বনানী বাবলি : আমার আজকের গল্পটা ঠিক গল্প নয়। তবে গল্প ভাবলে গল্প, অপহরণ ভাবলে অপহরণ। আবার রাঙামাটির গভীর জঙ্গলে শান্তি বাহিনীর আতিথেয়তা ভাবলে তাও ভাবতে পারেন আপনারা। বিষয়টা না হয় আপনাদের হাতেই ছেড়ে দিলাম। তা যাই হোক, গল্পের শুরু করি সেই দিনগুলি নিয়ে আপনাদের সাথে। এখানকার নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়াও আছে চিৎমরম বৌদ্ধ বিহার, পাবলাখালী বন্য প্রাণ অভয়ারণ্য। সুন্দর বনের পরে এটাই দ্বিতীয় বৃহত্তম অভয়ারণ্য প্রাণীকুলের। শান্তি বাহিনী নামে পার্বত্য চট্টগ্রামে একটা ছোট্ট পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক সংগঠন ছিল। সেটা ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির একটি অঙ্গ সংগঠন।

সাধারণ মানুষ এই সংগঠনের কথা জানতে পারে ১৯৭৩ সালের ৭ তারিখে যখন আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়। আমরা ছাত্রজীবনে যখন ভাড়া করা বড় বাস নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাঙামাটিতে বনভোজনে আসতাম তখন সন্ধ্যা হওয়ার আগেই এই এলাকা থেকে বের হয়ে আসতে হতো এই পার্বত্য শহরের নিয়ম অনুসারে। এদের সম্পর্কে জানার আগ্রহ ছিল আমার, জানি না কী যেন কী কারণে। তবে এই সংগঠনের পটভ‚মি তৈরী হয়েছিল ব্রিটিশ উপনিবেশিক ও পাকিস্তান আমলে। এরা নিজেদের জুমিয়া জাতি হিসাবে ঘোষণা দেয় তখন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন সংবিধানের মূল নীতিতে তাদের আবেদন খারিজ করা হয় তখন অসন্তোষ আরো ছড়িয়ে যায় এই পার্বত্য অঞ্চলে। কারণ তারা তো বাঙালি জাতীয়তাবাদের আওতায় নয়, সঙ্গত কারণে। যখন কাপ্তাই হাইড্রো – ইলেকট্রিক প্রজেক্ট তৈরী হয় ১৯৬০ সালে তখন এই পাহাড়ী অঞ্চলের অধিবাসীরা প্রচুর ক্ষতিগ্রস্তের সম্মুখীন হয়। তাছাড়া বাঙালিদের এই অঞ্চলে বসতি স্হাপন, জোর করে তাদেরকে ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করা, তাদের জুম চাষের জমি কেড়ে নেওয়া এই সব অত্যাচারের ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সালে আত্মপ্রকাশ ঘটে সেই সমিতির। শান্তি বাহিনীরা চেয়েছিলো একটা স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল হবে এই পার্বত্য চট্টগ্রামে। খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলার দুর্গম অরণ্যে এদের সদর দপ্তর ছিল।

আমার আজকের গল্প টা শান্তি বাহিনীর দাবি নিয়ে নয় কিংবা ওরা যে নির্যাতিত হয়েছিল সেটা নিয়েও নয়। আমি এবং আমার বন্ধু নিজান ভাই কী ভাবে এদের সাথে জড়িয়ে গেলাম সেটাই বলবো আজ আনুমানিক সাল ১৯৮৭ এবং জুন কিংবা জুলাই হতে পারে । আমি নুতন বিয়ে করেছি আমার বৌ এবং বড় ভাই বোন সবাই ঢাকাতে । চট্টগ্রামে শুধু আমার দুই বছরের বড় বোন ও তার পরিবার থাকে । নিজান (আশরাফ উদ্দিন নিজান) ভাই ও তাঁর স্ত্রী তাঁদের প্রথম সন্তানের আগমনের অপেক্ষারত। ওনাদের বাসা চট্টগ্রাম শহরেই। আমি বিভিন্ন ব্যবসা করে যখন সফলতা থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছিলাম তখন এই নিজান ভাইয়ের পরামর্শে এখানে কন্সট্রাকশনের কাজ শুরু করি। তিনি আমার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জীবনের একজন ঘনিষ্ট বড় ভাই ও বন্ধু। ছিপ ছিপে মাঝারি গড়ন এবং সব সময় হাসি খুশি মুখ। রসের গল্প ওনার ঠোঁটে লেগেই থাকে । আমরা শাহজালাল হলে এক সাথে অনেক বিনিদ্র রাত কাটিয়েছি গল্প করে । যাই হোক, নিজান ভাই তখন অনেক সফল ব্যবসায়ী এই রাঙামাটিতে। ওনারও কন্সট্রাকশনের ব্যবসা। আমাদের দুইজনের কাজের সাইট ছিল আলাদা, তবে কাছাকাছি।

শান্তি বাহিনীর সাথে প্রথম দিন :
আজকের প্ল্যান ছিল দুইজনের কাজের সাইট গুলি দেখে এবং লেবারদের সপ্তাহের মজুরি দিবো। তারপর রাঙামাটির বাসায় গিয়ে দুপুরের ভাত খেয়ে এরপর রওনা হবো চট্টগ্রামে। এখানে রাঙামাটি মেইন শহরে আমরা দুইজনে একটা ছোট বাসা ভাড়া নিয়েছি। কিন্তু বৃহস্পতিবার বিকালেই সাধারণত আমরা চলে যাই চট্টগ্রামে এবং আবার ফিরে আসি রাঙামাটিতে শনি বা রোববার। এখান থেকে চট্টগ্রাম শহরে গাড়িতে যেতে সময় লাগে আনুমানিক আড়াই তিন ঘন্টা যদি রাস্তায় গাড়ির ভিড় না থাকে। নিজান ভাইয়ের গাড়ি আছে এবং নিজেই গাড়িটা চালান। আর আমার হলো হোন্ডা ১২৫ মোটর সাইকেল । রাঙামাটিতে সন্ধ্যার পর যান বাহন চলাচল নিষেধ। অর্থাৎ চট্টগ্রাম শহর থেকে যে গাড়ি গুলি আসে রাঙামাটিতে সেই গুলি সন্ধ্যার আগেই আবার বের হয়ে যায় এখান থেকে। রাঙামাটি থেকে চট্টগ্রাম যেতে হলে মাঝখানে হলো ঘাগড়া এবং এখানেই রাস্তার পয়েন্টটা দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে। একটি পথে যাওয়া যায় কাপ্তাই পাহাড়ি পথে এবং অন্যটি বিভিন্ন উপজেলায় যায় যেমন এটি দিয়ে যাওয়া যায় নানিয়ার চর। এই নানিয়ার চরে যাওয়ার পথেই রাস্তায় কালভার্ট ও বড় সড়কের কাজ চলছিল।

রাঙামাটিতে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ছাড়াও বাঙালিরা কাজ করতে আসে। যেমন সেগুন কাঠের ব্যবসায়ী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সরকারি বেসরকারী কর্মচারী। অনেকে এখানে স্থায়ী ভাবে অবস্থান করে আবার কেউ বা ডেইলি প্যাসেঞ্জার এই চট্টগ্রাম আর রাঙামাটি রাস্তার। এখানকার রাস্তাগুলি পাহাড়ি উঁচু নিচু এবং আঁকা বাঁকা। রাস্তার দুই পাশে কখনো ঘন জঙ্গল, কখনো বা সারি সারি সেই জুম চাষ। বন বিভাগের অনুমতি ছাড়া সাধারণত কাঠের ব্যবসায়ীরা গভীর জঙ্গলে যায় না শান্তি বাহিনীর ভয়ে। এখানে অনেক গল্প আছে যে শান্তি বাহিনীর লোকেরা কাঠ ব্যবসায়ী সেজে বাহিরের লোকদেরকে গাছ দেখাতে নিয়ে যায় অনেক ভিতরে, গভীর জঙ্গলে। তারপর আটকে রেখে মুক্তি পণ দাবি করে তাদের লোকজনদের থেকে। পরে আভ্যন্তরীন নেগোসিয়েশন হয় টাকার অংক নিয়ে যেটা সংবাদপত্র বা মিডিয়াতে কখনোই আসে না।

(আমার গল্পের নাজমুল

যেহেতু আমরা আজকে লেবারদের মজুরি দিতে যাচ্ছি তাই আমরা ভাবলাম নিজান ভাইয়ের গাড়ি না নিয়ে আমার মোটর সাইকেল নিয়েই যাই। আমি চালাচ্ছি আর নিজান ভাই আমার পিছনে বসে। প্রতিদিনের মতো আজও যাচ্ছি সাইটে আমরা দুইজনে। রাস্তায় এখানে তেমন কোন ট্রাফিক জ্যাম নেই বললেই চলে । এগুলি পাহাড়ি খালি রাস্তা। এখানে কদাচিৎ গাড়ি দেখা যায়। এইবার আমরা রাঙামাটি মেইন রাস্তা থেকে ঢুকে যাচ্ছি সাব রোডে। কাছেই একটা সুন্দর সাদা টলটলে জলের হ্রদ আছে এখানে। আর ওপারেই হলো নানিয়ার চর (স্থানীয় ভাষায় নাইন্নার চর)। এখান থেকে কাছেই হলো আর্মি পাহারা ক্যাম্প পোস্ট, যেটা মাচার মতো উপর থেকে নজর রাখে চারিদিকের এলাকা ও রাস্তা গুলিকে। এই আর্মি পোস্টটা আমার আর নিজান ভাইয়ের দুইটা সাইটের অনেকটা মাঝখানে। যাই হোক, প্রথমে এসে পৌঁছলাম নিজান ভাইয়ের কনস্ট্রাকশন সাইটে। এসে দেখলাম কাজ শুরু করে দিয়েছে এই সকালেই। সবাই ব্যস্ত ইট, পাথর, বালি, সুরকি নিয়ে। নিজান ভাই সাইটের লোকদের কে বললেন, “আমরা এক্ষুনি ঘুরে এসে তারপর তোমাদের মজুরিটা দিয়ে দিব। কাজ কর। কাজ কর, ভাল মত।” নিজান ভাই কে নিয়ে আমি পনেরো মিনিটের মধ্যেই চলে আসলাম আমার সাইটে। আমি মোটর সাইকেলটার স্টার্ট অফ করে একটু জাম্প করে ঢালুতে নেমে আসতে আসতে বললাম নিজান ভাইকে, “কাজটা একটু দেখি, কী বলেন নিজান ভাই?” শুনলাম পেছন থেকে নিজান ভাই বললেন, “ঠিক আছে নাজমুল।” আমার সাইটে মিস্ত্রিরা এখনো এসে পৌঁছেনি। আজকে আবার এখানে আসতে হবে ওদের মজুরিটা দেওয়ার জন্য। ওদের কাজ দেখে বুঝলাম এখনো পীচের কাজ শুরু করতে পারবে না। অর্ধেক কাজও এগিয়ে নিতে পারেনি ওরা । মনের দুঃখ নিয়ে হোন্ডাতে উঠে বসলাম এবং আবার নিজান ভাইয়ের সাইটে চলে আসলাম। নিজান ভাই মিস্ত্রিদের টাকা পয়সা বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় নিলেন ওদের থেকে।

আবার দুই জনে মোটর সাইকেলে যাত্রা শুরু করলাম রাঙামাটির বাসার দিকে। এই যাত্রার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই চলে আসলো পাহাড়ি উঁচু নিচু রাস্তা। পুলিশ ফাঁড়িটা এখান থেকে মাত্র ৩০০ মিটারের মধ্যে। এইবার ঢালু থেকে রাস্তার উপরের দিকে উঠছি এবং মোটর সাইকেলের গতি তখন মাত্র ২০ শস র হটাৎ আমি দেখলাম রাস্তার উঁচুতে যেই দিক দিয়ে উঠছি, বিশ হাত দূরত্বের মধ্যেই চার জন লোক আমাদের গতি রোধ করার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। মাঝখানের দুইজনের হাতে বন্দুক তাক করা আমাদের দিকে এবং পাশের দুইজনের হাতে লাঠি। এই মুহূর্তের ভয়াবহ ঘটনাটা ৫০০ মিটার দূরে নিজান ভাইয়ের মিস্ত্রিরা দেখতে পাচ্ছে। মিস্ত্রিরা এই অবস্থা দেখার সাথে সাথে চিৎকার শুরু করে দিলো নিচ থেকে, যেখানে কন্সট্রাকশনের কাজ হচ্ছে। তখন উপর থেকে বন্দুকধারীরা তাদের দিকে বন্দুক তাক করাতেই ওরা সব এক এক জন এক এক দিকে দৌড়ে পালিয়ে যায় মুহূর্তেই।
আমি মোটর চাইকেলটা একটু সাইড করে দাঁড় করিয়ে সাহস নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী হইছে তোমাদের? বন্দুক ধারী ‘দুই’ চট্টগ্রামের ভাষায় বললো, আগে চল, তারপর কথা।” আমি আমার মোটর সাইকেলটা একটু সোজা করতে চাইলাম কারণ এইটার উপরে আমার খুব মায়া, মাত্র কয়দিন আগে এটা কিনেছি। আমি মোটর সাইকেলে হাত দেয়ার সাথে সাথে ওদের সাথে আমার একটু ধস্তাধস্তি হয় এবং এতে আমার মোটর সাইকেলটা নিচের দিকে ঢালুতে নেমে যায় গড়িয়ে। আমার ইচ্ছে ছিল মোটর সাইকেলটা নিয়েই ওদের সাথে হাঁটি। তখন বন্দুকধারী ‘এক’ বললো চট্টগ্রামের ভাষায়, ”এওং (এখন) যদি আর্মি দেখে তইলে তোয়ারারে পঁইল্লা মারি ফেললুম। চল চল, হাডও হাড়ও।” দেখি নিজান ভাইও সুবোধ বালকের মতো আমার পিছনে হাঁটছেন সামনে পিছনে দুই বন্দুকধারী আর আমাদের দুই জনের মাঝখানে দুই লাঠিয়াল। বন্দুকধারী ‘এক’ আমাদেরকে ক্রমাগত অতি দ্রুত হাঁটার জন্য তাড়া দিচ্ছিলো। এখন হালকা জঙ্গলের মধ্য দিয়েই যাচ্ছি। প্রায় এই ভাবে দশ মিনিট হাঁটার পর বন্ধুকধারী ‘এক’ আমাদেরকে দৌড়াতে বললো। এখন দৌড়াচ্ছি জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। আসে পাশে সব বুনো লতা পাতা, বড় বড় নাম না জানা সব গাছ । যেখানে হাঁটার কোন রাস্তা নেই সেখানে লাঠিয়াল ‘এক’ হটাৎ কোমর থেকে দা বের করলো এবং সেই লম্বা শানিত বাঁকা দা দিয়ে জঙ্গল কেটে পথের সৃষ্টি করছে। ওর কোমরে যে দা লুকানো ছিল এতক্ষন খেয়াল করিনি। আমি সাধারণত ধুম পান করি না। কিন্তু মাথা থেকে ভয় ও উত্তেজনা পরিহারের জন্য দৌড়ের গতি ঠিক রেখে দৌড়তে দৌড়তে নিজান ভাইকে বললাম,”নিজান ভাই, একটা সিগারেট দেন। নিজান ভাই আমাকে একটা ধমক দিয়া বললেন,”দূর মিয়া, সিগারেট চাইবার আর সময় পাইলা না। তৎক্ষনাথ বন্দুক ধারী ‘এক’ আমাদেরকে দৌড়ের সাথে সঙ্গতি রেখে বললো, কথা ন, কথা ন। ছুঁরও ছুঁরও। তার সাথে সাথে দৌড়তে লাগলাম আমরা দ্রæত লাইন ধরে পেছনে। বলা যায় এক রকম ঠিক বাঘের তাড়া খাওয়ার মতোই দৌড়চ্ছি।

এইবার ওরা ওদের পাহারার ধরণ পরিবর্তন করলো দৌড়তে দৌড়তে। সামনে লাঠিয়াল ‘এক’ তারপর আমি। আমার পেছনে বন্ধুকধারী ‘দুই’ তারপর নিজান ভাই। নিজান ভাইয়ের পেছনে বন্ধুকধারী ‘এক’ এর পর লাঠিয়াল ‘দুই’। কিছুই বুঝতে পারছি না। কথাও বলা যাচ্ছে না। এইভাবে প্রায় এক ঘন্টা দৌড়ানোর পরে এবার পাহাড়ের উপরের দিকে উঠা শুরু করলাম আমরা সবাই। আসে পাশে শুধুই জঙ্গল। এই পর্যন্ত কোন মানুষ বা জন বসতি দেখতেই পেলাম না। চারি দিকে অদ্ভুদ নীরবতা। যেনো এখানকার প্রাণী ও প্রকৃতি নীরবে আমাদের পর্যবেক্ষণ করছে।

জঙ্গল একটু হালকা হলে দূরে পাহাড়ের গায়ে কিছু সারি সারি আনারসের বাগান দেখতে পেলাম। এরই মধ্যে এক ঘণ্টা অতিক্রম হয়ে গেল আমাদের। এই যে আমরা এতক্ষন হাঁটলাম এবং দৌড়ালাম, কোথাও কোন বাড়ি ঘর দেখতে পেলাম না। যাই হোক, পাহাড়ি পথে উপরেই চলে গেলাম ওদের পিছু পিছু। অদূরে একটা ছাউনি দেয়া ঘর দেখা গেল। ঘরটার কাছে চলে এলাম। ভিতরে শুধু একটা বড় ঢেকি। কিছু আর নেই এখানে। ইশারায় আমাদের এখানে বসতে বললো, ঢেঁকিটার উপরেই । আমরা দুইজন পাশাপাশি বসে গেলাম ধপ করে। পায়ে অসম্ভব ব্যথা হচ্ছিলো। আমার তখন মনে হচ্ছিলো এখানেই মাটিতে শুয়ে থাকি। আমার দীর্ঘদিনের ব্যাক পেইন আছে। কথা বলা নিষেধ তাই আমি আর নিজান ভাই শুধু চোখে চোখে কথা বলছি। বন্দুকধারী দুইজন আমাদেরকে দরজায় দাঁড়িয়ে পাহারায় ছিল আর বাইরে কাদের সাথে যেন ওদের নিজেদের ভাষায় কথা বলছিলো। আর যে দুইজন লাঠিয়াল ছিল ওরা কোথায় যেন চলে গেলো? প্রায় পনেরো মিনিট আমরা এখানে বসে রইলাম অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দ্বারে। জানি না কী হতে যাচ্ছে। কিছুক্ষন পর ওই দুই লাঠিয়াল হাতে করে ডাব কাটতে কাটতে ঘরে ঢুকলো এবং আমাদের দিকে তা বাড়িয়ে দিলো। এক মুহূর্তে বুভুক্ষের মতো ডাবের পানিটা শেষ করে ফেললাম দুইজনে। একটা মরুভুমি যেনো শুষে নিলো একটা ঝর্ণার ছোট্ট জলপ্রপাতের ধারা কে। ওরা কিছু ডাব ঘরের ডান দিকের কোনাতে রাখলো। আমি ভাবলাম এই গুলি দিয়ে আমাদের কে আপ্যায়ন করা হবে হয়তো মেরে ফেলার আগে। আমরা অনুমানে বুঝলাম যে চারজন আমাদের এখানে ধরে নিয়ে আসলো, তাদের মধ্যে বন্দুকধারী ‘এক’ হলো এদের দলপতি। ও যখন কথা বলে তখন অন্য তিনজন চুপ করে শুনে। নিজান ভাই হটাৎ সেই দলপতিকে উদ্দেশ্য করে করুন সুরে বলে উঠলেন, ভাই, পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে আমাদের কে ছেড়ে দেন । দলপতি চকিতেই উত্তর দিল,”আঁরার এ কৈ লাভ নাই। আঁরার লিডাররে কইয়ো।

আবার যাত্রা শুরু হলো ওদের আদেশে, পাহাড়ি পথে। আবার আমরা ছয় জন। দুই বন্দুকধারী আমাদের সামনে ও পেছনে। লাঠিয়াল ‘দুইয়ের’ মাথায় এক ঝুড়ি ভর্তি তরিতরকারি আর অন্যজনের দুই কাঁধে ডাবগুলি নিয়ে আমাদের সাথে চলছে। সকাল দশটার দিকে আমাদেরকে ধরা হয়েছে এবং এখন বাজে প্রায় সাড়ে এগারোটা। পা যেন এখন আর চলছেই না। চারিদিকে ঘন জঙ্গল। কিছু কিছু জায়গায় সূর্যের আলো পৌঁছতে সক্ষম হয় না। আঁকা বাঁকা পাহাড়ি পথ। তবে এগুলি কোন তৈরী রাস্তা নয়। মানুষ চলতে চলতে হয়তো বুনো জঙ্গলের মধ্যে পথের সৃষ্টি হয়েছে। কোথাও কোন জনমানুষ নাই। মানুষের বসতিও নাই। চারিদিকে এক ভয়ঙ্কর নীরবতা। জঙ্গলের পর এইবার চলছি জমির আইলের মধ্য দিয়ে এবং এর পর আসলো ছোট খাল। হাঁটু পানির ভিতর দিয়ে জুতা খুলে হেঁটে পার হলাম। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমাদের, এটা শুধু ওরাই জানে। সবাই চুপ চাপ। চারিদিকে শুধু অজানা পাখির ডাক আর নীরবতার শব্দ। এই ভাবে চলতে চলতে আনুমানিক প্রায় ১:৩০ মিনিটের দিকে পাহাড়ের উপরে একটা ছোট্ট গৃহস্থ বাড়িতে এসে পৌঁছলাম। এটা ঠিক কুঁড়ে ঘর নয় আবার পাকা বাড়িও নয়। (চলবে)

তথ্যসূত্র: শান্তিবাহিনীর সাথে কয়দিন ও কিছু ভালোবাসার গল্প” প্রকাশিত বইয়ের অংশবিশেষ।
প্রকাশনা আপন আলো- মে ২০২২