Home কলাম রুথ আসাওয়া : দ্য ফাউন্টেইন লেডি

রুথ আসাওয়া : দ্য ফাউন্টেইন লেডি

ফরিদ আহমেদ : ১৯৪১ সালের ডিসেম্বর মাসের ৭ তারিখে পার্ল হারবারে সাঁড়াশি আক্রমণ চালায় জাপান। সকালে দুটো ধাপে বিমান আক্রমণ পরিচালনা করা হয়। সেই আক্রমণে পার্ল হারবারের ইউএস ন্যাভাল বেস পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। এই আক্রমণের পরে যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে পড়ে। এর আগ পর্যন্ত কাগজে কলমে তারা নিরপেক্ষ ছিলো।

জাপানের বিমান আক্রমণ শুধু পার্ল হারবারকেই ছিন্নভিন্ন করেনি, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করা জাপানি, কিংবা জাপানি- আমেরিকানদের জীবনকেও তছনছ করে দেয়। এর মধ্যে একজন হচ্ছে এক কিশোরী। তাঁর নাম রুথ আসাওয়া। ভাস্কর হিসাবে যিনি পরে বিখ্যাত হয়েছেন। স্যান ফ্রানসিস্কোতে তাঁকে ফাউন্টেইন লেডি হিসাবে ডাকা হয়। শহরের শোভাবর্ধক হিসাবে মারমেইড ফাউন্টেইনসহ বেশ কিছু ফাউন্টেইন তিনি করেছেন স্যান ফ্রানসিস্কোতে। যেগুলোর কারণে তাঁকে ওই নামে ডাকা হয়। তবে, ফাউন্টেইন নয়, তিনি বিখ্যাত ছিলেন তার দিয়ে তৈরি করা তাঁর ভাস্কর্যের কারণে।

রুথ আসাওয়া-র বাবা-মা জাপানিজ ইমিগ্রান্ট ছিলেন। কিন্তু, তিনি জন্মগতভাবে আমেরিকান। তাঁর জন্ম হয়েছিলো নরওয়াক, ক্যালিফোর্নিয়ায়। সেখানেই নিরিবিলিতে জীবন গড়ছিলেন তিনি। ষোল বছর বয়সে, একদল যুদ্ধবাজ জাপানিজের হঠকারী কাজের কারণে রুথের সেই নিরিবিলি শান্তিময় জীবনটা এলোমেলো হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকারী জাপানিদেরকে শত্রæ হিসাবে বিবেচনা করে তাদেরকে অন্তরীণ করার সিদ্ধান্ত নেয় ইউএস সরকার।
১৯৪২ সালের বসন্তকালে একটা মাত্র স্যুটকেস নিয়ে মা আর ছয় ভাইবোনকে নিয়ে সান্তা এ্যানিটা রেসট্রাকে চলে আসেন তিনি। এখানেই জাপানিদের অন্তরীণ করার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। রুথের ছোট বোন জাপানে গিয়েছিলো বেড়াতে। সে আটকে যায় সেখানেই। জাপান থেকে কাউকে আমেরিকাতে আসতে দেওয়া হচ্ছিলো না। এই সব ঘটনার আগেই রুথের বাবাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো এফবিআই। তাকে আটকে রাখা হয়েছিলো নিউ মেক্সিকোর এক শত্রু ক্যাম্পে। ছয় মাস ধরে রুথ বা তার পরিবারের কেউ জানতো না যে ভদ্রলোক আদৌ জীবিত আছেন কিনা।

সান্তা এ্যানিটা রেসট্রাকে অন্তরীণ করা লোকদের ঘোড়ার আস্তাবলে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। রুথদের পরিবার পেয়েছিলো দুটো কামরা।

এ রকম একটা জঘন্য পরিবেশে থাকতে দেওয়া হয়েছিলো, এ বিষয়ে তাঁর কোনো মনঃকষ্ট আছে কিনা, এ বিষয়ে পরবর্তীতে জানতে চাইলে রুথ বলেছিলেন, “I hold no hostilities for what happened; I blame no one. Sometimes good comes through adversity. I would not be who I am today had it not been for the internment, and I like who I am.”

রুথের কথাই সত্যি। চরম খারাপ অবস্থা থেকেও ভালো কিছু ঘটে। সান্তা এ্যানিটা রেসট্রাকে আঠারো হাজার জাপানি বংশোদ্ভূত মানুষকে অন্তরীণ করা হয়েছিলো। এদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন বিভিন্ন প্রফেশনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের লোক। এই রেসট্রাকে কতোদিন তাদের থাকতে হবে জানতেন না তারা। ফলে, অস্থায়ী স্কুল খুলে বাচ্চাদের পড়ানো শুরু করেন তাঁরা। স্বাভাবিক স্কুলে গেলে রুথ হয়তো কোনোদিনই এই সব মেধাবী মানুষদের শিক্ষক হিসাবে পেতেন না। রুথ সেখানে শিক্ষক হিসাবে পেয়েছে লস এঞ্জেলেসের আর্ট স্টুডেন্ট লীগের প্রাক্তন পরিচালক, একজন ডাবøæপিএ আর্টিস্ট এবং ডিজনি স্টুডিও-র তিনজন এনিমেটরকে। যে কারণে তিনি বলতে পেরেছেন, “How laucky could a sixteen-year old be?”

এই ভাগ্য অবশ্য বেশিদিন থাকে না রুথের। ছয় মাস পরেই তাঁদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় আরকানসাসের রোয়ার রিলোকেশন সেন্টারে। এখানকার হাইস্কুল থেকে গ্রাজুয়েশন করেন তিনি। এর পর তাঁকে একটা সরকারি বাস টিকেট দেওয়া হয়। এটা দিয়ে তিনি শুধুমাত্র মিডওয়েস্টে যেতে পারবেন। সেখানকার কোনো কলেজে ভর্তি হতে হবে তাকে। ক্যালিফোর্নিয়াতে জাপানিজ বংশোদ্ভূত কাউকে কলেজে ভর্তি করা হতো না।

মিলওয়াকি স্টেট টিচারস কলেজে ভর্তি হন তিনি। এটাকে পছন্দ করার মূল কারণ ছিলো এটাই সবচেয়ে সস্তা কলেজ ছিলো। এখানে আর্ট টিচার হবার জন্য আন্ডার গ্রাডে ক্লাস শুরু করেন। প্রথম তিনি বছরে কোনো ঝামেলা হয়নি। ঝামেলার সূত্রপাত ঘটে চতুর্থ বছরে গিয়ে। চতুর্থ বছরে তাঁর প্রয়োজন ছিলো ক্লাসরুমের অভিজ্ঞতা। এটার জন্য স্টুডেন্টদেরকে পাবলিক স্কুলে পাঠানো হতো। রুথের এডভাইজাররা তাঁকে কোনো স্কুলেই প্লেস করে না। তাদের ভয় ছিলো জাপানিদের প্রতি যে ঘৃণা সাধারণ মার্কিনিদের রয়েছে, তাতে করে তারা তাকে সহজভাবে মেনে নেবে না। স্কুলে প্লেসমেন্ট না হওয়াতে রুথের ডিগ্রিটা হয় না। তাঁর তিন বছরের পরিশ্রম জলে যায়। তিনি কলেজ ত্যাগ করেন।

মজার বিষয় হচ্ছে বহু বছর পরে রুথ যখন বিখ্যাত মিলওয়াকি স্টেট টিচারস কলেজের তাঁকে নিয়ে গর্ববোধ শুরু হয়। তিনি এখানকার ছাত্রী ছিলেন, এটা তাদের জন্য আবেগী ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সেই আবেগ থেকে তাঁকে অনারারি ডক্টরেট দেবার সিদ্ধান্ত নেয় তাঁরা। রুথ সেই অনারারি ডক্টরেট ডিগ্রি নিতে অস্বীকৃতি জানান। তাঁর বদলে তাঁর প্রাপ্য বিএ ডিগ্রি, যেটাতে তিনি তিন বছর সময় ব্যয় করেছিলেন, সেটা দেবার জন্য চাপ দেন কলেজকে।

কলেজ থেকে বের হয়ে গিয়ে একটা বাস নিয়ে মেক্সিকোতে চলে যান রুথ। তাঁর বড় বোন তখন মেক্সিকো সিটিতে পড়াশোনা করছিলো। মেক্সিকোতে গিয়েই তাঁর ক্যারিয়ার দিক বদল হয়। এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা একটা আর্টের ক্লাস নিতে গিয়ে তাঁর পরিচয় ঘটে এর শিক্ষিকা ক্লারা পোরসেটের সাথে। ক্লারাই তাঁকে জোসেফ আলবার্সের কথা বলেন। জোসেফ আলবার্স একটা পরীক্ষামূলক আর্ট কলেজ খুলেছিলেন নর্থ ক্যারোলাইনাতে। নাম হচ্ছে বøাক মাউন্টেইন কলেজ। সেখানে গেলে শিক্ষকতার সুযোগ পাওয়া যাবে বলে জানায় ক্লারা। সত্যি সত্যি বøাক মাউন্টেইন কলেজ শিক্ষকতার চাকরি দেয় রুথকে। শিক্ষক হবার পরেও মেক্সিকোতে যান তিনি। সেখানে গিয়ে বাচ্চাদের ছবি আঁকা শেখান তিনি। তবে, তার চেয়েও জরুরি যে জিনিসটা ঘটে, সেটা হচ্ছে তিনি গ্রামের লোকদের কাছ থেকে তার দিয়ে ঝুড়ি বানানোর কৌশল রপ্ত করেন। এটাই পরবর্তী জীবনে তাঁর পেশার ট্রেডমার্ক হয়ে দাঁড়ায়। তিনি তাঁর সমস্ত ভাস্কর্যই করেছেন তার দিয়ে, অদ্ভুত সব বুনন এবং জ্যামিতিক ফিগার দিয়ে। আমেরিকার স্কুলগুলোতে নিয়মিত শিক্ষকদের দিয়েই শিল্পকলার ক্লাসগুলো নেওয়া হয়। এর ঘোর বিরোধী ছিলেন রুথ আসাওয়া। তাঁর কথা হচ্ছে, একজন নিয়মিত শিক্ষকের আরো অসংখ্য কাজ থাকে। ফলে, এই কাজে পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। আর্ট একটা বিশেষায়িত বিষয়। ফলে, এর জন্য আলাদা যত্নের প্রয়োজন। এই প্রয়োজনীয়তার কথা ভেবেই ১৯৮২ সালে তিনি স্যান ফ্রানসিস্কো স্কুল অব দ্য আর্ট প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর সম্মানে এই স্কুলের নামকরণ করা হয় রুথ আসাওয়া স্যান ফ্রানসিস্কো স্কুল অব দ্য আর্ট।

জীবিতকালে রুথ সবসময়ই কিছু না কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। যখনই সময় পেতেন, দেখা যেতো তার দিয়ে বা অন্য কিছু দিয়ে কিছু একটা করছেন তিনি। এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য ছিলো, ভাস্কর্যকর্ম হচ্ছে কৃষি কর্মের মতো। কিছু করলে তার ফল আপনি পাবেনই। তাঁর নিজের ভাষাতে, “Sculpture is like farming. If you just keep at it, you can get quite a lot done.”
সারাজীবন কৃষিকাজের মতো শিল্পকর্ম করে গেছেন এই নিভৃতচারী এবং নীরব শিল্পী।

Exit mobile version