মুহাম্মদ তানিম নওশাদ : তুমি দ্রষ্টব্য, অথবা ভূতিকামী ব্যক্তিগণকর্তৃক স্মরণীয়া, সেইসকল তোমার অগ্রে বলিতেছি।’৮ এরপর বিষ্ণু সব দেবী যে একজনই তার একটি দীর্ঘ তালিকা উপস্থাপন করেন, তিনি বলেন,
‘দেবী তুমি পুস্করে সাবিত্রী, বারাণসীতে বিশালাক্ষী, নৈমিষারণ্যে লিঙ্গধারিণী, প্রয়াগে ললিতা দেবী, গন্ধমাদনে কামুকা, মানসে কুমুদা, অম্বরে বিশ্বকায়া, গোমন্তে গোমতী…’। এই ধারায় তিনি শতাধিক দেবীর নাম উপস্থাপণ করেছেন।৯ আর এখানেই তিনি লিখেছেন যে, ঐ মহাদেবীই দেবিকাতটে নন্দিনী, দ্বারবতীতে রু´িণী, বৃন্দাবনে রাধা…ইত্যাদি।
হিন্দু বা সনাতন ধর্ম ও তার শাস্ত্র সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আগেভাগেই বলে রাখি। এই শাস্ত্রে শক্তি ও শক্তির আধার একই বা অভেদ। আরো ভেঙ্গে বললে, যেকোন শক্তি আর তার সাথে সম্পর্কিত দেব বা দেবী আদতে অভিন্ন। যেমন: আগুন মানে অগ্নি; আবার আগুনের দেবতাও অগ্নি। বাতাসের আরেক নাম পবন; আবার তার দেবতাও পবন। ফলে হিন্দুশাস্ত্রে শক্তি জড় বা অচেতন নয়, বরং তা সচেতন। আর এই পরমা দেবীশক্তির বেলায় সেই সত্য আরো প্রবল। তিনি নিজে শুধু সচেতন নন, তিনি সর্বভূতে চেতনার কারণ। যেকারণে এই দেবীর স্তবে এও বলা হয় যে,
যা দেবী সর্বভূতেষু চেতনেত্যভিধীয়তে।
নম¯তস্যৈ নম¯তস্যৈ নম¯তস্যৈ নমো নমঃ\১০
অর্থাৎ, যে দেবী সর্বভূতে চেতনা রুপে বিরাজমান,
তাকে প্রণাম, তাকে প্রণাম, তাকে প্রণাম, তাকে নমস্কার, নমস্কার\
এই একই পরমা দেবী যে সকল দেবগণের ত্রাণকর্ত্রী তার আরেকটি প্রমাণ হচ্ছে বিষ্ণুপুরাণ। কাহিণীটি এই যে, দুর্বাশা মুণি দেবরাজ ইন্দ্রকে একটি মালা উপহার হিসাবে দিলে দেবরাজ ইন্দ্র সেই মালা অবহেলা করেন। এতে ক্রুদ্ধ দুর্বাশার অভিশাপে দেবগণ শ্রী বা লক্ষী হারান, যা ক্ষীরোদ সমুদ্রের গহীনে বিলীন হয় এবং দেবগণের সম¯ত গৌরব ও ঐশ্বর্য্য লুপ্ত হয়। এই সঙ্কট উত্তরণের জন্য দেবতারা পিতামহ ব্রহ্মাকে নিয়ে বিষ্ণুর শরণাপন্ন হন। আর বিষ্ণু অসুর ও দেবগণকে একত্রে মিলে সমুদ্র মন্থন করতে পরামর্শ দেন। এই মন্থনে সমুদ্রের অতল থেকে জগতের শ্রী ও সমৃদ্ধির প্রকাশ রুপে ‘শ্রীদেবী’ অর্থাৎ ‘লক্ষীদেবী’ আবির্ভূত হন। এই সমুদ্র মন্থনে দেবী লক্ষী দেবগণের সম¯ত মঙ্গল ও সৌকর্য হিসাবে প্রমাণিত হয়ে আবার দেব জগতের কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত হন। দেবীকে গ্রহণ করতে যেয়ে স্বর্গরাজ্যের গন্ধর্বগণ গান গেতে লাগলো, অপ্সরাগণ নৃত্য পরিবেশন করতে লাগলো, স্বর্গলোকের হাতীরা হেমপাত্র নিয়ে সর্বলোকমহেশ্বরী দেবীর উপর পানি বর্ষণ করে তাকে ¯œানে সহায়তা করতে লাগলো, ক্ষীরোদ সাগর নিজে রুপ ধারণ করে দেবীকে অমলিন পদ্মফুলের মালা প্রদান করলো। স্বর্গলোকের কারিগর দেব বিশ্বকর্মা দেবীর অঙ্গবিভূষণ করলেন। এতো কিছু বয়ানের অর্থ সম্ভবতঃ দেবীর গুরুত্ব উপস্থাপণ করা। আর আমাদের জন্য স্মর্তব্য হচ্ছে এই দেবী লক্ষীই শ্রীরাধিকা। বিষয়টি শশীভূষণ দাশগুপ্তও গুরুত্ব সহকারে বর্ণনা করেছেন।১১ পুরাণে এই বিবরণ আরো বি¯তৃত আকারে আছে। আমি আমার মত করে তার কিছুটা উপস্থাপন করলাম মাত্র, যাতে সাধারণ পাঠকও ব্যাপারগুলো বুঝতে পারেন। আর এতে বোঝা যাচ্ছে যে, সব দেবী মূলতঃ একজনই, স্থান-কাল-কর্ম ভেদে তার বহু রুপ। আর তান্ত্রিকদের কাছে এই দেবীই সব এবং তিনিই সর্বজগতের অধীশ্বরী। ‘রাধাতন্ত্রম’ বলছে,
ব্রহ্মের পরমকলা যে পদ্মিনী তা থেকে কোটি কোটি ব্রহ্মান্ড উৎপন্ন হয়। এবং তার প্রসাদগুণেই রুদ্র, বিষ্ণু ও ব্রহ্মা সংহার, পালন ও সৃষ্টি কার্য্যে নিয়ত আছেন। পদ্মিনীর দেহকাšিতই প্রকৃতি এবং তার কোটি কোটি অংশ কোটি কোটি চন্দ্রমা। (রাধাতন্ত্রম, দেব্যুবাচ: ১২-১৪)১২
এই পদ্মিনী শ্রীরাধারই রুপভেদ মাত্র। আবার অন্যত্র আমরা দেখতে পাই, বাসুদেব-কৃষ্ণ স্বয়ং দেবী ত্রিপুরাসুন্দরীর আরাধনা করছেন নি¤েœাক্ত বাক্যে,
হে ত্রিপুরাসুন্দরি! তুমি জীবের দুঃখনাশ কর হে মাতঃ! তোমাকে নমস্কার করি! তুমি শঙ্করের (শিবের) আরাধ্যা ও নারায়ণের (বিষ্ণুর) চিšতনীয়া তোমাকে নমস্কার করি। তুমি ত্রিভুবন প্রসব করিয়াছ এবং এইক্ষণ অমৃতসেক করিয়া আমার চেতনা প্রদান করিয়াছ হে মাত! তোমাকে নমস্কার করি। তুমি বিষ্ণুর হৃদয়বাসিনী আমাকে প্রত্যক্ষ দেখা দিয়াছ হে মাতঃ! তোমাকে নমস্কার করি\১৩
বলা বাহুল্য যে, রাধাতন্ত্রে দেবী ত্রিপুরাসুন্দরি শ্রীরাধারই এক বিশ্বমাত্রিক রুপ।
আর এই আদি পরাশক্তি যে রাধা তা আরো প্রকটিত করেছে নারদ পাঞ্চরাত্রম; সেখানে বলা হচ্ছে,
হে রাধারাণী! হে জগন্মাতা! হে সর্বেশ্বরী আদ্যাপ্রকৃতি কৃষ্ণ প্রাণাধিকা দেবী, মহাবিষ্ণু-প্রসূরপি (অর্থাৎ তুমি সেই জগন্মাতা, যে মহাবিষ্ণুকেও প্রসব করেছে)।১৪
৩.
রাধাকে বৈষ্ণব ও তান্ত্রিকদের সমগ্র জগতের অধীশ্বরীরুপে গ্রহণের প্রেক্ষাপট এক অর্থে বেদসমূহ এবং পুরাণাদির কারণে আগেই তৈরী ছিলো। আর শাক্ত ও তান্ত্রিকদের কাছে শক্তিই যখন মূল, তখন রাধাকে তাদের বা¯তবতায় শক্তিরুপিণী আদিদেবী বা আদ্যাশক্তির বহুমাত্রিক প্রকাশের একটি হিসাবে গণ্য করেই তাকে তাদেরো আরাধ্যা দেবী রুপে গ্রহণ করাটাই স্বাভাবিক। এই জায়গায় তান্ত্রিক ও শাক্তধারা বিষয়ে শশীভূষণ দাশগুপ্ত যা বিবৃত করেছেন তা নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করা যাক। তিনি বলেছেন যে, বাংলাদেশের মানুষ বৈষ্ণব ধর্ম বলতে শ্রীচৈতন্য প্রবর্তিত বৈষ্ণব ধারাকেই বোঝে। কিন্তু বৈষ্ণব ধর্মের বীজ অত্যšত প্রাচীণ। বৌদ্ধ সহজিয়া ধারাও এতে কোন কোন সময় প্রভাব রেখেছে। তান্ত্রিকদের প্রভাব যে সেখানে আছে, তা বলা বাহুল্য। তবে এসব ধারায় শক্তি অর্জনের পথ কতগুলো গুহ্য সাধনার উপর গড়ে উঠেছে, সেখানে দর্শণের তেমন কোন প্রভাব নেই বলেই তার অভিমত। এগুলো বামাচারী তান্ত্রিক সাধনা, বৌদ্ধ তান্ত্রিক সাধনা, বৌদ্ধ সহজিয়া সাধনা, বৈষ্ণব সহজিয়া সাধনা প্রভৃতির উদ্রেক ঘটিয়েছে বলে শশীভূষণ দাশগুপ্ত মšতব্য করেছেন। এদের বহিরঙ্গ বিবিধ রুপ ও নামে পরিচিত হলেও ভেতরে তাদের মধ্যে গভীর ঐক্য আছে বলে তিনি বলেছেন, আর তা হচ্ছে এক উপলব্ধির ঐক্য- ‘চরম সত্য অদ্বয় পরমানন্দ স্বরুপ’। এই অদ্বয় আনন্দ-তত্ত¡ই (সংক্ষেপে অদ্বয়তত্ত¡) হোল ‘পরম সামরস্য’।১৫
অদ্বয়তত্তে¡র দু’টি ধারা; একটি শিব, অপরটি শক্তি। কিন্তু অদ্বয়তত্ত¡ এই দুইধারাকে বিচ্ছিন্ন করে না, বিভাজিত করে না, বরং এই দুইধারার মধ্যে সমন্বয় সাধন করে, একে অপরকে পূর্ণতা দান করে। এরাই সৃষ্টির আদিতে অবস্থানকারী ‘পুরুষ’ ও ‘প্রকৃতি’, যে বিষয়ে আমরা পরে আলোচনা করবো। যাহোক এই দুই ধারা নিজেদের সম্মেলনে যে তত্তে¡র জন্ম দিয়েছে তার নাম ‘মিথুনতত্ত¡’, যাকে ‘যামলতত্ত¡’ বা ‘যুগলতত্ত¡’ নামেও অভিহিত করা হয়। এটিই তান্ত্রিক বৌদ্ধদের কাছে ‘যুগনদ্ধ তত্ত¡’ নামে পরিচিত। তান্ত্রিক বৌদ্ধমত যে হিন্দু শাক্ত ও তান্ত্রিক ধারার সংস্পর্শে উদ্ভুত তা এখান থেকে অনুমান করা সহজ। তান্ত্রিক সাধনার ক্ষেত্রে এই অখন্ড যুগলতত্ত¡ই ‘কেবলানন্দ তত্ত¡’। অদ্বয়তত্ত¡ যে শিবতত্ত¡ ও শক্তিতত্তে¡র জন্ম দিয়েছে সেখানে সূক্ষ্ম ও স্থূল উভয় অর্থে পুরুষ শিবতত্তে¡র ও নারী শক্তিতত্তে¡র প্রতীক। ফলে এই দুইয়ের সম্মেলনে দুই তত্ত¡ই নিজেকে পূর্ণ করতে চায়। নারী-পুরুষের মিলনের মাধ্যমে এটি পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়, যা সাধক-সাধিকাকে পূর্ণ সামরস্যে পৌঁছে দেয়। তান্ত্রিক ভাষায় এটিই ‘সামরস্য-সুখ’, বৌদ্ধদের (আমার মতে তান্ত্রিক বৌদ্ধদের – লেখক) ভাষায় ‘মহাসুখ’, আর বৈষ্ণবদের ভাষায় ‘মহাভাব’ স্বরুপ।১৬ যুগলতত্ত¡ ও তার যুগল সাধনা যখন বৈষ্ণব সমাজে প্রবেশ করে তখন সহজিয়া বৌদ্ধদের যোগ-সাধনা প্রেম-সাধনায় রুপাšতরিত হয়, বৈষ্ণব ধর্ম পরিণত হয় প্রেমধর্মে – যেখানে চরমাবস্থায় প্রেমই আনন্দ স্বরুপ।১৭ বলে রাখা ভালো যে, এইসব সাধনায় যৌনতাকে কোনভাবেই নেতিবাচক রুপে দেখা হয় না। বরং তা সাধনার একটি অন্যতম ধাপ, যার সাথে সৃজনশীলতা, আধ্যাত্মিকতা ও প্রকৃতির সাথে সাধক বা সাধিকার ঐকাšিতকতা জড়িত। তবে শশীভূষণের আলোচনায় দু’টি সমস্যা দেখা যায়। তিনি অনেক তান্ত্রিক ও সহজিয়া বৌদ্ধ-সাধনাকে ¯্রফে বৌদ্ধ-সাধনা বলে মšতব্য করে গিয়েছেন। অন্যদিকে বৈষ্ণবধর্ম মাত্রই রাধাতত্ত¡ নয়। চৈতন্যের কারণে রাধাবাদের জনপ্রিয়তা বঙ্গাঞ্চলে ও উড়িষ্যায় বেশী। কিন্তু বৈষ্ণবদের এমন শাখাও ইতিহাসে আছে যেখানে রাধা অনুপস্থিত। যেমন: চৈতন্য যখন পুরীতে ছিলেন, তখন ‘পঞ্চশাখার’ বৈষ্ণবদের সাথে তার পরিচয় ঘটে। তারা চৈতন্যকে অবতার জ্ঞানে সম্মান করতেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ঈশ্বর দাস ‘চৈতন্য ভাগবত’ লেখেন এবং সেখানে চৈতন্যকে স্বয়ং ঈশ্বর রুপে উপস্থাপণ করেন। অথচ পঞ্চশাখার বৈষ্ণবদের মধ্যে রাধা অনুপস্থিত।১৮তার মানে চৈতন্যের কারণে জনপ্রিয় রাধাবাদ একটি বিশেষ শ্রেণীর রাধাতত্ত¡, যার সাথে শাক্ত, বামাচারী ও তান্ত্রিকদের সাথে ততটুকু মিল যতটুকু শক্তির কেন্দ্ররুপে নারীকে উপস্থাপণ করা যায়। পরিশেষে চৈতন্যের প্রবর্তিত রাধাতো হ্লাদিনী শক্তি অর্থাৎ প্রেমদায়িনী শক্তি।
৪.
বৈষ্ণব ও অনেক তান্ত্রিক মতে প্রবল পরাক্রাšতা দেবীই ধ্বংসযজ্ঞের শেষে সৃষ্টির ধারা অব্যাহত রাখতে এবং প্রধান দেবগণের সৃজনীশক্তির মূলপ্রবাহ রুপে হ্লাদিনী শক্তি হিসাবে আবির্ভূতা। দেবীর এই হ্লাদিনী রুপ হলো প্রেমদায়িনী রুপ। এই বর্গে মহামায়া বা ‘আদি পরাশক্তি’ যেসব রুপ ধারণ করেছেন তারা হলেন বৈকুন্ঠবাসিনী নারায়ণের অর্ধাঙ্গিনী লক্ষী, পিতামহ ব্রহ্মার সঙ্গিনী স্বরস্বতী, আর মহাদেব শিবের পার্শ্বচারিণী উমা, গৌরী, পার্বতী, সতী ইত্যাদি – সেইসাথে আরো অনেকে; কিন্তু এদেরকে যে নামেই ডাকা হোক না কেনো, তারা আদতে একজনই। অন্যদিকে এই ধারাতেই শ্রীমতি রাধা নামে মহাদেবী পৃথিবীতে শ্রীকৃষ্ণের লিলাসঙ্গিনী বা লিলাবিলাসিনী,- এক কথায় তিনি কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি, যিনি প্রেমঘন কৃষ্ণের প্রেমপরিণাম। তিনি মানুষ রুপে লীলাবাসনায় বৃন্দাবনে গোপীশ্রেষ্ঠা। এ হলো গৌড়ীয় বৈষ্ণব শাস্ত্রের মিমাংসা।১৯ শ্রীগোপাল গোবিন্দ ভট্টাচার্য লিখেছেন যে, বৈষ্ণব দর্শন এই দেবী রুপী পরাশক্তিকে আহ্লাদিনী নামে অভিহিত করেছে এবং শাক্ত দর্শন একই পরাশক্তিকে জগন্মাতা আদ্যাশক্তিরুপে অভিহিত করেছে এবং শাক্ত দর্শন এই পরব্রহ্মের গুণময়ী শক্তিকে মাতৃভাবে ভজনা করে।২০ রাধার আরো নাম আছে- রাধিকা, রাধে, মাধবী (যেহেতু তার সখা মাধব অর্থাৎ কৃষ্ণ), কেশবী (যেহেতু তার সখা কেশব অর্থাৎ কৃষ্ণ), রাসেশ্বরী (যেহেতু তিনি রাসউৎসবের ঈশ্বরী ও প্রধান নায়িকা), কিশোরী (কারণ অনেকে মনে করেন তিনি কৃষ্ণের সাথে লীলাকালে কিশোরী ছিলেন), শ্যামা (যেহেতু তিনি শ্যাম অর্থাৎ কৃষ্ণের সহচরী), নিত্যা (যেহেতু তিনি নিত্য বিরাজমান) ইত্যাদি। এইধারায় বৈষ্ণবদের মাঝে তাকে রাইকিশোরী অর্থাৎ কিশোরী রাধিকা (রাই রাধার আরেক নাম), রাইবিনোদনী অর্থাৎ কিশোরী বিনোদিনী ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আমরা পাই যে, কৃষ্ণ নামে ধরাধামে বিষ্ণুর অবতার অবতরণ করলে বৈকুন্ঠধামে তার সঙ্গিনী দেবী লক্ষী গোকুলে রাধা নামে জন্মগ্রহণ করেন। আর বড়– চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনেও কিন্তু রাধা তাই। সনাতন ধর্ম বলে যে, এই দেব ও দেবী শক্তি আদিতে এক ও অভেদ শক্তি রুপে বিরাজিত ছিলো। পরে তার দ্বিভাজন হয়েছে।
“সৃষ্টির পূর্বে ঈশ্বর আপনাকে দুইভাগে বিভক্ত করে এক অংশে পুরুষ এবং অপরাংশে নারীমূর্তি পরিগ্রহ করলেন ও সঙ্গত হলেন।”(মনুসংহিতা, ১:৩২)২১
‘দেবী ভাগবতে’ দেবী নিজেই তা পরিস্কার করে ব্যক্ত করেছেন,
“আমি ও ব্রহ্ম এক। উভয়ের মধ্যে ভেদ নেই। যিনি ব্রহ্ম তিনিই আমি। আমি যা তিনিও তা, এই ভেদ ভ্রমকল্পিত, বা¯তব নয়।”২২
তার মানে পরমশক্তির নারী অংশ বা ‘প্রকৃতি’ এক অর্থে সামগ্রিক শক্তিরই প্রকাশক এবং এই জায়গায় বৈষ্ণব, শাক্ত ও তান্ত্রিকদের মধ্যেকার চিšতায় সমতা রয়েছে।
শশীভূষণ দাশগুপ্ত পুরো বিষয়টিকে বৈষ্ণব শাস্ত্র থেকে সার আকারে লিখেছেন এই বলে যে, শ্রীরাধা ভগবানের হ্লাদিনী শক্তির বিকাশ – সুতরাং তিনি মূলপ্রকৃতি, ঈশ্বরী এবং শ্রীকৃষ্ণের অর্ধাংশস্বরুপা। ভগবান একাধারে ভোক্তা ও ভোগ্য, কিন্তু ‘তস্মাৎ একাকী ন রমতে’-তিনি একাকী রমণ করেন না-সেজন্য ‘দুই’ হওয়ার ইচ্ছা করে আপনাকে দ্বিধাবিভক্ত করে ‘লীলারস’ আস্বাদন করেছেন, যা তার নিজেরই অšতর্নিহিত প্রেম রসের আস্বাদন । নিত্য বৃন্দাবনে আদতে শ্রীকৃষ্ণ অনšতকাল ধরে নিজেই নিজেকে আস্বাদন করে যাচ্ছেন।২৩
আর গৌরী সেন শ্রীরাধাকে বৈষ্ণব আচার্যরা কিভাবে দেখেন তার সার বর্ণনা করেছেন নি¤েœাক্তভাবে,
[…] ঈশ্বর ও ভক্তের সম্পর্ক হবে রাধাকৃষ্ণের সর্ম্পকের মতো। এই সম্পর্কের স্বরুপ বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে, রাধা সর্বশক্তির আধার কৃষ্ণের হ্লাদিনী বা আনন্দদায়িনী শক্তি। শক্তি ও শক্তিধর অভিন্ন, রাধা ও কৃষ্ণ তাই অভিন্ন। (চলবে)