কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।

মনিস রফিক

দুই.
আমার জন্মের দুই বছর পর আলেকজান্দর অর্থাৎ শাসার জন্ম হয়, আর তার দুই বছরের মধ্যে মিশেলের। আমাদের এই কাছাকাছি জন্ম হওয়ায় আমরা তিনজনে একেবারে তিন বন্ধুর মত বেড়ে উঠেছি। একসাথে খেলাধুলা করা, দৌড়ঝাঁপ করা এমনকি একে অপরের পেছনে লাগা – এগুলো ছিল আমাদের পরম আনন্দের বিষয়। সত্যি বলতে কি আমরা ছিলাম তিন দূরন্ত সিংহ শাবক। শাসা যখন ডায়াপার ছাড়েনি তখনই আমি তাকে কুস্তি শেখাতাম আর মিশেল যখন একেবারে পুচকে শিশু তখনই শাসা তার পাশে ঘুরঘুর করে খবরদারি করতো। আমাদের এই দস্যিপনা দেখে ২৪ সাসেক্স এর বেইজমেন্টে আমাদের ছুটোছুটির সুবিধার্থে বিশেষ পুরু মাদুর পাতা হয়েছিল। হয়তো আমাদের পিতামাতা দেখতে চেয়েছিলেন আমরা কত বেশি ছুটোছুটির পর ক্লান্ত হই।

তখনকার হ্যারিংটন লেকটার কথা মনে পড়লেই আমার হার্ডির উপন্যাসের সেই কিছুটা ভূতুরে জলাভূমি আর গাছ গাছালির কথা মনে পড়ে যায়। বলা যেতে পারে সত্যিকারের দুঃসাহসিক অভিযান চালানোর মত একটা জায়গা ছিল হ্যারিংটন লেক আর তার আশপাশ। দুঃসাহসিক কাজে চিরকাল ছিল বাবার গভীর আগ্রহ। তিনি চাইতেন আমরাও যেন দুঃসাহসিক চিন্তাভাবনা আর কাজকর্মে মেতে থাকি। ২৪ সাসেক্সের আমাদের বাড়ির কাছেই ছিল একটা খামারবাড়ী। সেখানে ছিল পরিত্যক্ত একটা গোলাঘর। জায়গাটার প্রতি ছিল আমাদের বিশেষ আকর্ষণ। আমরা সুযোগ পেলেই সেখানে অভিযান চালাতাম। ওখান থেকে একটু দূরে একটা পুরনো অভ্র খনি পেরিয়ে কিছুটা পথ এগুলেই লেকের পাশে পাওয়া যেত এক পরিত্যক্ত নৌকাঘর। গ্রীষ্মের সময় সেখানে আমরা তিনভাই রোদের মধ্যে শুয়ে থাকতাম। লেকের পাড় থেকে এক’শ মিটার দূরে ছিল একটা ছোট্ট দ্বীপ। মিশেলের বয়স যখন সাত বছর পার হয়েছিল তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমরা সাঁতরে সেই দ্বীপে গিয়ে আবার ফিরে আসবো।

আমাদের বাবা সব সময় এমন কাজে আমাদের উৎসাহ দিতেন। বাবা আমাদের এই পরিকল্পনার কথা জেনে রাগ না করে বরং আমাদের বাহবা দিয়েছিলেন এবং নির্দিষ্ট দিনে যখন আমরা সাঁতারের প্রস্ততি নিচ্ছিলাম, সেদিন তিনি আমাদের সাথে ছিলেন। এমনকি আমাদের পাশপাশি সাঁতরে সেই দ্বীপে গিয়ে আমাদের সাথেই তিনি ফিরে এসেছিলেন।


আমাদের এই দূরন্ত দুঃসাহসিক কাজে উৎসাহ দেবার পাশাপাশি বাবা মাঝে মধ্যে এমন সব কাজ করতেন যে আমরা অবাক না হয়ে পারতাম না। হয়তো আমরা গতিনিউ পার্কে ভ্রমণে বের হয়েছি, দেখা গেল, বাবা হঠাৎ করেই পার্কের একটা ম্যাপ বের করে কোনো একটা বিশেষ জায়গায় আঙ্গুল রাখতেন আর আমাদের দিকে তাকাতেন। আমরা ওর মানে বুঝে যেতাম অর্থাৎ আমাদের ওই জায়গাটায় যেতে হবে। আমরা পরম উৎসাহে আমাদের অভিযান শুরু করতাম। হয়তো আধ ঘন্টা লেগে যেত চিহ্নিত জায়গায় যেতে। আমাদের সাথে আমাদের মা’ও থাকতেন। তেপান্তরের পানে আমাদের এই ছুটে চলা সত্যি খুবই মজার ছিল। দিক ও জায়গা খুঁজে বের করায় বাবার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। তিনি কখনও পথ হারাতেন না। কিন্তু ঐ জায়গা ভ্রমণে যারা আসতেন তারা প্রায় সবাই কিন্তু পথ হারিয়ে ফেলতেন। দেখা যেতো, অনেক পথযাত্রীই পথ হারিয়ে আমাদের কাছে এসে কানাডার প্রধানমন্ত্রীরকে জিজ্ঞেস করতেন তারা কোন পথ ধরে তাদের ঈপ্সিত জায়গায় যাবেন। বর্তমানে আমি যখন সেই সব দিনগুলোর কথা ভাবি তখন সব যেনো কেমন পরাবাস্তব মনে হয়। কিন্তু ছোটবেলার ঐ বিষয়টা অর্থাৎ কানাডার প্রধানমন্ত্রীর কাছে এসে পথ হারানো মানুষগুলোর তাদের পথের দিক নির্দেশনা জেনে নেয়াটা আমাকে খুবই স্বাভাবিকই মনে হতো।

আমার বাবা কি চাকুরী করতেন বা তার কাজটা আসলেই কি ছিল, আমার আট নয় বছর বয়সে আমি ঠিক ধরতে পারতাম না। আমার মা গল্প করতে ভালোবাসেন এবং মাঝে মাঝেই আমার ছোটবেলার হারিয়ে যাওয়া গল্পগুলো খুঁজে বের করেন। আমি একবার মায়ের সামনে বাবা সম্পর্কে বলেছিলাম, ‘দ্য বস অব কানাডা’। হয়তো কোথাও কথাটা শুনেছিলাম। কিন্তু আমি তখন জানতাম না কথাটার মানে কী? আমার বন্ধুদের বাবা-মা’রা কাজ করতেন, সেটা আমি বুঝতে বা ধরতে পারতাম। কেহ হয়তো স্টোরে কাজ করতেন, বা রুগী দেখতেন অথবা রেডিও’তে কথা বলতেন। আমি ধারণা করতে পারতাম তারা কী করেন। কিন্তু ‘পাবলিক সার্ভিস’ কথাটা আমার কাছে খুবই দূর্বোধ্য ছিল, আমি একেবারে বুঝতে পারতাম না।

বিষয়টা আমার কাছে আরো বেশি খটকা লেগেছিল যেদিন আমি বাবার সাথে আমাদের বাড়ির ব্যাপারে কথা বলছিলাম। বাবা আমাকে জানিয়েছিলেন আমাদের কাপড়-চোপর, বইপত্র যেমন একেবারে আমাদের সেই অর্থে বাড়িটা আমাদের নই। বাবার কথা শুনে আমি অবাক হয়েছিলাম। আমি প্রশ্ন করেছিলাম, আমরা ২৪ সাসেক্স এর বাড়িটাতে বাস করি, তাহলে বাড়িটা কেন আমাদের হবে না? বাবা আমাকে বুঝিয়েছিলেন, ওটার মালিক সরকার। বাবার এমন উত্তর আমার কাছে আরো বেশি দূর্বোধ্য লেগেছিল। আমি মনে মনে শুধু ভাবতাম, আমার বাবাতো কানাডার বস, তাহলে ওটা আমাদের হবে না কেনো? আমি কিছুদিনের মধ্যেই এর উত্তর পেয়েছিলাম। ১৯৭৯ সালে ফেডারেল নির্বাচনে লিবারেল পার্টি হেরে গেলে আমাদের রাতারাতি ২৪ সাসেক্স এর বাড়িটা ছেড়ে কয়েক বøক পরে বিরোধী দলের নেতার স্টোরনোওয়ে’র বাসভবনে গিয়ে উঠতে হয়। এই সময় সত্যি সত্যিই বুঝতে পেরেছিলাম, কানাডার জনগণই হচ্ছে কানাডার আসল ‘বস’।

আমি ধীরে ধীরে বড় হতে হতে আস্তে আস্তে বাবার নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপগুলো ধরতে পারছিলাম এবং আমি এটাও উপলব্ধি করছিলাম একটা সুন্দর কানাডা গড়ার জন্য পদক্ষেপগুলো কতটুকু ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে বহু ভাষাভাষি ও জাতিগোষ্ঠীর এই দেশটিতে। আমার বয়স যখন দশ বছর তখনই বাবা আমাকে ‘চার্টার অফ রাইটস এন্ড ফ্রিডমস’ এর বিষয়টা বুঝিয়ে বলেছিলেন। আমি তখন গণতন্ত্রের স্বরূপ, বৈশিষ্ট্য বা ক্ষমতার বিষয়গুলো তেমন বুঝতাম না। এই চার্টারের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলতেন, সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকার যেনো কোনোক্রমেই স্বেচ্ছাচারী না হয়ে পড়ে সেজন্যই এমন বিধান থাকা প্রয়োজন। ষাটের দশকে পিয়ারসন সরকারের বিচারমন্ত্রী থাকার সময় মূলত বাবাই ‘চার্টার অফ রাইটস এন্ড ফ্রিডমস’ বিষয়টা পার্লামেন্টে তুলেন।

বাবা আমার মত এক বালককে বিষয়টা বুঝানোর জন্য একটা সুন্দর উদাহরণ দিয়েছিলেন। তিনি তার দু’হাত আমার সামনে দেখিয়ে বলেছিলেন, মনে কর আমার এই ডান হাতটা সংখ্যাগরিষ্ঠ, এ সংখ্যাগরিষ্ঠতা হতে পারে কানাডার জনগণের দিক দিয়ে, অর্থাৎ অধিকাংশ নাগরিকের ভোট আছে এই পক্ষে, কিন্তু এই যে বাম হাতটা দেখছো, এর লোকসংখ্যা অনেক কম এবং পার্লামেন্টে এদের প্রতিনিধিও একেবারে নেই, তারপরও সংখ্যাগরিষ্ঠের দল এমন কোনো আইন পার্লামেন্টে পাশ করতে পারবে না যেটা কানাডায় বসবাসরত যে কোনো সংখ্যালঘিষ্ঠ দলের কোনোরূপ দুঃখ ও কষ্টের কারণ হতে পারে।

বাবা তাঁর সারা জীবন ধরে এমন এক কানাডা গড়তে চেয়েছিলেন যা হবে বহু ধর্ম, বহু জাতি আর বহু বিশ্বাসের এবং যেখানে সকল নাগরিক জাতি, ধর্ম, বিশ্বাস নির্বিশেষে সমান অধিকার ভোগ করবে আর মুক্ত ও স্বাধীনভাবে চলতে পারবে। আমি আমার বালক বয়সেই বাবার এই কথাগুলো অনুধাবন করতে পেরেছিলাম সেজন্য আমিও পরমভাবে বিশ্বাস করি কানাডায় বসবাসরত সকল নাগরিক সকল রাষ্ট্রীয় বিষয়ে সমান অধিকার ভোগ করবে, সে যে জাতি বা যে গোত্রেরই হোক না কেন। এই চার্টারে ফলেই কিন্তু কানাডায় নারী অধিকার ও আদিবাসীদের অধিকার সংরক্ষিত হয়েছে।

১৯৮০ সালের ৩ মার্চ পিতা পিয়েরে ট্রুডো’র দ্বিতীয় বারের মত কানাডার প্রধানমন্ত্রী হবার শপথ অনুষ্ঠানে তিন ভাই, (বাম থেকে) জাস্টিন, মিশেল ও শাসা।

২০০৮ সালে আমি পার্লামেন্টের সদস্য হবার পর লক্ষ্য করেছি এই ‘চার্টার অফ রাইটস এন্ড ফ্রিডমস’ এর প্রতি হারপার সরকার এক ধরনের অনিহা পোষণ করে আসছে। তারা এ চার্টারের ত্রিশ বছর পূর্তি পালন করেনি। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, এখানেই লিবারেল আর কনজারভেটিভদের মধ্যে প্রধান পার্থক্য। লিবারেল এর আদর্শ হচ্ছে, একজন মানুষ সে যে ধর্ম, বর্ণ, জাতি বা যে সংস্কৃতিরই হোক না কেনো সে সবার মত সমান অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করবে আর সংবিধান সবসময় এটার রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে।
এতদিন পর এসে আমি আরো বেশী উপলব্ধি করি, বাবার পদক্ষেপগুলো সত্যিই চমৎকার ছিল। তিনি ছিলেন সুদূরপ্রসারী চিন্তার মানুষ আর তাঁর চিন্তায় সব সময় থাকতো সামষ্টিক মানুষের মঙ্গল ও উন্নয়ন। বাড়ীতে বাবাকে আমরা ‘পাপা’ বলে ডাকতাম। কারণ তাঁর সাথে আমরা সবসময় ফরাসী ভাষায় কথা বলতাম। অটোয়ায় যখন তাঁর সাথে আমরা থাকতাম তখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর কাজ খুব কাছ থেকে দেখা হতো না। কারণ তিনি সব সময় তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্ব ও পিতার কাজের মধ্যে একটা বিরাট ব্যবধান রাখতেন। কিন্তু আমরা যখন তাঁর সাথে অটোয়ার বাইরে এবং দেশের বাইরে যেতাম তখন ব্যাপারটা হতো সম্পূর্ণ আলাদা।

বাবার সাথে দেশের বাইরে যাবার যখন আমার পালা আসতো তখন এক অন্য ধরনের আনন্দ পেতাম। দেখা যেতো বাবাকে তাঁর ফরেন পলিসি এডভাইজার বব ফাউলার বা তাঁর একজিকিউটিভ এসিস্টেন্ট কিছু বিষয়ে ব্রিফিং দিচ্ছেন, তখন আমি বাবার পাশে একটা চেয়ারে বসে কিছু চিবাচ্ছি। বাবার সাথে এই বিদেশ ভ্রমণে মাঝে মধ্যে আমিও নৈশভোজে অংশ নিতাম। এভাবে পৃথিবীর অনেক বড় বড় নেতার সাথে আমার দেখা হয়েছে। এক্ষেত্রে আমি উল্লেখ করতে পারি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার, জার্মান চ্যান্সেলর হেলমুট স্মিথ এবং সুইডিশ প্রধানমন্ত্রী ওলফ পামের কথা। শেষজন আমাকে একটি রেইন ডিয়ারের শিং এর চাকু উপহার দিয়েছিলেন যা এখনো আমি যতœ সহকারে রেখে দিয়েছি।

বাবার সাথের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে মাঝেমধ্যে আমার সামনের সারিতে বসার ব্যবস্থা হতো। ১৯৮২ সালে বাবার সাথে পশ্চিম ইউরোপের কানাডিয়ান মিলিটারী বেইজ এ গিয়েছি, সেখানে আমার আসন ছিলো প্রথম সারিতে। হঠাৎ সংবাদ আসল সোভিয়েত নেতা লিওনার্দো ব্রেজনেভ মারা গেছেন, ফলে তাঁর অন্তোষ্টিক্রিয়ায় অংশ নিতে পরের দিন সকালেই বাবা মস্কোর দিকে রওনা হলেন।

বিমানবন্দরে আমাদের নিতে এসেছিলেন সোভিয়েত রাশিয়ায় নিযুক্ত কানাডার রাষ্ট্রদূত জিওফ্রে পিয়ারসন। গাড়ীতে যেতে যেতে তিনি রাশিয়ার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলছিলেন। আমার এখনো মনে আছে তাদের আলোচনার প্রধান বিষয় ছিল ব্রেজনেভের পর কে রাশিয়ার ক্ষমতায় বসবেন। মস্কোর রাস্তা দিয়ে যখন আমাদের গাড়ীটি এগিয়ে যাচ্ছিলো তখন চারিদিকে আধার করে সন্ধ্যা নামছিল। এই সন্ধ্যার রাস্তা ফুড়ে যখন আমাদের গাড়ীটি সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন আমার কানে বার বার ভেসে আসছিল রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে রাষ্ট্রদূতের সাথে বাবার গভীর আলোচনা। সেই গভীর চুলচেরা আলোচনা শুনে আমার কেনো যেন মনে হয়েছিল আমাদের আশপাশ আর জগতের সবকিছু সম্পর্কে বাবা যতটুকু জানেন তা আর কেউ জানেন না। (চলবে)