রবার্ট ইগার : (দা ওয়াল্ট ডিজনী কোম্পানির প্রধান নির্বাহী হিসাবে রবার্ট ইগারের পনের বছরে অর্জিত শিক্ষামূলক অভিজ্ঞতা। ২০০৫ সালে রবার্ট ইগার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন যখন কোম্পানি এ যাবৎ কালে সর্বাধিক সঙ্কটময় পরিস্থিতি অতিবাহিত করছে। তিনটি মূলনীতির উপর ভর করে তিনি এগুলেন এক. গুণগত মানের শ্রেষ্ঠতা বজায় রাখা, দুই. নিত্য নতুন প্রযুক্তির সাথে প্রতিযোগিতা না করে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিৎ করা এবং তিন. গন্ডির বাইরে বিশ্বব্যাপী নিজেদের চিন্তা-চেতনার প্রসার ঘটানো। চৌদ্দ বছরে তিনি ডিজনিকে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মর্যাদাসম্পন্ন মিডিয়া কোম্পানিতে রূপান্তর করলেন। এখন পিক্সার, মার্ভেল, লুকাসফিল্ম, টুয়েন্টি ওয়ান সেঞ্চুরি ফক্স প্রভৃতি স্বনামধন্য কোম্পানির মালিক দা ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি। রবার্ট ইগারের লেখা “দা রাইড অফ এ লাইফ টাইম” সাপ্তাহিক ‘বাংলা কাগজ’এ ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন উন্নয়ন সংগঠক ও অনুবাদক কোরবান আলী)

অষ্টাদশ.
পঞ্চম অধ্যায়
ডিজনিতে দ্বিতীয় অবস্থান
(পূর্ব প্রকাশিতের পর) আমি পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছিলাম। গত কয়েক বছর যাবৎ মাইকেল ওভিজের কাছে রিপোর্ট করতে যেয়ে চরম মানসিক উত্তেজনা আর হতাশায় ভূগেছি। এবিসিকে ডিজনির সাথে একীভূত করতে যেয়ে অমানসিক পরিশ্রম করেছি। ভীষণ মানসিক কষ্টের মুখোমুখি হয়েছি। নিশ্চিৎ করেছি আমাদের লোকজন কাজের এবং মূল্যবান। তাঁরা সম্মান পাবার যোগ্য। আত্মীকরণ প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করে চলেছেন। এ সমস্ত বিষয়ে ডিজনি কখনও কোন ধরনের চিন্তা মাথায় নেয়নি। ডিজনির জন্য আমি নিজে একটা আন্তর্জাতিক সাংগঠনিক কাঠামো নির্মাণ করেছি এবং তা বাস্তবায়ন করেছি। যা করতে যেয়ে আমাকে একবছরেরও বেশি সময় ব্যাপী দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। পরিবার পরিজনদের সময় দিতে পারিনি। এতসব কর্মযজ্ঞের মধ্যে দিয়েও আমি সবসময় মাইকেলের রক্ষাকবচ হিসেবেই কাজ করেছি। আমি তাঁর একান্ত অনুগত ছিলাম। আর এখন আবার আমাকে শুনতে হল ‘পদন্নতি পাবার যোগ্যতা আমার নেই’। পঁচিশ বছর আগে ১৯৭৫ সালে আমার প্রাক্তন বস একই কথা আমাকে বলেছিলেন।

টমকে বলেছিলাম আমি পদত্যাগ করবো না। বছর শেষে আমি একটা বোনাস পাবো আমি সেটা হারাতে চাই না। যদি মাইকেল আমাকে পদচ্যুত করতে চান তবে আমি তাঁর কাছ থেকেই সেটা সরাসরি শুনতে চাই। আমি ফোন কেটে দিলাম এবং চোখেমুখে শান্ত ভাব ফিরিয়ে আনলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম উইলোকে বলবো না। আমরা এখন ছুটি কাটাতে এসেছি। আমি সবকিছু বিষাদময় করতে চাই না। উইলো সে সময়ে সিএনএন টেলিভিশনে জনপ্রিয় উপস্থাপক। মানিলাইন যৌথভাবে উপস্থান করে আর এক ঘন্টার একটা অর্থনৈতিক সংবাদ পরিবেশন করে। তার পেশাগত জীবন উর্ধ্বমূখী ছিল। কাজের চাপও ছিল ব্যাপক।
এতদসত্বেও সে ম্যাক্সের জন্য সময় ও শক্তি দুটোই বের করে আনতে সক্ষম হয়েছিল। সে ম্যাক্সের চমৎকার মা। উইলো এতসব কর্মযজ্ঞ থেকে খানিকটা বিরতি চেয়েছিল তাই আমারা কটাদিন বাইরে কাটানোর সিদ্ধান্ত নেই। আমার মধ্যে যে ঝড় বইছে সেটা নিউ ইয়র্কের বাসায় না ফেরা পর্যন্ত চাপা দিয়ে রাখলাম।

যে কোন খারাপ পরিস্থিতির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নিলাম আর অপেক্ষা করতে থাকলাম। সেপ্টেম্বের মাসে আমি ডিজনির হেড অফিস, বারব্যাঙ্ক গেলাম। মাইকেল আমাকে দেখা করতে বলেছেন। আমি নিশ্চিৎ ছিলাম এটিই আমাদের শেষ দেখা। আমি নিজেকে স্পাৎ কঠিন করে মাইকেলের অফিসে ঢুকলাম। যে কোন তান্ডবের জন্য আমি প্রস্তুত। তাঁর সামনা সামনি একটা চেয়ারে বসে অপেক্ষা করতে থাকলাম। মাইকেল জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি লস অ্যাঞ্জেলেসে স্থায়ীভাবে স্থানান্তর হবার জন্য প্রস্তুত? এখানে আমাকে কোম্পানি পরিচালনার কাজে সহযোগিতা করবেন। আপনার কি মনে হয়?’

তিনি কি বলতে চাচ্ছেন সেটা বুঝতে আমার এক মুহূর্ত সময় লেগে গেল। প্রথমত আমি বিভ্রান্ত হয়েছি তরপর শঙ্কামুক্ত হলাম। এটা কি বিশ্বাসযোগ্য আমি নিশ্চিৎ হতে পারছিলাম না। শেষে আমি বললাম, ‘মাইকেল, আপনার কি কোন ধারনা আছে আপনি আমার প্রতি কি পরিমান অসামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ করে চলেছেন?’ মাত্র চার সপ্তাহ আগে এক টেবিল মানুষের সামনে তিনি বলেছেন আমি কখনোই তাঁর উত্তরসূরী হতে পারবো না। এখন তিনি বলছেন স্থায়ীভাবে ক্যালিফর্নিয়া চলে আসতে। অর্থাত উইলোকে তার বিশাল চাকুরীর মায়া ত্যাগ করতে হবে। আমি বললাম, ‘আপনি কি বলছেন আমাকে পরিষ্কার করে বলুন।’

তাঁর প্রতিক্রিয়া আমার প্রত্যাশার চেয়েও স্বচ্ছ ছিল। তিনি বললেন আমি লস অ্যাঞ্জেলেসে ফিরে আসতে পারবো কিনা সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিৎ নন। সেটি তাঁর উদ্বেগের কারণ। তিনি বললেন বড় সমস্যা হচ্ছে তিনি যদি প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা পদে আমাকে বসান তবুও আমি তাঁর সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবো। অনুমান করে বলা যায় তিনি ভয় করছেন যে কোম্পানির সংকটপূর্ণ মুহূর্তে বোর্ড তাঁকে সরিয়ে প্রিয়ভাজন কারও স্মরণাপন্ন হতে পারে, তাঁকে পদচ্যুত করতে পারে। সত্যিকারর্থে আমি কিন্তু এ বিষয়ে মোটেই নিশ্চিৎ নই।
আমি বললাম, ‘মাইকেল, আপনাকে দোষারোপ বা আক্রমণ করার কোন ইচ্ছাই আমার নেই। গোপনে আপনার ক্ষতিসাধন করার কুপ্রবৃত্তি আমার মধ্যে কখনই কাজ করে না।’ আমি তাঁকে আরও বললাম কোন একদিন হয়তো আমি এ কোম্পানি পরিচালনার দ্বায়িত্ব পাবো। সেটা আমার জন্য সুখকর হবে তাতে কোন সন্দেহ নায়। তবে খুব দ্রুত এটি ঘটবে আমি সেটা বিশ্বাস করি না। আমি বললাম, ‘আমি কখনও চিন্তাও করতে পারি না আপনি আমাদের ছেড়ে যাবেন। বোর্ড আপনাকে চলে যেতে বলবে এটা আমার কল্পনার বাইরে।’ এটি সত্য আমার চিন্তার মধ্যে এ রকম বিষয় কখনও আসেনি। আমরা কেউই মসৃণ সমতলে বসবাস করি না এটি সত্য। তবে এ বিষয়ে মাইকেলের মনে কোন দ্বিধাদ›দ্ব থাকা উচিৎ না। তিনি এখনও পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানিত প্রধান নির্বাহীদের মধ্যে একজন।

কোন সিদ্ধান্ত ছাড়াই মিটিং শেষ হয়ে গেল। মাইকেল আমাকে কোন পদের জন্য প্রস্তাব করলেন না। তিনি কোন লিখিত পরিকল্পনার কথাও কিছু বললেন না। আমি নিউ ইয়র্কে ফিরে গেলাম। অপেক্ষা করতে লাগলাম এ বিষয়ে আরও কিছু শোনার জন্য। কিন্তু এক মাসের আগে কোন কিছুই শোনা গেল না। দা লিয়ন কিং মঞ্চায়নের প্রথম প্রদর্শনী অনুষ্ঠানে আমরা লন্ডনে উপস্থিত ছিলাম। মাইকেল আমাকে লস অ্যঞ্জেলেসে তাঁর সাথে ফেরার জন্য পরামর্শ দিলেন, বললেন সেখানে আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা হবে। আমার ভ্রমণসূচিতে লন্ডন থেকে চীন যাবার কথা। কাজেই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম কয়েক সপ্তাহ পরে আমরা লস অ্যঞ্জেলেসে মিলিত হবো বিস্তারিত জানার জন্য।

ডিসেম্বরের শুরুতে মাইকেল অবশেষে আমার জন্য একটা প্রস্তাবনা পেশ করলেন। সেখানে আমাকে কোম্পানির প্রেসিডেন্ট, প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা এবং ডিজনি বোর্ডের একজন সদস্য করার প্রস্তাব ছিল। মাত্র কয়েক মাস আগে টমের সামনে মাইকেল আমার সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছিলেন সেটি এক ধাক্কায় ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। আমার প্রতি তাঁর গভীর আস্থার কথায় প্রতিফলিত হল।

আমি দ্রæত স্যান্ডি লিটভ্যাকের সাথে আমার নিজের চুক্তিনামার জন্য শলাপরামর্শ সেরে ফেললাম। তিনি নিজেকে প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা ভাবতেন পাশাপাশি আমাদের সাধারণ পরামর্শক ছিলেন। তিনি আমার নতুন পেশাগত মর্যাদায় খুশি হন নায়। আমার নতুন পদমর্যাদা ঘোষণার একদিন আগে স্যান্ডি আমাকে ডেকে চুক্তিনামাটা পরিবর্তন করার কথা বললেন। বললেন আপনি প্রেসিডেন্ট আর প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা হওয়ার চেয়ে নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট হন এবং বোর্ড সদস্য হবার প্রয়োজন নেই। আমি স্যান্ডিকে বললাম আমি প্রেসিডেন্ট, প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা এবং বোর্ড সদস্য ছাড়া কিছুই হতে চাই না। এক ঘন্টা পরে তিনি আমাকে ডেকে আনলেন এবং তিনটিই নিশ্চিৎ করলেন। পরের দিন আমার উপরোক্ত তিনটি পদের কথা ঘোষণা হয়ে গেল।

পেশাগত জীবনে এটি একটা অসাধারণ সুযোগ। আমি একদিন এ কোম্পানির প্রধান নির্বাহী হবো তার কোন নিশ্চয়তা নেই তবে কমপক্ষে নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ পাচ্ছি। ব্যক্তিগতভাবে এটি আমার জন্য আর একটা জটিল পদক্ষেপ। তখন আমার বাবা-মা সত্তরের শেষের কোঠায় পা রেখেছেন। তাঁদের এখন আরও বেশি আমার সহযোগিতার প্রয়োজন। আমার কন্য দুজনের একজন একুশ বছর আর একজন আঠার বছর বয়স। আমি তাদের ছেড়ে দেশের আর এক প্রান্তে যেতে চাই না। সিএনএন উইলোকে লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে তাঁর শোগুলো স¤প্রচারের সুযোগ করে দিতে রাজি হয়েছে। বিনোদন শিল্প ও নতুন প্রযুক্তির কারণে তা হয়তো সম্ভব কিন্তু বাস্তবায়ন করা বেশ জটিল। উইলো অপ্রত্যাশিতভাবে আমার সহায়ক ছিল। আমার প্রতিটা পদক্ষেপে আমাকে সাহায্য সহযোগিতা করেছে। আমার প্রতি মনোযোগের কোন ঘাটতি কখনও তাঁর মধ্যে দেখিনি। এক দশক পরে আর একজন স্ত্রীকে আমার পেশাগত কারণে তাকে তার নিজের পেশাগত সুখ স্বাচ্ছন্দ ত্যাগ করে আমাকে সেবা দেয়ার জন্যে লস অ্যাঞ্জেলেসে যাবার জন্য অনুরোধ করতে হচ্ছে।
দশ লক্ষ বছরেও অনুমান করা সম্ভব না আমাদের ভাগ্যে কি আছে। ডিজনি বা মাইকেল বা আমার ভাগ্যে কি ঘটবে কে জানে। জীবনের ঘটনা প্রবাহগুলো এমনই অনিশ্চিৎ। আমার এতদিনের সংগ্রামের পরিসমাপ্তি ঘটল। আমি যা চেয়েছিলাম তা শেষ পর্যন্ত পেলাম। আর আমাদের কষ্টময় জীবনের এখানেই শুরু।

ষষ্ঠ অধ্যায়
চমকপ্রদ ঘটনার প্রত্যাশায়
আমি প্রায়ই বলতাম মাইকেল ওয়াল্ট কোম্পানিটিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠা করেছেন। ১৯৮৪ সালে যখন তিনি ডিজনির দ্বায়িত্বভার গ্রহণ করলেন তখন তার গৌরবময় দিনগুলো ছিল দূরবর্তী স্মৃতি। ১৯৬৬ সালে ওয়াল্ট যখন মারা যান তখন থেকেই ডিজনি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। ওয়াল্ট ডিজনি স্টুডিও আর অ্যানিমেশন বেহাল দশায় নিপতিত হয়েছিল। ডিজনি ল্যান্ড আর ওয়াল্ট ডিজনি ওয়ার্ল্ড তখনও জনপ্রিয়। কোম্পানির চারভাগের তিনভাগ আয় ওখান থেকেই আসতো। মাইকেলের আসার দুবছর আগে ডিজনির আয় শতকরা ২৫ ভাগ কমে যায়। ১৯৮৩ সালে লুটেরা স্টেইনবার্গ ডিজনি দখল করতে চেয়েছিল। এর পর অনেকেই ডিজনি অধিগ্রহণের প্রচেষ্টা চালায়। ফলে ডিজনি কেবলমাত্র টিকেছিল। (চলবে)