অনলাইন ডেস্ক : গত দুই মাসে বাংলাদেশের প্রবাসীদের পাঠানো রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স দেখে আত্মতৃপ্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে সর্তক করে দিয়ে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিদেশের শ্রমবাজারের পরিস্থিতি এখনও অনিশ্চিত এবং প্রবাসী শ্রমিকরা সম্ভবত ফিরে আসার আগে তাদের শেষ সঞ্চয় পাঠিয়ে দেয়ার কারণে প্রবাহ এমনটা হয়ে থাকতে পারে।

তারা বলছেন, কোভিড-১৯ সংকট ও ঈদ উৎসবে পারিবারিক খরচের চাহিদা বৃদ্ধির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ রেমিটেন্সের বিপরীতে দুই শতাংশ প্রণোদনাও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকরা গত জুলাই মাসে রেকর্ড ২.৫৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। যা এর আগের মাসের ১.৮৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চেয়ে অনেক বেশি। বিভিন্ন দেশে কোভিড-১৯ লকডাউন থাকা সত্ত্বেও অভিবাসী শ্রমিকরা বিগত অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। এ সময়ে তারা ১৮.২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রেরণ করেছেন।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো এবং বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বিমান চলাচল পুনরায় স্বাভাবিক হয়ে গেলে বুঝা যাবে আসলে ঠিক কি পরিমাণ লোক একেবারে দেশে ফিরে এসেছেন।

তিনি ইউএনবিকে বলেন, ‘দেশে গত দুমাসের রেমিট্যান্স প্রবাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও আমাদের আত্মতৃপ্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’

ঈদের মতো ধর্মীয় উৎসব এবং জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনের সময় সাধারণত রেমিট্যান্সের প্রবাহ বেড়ে যায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্বাস্থ্য সংকট এখানে তৃতীয় অনুঘটক হিসাবে দেখা দিয়েছে।

কোভিড-১৯ সংকটের মধ্যে চলমান মন্দার কারণে অভিবাসী শ্রমিকরা তাদের পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে বেশি করে টাকা পাঠাচ্ছেন। পরিবারের চাহিদার এটা হলো প্রথম বিষয়। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো তারা সম্ভবত প্রবাস থেকে ফিরে আসার আগে তাদের শেষ সঞ্চয়টুকু পাঠিয়ে দিচ্ছেন, বলেন ড. দেবপ্রিয়।

তিনি বলেন, দুটি প্রধান কারণ- ওইসব দেশে স্থানীয়দের চাকরি দেয়া এবং তেলের দাম কমে যাওয়া- এর ফলে শ্রমিকদের চাহিদা কমে যাচ্ছে।

ড. দেবপ্রিয় বলেন, রেমিট্যান্সের প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে আরও একটি বড় কারণ হলো সরকারের দুই শতাংশ প্রণোদনা।

এ পাবলিক পলিসি বিশ্লেষক বলেন, ‘সরকারের দুই শতাংশ প্রণোদনা দেয়ার ফলে এখন ইনফরমাল চ্যানেলের পরিবর্তে সরকারি চ্যানেল দিয়ে বেশি বেশি টাকা পাঠাচ্ছেন তারা।’

বিভিন্ন দেশ থেকে ফিরে আসা অভিবাসীদের জন্য সহায়তা কার্যক্রম জোরদার করা অত্যন্ত দরকারি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ জন্য প্রত্যাবাসীদের ঋণ-ভিত্তিক প্রণোদনা প্রদানের সহায়তা কার্যক্রমের প্রয়োজন হবে।’

ড. দেবপ্রিয়ের কথার সুর ধরে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, রেমিট্যান্সের শক্তিশালী প্রবাহের এ ধারা ভবিষ্যতে অব্যাহত থাকবে কি না তা বলা যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, ‘বিমান চলাচল স্বাভাবিক হয়ে গেলে অনেক অভিবাসী শ্রমিককে ফিরে আসতে হতে পারে। মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপীয়ান দেশগুলোতে অর্থনৈতিক মন্দা চলার কারণে অনেক বিদেশি শ্রমিকই তাদের চাকরি হারিয়েছেন বা চাকরি চলে যাওয়ার পথে রয়েছেন।’

যারা চাকরি হারিয়েছেন তারা হয়ত তাদের শেষ সঞ্চয় পাঠিয়েছেন এবং আর যারা চাকরি হারাননি তারা সংকটে সময়ে তাদের পরিবারকে সহায়তার জন্য টাকা পাঠিয়েছেন। তবে, রেমিট্যান্সের প্রধান উৎস বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে রেমিট্যান্সের প্রবাহ গত মাসে কমেছে, যোগ করেন তিনি

ড. রায়হান বলেন, ঈদ উৎসব এবং দুই শতাংশ প্রণোদনাও অভ্যন্তরীণ রেমিটেন্স বাড়ার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে।

তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশ নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান ইতোমধ্যে তাদের অভ্যন্তরীণ রেমিটেন্সে কোভিড সংকটের বিরূপ প্রভাব দেখতে শুরু করেছে। সম্ভবত, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটা ঘটতে কিছুটা সময় লাগবে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি রিসার্চ মুভমেন্ট ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ড. তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, অভ্যন্তরীণ রেমিটেন্সের এ ধারা বেশি দিন স্থায়ী নাও হতে পারে।

স্বল্পমেয়াদি অভিবাসীদের প্রায় ৬০ শতাংশ তাদের পরিবারে কাছে রেমিট্যান্স পাঠাতে পারেননি দাবি করে তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদি অভিবাসীদের চাকরি থাকলেও স্বল্পমেয়াদি অভিবাসীদের বেশির ভাগই চাকরি হারিয়েছেন।

রেমিট্যান্স প্রবাহের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, গত ছয় মাসে বিদেশে নতুন করে নিয়োগ বন্ধ থাকা, ভিসার জন্য রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর বিদেশে অর্থ পাঠানোর প্রয়োজন না হওয়া বা অভিবাসী কর্মীদের ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর জন্য কোনো অর্থ ব্যয় করতে হয়নি।

পাশাপাশি অর্থপাচার এবং অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে অর্থ প্রেরণ বন্ধ থাকা এবং সরকার দুই শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে। তাই, আপাতত প্রথাগত চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বেড়েছে, বলেন ড. সিদ্দিকী।

রেমিট্যান্সের প্রবাহ ভালো থাকায় প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড ৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে।

রেমিটেন্সের প্রবাহ ছিল গত জানুয়ারিতে ১.৬৪ বিলিয়ন, ফেব্রুয়ারিতে ১.৪৫ বিলিয়ন, মার্চে ১.২৮ বিলিয়ন, এপ্রিলে ১.০৯ বিলিয়ন এবং মে মাসে ১.৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

বাংলাদেশি প্রবাসীরা ২০১৮ সালে ১৫.৫৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং গত বছর ১৮.৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন।