Home কলাম যে বাহনে সারা জীবন

যে বাহনে সারা জীবন

রবার্ট ইগার : (দা ওয়াল্ট ডিজনী কোম্পানির প্রধান নির্বাহী হিসাবে রবার্ট ইগারের পনের বছরে অর্জিত শিক্ষামূলক অভিজ্ঞতা। ২০০৫ সালে রবার্ট ইগার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন যখন কোম্পানি এ যাবৎ কালে সর্বাধিক সঙ্কটময় পরিস্থিতি অতিবাহিত করছে। তিনটি মূলনীতির উপর ভর করে তিনি এগুলেন এক. গুণগত মানের শ্রেষ্ঠতা বজায় রাখা, দুই. নিত্য নতুন প্রযুক্তির সাথে প্রতিযোগিতা না করে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিৎ করা এবং তিন. গন্ডির বাইরে বিশ্বব্যাপী নিজেদের চিন্তা-চেতনার প্রসার ঘটানো। চৌদ্দ বছরে তিনি ডিজনিকে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মর্যাদাসম্পন্ন মিডিয়া কোম্পানিতে রূপান্তর করলেন। এখন পিক্সার, মার্ভেল, লুকাসফিল্ম, টুয়েন্টি ওয়ান সেঞ্চুরি ফক্স প্রভৃতি স্বনামধন্য কোম্পানির মালিক দা ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি। রবার্ট ইগারের লেখা “দা রাইড অফ এ লাইফ টাইম” সাপ্তাহিক ‘বাংলা কাগজ’এ ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন উন্নয়ন সংগঠক ও অনুবাদক কোরবান আলী)

পঞ্চান্ন.
ত্রয়দশ অধ্যায়
সততা ও ন্যায়পরায়ণতা অমূল্য সম্পদ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর) আমরা মে মাসের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছি এবং বিচারকের সিদ্ধান্ত দেবার দিনক্ষণের আর বেশি দেড়ি নেই। এর পরেই ফক্স শেয়ারহোল্ডারদের ভোট গ্রহণ। আমি সকাল ৭.০০ টার একটু আগে আমার অফিসে পৌঁছালাম। এবিসির প্রেসিডেন্ট বেন শেরউডের পাঠানো একটা ই-মেইল খুললাম। এটিতে একটি টুইট মন্তব্য অন্তর্ভুক্ত ছিল যা রোজান বার (রোজেন চেরি বার হলেন একজন আমেরিকান অভিনেত্রী, কৌতুক অভিনেতা, লেখক, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রার্থী এবং প্রযোজক) সেদিন সকালে পোস্ট করেছিলেন, যেখানে তিনি বলেছেন যে ভ্যালেরি জ্যারেট (প্রাক্তন ওবামা প্রশাসনের উপদেষ্টা) ‘মুসলিম ব্রাদারহুডের’ সৃষ্টি এবং আমেরিকায় অবৈধ অভিবাসী এবং আমেরিকার শত্রæ (প্ল্যানেট অফ দ্য এপস) । বেনের বার্তাটি ছিল: ‘আমাদের এখানে একটা গুরুতর সমস্যা হয়েছে… যা সম্পূর্ণ ঘৃণ্য এবং অগ্রহণযোগ্য।’

আমি অবিলম্বে উত্তরে লিখলাম: ‘আমাদের আগে বিষয়টি নিশ্চিৎ হতে হবে। আমি এখন অফিসে। আমি এখনও নিশ্চিৎ নই যে রোজানের টেলিভিশন শোটি আমরা প্রচার অব্যাহত রাখতে পারবো কিনা।’ এক বছর আগে ২০১৭ সালের মে মাসে আমরা ঘোষণা করেছিলাম যে আমরা রোজানকে এবিসি প্রাইম টাইমে ফিরিয়ে আনবো। তাকে প্রাইম টাইমে ফিরিয়ে আনার ধারণাটি সম্পর্কে আমি বেশ কৌতুহলী ছিলাম। কারণ ’৮০ এর দশকের শেষ থেকে ’৯০ এর দশকের শুরু পর্যন্ত আমি যখন এবিসি এন্টারটেইনমেন্ট পরিচালনা করছিলাম তখন আমরা একসাথে কাজ করেছি। তখন আমি রোজানকে কতটুকু চিনতে পেরেছিলাম এখন তা আর স্পষ্ট মনে নেই। কিছুটা অবশ্যই মনে করতে পারি আর সেটা হচ্ছে তার টেলিভিশন শোটির সৃজনশীল ধারণা দেখে আমি তাকে পছন্দ করি। গল্পটি ছিল দিনের বিতর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া সমৃদ্ধ একটা মানবিক প্রতিফলন- যা আমাকে মুগ্ধ করে।

আমরা শোটি পুনরায় স¤প্রচার করার কথা বিবেচনা করার আগে রোজান অতীতে যে বিতর্কিত টুইটগুলি পোস্ট করেছিলেন সে সম্পর্কে আমি অবগত ছিলাম না। কিন্তু টিভি শোটি চালু হওয়ার পরে তিনি আবার টুইট করা শুরু করলেন এবং এগুলোর মধ্যে বেশ কিছু খামখেয়লী মন্তব্য ছিল আবার বিভিন্ন বিষয়ে কিছু আপত্তিকর কথাও ছিল। এ ধরণের মন্তব্য করতে থাকলে আমাদের সমস্যা হবে। এপ্রিলে ভ্যালেরি জ্যারেট সম্পর্কে টুইট করার কয়েক সপ্তাহ আগে আমি তার সাথে দুপুরের খাবার খেয়েছিলাম। আমার ক্ষেত্রে এটা মানায় না। রোজান আমার জন্য নিজে বেক করে কুকিজ এনেছিলেন। তিনি আমাদের আগের কথোপকথনের কিছু অংশ স্মরণ করলেন। বললেন আমি তার কয়েকজন প্রিয় মানুষদের মধ্যে একজন। তিনি আরও বললেন যে তিনি সবসময় আমাকে বিশ্বাস করেন।
দুপুরের খাবারের শেষের দিকে আমি তাকে বললাম, ‘আপনাকে টুইটার থেকে দূরে থাকতে হবে।’ আপনার টিভি শোটি অবিশ্বাস্য রেটিং পেয়েছেন এবং আমি তাকে আবার উন্নতি করতে দেখে ব্যক্তিগতভাবে খুশি হয়েছিলাম। আমি বললাম, ‘আপনি এই শোটিতে দুর্দান্ত রকমের কৃতিত্ব পেয়েছেন। এটা ফুঁ মেরে উড়িয়ে দেবেন না।’

তিনি তার মজার অনুনাসিক কণ্ঠে বললেন, ‘হ্যাঁ বব, আপনি ঠিকই বলেছেন।’ তিনি আমাকে প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন যে তিনি আর টুইটারে যাবেন না এবং আমি আশ্বস্ত হয়ে দুপুরের খাবার শেষে গন্তব্যে ফিরেছিলাম। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি তখন যে সাফল্য পেয়েছিলেন তা বিরল এবং সহজেই হাত ছাড়া হয়ে যেতে পারে।

আমি ভুলে গেছিলাম বা খুব একটা গুরুত্ব দেইনি যে রোজান সর্বদা অপ্রত্যাশিতভাবে ভিন্ন মানুষ। অস্থির প্রকৃতির একজন মানুষ। এবিসি এন্টারটেইনমেন্টের সভাপতি থাকাকালীন সময়ের প্রথম দিকে আমরা ঘনিষ্ঠ ছিলাম। আমি তার টিভি শোটি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলাম। এবিসি এন্টারটেইনমেন্টের সভাপতি পদে যোগদানের সময় এটির প্রথম মৌসুম চলছিল এবং আমি ভেবেছিলাম সে আশ্চর্যজনকভাবে প্রতিভাবান। কিন্তু আমি তার আর একটা বৈশিষ্টও আঁচ করতে পেরেছিলাম। আমার মনে হত তিনি মাটি নয় বরং পারদ দিয়ে তৈরি এবং উদ্বায়ী। এমনও সময় ছিল যখন তিনি এতটাই হতাশ থাকতেন যে তিনি বিছানা থেকে উঠতে পারতেন না। টেড হারবার্ট এবং আমি মাঝে মাঝে তার বাড়িতে যেতাম এবং তিনি সুস্থ স্বভাবিক না হওয়া পর্যন্ত তার সাথে কথা বলতাম। হয়তো আমার বাবা এবং তার বিষণ্নতার সাথে কিছুটা মিল ছিল যা আমাকে তার প্রতি সহানুভূতিশীল করে তুলেছিল। তার প্রতি আমার সতর্ক দৃষ্টি ছিল এবং খোঁজ-খবর রাখতাম। এজন্য তিনিও আমার প্রশংসা করতেন।

বেনের ই-মেইল পড়ার পরে আমি জেনিয়া, অ্যালান, বেন এবং তৎকালীন এবিসি এন্টারটেইনমেন্টের প্রধান চ্যানিং ডাঙ্গির সাথে যোগাযোগ করলাম এবং তাদের জিজ্ঞাসা করলাম আমাদের কী করা উচিত বলে মনে করেন। তারা সাসপেনশন এবং বেতন কর্তন থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া বিবেচনা করলেন। তারা গুরুতরভাবে সতর্ক করার কথা বললেন এবং গণতিরস্কারের কথাও বিবেচনা করা যেতে পারে বললেন। কোনটিই আমার কাছে যথেষ্ট মনে হয়নি। তাদের মধ্যে কেউই তাকে বরখাস্ত করার কথা উল্লেখ করেননি। আমি জানতাম যে বরখাস্ত করার কথা তারা মনের ভিতরে চাপা দিয়ে রেখেছিলেন। অবশেষে আমি বললাম ‘আমাদের এখানে কোন বিকল্প পছন্দ থাকা উচিত নয় । আমাদের যা সঠিক তাই করতে হবে। যেটি রাজনৈতিকভাবে সঠিক তা নয় এবং এমনকি বাণিজ্যিকভাবে যা সঠিক সেটিও নয়। ঠিক যা করা দরকার তাই করতে হবে। আমাদের কর্মচারীদের কেউ যদি এমন টুইট করতেন তবে তাকে কোন বিলম্ব না করেই বরখাস্ত করা হত।’আমি তাদের বললাম নির্দ্বিধায় আমার বিরোধিতা করতে পারেন অথবা আমাকে পাগল বলতে পারেন কিন্তু কেউ কোন উত্তর দিলেন না।

জেনিয়া একটি বিবৃতির খসড়া তৈরি করলেন যা চ্যানিং এবিসি টিভি দর্শকদের উদ্দেশ্যে ঘষণা করবেন। আমি ভ্যালেরি জ্যারেটকে ফোন করে ক্ষমা চাইলাম এবং তাকে বললাম আমরা রোজানের অনুষ্ঠানটি বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং পনের মিনিটের মধ্যে এবিসি টিভিতে একটা ঘোষণা প্রচার হবে। তিনি আমাকে ধন্যবাদ জানালেন এবং পরে আবার ফোন করে বললেন যে তিনি আজ সন্ধ্যায় এমএসএনবিসি টেলিভিশনে বর্ণবাদ সম্পর্কে একটা প্যানেলে উপস্থিত থাকবেন। আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে সেদিন স্টারবাকস তাদের স্টোরসমূহ বন্ধ করে সংবেদনশীলতা বিষয়ে প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘সেখানে আমি কি আলোচনায় উল্লেখ করতে পারি যে আপনার সাথে আমার ফোনে কথা হয়েছে?’ আমি তাকে অনুমতি দিলাম।

তারপরে আমি ডিজনি বোর্ডে একটি ই-মেইল পাঠালাম: ‘আজ সকালে আমরা সকলেই রোজান বারের একটি টুইট দেখে ঘুম থেকে উঠেছি, যেখানে তিনি ভ্যালেরি জ্যারেটকে মুসলিম ব্রাদারহুডের পণ্য এবং প্ল্যানেট অফ দ্য এপস হিসাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি যে প্রসঙ্গেই এমন মন্তব্য করুন না কেন, আমরা মন্তব্যটিকে অসহনীয় এবং দুখঃজনক বলে ধরেছি এবং আমরা রোজানের শো বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি উচ্চ মর্যাদাপূর্ণ আসনে বসতে চাই না। একটা কোম্পানি হিসাবে আমরা সবসময়ই সঠিকটা করার চেষ্টা করেছি। আমরা কখনও রাজনীতি বা বাণিজ্যিকভাবে লাভ-ক্ষতির হিসাব করিনি। অন্য কথায় আমরা সবসময় আমাদের সমস্ত কর্মীর কাছে তাদের সততা দাবি করেছি এবং আমাদের সমস্ত পণ্যের শ্রষ্ঠ গুণগত মান বজায় রাখার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এখানে দ্বিতীয় বার সুযোগ দেবার কোন পথ খোলা নেই। সহনশীলতারও কোন জায়গা নেই। এটি একটি প্রকাশ্য সীমালঙ্ঘন যা কোম্পানিকে অসম্মান করে। রোজেনের টুইট আমাদের মূলনীতি লঙ্ঘন করেছে এবং আমাদের একমাত্র করণীয় হচ্ছে যা নৈতিকভাবে সঠিক তাই করা। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আমাদের টেলিভিশনে এ প্রসঙ্গে একটা বিবৃতি প্রকাশ হবে।’

সত্যিই এটি একটি সহজ সিদ্ধান্ত ছিল। আমি কখনই কাউকে জিজ্ঞেস করিনি যে টিভি শোটির স¤প্রচার বন্ধ করলে আমরা কি পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির সম্মূখিন হবো এবং নিজেও এ বিষয়ে চিন্তা করিনি। এই ধরনের মুহুর্তগুলিতে আপনাকে বাণিজ্যিক ক্ষতি যাই হোক না কেন অতীতের দিকে তাকাতে হবে এবং সহজ নিয়মের দ্বারা পরিচালিত হতে হবে। আপনাকে বুঝতে হবে আপনার কর্মীবৃন্দের সততা এবং আপনার পণ্যের শ্রেষ্ঠ গুণগত মানের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই নেই। সবকিছু নির্ভর করে আপনার কোম্পানির নীতি অনুসরণের ওপর।

সেদিন সারা দিন এবং সপ্তাহের বাকি কয়েকদিন মোটামুটি প্রশংসা পেয়েছি এবং সাথে কিছু অভিশাপ। সমাজের নানা মহল থেকে অনেক প্রশংসা এসেছিল: স্টুডিওর প্রধান; রাজনীতিবিদ; নিউ ইংল্যান্ড প্যাট্রিয়টসের মালিক রবার্ট ক্রাফট সহ ক্রীড়া জগতের কিছু মানুষ। ভ্যালেরি জ্যারেট আমাকে অবিলম্বে লিখেছিলেন যে তিনি আমাদের প্রতিক্রিয়ার অনেক প্রশংসা করেছেন। প্রেসিডেন্ট ওবামা তার পাঠানো বার্তায় অনেক প্রশংসা করেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আমাকে টুইটারে আক্রমণ করেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন তাকে কি একটু ক্ষমা করা যেত না এবং এবিসির সংবাদ প্রতিবেদনে আমরা তার সম্পর্কে যে ‘ভয়ংকর’ বিবৃতি দিয়েছিলাম তার সমালোচনা করলেন। কেলিয়ান কনওয়ে এবিসি নিউজের প্রধান জেমস গোল্ডস্টনের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন এবং জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে আমি ট্রাম্পের টুইটগুলি দেখেছি কিনা এবং আমার কোন প্রতিক্রিয়া আছে কিনা। তার প্রথম প্রশ্নের উত্তর ছিল ‘হ্যাঁ’ এবং দ্বিতীয়টির উত্তর ‘না’। (চলবে)
কোরবান আলী, অনুবাদক, টরোন্ট, ক্যানাডা।

Exit mobile version