খুরশীদ শাম্মী : রাজনীতি একটি বহুমুখী শব্দ। রাজনীতি নিয়ে কথিত আছে ইতিবাচক ও নেতিবাচক অজস্র মন্তব্য। রাজনীতি যেমন অধিকার আদায়ের মাধ্যম, বিদ্রোহ, ঠিক তেমন আপোষ মীমাংসা, শান্তির একটি প্রধান সূচক। বহুমুখী জনগণের বহুমুখী অভিমতের ভিত্তিতে একটি দেশে একাধিক রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে এবং নির্বাচনের মাধ্যমে দলনেতা ও রাষ্ট্রপ্রধান নির্ধারিত হয়। আবার ওই দলনেতাগণ ও রাষ্ট্রপ্রধান জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন। রাজনীতির মাধ্যমে জনগণের অধিকার-অনাধিকার, চাওয়া-পাওয়াগুলো বিচার বিবেচনা করে সকলের কল্যাণের জন্য রীতিনীতি নির্ধারন করা হয়ে থাকে। সুতরাং বলা যায়, জনতা ও জননেতাগণ রাজনীতির চাবিকাঠি।
“সুষ্ঠু রাজনীতি একটি দেশের মেরুদণ্ড” বলেই আমার বিশ্বাস। আবার এও বিশ্বাস করি, জননেতাগণ কোনো দেশের রাজনীতির মাপকাঠি। রাজনীতি কোনো ব্যক্তির একক সত্তা নয়, ইহা জনগণের চাহিদা, ইচ্ছা শক্তির ধারকও বটে। জনগণই নির্বাচিত করে রাজনৈতিক নেতাবৃন্দ। দক্ষতা, যোগ্যতা, স্বার্থহীনতা ও বিচক্ষণতা যখন নেতৃত্ব গঠনের ভিত্তি হয়, রাজনীতি তখন সামগ্রিক কল্যাণের পক্ষেই থাকে। তবে, রাজনীতিতে এর ব্যতিক্রমও দেখা যায় অহরহ।
বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্ব স্থানীয় একটি দেশ বহুদিন ধরে। তাদের মোড়লি কর্তৃত্ব যেমন প্রমাণিত হয় বারবার, তেমন বিশ্বের দরিদ্র ও দুর্বল দেশগুলোকে সাহায্যও করে প্রয়োজনে। পররাষ্ট্রনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের দু’টো দলই এক ও অভিন্ন প্রমাণ করেছে বহুবার। পাশাপাশি নিজেদের দেশে গণতান্ত্রিক প্রথাকে সম্মান করার একটি নিয়মও গড়ে তুলেছে তারা। ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে দেশের প্রচলিত নির্বাচন আইন ও ফলাফলে সম্মান করার প্রমাণ রেখেছেন অতীতের প্রায় সকল রাষ্ট্রপ্রধান।
তবে, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন আইন ও ফলাফলে বাধ সাধলেন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান ও ৪৫তম রাষ্ট্রপ্রধান ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি ২০২০ সালের নির্বাচনে নিজের পরাজয়কে মেনে নিতে পারছেন না। একের পর এক বৈধ ও অবৈধ উপায়ে নির্বাচনের ফলাফল পাল্টের দেয়ার চেষ্টা করছেন গত দুইমাস ধরে। তিনি ক্রমাগত মিথ্যা অভিযোগ তুলে ভোট পুনর্গণনা করিয়েছেন কোথাও একাধিকবার, আদালতের শরণাপন্নও হয়েছেন। আদালতে হেরেছে তার মামলাগুলো বারবার। এমন কি ভিত্তিহীন, যুক্তিহীন, প্রমাণহীন মামলাগুলো শুরুতেই শেষ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন বিচারক। তার সর্বশেষ রক্তবিহীন অবৈধ প্রচেষ্টা ছিল, নির্বাচনে বিজয়ী জোসেফ আর বাইডেন (জো বাইডেন) এর বিজয়কে যুক্তরাষ্ট্র সিনেটের অফিসিয়াল সার্টিফাইড অনুষ্ঠানের পূর্বে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকে তার কর্তব্য যথাযথভাবে পালন না করার জন্য অনুরোধ করা। ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স তার অনুগত থাকলেও আইনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে তিনি তার অনুরোধ প্রত্যাখান করেন।
ধনকুবের ডোনাড ট্রাম্প শূন্য হাতে ফিরে যাওয়ার লোক নন। বিকল্প পদ্ধতিতে তিনি তার সমর্থকদের আমন্ত্রণ জানান যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে জানুয়ারির ৬ তারিখ, সিনেট কর্তৃক যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট জোসেফ আর বাইডেনের বিজয়কে সরকারিভাবে ঘোষণার দিন। তিনি তার সমর্থকদের সাথে থাকার অঙ্গীকারও করেন।
হ্যাঁ, জানুয়ারি ৬, ২০২১ যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল হিলে সিনেট অধিবেশ চলাকালে হামলা করে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধান ডোনাড ট্রাম্পের অন্ধ সমর্থকেরা। তারা স্লোগান দিয়ে স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি ও ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকে মারার উদ্দেশ্যে খোঁজে। তাদের না পেয়ে তারা ভাঙচুর করে কয়েকটি কক্ষের চেয়ার টেবিল, কম্পিউটার, ফাইলপত্র। প্রাণ হারায় একজন পুলিশ অফিসারসহ মোট পাঁচজন। এর দায় পুরোপুরি কিন্তু ডোনাড ট্রাম্পের ওপরই পড়ে। একজন বর্তমান প্রেসিডেন্টের প্রশ্রয়ে ডোমেস্টিক টেরোরিস্ট দ্বারা ক্যাপিটল হিলে সন্ত্রাসী হামলা রিপাবলিকান দল ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য যেমন লজ্জার তেমন ভয়াবহও।
একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেই ক্যাপিটল হিলে হামলার হুকুমদাতা। তার মতোন একজন অযোগ্য, অদক্ষ, স্বার্থপর রাষ্ট্রপ্রধানের ক্রমাগত মিথ্যা ও ভিত্তিহীন মন্তব্যের ফলে হাজার হাজার অন্ধ-সমর্থকেরা এমন রক্তক্ষয়ী এক সংঘর্ষের সিদ্ধান্ত নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে জানুয়ারি ৬, ২০২১ এক কালোদিন। গণতন্ত্র চর্চার সর্বনিকৃষ্ট একদিন।
এই কালোদিন কিন্তু একদিনে সৃষ্টি হয়নি। গত চারবছর ধরে মহড়ার পর মহড়ায় গাঁথা হয়েছিল এই আঁধার দিনের চিত্রপট। বিজ্ঞজনেরা ভয়াবহতা অনুমান করতে পারলেও গণতন্ত্রের অজুহাতে তার বিরুদ্ধে কোনো কঠিন পদক্ষেপ নেয়নি কর্তৃপক্ষ। ডোনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্নভাবে বারবার বলেছেন, “উই উইল মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন” অর্থৎ আমরা আমেরিকাকে পুনরায় মহান করব। হ্যাঁ তিনি আমেরিকাকে পুনরায় মহান করেছেন বৈকি। বিগত চার বছর তার যুক্তিহীন ক্রিয়াকলাপ ও মন্তব্যে অতিষ্ঠ হয়ে জনগণ প্রথম টার্মের পর দ্বিতীয় টার্মে তাকে পরাজয় উপহার দিয়েছেন, তার দল রিপাবলিকান কংগ্রেস ও সিনেট সংখ্যাগরিষ্ঠতাও হারিয়েছে, বর্তমানে ক্ষমতা পুরোপুরি ডেমোক্রেটিকদের দখলে। রক্তক্ষয়ী হামলার পরও কিন্তু থেমে থাকেনি সিনেট অধিবেশন। অবস্থা নিয়ন্ত্রণে এলে ওই রাতেই শুরু হয় নির্বাচন ফলাফল ঘোষণা আনুষ্ঠানিকতার বাকি অংশ। তারা অপেক্ষা করেনি। ভোর চারটা পর্যন্ত চলে অধিবেশন, অত রাতেও কংগ্রেসম্যান ও সিনেটরদের মতামত ও ভোট গণনা করা হয়েছে আইন অনুযায়ি। তারা আইনের প্রতি সম্মান দেখিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও টুইটার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছে। ক্ষমতার চার বছরে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য ২য় বারের মতো ইম্পিচমেন্টের প্রস্তুতিও চলছে, যদিও তার ক্ষমতার মেয়াদ বাকি আছে আর মাত্র বারোদিন। সুতরাং, জানুয়ারি ৬, ২০২১ কিন্তু এক অর্থে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের সর্বশ্রেষ্ট একটি দিনও।
খুরশীদ শাম্মী, টরন্টো, অন্টারিও