথাটা সিটের সাথে লাগিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলেন। কিছুক্ষণ পর খাবারের ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ালো দুই বিমানবালা। তাদের একজন সহাস্যে হাতে তুলে দিল কুকিজ আর কফি। কত কফি খেলাম এখানে সেখানে! কিন্তু এত সুস্বাদু কফি কোথাও খাইনি। মনে মনে ভাবলাম, আহা, আমার প্রিয় টিম হরটন্সের কফি যদি এমন সুস্বাদু হতো! কফি-কুকিজ খেয়ে এবার মন দিলাম সিটের সাথে সংযুক্ত টিভি পর্দায়। চাপ দিলাম এন্টারটেইনমেন্টে। পর্দায় ভেসে এলো মুভি, মিউজিক, ইত্যাদি। ভেবে চিন্তে মুভিতেই চাপ দিলাম। ভেসে এলো অনেক ধরনের মুভির নাম। বেছে নিলাম কমেডি শ্রেণীর একটা। নাম- এরোপ্লেন। “দেয়ার ইজ অনলি ওয়ান রিভার, দেয়ার ইজ অনলি ওয়ান সী অন্ড ইট ফ্লোস থ্রো ইউ এন্ড ইট ফ্লোস থ্রো মি” এই গানটিও এ মুভির প্রতি আমার আকর্ষণের একটি কারণ। সময় থেমে থাকে না। মিউজিক, মুভি, ইত্যাদিতে ঘুরে ঘুরে সময় পার করে দিলাম। হঠাৎ বিমান ঘোষণা করলো- বিমান এখন শিকাগোর আকাশে; অল্প কিছুক্ষণ পর ও’হেয়ার ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে অবতরণ করবে। কিছুক্ষণ পর বিমান অবতরণ করলো মাটিতে। একে একে যাত্রীরা বের হচ্ছে বিমান থেকে। আমি বের হয়েই বুঝলাম শিকাগোতে ভালই ঠান্ডা পড়ছে। টার্মিনাল থেকে বের হবার কোন দরকার নাই। শুধু গেট পরিবর্তন। অন্য এক গেট দিয়ে আমরা উঠবো ডালাসগামী অন্য এক বিমানে। তবে এখন নয় দুই ঘন্টা পর। এই দুই ঘন্টা ব্যয় হবে টার্মিনালে বেকার বসে থেকে। স্ত্রীকে বললাম- “চল ঘুরে দেখি চারদিক। আগেতো কোনদিন আসিনি, এই প্রথম শিকাগোর ও’হেয়ার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পা ফেলা”। স্ত্রীও রাজি হলেন। দুইজন হাঁটা শুরু করলাম। একটু এগোলেই মিললো ম্যাক ডোনাল্ডস কফি শপ। স্ত্রীকে বললাম- “চল কফি খাই”। স্ত্রী বললেন- “কেন? কফি খেয়েইতো প্লেন থেকে নামলে, এখন আবার কেন কফি”? আমি বললাম- “ক্ষতি কী”? স্ত্রী বললেন- “ক্ষতি আছে। প্লেনে উঠে আবার খাবে দুই কাপ। আগে খেয়েছ দুই কাপ। একদিনে পরপর এত কাপ কফি গেলা কী ঠিক হবে”? কী আর করা? ঠিক হবে না যে তার সে কথা মেনে অন্যদিকে হাঁটা শুরু করলাম। কত আর হাঁটবো? কী আর দেখবো? ঘুরে ফিরে এসে আবার বসলাম গেটে যাত্রীদের সিটে। স্ত্রী আইপড খুলে গান শুনতে লাগলেন। রুনা লায়লার সেই জনপ্রিয় গান; তবে একই গান আমি শুনছিলাম আমার মত করে।
“এয়ারপোর্টের এরোপ্লেনটা,
মাইপা চলে ঘড়ির কাঁটা;
টার্মিনালে বইসা ভাবি,
কখন বাজে বারটা, কখন বাজে বারোটা”।
এক সময় ঠিকই বারোটা বাজলো। ডালাসগামী বিমানের যাত্রীদের বিমানে উঠার জন্য প্রবেশ পথে এগিয়ে যেতে বলা হলো। বিমানে উঠলাম। সেই একই বিমান- এয়ারবাস কোম্পানির শার্কলেট বিমান। আমেরিকান এয়ার লাইনস-এর ডমেস্টিক ফ্লাইটের সব বিমান কী শার্কলেট শ্রেনীর? কে জানে! তবে শুনেছি বড় প্লেন অপেক্ষাকৃত বেশি নিরাপদ। শার্কলেটের আভ্যন্তরিন চিত্র – সাজ- শয্যা আগের বিমানের মতই। ভিতরে দুই দিকে দুটি কলাম। দুই কলামের মাঝখানে হাঁটা-চলার পথ। প্রত্যেক কলামে সারি সারি সিট। প্রতি সারিতে তিনটা সিট। আমি আর আমার স্ত্রী বসলাম পাশাপাশি দুটি সিটে। তৃতীয় সিটটা জানালার পাশে। ওটাতে বসে আছেন এক ব্যক্তি যাকে দেখেই মনে হলো তিনি ধ্যানে আছেন। কফি আসলো, চকলেট আসলো। কিন্তু কফির সেই স্বাদ আসলো না। স্বাদ যে কোথায় হারিয়ে গেল! কাগজ, গান, মুভি, ধ্যান, এসব করে করে কেটে গেল দুই ঘন্টা। বিমানের ফ্লাইট ড্যাক থেকে ঘোষণা এল- বিমান এখন ডালাসের আকাশে; অল্প কিছুক্ষনের মধ্যে ডালাস-ফোর্ট ওয়ার্থ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে অবতরন করবে। সিটে লাগানো টিভির পর্দায় চোখ রাখলাম। চমৎকার! সাঁ সাঁ করে বিমান নিচে নামছে। বিমান দশ হাজার-সাত হাজার-চার হাজার-দুই হাজার ফিট-এক হাজার- পাঁচ শত- দুই শত ফিট উপরে; তারপরতো একেবারে মাটিতে। বিমান থেকে বের হয়ে টারমিনালে প্রবেশ করলাম। চারদিকে তাকালাম। কী সুন্দর রোদেলা দুপুর। এমন রোদেলা দিন বহুদিন দেখি নি। দেখে মনটা ভরে গেল। লাগেজ সংগ্রহ করার জন্যএয়ারপোর্টের লাগেজ বেল্টের পাশে দাঁড়ালাম। দুই মিনিট পর আমার ভাইও এসে গেল। প্রায় সাত মাসপর দুই ভাই আবার একত্র হলাম। লাগেজ, ক্যারী-অন ব্যাগ সব নিয়ে উঠলাম আমার ভাইয়ের গাড়িতে। ট্যাক্সাস অঙ্গরাজ্যের ডালাস কাউন্টির উত্তর -পশ্চিম কোণে অবস্থিত ছোট অভিজাত টাউনশিপ কোপেল-এ আমার ভাইয়ের বাড়ি। ভাই গাড়ি নিয়ে এখন তার বাড়ির দিকেই যাচ্ছে। চলতে চলতে দুই পাশের গাছ-পালা, ঘাস- পাতা দেখে বুঝলাম ঠান্ডা ডালাসেও পড়েছে তবে বরফের কঠিন চড়ে টরন্টো যেরকম বেদিশা সেরকম কিছু ডালাসে হয়নি। এখানকার শীত তীব্র বটে তবে সে তীব্রতার যন্ত্রনা নাই।