রবার্ট ইগার : (দা ওয়াল্ট ডিজনী কোম্পানির প্রধান নির্বাহী হিসাবে রবার্ট ইগারের পনের বছরে অর্জিত শিক্ষামূলক অভিজ্ঞতা। ২০০৫ সালে রবার্ট ইগার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন যখন কোম্পানি এ যাবৎ কালে সর্বাধিক সঙ্কটময় পরিস্থিতি অতিবাহিত করছে। তিনটি মূলনীতির উপর ভর করে তিনি এগুলেন এক. গুণগত মানের শ্রেষ্ঠতা বজায় রাখা, দুই. নিত্য নতুন প্রযুক্তির সাথে প্রতিযোগিতা না করে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিৎ করা এবং তিন. গন্ডির বাইরে বিশ্বব্যাপী নিজেদের চিন্তা-চেতনার প্রসার ঘটানো। চৌদ্দ বছরে তিনি ডিজনিকে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মর্যাদাসম্পন্ন মিডিয়া কোম্পানিতে রূপান্তর করলেন। এখন পিক্সার, মার্ভেল, লুকাসফিল্ম, টুয়েন্টি ওয়ান সেঞ্চুরি ফক্স প্রভৃতি স্বনামধন্য কোম্পানির মালিক দা ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি। রবার্ট ইগারের লেখা “দা রাইড অফ এ লাইফ টাইম” সাপ্তাহিক ‘বাংলা কাগজ’এ ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন উন্নয়ন সংগঠক ও অনুবাদক কোরবান আলী)

একুশ.
ষষ্ঠ অধ্যায়
চমকপ্রদ ঘটনার প্রত্যাশায়
(পূর্ব প্রকাশিতের পর) ১১ই সেপ্টেম্বরের হামলার পরের বছরগুলোতে দুজন মূল বোর্ড মেম্বার রয়-ই-ডিজনি এবং স্টেনলি গোল্ড মাইকেলের কোম্পানি পরিচালনার ক্ষমতার উপর তাঁদের আস্থার ঘটতির কথা প্রকাশ্যে আলোচনা শুরু করেন। এখানে বলে রাখা ভালো স্টেনলি গোল্ড ছিলেন রয়-ই-ডিজনির ব্যক্তিগত কৌঁসুলি। মাইকেলের সাথে রয়ের সম্পর্কের ইতিহাস দীর্ঘ ও জটিল। রয়ই তাঁকে প্রধান নির্বাহী আর বোর্ডের চেয়াম্যান করে কোম্পানিতে এনেছিলেন। এ বিষয়ে তিনিই কোম্পানির কাছে বেশি দ্বায়বদ্ধ। আবার মাইকেলের নেতৃত্বেই সকল শেয়ার হোল্ডারের চেয়ে তিনিই সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছেন। ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৪ সালের মধ্যে কোম্পানির আয় চার গুণ বৃদ্ধি পায় আর কোম্পানির শেয়ার মূল্য ১,৩০০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।

এই বছর গুলোতে রয়ের প্রতি আনুগত্য ও সম্মান প্রকাশের জন্য, মাইকেল তাঁর পথ থেকে সরে দাঁড়ান। এটা অতটা সহজ বিষয় ছিল না। রয় সময়ের প্রেক্ষিতে অনেক জটিল হয়ে উঠতে পারেন। তিনি নিজেকে ডিজনির উত্তরাধিকারী ও ত্রাতা ভাবতেন। তিনি ভাবতেন ডিজনিকে রক্ষা করার জন্য তিনি বেঁচে আছেন, শ্বাসপ্রশ্বাস নিচ্ছেন। প্রয়োজনে শরীরের রক্ত দিয়ে ডিজনিকে রক্ষা করবেন। ডিজনিতে কোন ঐতিহ্য বা মূল্যবোধের সামান্য বিচ্যুতি ঘটলে তিনি মনে করতেন, ওয়াল্টের (যিনি তাঁর ভাতিজাকে খুব একটা মর্যাদা দেননি বলেই অনুমেয়) সাথে তিনি যে পবিত্র ওয়াদা করেছিলেন সেটার ব্যত্যয় ঘটালেন। ডিজনির অতীতকে সম্মান করার পরিবর্তে তিনি তার আরাধনা করতেন। ফলে যে কোন ধরনের সামান্য পরিবর্তন তিনি মন থেকে মেনে নিতে পারতেন না। মাইকেলের ক্যাপ-সিটি/এবিসি ক্রয়ের বিষয়টি তিনি কখনও মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। তিনি মনে করেন একটা ডিজনি বহির্ভূত ব্রান্ড ডিজনির ধমনিতে প্রবাহিত করা হচ্ছে। তাঁর মন মানসিকতার আর একটা দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যেতে পারে। একবার বড়দিন উৎসব মৌসুমে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমরা আমাদের ডিজনি স্টোরে উচ্চ মূল্যের বিলাস বহুল মিকি মাউসের পুতুল বিক্রি করবো। তখন রয় আমাদের দুজনকে একটা ই-মেইল পাঠালেন। ই-মেইলে লেখা ছিল, ‘মিকি মাউসের পুতুল শুধুমাত্র সাদা-কালো এবং লাল-হলুদ রঙের হবে, এবং এটিই চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত!’ তিনি চ্ইাতেন শুধু অ্যালবিনো মিকি হবে। তাক থেকে মিকি বের করে তিনি তাঁদের ’অ্যালবিনো মিকি’ বলে সম্বোধন করতেন। কিন্তু আমরা তাঁর কথা মত কাজ করিনি। ফলে আমাদের অনেক বিভ্রান্তির মুখোমুখি হতে হয়েছে।

তাঁর মদ্যপানের সমস্যা ছিল। যতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন আমরা ডিজনিতে এ বিষয়ে আলোচনা করিনি। কিন্তু অনেক বছর পরে তাঁর একটা বাচ্চা আমাকে তার বাবা-মার অ্যালকাহল জনিত সমস্যা সম্পর্কে খোলাখুলিভাবে আলোচনা করেছিল। রয় এবং তাঁর স্ত্রী প্যাটি কয়েক ঢোঁক অ্যালকাহল গেলার পরই রেগে যেতেন। গভীর রাতের ই-মেইল গুলোতে তার প্রতিফলন দেখতে পেতাম। কতকগুলো ই-মেইল আমিও পেয়েছিলাম। আমাদের যে সমস্ত সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রম তাঁর বিশ্বাস মতে ভুল হয়েছে সেগুলোকে আলোকপাত করে তিনি লিখতেন। স্মরণ করিয়ে দিতেন আমরা ডিজনি উত্তরাধিকারের গোমস্তা মাত্র।

আমাদের চ্যালেঞ্জগুলো যতই বড় হতে থাকল, রয় তৎোই মাইকেলের প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন হয়ে উঠতে লাগলেন। তিনি প্রকাশ্যে মাইকেলের সমালোচনা করতে লাগলেন। এমনকি মাইকেলের দিক থেকে সম্পূর্ণভাবে মূখ ফিরিয়ে নিলেন। ২০০২ সালে রয় ও স্টেনলি যৌথভাবে বোর্ডের কাছে তাঁদের বেশ কিছু সংখ্যক উদ্বেগের ফিরিস্তি উল্লেখ করে একটা চিঠি পাঠালেন। তাঁরা মাইকেলের কাছে তাঁদের উদ্বেগগুলোর ব্যাখ্যা দাবী করলেন। তাঁদের উদ্বেগগুলো হচ্ছে – এবিসি টেলিভিশনে রক্ত স্বলপতা, স্টিভ জবস আর পিক্সারের সাথে বৈরিতা, থিম-পার্ক কৌশল সম্পর্কে তাঁদের মতভেদ, মাইকেলের সমস্যাযুক্ত মাইক্রো ম্যানেজমেন্ট। তাঁদের উদ্বেগগুলো অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট ছিল এবং ক্ষোভে পরিণত হয়েছিল। ফলে আমরা বিষয়গুলো বিধিসম্মতভাবে বিবেচনা করতে বাধ্য হলাম। ফলে আমাদের সম্পূর্ণ ব্যবস্থাপনা কৌশল বোর্ডের কাছে উপস্থাপন করলাম, সমস্যাগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা হলো এবং এগুলো কিভাবে সমাধান করা হবে তার দিক নির্দেশনা দিলাম।

এই উপস্থাপনা কোন কাজে দিলনা। রয় আর স্টেনলি মাইকেলকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য বোর্ডকে বোঝানোর কাজে প্রায় এক বছর ব্যাপী চেষ্টা করে গেলেন। ২০০৩ সালের শরতে মাইকেল অবশেষে তাঁদের কাছে তাঁর সীমা অতিক্রম করলেন। মাইকেল কৌশলী হলেন। তিনি কোম্পানি পরিচালনার বিধি-বিধানগুলো নেড়েচেড়ে দেখলেন, যেখানে লেখা ছিল বোর্ড মেম্বাররা বাহাত্তর বছর বয়সে অবসরে যাবেন। কোম্পানি পরিচালনার বিধান সমূহের এই ধারা ইতিপূর্বে কখনও মানা হয়নি। কিন্তু রয় মাইকেলকে এমনভাবে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন যে মাইকেল এক প্রকার বাধ্য হয়ে এই ধারাটি কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। রয়ের সাথে কোন প্রকার আলোচনা ছাড়াই মাইকেল বোর্ডের মনোনয়ন কমিটির চেয়ারম্যানকে বলেছিলেন রয়কে বলে দিন, ‘তিনি পুনরায় নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন না আর ২০০৪ এর মার্চ মাসে পরবর্তী শেয়ার হোল্ডার মিটিংএ তাঁকে অবসরে পাঠানো হবে।’

থ্যঙ্কসগিভিং এর পরের মঙ্গোলবারে আমাদের পরবর্তী বোর্ড মিটিং এর তারিখ নিউ ইয়র্কে নির্ধারিত হয়েছিল। রবিবার বিকেলে আমি আর উইলো যাদুঘরে যাচ্ছিলাম এবং সন্ধায় একটা ডিনারের পরিকল্পনাও ছিল। এমন সময় মাইকেলের সহকারী আমাকে জরুরী তলব করলেন। আমাকে এক্ষনে মাইকেলের কামরায় বিশেষ মিটিংএ হাজির হতে হবে। পূর্ব একষট্টি নম্বর সড়কে পিয়ারে হোটেলে তিনি নোঙ্গর করেছেন। আমি যখন তাঁর কামড়ায় যেয়ে পৌছালাম তখন দেখলাম রয় আর স্টেনলির লেখা একটা চিঠি তাঁর হাতে। কে যেন তাঁর কামরায় দরজার নিচ দিয়ে ঠেলে দিয়েছে।

তিনি চিঠিটা আমার হাতে দিলেন আর আমি পড়তে শুরু করলাম। রয় চিঠিতে লিখেছেন তিনি আর স্টেনলি বোর্ড থেকে সদস্যপদ প্রত্যাহার করবেন। তারপর তিনি তিন পৃষ্ঠা ব্যাপী কোম্পানিতে মাইকেলের নেতৃত্বের সমালোচনা তুলে ধরেন। কথাগুলো পড়লে গা জ্বালা শুরু হবে। তিনি স্বীকার করেছেন মাইকেল প্রথম দশ বছর বেশ সফলতার সাথেই কোম্পানি পরিচালনা করেছেন। কিন্তু পরের বছরগুলোতে তাঁর সাতটি ব্যার্থতার কথা এক এক করে বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরেন।

১. এবিসি টেলিভিশনকে জনপ্রিয়তার তলানী থেকে তুলে আনতে ব্যার্থ হয়েছেন। ২. ‘আপনার চার পাশের সকলেই আপনার অপ্রতিরোধ্য মাইক্রো-ম্যানেজমেন্টের শিকার ফলে এই কোম্পানির কারও কোন মনোবল নেই’। ৩. থিম-পার্কগুলোতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের অভাব ফলে পার্কে যাদের পদচারণা তারা হতাশ হয়েছেন। ৪. আমাদের স্টকহোল্ডারদের ধারনা কোম্পানিটি ভয়ঙ্কর রকমের লোভী, হৃদয়হীন সর্বদা দ্রুত অর্থ কামায়ের পেছনে ছুটে কখনও দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের দিকে নজর দেয় না, যার ফলে কোম্পানিটি ক্রমে গণআস্থা হারাচ্ছে। ৫. অব্যাবস্থাপনা, শৃঙ্খলার অভাব, উৎসাহ-উদ্দীপনার অভাবে কোম্পানি থেকে সৃজনশীল মেধাবী মানুষ বের হয়ে যাচ্ছে। ৬. ডিজনির পার্টনারদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ব্যার্থতা, বিশেষকরে পিক্সারের সাথে। ৭. ‘একটা স্পষ্ট উত্তরাধিকার পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আপনার গড়িমসি এবং এটির বাস্তবায়ন করতে আপনার নিরন্তর অনিহা’।
রয় সবশেষে লিখেছেন, ‘মাইকেল, আমি মনেপ্রানে বিশ্বাস করি আপনার উচিৎ হবে কোম্পানি ছেড়ে যাওয়া, আমার জন্য এটি প্রযোজ্য নয়। তাই আমি আবারও আপনার পদত্যাগ ও অবসর গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি।’

রয়ের বেশকিছু অভিযোগের বৈধতা ছিল, আবার অনেকগুলো বেশ অপ্রাসংঙ্গিক। এটি কোন বিষয় না। আসলে আমরা সবাই অনুধাবন করছিলাম আমরা সবাই কঠিন পথের যাত্রী। আমরা সকলেই অনিবার্য দুঃস্বপ্ন, আতঙ্ক আর জনসংযোগের মুখোমুখি হবার জন্য নিজ নিজ কৌশলগত পরিকল্পনা নির্মাণ করে চলেছি।

চিঠিটা ছিল তাঁদের বড় পরিকল্পনার সূচনা মাত্র। রয় ও স্টেনলি খুব দ্রæতই তাঁদের ভাষায় ‘সেভ ডিজনি’ অভিযানে নেমে পড়েন। ২০০৪ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠেয় বাৎসরিক শেয়ার হোল্ডার মিটিংকে টার্গেট করে তাঁদের এই অভিযান শুরু হয়। মাইকেলের প্রকাশ্য সমালোচনা করার একটা সুযোগও তাঁরা হাতছাড়া করেন নায়। তাঁরা অন্যান্য বোর্ড মেম্বারদের মাইকেলের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবার জন্য কাজ করেছেন। ’সেভ ডিজনি’ নামে তাঁরা একটা ওয়েব-সাইট চালু করেন। তাঁরা অপ্রতিরোধ্য গতিতে ডিজনির শেয়ারহোল্ডাদের নিকট তদবির করতে শুরু করলেন যাতে তাঁরা আগামী শেয়ারহোল্ডার সভায় ভোট বন্ধ করে মাইকেলকে বোর্ড থেকে বহিষ্কার করে। ( আপনি যদি কোম্পনির স্টকের মালিক হন তবে আপনি একটি বদলি ভোট দেবার অধিকার পাবেন। আপনি প্রতি বছর একজন বোর্ড সদস্যর পক্ষে ভোট দিতে পারবেন। অথবা আপনার ভোট আটকে রাখতে পারবেন, যা একটা ‘না’ ভোটের সমতুল্য।)

এমনতর অবস্থায় মাইকেল আর স্টিভ জবসের মধ্যেকার হালকা শত্রæতা হঠাৎ বিস্ফোরিত হয়ে গেল। ডিজনি চেষ্টা করছিল পিক্সারের সাথে তাঁদের যে পাঁচটি ছবির চুক্তি হয়েছিল, সেটির স¤প্রসারণ করতে কিন্তু স্টিভ জবস একটা নতুন খসড়া চুক্তিনামা মাইকেলকে দিয়েছিলেন যেটি গ্রহণ করা সম্ভব না। নতুন খসড়া অনুসারে পিক্সার উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করবে এবং ছবি অবমুক্ত করা, স¤প্রচার করা এবং রেকর্ড করার অধিকার থাকবে পিক্সারের। ডিজনি সেখানে শুধুমাত্র বিতরণ পার্টনার হিসাবে কাজ করবে। মাইকেল সেটি প্রত্যাখান করেছিলেন। আবার স্টিভ কোন বিকল্প চুক্তি মেনে নিতে অস্বীকার করেন। এই দীর্ঘ আলোচনার মাঝখানে, ‘ফাইন্ডিং নিমো’ ছবিটি মুক্তি পাবার আগে মাইকেল বোর্ডকে একটা অভ্যন্তরীণ চিঠি দিয়েছিলেন। সেই চিঠিটা গণমাধ্যমে ফাঁস হয়ে যায়। তিনি লিখেছিলেন ছবিটির খসড়া দেখে তিনি মুগ্ধ হননি এবং তিনি বিশ্বাস করেন পিক্সারকে তাঁদের অযৌক্তিক দম্ভের খেসাড়ৎ দিতে হবে। যদি নিমো ভালো না করে তবে এটি খুব খারাপ হবে না কারণ তখন ডিজনি পিক্সারের সাথে আলোচনার টেবিলে বেশি সুবিধা পাবে। (চলবে)