সাজ্জাদ আলী : বেকি ব্যড়া পেরিয়ে একেবারে ভেতর বাড়ি ঢুকে গেল সে। বাইরের লোকের ঢোকা মানা। কিন্তু মুন্তাজের বেলায় সে নিয়ম খাটে না। আর ধরতে গেলে সে বাইরের লোকও না। গত ২১ বছর ধরে দাদীর বাড়িতে সে বাঁধা অতিথি। প্রতি বছর পৌষ-মাঘ মাসের দিকে সে আসে। মাসখানেক থেকে চলে যায়। কোথা থেকে আসে, কোথায় যায়, কেউ জানে না। আসে দিনে, যায় রাতে। যাওয়ার সময় কাউকে কিছু বলেও যায় না। কোনো একদিন ভোরে দেখা যায় কাচারী ঘর ফাঁকা। মুন্তাজ নেই।

যুদ্ধের বছরে সে শেষ এসেছিলো। সোজা গিয়ে দাদীর ঘরের সামনে দাঁড়ালো। মুন্তাজ আসায় তিনি খুব খুশি। ও এলে নাকি সংসারের আয় বরকত বাড়ে। সাড়া পেয়ে দাদী দরজায় এসে দাঁড়ালেন। অনেকটা সামরিক কায়দায় মুন্তাজ দাদীকে অভিবাদন করলো। হাসি মুখে বললো, ভাবী আপনের বাড়িত মরতি আইলাম।

বালাই ষাট! তুমি মরবা ক্যান? গত কুড়ি বছর ধইরা তুমারে দেখতাছি। আমি যতদিন বাঁইচা আছি, তুমি ফি বছর আইসবা। মন ভইরা বেড়াবা। কু-কথা মুখে আইনো না। তোমার শরীলডা কেমন মুন্তা?

জবাব পাওয়া যাবে না জেনেও দাদী প্রশ্নটি করলেন। মুন্তাজ কথা বলে না। প্রতি বছর আসবার পর পরই দাদীকে শুধু একটি মাত্র বাক্য বলে। এই যেমন এবার বলেছে “ভাবী আপনের বাড়িত মরতি আইলাম”। মাসখানেক থাকবে সে। এর মধ্যে আর কারো সাথে একটি কথাও বলবে না। ভুলেও না। দাদী চাকরবাকরদের উদ্দেশ্যে হাক ছাড়লেন, ওই মুন্তা আইছে। কাচারী ঘরে ওর বিছানাপাটি দে। আর কন্নে কী খাইছে না খাইছে, আগে ওরে খাইতে দে।

এ গাঁয়ের প্রায় সবাই লুঙ্গি-গামছা পরা মানুষ। যে একটু সামর্থবান, তার বড়জোর একটা হাতাওয়ালা গেঞ্জি আছে। বিবাহ সাদির অনুষ্ঠানে যেতে হলে লোকদের অন্যের জামা-স্যান্ডেল ধার করে যেতে হয়। বিশ্বাস বাড়ির সিরাজ আর মোল্লাদের ভাগ্নে আহাদ এই ধার দেবার ব্যাপারে উদার। এমনই একটা গাঁয়ের অতিথি মুন্তাজ। সে নিজেও দীনহীন। সম্বল বলতে ছোট্ট একটা পোটলা। অন্যের বাড়িতে থাকে খায়। তবে তার বেশভ‚ষা একেবারেই সাহেবী ঘরাণার। দেখলে মনে হয় যেন বৃটিশ আমলের পুলিশ।

পরনে খাকি রঙের হাফ প্যান্ট। কোমরে চামড়ার চওড়া বেল্ট। বেল্টের বড়সড় বকলেসটি পিতলের। তারার মতো দেখতে। খালি পা, গায়ে একটা হাতাওয়ালা গেঞ্জি। মেজাজ ভালো থাকলে বিকালে গাঁয়ের পথে হাঁটতে বের হয়। তখন একটা সাহেবী হ্যাট মাথায় পরে। হ্যাটটা ছিঁড়েবুড়ে একেবারে জীর্ণ। আর কতদিন যে পরতে পারবে সন্দেহ। গাঁয়ের জেষ্ঠরা বলেন, ১৫/২০ বছর আগে হ্যাটটি নাকি ঝকঝকে ছিলো।

দাদী মাফিকের মাকে বাড়ির অন্য সব কাজ থেকে অব্যাহতি দিলেন। কাল থেকে ঢেঁকি ঘরে তার ধান ভানার কাজ। প্রতিবারের ফারানিতে সে ধান উল্টে দেবে। আর ভারানি মুন্তাজ। যতদিন মুন্তাজ থাকবে ততদিনই ধান ভানবে। এমনই চলে আসছে গত ২০ বছর। অতিথি কাজ করবে, এটা বাড়ির রীতি না। কিন্তু বিনা কাজে মুন্তাজ তো বসে বসে খাবে না। এটা তার আত্মমর্যাদার প্রশ্ন।

ঢেঁকির পা-দানিতে তালে তালে মুন্তাজের পা চলে। আর সেই তালে সামনের ভারি চুরনি দেড় দুই সেকেন্ডের জন্য উপরে উঠে। ওই ফাঁকটুকুতেই মাফিকের মাকে হাত চালিয়ে নোটের মধ্যকার ধানগুলো উল্টে দিতে হয়। এভাবেই ধান ছাটা এগুতে থাকে। কাজটি শতভাগ ছন্দে ছন্দে করা চাই। অনেকটা যেন “ও ধান ভানি রে ঢেঁকিতে ফার দিয়া, ঢেঁকি নাচে আমি নাচি হেলিয়া দুলিয়া” গানটির ছন্দের মতো। এই ছন্দের সামান্য পতন হলে হাতের আঙুল মুহুর্তেই ঢেঁকিতে পিষে যাবে।

আঙ্গুল ভচকানোর ভয়ে মাফিকের মা মুন্তাজের মুখখানার দিকে একদন্ড তাকাতেও পারে না। সব সময় ঢেঁকির নোটের দিকে খেয়াল রাখতে হয়। ঘণ্টাখানেক ধান ভানার পরে মুন্তাজ মিনিট দশেক তামাক টানে। কাজ শেষে প্রতিদিনই সে মাফিকের মায়ের হাতে দুখানা সাজ-বাতাসা গুজে দেয়। কিন্তু এ বাতাসা সে কোথায় পায়? তার তো কেনার সামর্থ্য নেই!


কখনও হাতি আকৃতির, কখন ঘোড়া বা গরু, আবার কখনও বা কৃষ্ণর্মূতির বাতাসা পকেট থেকে বের করে। সে এক বিস্ময়! এ যেন যাদুর পকেট। সে হাত ধুকালেই বাতাসা বেরিয়ে আসে! লোভের বসে বাড়ির দুষ্টুরা কয়েকবার তার পকেট হাতড়ে দেখেছে। কিন্তু বাতাসার খোঁজ মেলেনি। এমন কি তার পোটলায়ও লুঙ্গি তসবি ছাড়া আর কিছুই নেই। সে যাই হোক মাফিক প্রতিদিনই দুখানা করে বাতাসা খায়। একেবারে খাঁটি চিনির শিরার বাতাসা।
গাঁয়ের উত্তর দিকে দেড় দুই কিলোমিটার দূরে বালা ভিটা। ফাঁকা শুনশান। ধারে কাছে কোনো বসতি নেই। ভিটায় দুটি মাত্র তাল গাছ। অন্য কোনো ঝোপঝাড়ও নেই। লোকেরা ওই ভিটা মুখো হয় না। জিকাবাড়ির হিন্দুরা ওখানে মরা পোড়ায়। মানুষ পোড়ানোর জ্বালানী খরচ কিছু কম না। গরীব ঘরের মরা আধা পোড়াই থেকে যায়। ভিটা জুড়ে মানুষের হাড়, মাথার খুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে। দিনভর কুকুর শকুনদের আনাগোনা, আর রাতে শিয়ালের হুক্কাহুয়া। ভুত-পেতিœ, জ্বীন-পরীর আনাগোনার কথাও লোকের মুখে মুখে ফেরে!

দিনের ধান ভানা সেরে বিকালে মুন্তাজ মেঠো পথে হাঁটতে বের হয়। গাঁয়ের ছেলেমেয়েরা যেন সেই অপেক্ষাতেই থাকে। কখন মুন্তাজ বের হবে। শুধু যে তার অদ্ভুত পোষাক বাচ্চাদের আকৃষ্ট করে তা না। আরো কারণ আছে। বাড়ি থেকে বের হয়ে মুন্তাজ সোজা উত্তর দিকে হাঁটা ধরে। বাচ্চাদের দলও পিছু পিছু। গাঁয়ের একেবারে প্রান্তে গিয়ে সে দাঁড়ায়। এর পরেই ফাঁকা মাঠটি শুরু। ততক্ষণে ২০/২৫ জন কিশোর কিশোরী তার পিছু নিয়েছে।

হাসি মুখে বাম হাত নেড়ে নেড়ে মুন্তাজ বাচ্চাদের আদর জানায়। আর ডান হাতখানা হাফ প্যান্টের পকেটে ঢুকায়। সে হাত যতবার ঢোকে ততবারই এক মুঠো করে বাতাসা বেরিয়ে আসে। সব শিশুরাই তার ভাগ পায়। তবে কেউ একটার বেশি না, আবার কেউ বাদও পড়ে না। বাতাসা বিলানো শেষে দুহাতের ইশারায় মুন্তাজ শিশুদের বাড়ি ফেরত পাঠায়।

এরপর হাঁটতে হাঁটতে মাঠ পেরিয়ে সে বালা ভিটায় গিয়ে বসে। তখন প্রায় সন্ধা। কোনো দিন দক্ষিণ দিকে মুখ করে বসে থাকে, কোনোদিন বা পশ্চিম মুখো। আবার হয়তো বড় তাল গাছটিতে হেলান দিয়ে বসে কখনও। ওখানে তার কী কাজ? এই ভিটায় শত মানুষের শেষ ঠিকানা। জীবিতরা কেউ সে ঠিকানা মুখো হয় না। চিঠি পাঠায় না। কড়াও নাড়ে না। ডাকলেও সেখানে কারো সাড়া পাওয়া যায় না। ভিটার বাতাসে শুধু কান্না যেন গুমরে ফেরে। এমন একটি জায়গায় মুন্তাজ কিসের খোঁজ করে?

একদিন দাদী ভেতর বাড়ির উঠোনে চেয়ার পেতে বসে রোদ পোহাচ্ছেন। পাশেই পাটি পেতে জুলেখা বুজি কাঁচা সুপারি কুঁচি কুঁচি করে কাটছে। পানের ডাবর, পান ছেচনি পাশেই রাখা। তা প্রায় ৮/১০ দিন হলো মুন্তাজ উধাও। বরাবরের মতোই কাউকে কিছু না বলেই চলে গেছে। এমন সময় গোমস্তাদের একজন হন্তদন্ত হয়ে এসে খবর দিলো, বালা ভিটায় একটা লাশ পইচা গন্দে ময়ময়। পচা গন্দে ওদিকটায় কেউ হাঁটাচলা করতি পারতিছে না।
দাদী যেন চমকে উঠলেন, বললেন কার লাশ?

গোমস্তা বললো, দাদীআম্মা মনে হয় মুশায়গো কারো লাশ হবি। কাঠ কিনার ট্যাকা নাই বইলা ফালাইয়া গ্যাছে।
আশপাশ গাঁয়ের কেউ কি মারা গ্যাছে? খবর জানিস কিছু, দাদী জিজ্ঞাসা করলেন।
না আম্মা, তেমন তো কিছু শুনি নাই।
আইচ্চা, ঈমানরে বুলা, শিগগির, দাদীর গলা কেঁপে উঠলো।

তলব পেয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে ছুটে এলো ঈমান দাদা। দাদী বললেন, শীগগির বালা ভিটায় যা। লাশ চেনা যায় নাকি দ্যাখ। ভাল কইরা উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিস। আর আশপাশের হিন্দু গাঁয়ে খবর নিবি, দিন পনারোর মদ্যি কেউ মারা গ্যাছে নিকি। দেরি করিস না, যা।
কিসের আশঙ্কায় দাদী যেন ছটফট করছেন। চায়ের কাপের চা ঠান্ডা হলো, চুমুক দিলেন না। ছেচনিতে ছ্যাচা পান শুকায়ে গেল, মুখে পুরলেন না। এই বসেন তো এই দাঁড়ান। উঠোনের এ মাথা থেকে ও মাথায় পায়চারি করেন। একে ডাকেন, তাকে হাঁকেন—ভীষণ অস্থির তিনি। বাড়ির উত্তর মুড়ার গাব গাছের তলায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। ঈমান ফিরতে এত দেরী করছে কেন?

ঘণ্টা দুই বাদে ঈমান দাদা ফিরলো। সোজা পুস্কুর্নিতে নেমে ডুব দিলো। দাদী রেগেমেগে আগুন। বাড়ির নিয়ম ভেঙে তিনি পুকুর পাড়ে চলে গেলেন।
কী রে ঈমান তুই আমারে খবর না কইয়া নাইতি নামছিস যে? তোর আর আক্কেল হবিনে কোনোদিন, ক্ষোভ ঝাড়লেন দাদী।
বুক পানিতে দাঁড়ায়ে নত মুখে ঈমান দাদা বললো, পচা লাশ উল্টাইছি পাল্টাইছি। পাকছাপ না হইয়া আপনার সামনে কেম্বায় যাই।
আইচ্চা হইচে, আগে ক’ লাশ চিনতি পারলি?
না, চিনার উপয় নাই। লাশের গোস্ত গইলা হাড় বাউরাইয়া গ্যাছে।
কাপড় চোপড় কিছু ছেলো না গায়? মাজার বেল্ট বা টুপি, ধরা গলায় দাদী জিজ্ঞাসা করলেন।
না ভাবী, ওগুলান আমি ভাল কইরা খুঁজছি, ভিটায় কিচ্ছুই নাই। তয় লাশের পাশে খালি কয়খান বাতাসা পইড়া আছে।
পাদটিকাঃ এ ঘটনার পর থেকে আর কোনো বছরই মুন্তাজ ফিরে আসেনি।

(ব্যবহৃত আঞ্চলিক শব্দের ব্যাখ্যাঃ বেকি ব্যাড়া -বাড়ির অন্দর মহলের পাঁচিল, ভারানি -যে ধান ভানে, চুরনি -ঢেঁকির যে অংশ ধানের উপরে আঘাত করতে থাকে, নোট -যে গর্তের মধ্যে ধান ঢালা হয়, ছেচনি -পান সুপারি চুর্ণ করার হামান দিস্তা)
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)