রবার্ট ইগার : (দা ওয়াল্ট ডিজনী কোম্পানির প্রধান নির্বাহী হিসাবে রবার্ট ইগারের পনের বছরে অর্জিত শিক্ষামূলক অভিজ্ঞতা। ২০০৫ সালে রবার্ট ইগার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন যখন কোম্পানি এ যাবৎ কালে সর্বাধিক সঙ্কটময় পরিস্থিতি অতিবাহিত করছে। তিনটি মূলনীতির উপর ভর করে তিনি এগুলেন এক. গুণগত মানের শ্রেষ্ঠতা বজায় রাখা, দুই. নিত্য নতুন প্রযুক্তির সাথে প্রতিযোগিতা না করে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিৎ করা এবং তিন. গন্ডির বাইরে বিশ্বব্যাপী নিজেদের চিন্তা-চেতনার প্রসার ঘটানো। চৌদ্দ বছরে তিনি ডিজনিকে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মর্যাদাসম্পন্ন মিডিয়া কোম্পানিতে রূপান্তর করলেন। এখন পিক্সার, মার্ভেল, লুকাসফিল্ম, টুয়েন্টি ওয়ান সেঞ্চুরি ফক্স প্রভৃতি স্বনামধন্য কোম্পানির মালিক দা ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি। রবার্ট ইগারের লেখা “দা রাইড অফ এ লাইফ টাইম” সাপ্তাহিক ‘বাংলা কাগজ’এ ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন উন্নয়ন সংগঠক ও অনুবাদক কোরবান আলী)

একত্রিশ.
অষ্টম অধ্যায়
শ্রদ্ধাই শক্তি
(পূর্ব প্রকাশিতের পর) পিটার এ ধরনের সিদ্ধন্ত গ্রহণ পদ্ধতিতে কোন সমস্যা দেখেন না যেখানে তিনি এবং তার বিশ্লেষকরা কোম্পানির অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। অথচ আমাদের চারপাশের ব্যবসা-বাণিজ্যগুলো চলমান বিশ্বের সাথে খাপ খাইয়ে চিত্তাকর্ষকভাবে অত্যন্ত দ্রæত গতিতে পরিবর্তিত হচ্ছিল। আমাদের পরিবর্তন করা দরকার, আমাদের আরও চতুর হতে হবে এবং আমাদের শীঘ্রই নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ পদ্ধতি বাস্তবায়ন করতে হবে।
হংকং টিকিটের মূল্য সম্পর্কে মত বিনিময়ের এক সপ্তাহ বা তার একটু পরে, আমি পিটারকে আমার অফিসে ডাকলাম এবং তাকে বললাম যে আমি কৌশলগত পরিকল্পনা বিভাগ পুনর্গঠনের পরিকল্পনা করেছি। আমি বললাম আমি বিশ্লেষকদের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমাতে চাই এবং ব্যবসায?িক নেতাদের হাতে আরও বেশি সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতা ছেড়ে দেব, আমি সিদ্ধান্ত গ্রহণ পদ্ধতি সহজ করে তাদের আরও দক্ষ ও কার্যকর করে গড়ে তুলতে চাই। আমরা দুজনেই জানতাম, আমার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তার জন্য কখনোই মঙ্গোলজনক হবে না এবং তার কোম্পানিতে থেকে যাওয়া কোনভাবেই যুক্তিসংগত হবে না।

সেই কথোপকথনের কিছুক্ষণ পরেই আমি একটি প্রেস রিলিজ তৈরি করেছিলাম যাতে বলা হয় যে পিটার কোম্পনি ছড়ে যাচ্ছেন এবং কৌশলগত পরিকল্পনা বিভাগ সংস্কারের কাজ চলছে। আমি আর কাল বিলম্ব না করে কৌশলগত পরিকল্পনা বিভাগ ভেঙে ফেলার কাজ শুরু করলাম। কৌশলগত পরিকল্পনা বিভাগের পঁয়ষট্টি জন সদস্য সংখ্যা থেকে পনের জনে সঙ্কুচিত করে ফেললাম। আমার প্রধান ফাইনানসিয়াল অফিসার টম স্ট্যাগস কেভিন মায়ারের কথা বললেন, যিনি একসময় কৌশলগত পরিকল্পনা বিভাগ কর্মরত ছিলেন এবং কয়েক বছর আগে তিনি কোম্পানি ছেড়ে যান। মেদহীন নতুন কৌশলগত পরিকল্পনা বিভাগ পরিচালনা করার জন্য তাকে কোম্পানিতে ফিরিয়ে আনা হল। কেভিন টমের কাছে দ্বায়বদ্ধ থাকবেন। তিনি এবং তার দল সম্ভাব্য অধিগ্রহণের উপর মনোনিবেশ করবেন। একটি স্বচ্ছ আদেশ দিয়ে তাদের বলা হল যে কোন অধিগ্রহণ আমাদের তিনটি মূল অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সম্পন্ন হবে।

কৌশলগত পরিকল্পনা বিভাগ ভেঙ্গে দেয়া একটা বিষ্ময়কর চ্যালেঞ্জিং ঘটনা এবং উল্লেখযোগ্য অর্জন হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে, যা আমি কোম্পানির দায়িত্বভার গ্রহণের আগের ছয় মাসের মধ্যে সম্পন্ন করেছিলাম। আমি জানতাম যে এটির একটা তাৎক্ষণিক বাস্তব প্রভাব দেখা যাবে। কিন্তু যখন ঘোষণা করা হল তারা আর আমাদের ব্যবসার সমস্ত দিকগুলিকে লোহার বেড়ি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখবে না, এখন থেকে দখল মুক্ত। তা কোম্পানির সকল মানুষের নৈতিকতার উপর একটি তাৎক্ষণিক শক্তিশালী প্রভাব ফেলেছিল। মনে হচ্ছিল যেন সমস্ত জানালা খুলে দেয়া হয়েছে এবং মুক্ত সতেজ বাতাস হঠাৎ করে বদ্ধ ঘরে প্রবেশ করছে। আমাদের একজন সিনিয়র এক্সিকিউটিভ সেই সময়ে আমাকে বলেছিলেন, ‘যদি ডিজনি জুড়ে সমস্ত টাওয়ারগুলোতে চার্চের ঘণ্টা থাকত, তবে সেগুলি হঠাৎ সমস্বরে বেজে উঠতো।’

নবম অধ্যায়
ডিজনি-পিক্সারের নতুন পথপরিক্রমা
স্টিভের নতুন নতুন আইপডে আমাদের টিভি শোগুলো দেখানোর স্বার্থে সেই মাসগুলিতে তাঁর সাথে কথা বলা শুরু হয়েছিল। ধীরে ধীরে, ইতস্তত পদক্ষেপে একটি সম্ভাব্য ডিজনি/পিক্সার চুক্তির জন্য আলোচনার পথ প্রশস্ত করার জন্যই এই পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। স্টিভ নরম হয়েছিলেন, কিন্তু সামান্যই। তিনি কথা বলতে ইচ্ছুক ছিলেন, কিন্তু তার যে কোনো নতুন চুক্তির সংস্করণ পিক্সারের পক্ষে অত্যাধিক পক্ষপাতদুষ্ট ছিল।

একটি চুক্তির নমুনা কেমন হতে পারে তা নিয়ে আমরা কয়েকবার তাঁকে খোঁচা দিয়েছি কিন্তু কোন ফল পাইনি। আমি টম স্ট্যাগসকে আলোচনায় উপস্থিত রেখে সে কোন অগ্রগতি করতে পারে কিনা তা দেখতে চেয়েছিলাম। ওয়েলসো গোল্ডম্যান শ্যাক্স, জেন সাইকস যাদেরকে আমরা বিশ্বাস করতাম এবং তাঁদের সাথে স্টিভের ভালো জানাশোনা ছিল তাদেরকে মধ্যস্থতা করার জন্য আলোচনায় অন্তর্ভূক্ত করেছিলাম। আমরা জেনের কাছ থেকে কতকগুলো ভিন্ন ধারণা নিয়ে স্টিভের সাথে আলোচনা করেছি কিন্তু স্টিভ তাতেও সাড়া দেননি। তাঁর প্রতিরোধ ব্যাবস্থা জটিল ছিল না। স্টিভ পিক্সার ভালোবাসতেন এবং তিনি ডিজনির বিষয়ে চিন্তা করতেন না। তাই তিনি বিবেচনা করতে চান এমন যে কোনো চুক্তিতে পিক্সারের জন্য বিশাল উত্থান হবে এবং আমাদেরকে একটা উচ্চ মূল্যে পরিশোধ করতে হবে।

টয় স্টোরি, মনস্টার, ইনক এবং দা ইনক্রেডিবলস এই চারটি ফিল্ম আমরা পিক্সারের সাথে যৌথভাবে নির্মাণ এবং অবমুক্ত করি। এগুলোর মূল্যবান সিক্যুয়েল স্বত্ব (চলচ্চিত্রের গল্প, ছবিগুলো পুননির্মাণ, টিভিতে প্রদর্শণ বা মঞ্চায়নের স্বত্বাধিকার) পিক্সারের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। বিনিময়ে তাদের কোম্পানির ১০ শতাংশ শেয়ার পাবো। আমরা তাদের গভার্নিং বোর্ডে আসন পাব, সমস্ত নতুন পিক্সার ফিল্ম বিতরণের অধিকার আমাদের থাকবে, এবং একটি বড় প্রেস কনফারেন্স করে ঘোষণা করা হবে ডিজনি এবং পিক্সার অংশীদারী প্রতিষ্ঠান। এ ধরনের চুক্তিতে আর্থিক দিক থেকে পিক্সারই বেশি লাভবান হবে। তারা পিক্সার-ব্র্যান্ডেড ফিল্ম এবং সিক্যুয়েলগুলি নির্মাণ করবে এবং তারাই চিরকালের জন্য এগুলোর মালিক থাকবে। আর আমরা শুধু ডিস্ট্রিবিউটর হিসাবে কাজ করবো। আরও কয়েকটি অনুরূপ প্রস্তাব তারা আমাকে দিয়েছিল, আমি সেগুলো ফিরিয়ে দিয়েছি। টম এবং আমি প্রতিবার আলোচনা শেষে একে অপরের দিকে তাকাতাম। নিজেদেরকে প্রশ্ন করতাম, আমরা কি পাগল যে স্টিভের সাথে চুক্তি না করেই প্রতিবার ফিরে আসছি। কিন্তু না, পরে আমরা দ্রæত সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম আমাদের যে কোনও চুক্তির দীর্ঘমেয়াদী মূল্য থাকতে হবে। এবং এটি ঘোষণার অন্তর্ভূক্ত হতে হবে।

বাস্তবতা হল স্টিভের পক্ষে সারা বিশ্ব। ততক্ষণে পিক্সার তার উদ্ভাবনী শক্তি প্রয়োগ করে পরিশীলিত অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র নির্মাণে আদর্শ কোম্পানিতে রূপান্তরিত হয়েছে। আমাদের থেকে দূরে চলে যাওয়ার বিষয়ে তিনি কখনই চিন্তিত ছিলেন না। দরকষাকষির জন্য আমাদের হাতে একমাত্র পুঁজি ছিল আগের কয়েকটি ছবির সিক্যুয়াল স্বত্বাধিকার। আমরা মাইকেলের অধীনে অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র নির্মাণে সামান্যই কাজ শুরু করেছি যখন দুই বছর আগে স্টিভের সাথে আমাদের আলোচনা ভেঙে যায়। স্টিভ জানতেন যে আমরা যে কোন কিছুকে সত্যিকারর্থে দুর্দান্ত করার জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখব । যদিও তিন ডিজনি অ্যানিমেশনকে মর্যাদা দিয়েছেন এবং ভালো করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার সাহস যুগিয়েছেন।

৩০ সেপ্টেম্বর ২০০৫, মাইকেল ২১ বছর ধরে যে কোম্পানির প্রধান নির্বাহী ছিলেন তার শেষ দিন কাটাচ্ছেন। এটি একটি দুঃখজনক, বিশ্রী দিন ছিল। তিনি ডিজনির সাথে কোন চলমান সংযোগ ছাড়াই চলে যাচ্ছেন। গভার্নিং বোর্ডে তার কোন পদ থাকবে না। কোম্পানিতে কোন সম্মানসূচক পদবীও তাকে দেয়া হচ্ছে না বা পরামর্শমূলক কোন ভূমিকাও থাকবে না।

আকস্মিকভাবে এবং সম্পূর্ণরূপে মাইকেলের বিদায়। তিনি আমার প্রতি সদয় ছিলেন। আমরা নিজেদের মধ্যে তাঁর জন্য একটা উত্তেজনা অনুভব করছি। গত কয়েক বছর অনেক কঠিন ছিল। মাইকেল আমাদের ছেড়ে যেতে চাননি। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম।

আমি জেনিয়া মুচা এবং টম স্ট্যাগস এবং অ্যালান ব্রেভারম্যানের সাথে সংক্ষিপ্তভাবে কথা বললাম। তাদের বললাম আমার মনে হয় ‘তিনি থেকে গেলেই কোম্পনির জন্য ভালো হতো’। তার সাথে সেদিন আমরা একটা সম্মানজনক দূরত্ব বজায় রেখেছিলাম। তাঁকে তার নিজের মতো করে স্বাধীনভাবে কোম্পানিতে তাঁর সময়কালের শেষ দিন উপভোগ করার সুযোগ দিয়েছিলাম। মাইকেলের স্ত্রী জেন এবং তাদের এক ছেলে দুপুরের খাবারের জন্য এসেছিল, এবং সেই দিনই শেষবারের মতো কোম্পানির পার্কিং লট থেকে গাড়ি চালিয়ে বের হয়ে গেলেন। তাঁর চিন্তা-চেতনায় কি ঝড় বয়ে যাচ্ছিল সে মুহূর্তে আমি তা কল্পনাও করতে পারি না । দুই দশক আগে তিনি এখানে এসেছিলেন এবং এখানে একটা কোম্পানিতে তিনি প্রানের সঞ্চার করেছিলেন এবং এখন তিনি তা ছেড়ে দূরে চলে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে তিনি জেনেছেন তাঁর প্রয়োজন ফুরিয়েছে, তাঁর যুগ শেষ হয়ে গেছে। যে জায়গাটিকে তিনি বিশ্বের বৃহত্তম বিনোদন সংস্থায় পরিণত করেছিলেন তা এখন থেকে তাঁকে ছাড়াই চলতে থাকবে? আমার ধারণা এটি মানুষের জীবনে সেই গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্তগুলির মধ্যে একটি যখন মানুষ বুঝতে সক্ষম হয় সে কে। এ মুহূর্ত থেকে তাঁর সেই পদ নেই, পদ-মর্যাদা নেই, ক্ষমতা নেই কোম্পানির সাথে কোন সংশ্লিষ্টতা নেই, কোম্পানিতে কোন ভূমিকা নেই। মানুষের জীবনে জিটিল এক মুহুর্ত। আমি তাঁকে গভীরভাবে অনুভব করেছি, কিন্তু আমি জানতাম তাঁর ব্যথা লাঘব করার জন্য আমার করণীয় কিছুই ছিল না।

তিন দিন পর, ৩ অক্টোবর সোমবার আমি আনুষ্ঠানিকভাবে ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানির ষষ্ঠ প্রধান নির্বাহী হলাম। আমার দীর্ঘ কর্মজীবনে প্রথমবারের মতো শুধুমাত্র পরিচালনা পর্ষদের কাছে দ্বায়বদ্ধ হতে যাচ্ছি। দীর্ঘ উত্তরাধিকার প্রক্রিয়া শেষে ছয় মাস অপেক্ষার পর, আমি আমার প্রথম বোর্ড সভায় সভাপতিত্ব করতে যাচ্ছি। বেশির ভাগ বোর্ড মিটিংয়ের আগে, আমি আমার সমস্ত ব্যবসায?িক প্রধানদের তাদের ব্যবসার আপডেট উপস্থাপনের জন্য অনুরোধ করেছি, যাতে আমি ব্যবসায?িক কর্মক্ষমতা, গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা, চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ সম্পর্কে বোর্ডকে অবহিত করতে পারি। প্রথম সভায় আমার জন্য যদিও মিটিং এজেন্ডায় মাত্র একটা আইটেম ছিল।

মিটিংয়ের আগে, আমি আমাদের স্টুডিওর প্রধান ডিক কুক এবং স্টুডিওর দুই নম্বর ব্যক্তি অ্যালান বার্গম্যানকে ডিজনি অ্যানিমেশনের গত দশ বছর কভার করে একটা উপস্থাপনা প্রস্তুত করতে বলেছিলাম। যেমন আমরা প্রতিটি চলচ্চিত্র মুক্তি দেবার পর বক্স অফিস কী পরিমান আয় করেছিল তার একটা হিসাব অন্তর্ভূক্ত করতে বলেছিলাম । তারা দুজনেই ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। ডিক বললেন ‘এটা একটা কুৎসিত উপস্থাপনা হবে’।
অ্যালান বললেন, ‘সংখ্যাগুলো ভয়ঙ্কর। এটি সম্ভবত শুরু করার সেরা উপায় নয়।’ (চলবে)
কোরবান আলী: অন্বুাদক, টরন্টো, কানাডা