আতোয়ার রহমান : কানাডায় আসার এক বছরের মাথায় বউ পালাবে রাশেদ সেটা ভাবতেই পারেনি। তবে বউ পালানোর পর তার এদেশে আসার উৎসাহ উদ্দীপনা ও উত্তেজনাগুলো মরে গেছে। ওর বুকটা জ্বলে যাচ্ছে, মনটা হু হু করছে। পোকায় খাওয়া শস্যহীন বিবর্ণ ধানক্ষেতের মতো ওর মনটা ধূসর ঝাপসা। শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। এমনিতে প্রেসারের রোগী। এখন রক্তচাপ আরো বেড়ে গেছে। প্রচণ্ড পানির পিপাসায় একটু পরপর গলা শুকিয়ে যায়। ঘন ঘন পানি খায় আর তার ছয়তলার ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে হাঁটাহাঁটি করে। নাজমা এত দ্রুত বদলে যাবে জানতে পারলে সে তাকে স্পন্সর করত না।

এই কয়েকদিনে রাশেদের বয়স যেন বেড়ে গেছে কয়েক বছর। শুয়ে-বসে, টেলিভিশন দেখে আর বাসি খবরের কাগজ পড়ে সময় কাটে। বন্ধুদের সাথে কফি খেয়ে ড্যানফোর্থের কান্ট্রিস্টাইলে সে আর আড্ডা দেয় না। পুরোপুরি লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেছে। মাস দুয়েক কাটল বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে লুকোচুরি করে। কিছুটা নিজের মনের সঙ্গেও। রাস্তায় বের হলে মাথা নিচু করে হাঁটে। সবসময় তটস্থ থাকে, এই বুঝি পরিচিত কেউ পিছন থেকে উচ্চস্বরে ডেকে উঠল।বন্ধুরা জানলে আড়ালে আবডালে বলাবলি করবে। ভাঙাচোরা একটা সংসার, সন্দেহজীর্ণ একটা মন নিয়েই তাকে কাটাতে হবে বাকি জীবন। বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন সকলের সামনে মাথা নিচু হবে। সে মনকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করল।

দিনে কয়েকবার গোসল করে বাথরুমের সুপরিসর হাউজে। নামাজ পড়ে সময় মতো। সারাদিন দোয়া করতে থাকে এ জীবন বিপর্যস্তকারি বিপদ থেকে মুক্তির প্রত্যাশায়। রাশেদ অত্যন্ত শক্ত ধাঁচের মানুষ। কোন কিছুতে সহজে ভেঙে পড়েনা। কিন্তু এবার ভেঙে পড়েছে। জীবনে অনেক ধাক্কা সামলিয়েছে সে। কিন্তু এবার এ ধাক্কা সামলাতে পারবে বলে তার মনে হচ্ছে না। সে জানে সংকটের সময় ঘাবড়ালে চলেনা, বিপদে মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। কিন্তু এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে এবার সে চরম অসহায় বোধ করছে। এটা এত দ্রুত ঘটে গেছে যে তার এ নিয়ে চিন্তা করার সময় হয়নি, শুধু তার পরিণতি ভোগ করা ছাড়া। তাছাড়া এখন তার বয়স হয়েছে। ইচ্ছে করলেও সে এখন নতুন করে জীবন শুরু করতে পারবে না। তাদের এই ছন্দহীনতা, তাদের এই বিচ্ছেদ এর জের টানতে হবে তার সন্তানদেরও। এর প্রভাব পড়বে তাদের ফুটফুটে চাঁদের মত দুটি সন্তান – ছয় বছরের সিয়াম আর চার বছরের বন্যার ভবিষ্যতের ওপরেও। ইতিমধ্যে তারা মানসিক ভাবে বেশ মুষড়ে পড়েছে, হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। খাবারদাবার, খেলাধুলা ও পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ কমে গেছে।

পর পর কয়েক রাত অনেক চেষ্টা করেও এক ফোটা ঘুমোতে পারেনি। কাল সারা রাত বিছানায় এপাশ ওপাশ করেছে। ঘুম আসেনি চোখে। চোখ দুটো কোটরে ঢুকেছে, পান্ডুর বর্ণ ধারণ করেছে। জীবন তার কাছে একেবারে অসহ্য মনে হচ্ছে। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আনন্দই তার অন্তর্হিত হয়েছে। এরকম দুর্বিষহ পরিস্থিতে জীবনে আর কখনো পড়েনি। এটা তার কাছে মৃত্যুর মতই বেদনাদায়ক মনে হচ্ছে। আজকাল স্বপ্নে তার মরা মায়ের মুখ দেখে, ফেলে আসা দেশের ছবি দেখে। মৃত্যুর আগে মানুষের মনে প্রিয় মুখ ভাসে। বিদেশ-বিভুঁইয়ে বিপদে পড়লে এমনকি মরে যাবার সময় মা ও মাটি তথা দেশের কথাও কি মনে আসে? একসময় সেই ভয়ংকর দূর্বিসহ রাত কেটে গিয়ে ভোরের নরম মাখম আলো ছড়িয়ে পড়ে অন্ধকার ঘরের ভেতর। সিদ্বান্ত নেয় ডাক্তারের কাছে যাবে।

এখন সে বুঝতে পারে দেশে থাকতে তার কলেজ জীবনের বন্ধু প্রকৌশলী রায়হান বিবাহ বিচ্ছেদের পর কেন ট্রেনের নিচে লাফ দিয়ে আত্মাহুতি দিয়েছিল। কেন তারই মত টরন্টো অভিবাসি এক বাঙালি কয়েক বছর আগে বউ পালানোর যন্ত্রনা সইতে না পেরে আঠার তলা থেকে লাফিয়ে পড়েছিল। আর এক ব্যবসায়ী বন্ধু চয়ন কেন মাদকাসাক্ত হয়েছিল। যে চয়ন সিগারেট পর্যন্ত খেত না, সে কিনা রুমকী ভাবির সঙ্গে বিচ্ছদের পর দিনরাত মাদকে ডুবে গেল। নানা দুশ্চিন্তা তার মনেও আসে। মাঝে মাঝে মনে হয় সেও গলায় দড়ি দিবে। অসহ্য বোধ হলে ঘরে থাকা তেলাপোকা মারার বিষের শিশিটির দিকে তাকায়। কিন্তু নিষ্পাপ ফুটফুটে দুটি সন্তানের কথা ভেবে সে নিজেকে আতœহননের পথ থেকে নিবৃত্ত করে। প্রিয় মানুষের কাছ থেকে পাওয়া ব্যথা সহ্য করাই বোধ হয় পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন কাজ।

বন্ধুরা তাকে আগেই সতর্ক করেছিল। বলেছিল কানাডা আসার কিছুদিনের মধ্যে আমাদের দেশের কিছু মেয়ে এমনিতে বদলে যায়। কানাডার মতো অত্যাধুনিক ও অগ্রসর দেশের চাকচিক্য ও জৌলুস দেখে তারা রনহুঙ্কার দেয়। এখানে ডিভোর্সের হার পঞ্চাশ শতাংশ, ডিভোর্স-বান্ধব সমাজ এটা। এখানে বাঙালি কম্যুনিটির মধ্যেও ডিভোর্স দেয়ার প্রবণতা বাংলাদেশের তুলনায় বেশি। বাংলাদেশে ডিভোর্সকে যতটা সিরিয়াসলি নেওয়া হয়, এখানকার পাশ্চাত্য সমাজে ততটা সিরিয়াসলি দেখা হয় না। অনেকে জন্মবার্ষিকী, বিবাহবার্ষিকীর মত ডিভোর্স বার্ষিকী পালন করে থাকে।বন্ধুদের সতর্কতা সত্বেও সে তাকে স্পন্সর করেছে।এখন মনে হচ্ছে নাজমাকে এদেশে নিয়ে আসাটা চূড়ান্ত বোকামি হয়েছে।
ওদের বিবাহিত জীবন মোটামুটি আনন্দময় ও সুখেই কাটছিল। মাঝেমধ্যে সামান্য ঝগড়াঝাটি যে হয়নি তা নয়; তবে সেটা কখনই খুব বেশীদূর গড়ায়নি; পরের দিন সেসবের সব কিছুই তারা ভুলেও গেছে। এই আট বছরে নাজমাকে রাশেদ সময় পেলেই ভালবাসার কথা শুনিয়েছে, সোহাগে আদরে ভিজিয়েছে। প্রতিদানে নাজমাও রাশেদকে সব দিয়েছে। শরীর, সংসার, সুখ আর দুটি সন্তান। একজন স্নেহময় পিতা ও প্রেমনিষ্ঠ স্বামী হিসেবে সংসারের প্রতি কর্তব্য রাশেদ অবিচলচিত্তে পালন করেছে।

নাজমার সঙ্গে তার টুকটাক ঝগড়া হওয়ার কথা বন্ধুরা জানত। তাই তাকে আগেই সতর্ক করেছিল। কিন্তু রাশেদ বুঝতে পারত না দু দুটি সন্তানের মা নাজমা কি করে ডিভোর্সের মত চুড়ান্ত সিদ্বান্ত নিতে পারবে। বাচ্চাদের কথা ভেবে হয়ত সংযত হবে। যে নারী দেশে একই ছাদের নীচে দীর্ঘ আট বছর সংসার করেছে, ভালোমন্দে, সুখেশান্তিতে একে অপরের পাশে থেকেছে, সেই একই নারী এদেশে আসার এক বছরের মধ্যে সামান্য কলহের জের ধরে কিভাবে সংসার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্বান্ত নেয় তা রাশেদের মাথায় ঢোকে না।

অভাব আর দারিদ্র্যের সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম করা রাশেদ নিজ মেধার গুনে একটা বহুজাতিক কোম্পানিতে কাজ পেয়েছিল বছর দশেক আগে। সে সুবাদে আজ এখানে তো কাল ওখানে। চট্টগ্রামে নতুন ব্রাঞ্চ খুলেছে, বস তাকে ওখানে পাঠাল ওটাকে চালু করে দেয়ার জন্য। দু সপ্তাহ পরে পাঠাল রাজবাড়িতে অফিসের টার্গেট পুরণের জন্য। তার পর এক সময় নীলফামারী, আরেক সময় সারিয়াকান্দি। এক জায়গায় কোথাও থিতু হতে পারল না সে। এভাবে পরিযায়ী পাখির মতো অবিরাম জায়গা বদলানোর কারণে কারও সঙ্গে তার অর্থপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠল না। পরিবারকে যে নূন্যতম সময়টুকু দেয়া দরকার তা দেয়া হয়নি। যদিও পরিবারের মৌলিক চাহিদাগুলো পুরণ করার পরও বাড়তি কিছু দেয়ার সামর্থ্য এখন তার হয়েছে। বলা হয়ে থাকে মৌলিক চাহিদাগুলো বাদ দিয়ে একজন মানুষের সামাজিক প্রাণী হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য যে জিনিষটির সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তা হলো মানুষের সঙ্গ, প্রিয়জনের সঙ্গ। এ জায়গাটিতে রাশেদের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে।

গত পরশু ভোরে রাশেদ ঘুম থেকে উঠে দেখে পাশে নাজমা নেই। তার দিকের বিছানাও নেই। ঘরের দরজাটা ভেড়ানো। চারিদিকে তাকিয়ে দেখল, নাজমা কোথাও নেই। আলমারি খোলা, কাপড়চোপড়ও কম কম লাগল। নিমিষে অজানা একটা আশঙ্কা তার মেরুদন্ড স্পর্শ করল। কাকে ফোন করে নাজমার খোঁজখবর করবে রাশেদ? বন্ধুদের বললে হাসিঠাট্টা, টিটকারি ফিটকারি করবে। পুলিশে খবর দিবে? কিন্তু এখানকার পুলিশ নাকি এসবক্ষেত্রে স্বামীদেরকেই অভিযুক্ত করে। সে অন্যদের কাছ থেকে শুনেছে। কার সঙ্গে পালিয়েছে নাজমা? তার সন্দেহের আঙুল যায় সোবহান সাহেবের দিকে। সোবহান সাহেবের সঙ্গে ফোনে নাজমাকে কথা বলতে দেখেছে রাশেদ দু একদিন। দুজনে নায়াগ্রায় বেড়াতে গেছে। হাতে হাত। ঝর্ণার ধারে পাশাপাশি, মুখ থেকে ঝর্ণার জলের মতো গলে পড়ে হাসি। কানাঘুষো শুনে তার দম বন্ধ হবার যোগাড়।

মাস দুয়েক হল নাজমা ডাউন্টাউনে একটা রেস্তরাঁয় কাজ নিয়েছিল। বাঙালি মালিক। নাম আব্দুস সোবহান। অনেকদিন হল এদেশে এসেছে। একরকম খালি হাতে এলেও এখন প্রচুর অর্থ-বিত্তের মালিক। এরকম তিনটি রেস্তরাঁর মালিক। প্রশ্নবোধক চরিত্রের মানুষ। তার সম্পর্কে অনেক কথা রাশেদের কানে এসেছে। এ পর্যন্ত দুজন স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়েছে। এর আগেও সে একবার পরের বউ চুরি করেছে। শোনা কথা দেশেও তার একজন স্ত্রী রয়েছে। গোপনে তাকে টাকা পয়সা পাঠায়। ডাউন্টাউনে দামী কন্ডোতে থাকে। মধ্য বয়সী, তবে চেহারার মধ্যে একটা প্লেবয় ভাব আছে। দুহাতে অঢেল টাকা পয়সা খরচ করে।

তার পরিচিত পদ্ধতিতে নাজমার সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করে। অন্য কর্মচারীদের চেয়ে নাজমাকে একটু বাড়তি সুবিধা দেয় এবং এভাবে দিনে দিনে তারা ঘনিষ্ঠ হয়। টাকাই কি সব? ঘর-সংসার, সন্তান সন্ততি কি টাকার চেয়ে বেশি মুল্যবান নয়? নানান ভাবনা তার মাথায় এসে ভর করে। এর উত্তর সে কোথাও খুঁজে পায়না। অথচ ও যখন নতুন বউ হিসেবে এ বাড়িতে আসে তখন রাশেদকে বলেছিল, ‘তোমার কাছে আমি বেশি কিছু চাই না। তুমি যেভাবে রাখবে সে ভাবেই থাকব। তুমি আর আমি সারাজীবন রেললাইনের মত পাশাপাশি থাকব।’ ও যখন লাল বেনারসিতে মুখ ঢেকে ট্রেনে উঠল তখন ওর মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘সুখে থাক সারাজীবন।’ সেই নাজমা যে এত দ্রুত বদলে যাবে সেটা রাশেদের ভাবনাচিন্তার মধ্যে আসেনি। নারীচরিত্র সন্মন্ধে খুব ওয়াকিবহাল নয়, মেয়েদেরকে বড় আনপ্রেডিক্টেবল মনে হয় তার কাছে। মানব চরিত্র নানা বৈচিত্রে ভরা। আজ বড় দুঃখ বোধ হয় তার। কত ত্যাগ স্বীকারই না সে করেছে নাজমার জন্য। নিজে কষ্ট করে চাকরির সীমিত টাকায় বউয়ের নামে ঢাকার মিরপুরে তিন কাঠা জমি কিনেছে। এখন তাকে বড়ই অকৃতজ্ঞ মনে হয় রাশেদের।

নতুন দেশে নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর বিড়ম্বনায় জীবন যুদ্ধে ব্যস্ত থাকার কারণে সোবহানের সঙ্গে নাজমার এই গোপণ সম্পর্কের বিষয়টি রাশেদের চোখে পড়েনি। সংসারের ঈশাণ কোনে কখন যে ঝড় উঠেছে, বিপদের ছায়াপাত হয়েছে টের পায়নি। নাজমাকে খুশি করার জন্য, বউয়ের সঙ্গে আরো ঘনিষ্ঠ হওয়ার জন্য সে দেশে থাকতে তেমন সময় না পেলেও এখানে এসে সময় সুযোগ হয়েছে এবং সব কিছুই করেছে। এইতো কয়েকদিন আগে নায়াগ্রা থেকে ঘুরে এল। ফলসের পাশেই একটি হোটেলে রাতে থেকেছে। ফলসকে ঘিরে নানান রঙের বৃষ্টি তাদের জানালার কাঁচ গলে ঘরেও এসেছে। যেকোন নারীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার মতো একটি চমৎকার রোমান্টিক পরিবেশ। সে নাজমাকে কাছে খুঁজে পায়না।ঘুম থেকে উঠে পাশ ফিরে তাকাতেই একটু খটকা লাগে-নাজমা গেল কোথায়? সারা ঘর ঘাঁটাঘাঁটি করেছে। নাজমাকে ডাকে, ‘কই এসো?’ সে আঁতিপাতি করে খুঁজেছে। তার শরীর হাতড়িয়েছে।

‘এই তোমার মন কোথায়, অ্যাঁ? ব্যাপার টা কী?’ সে রাগে চিৎকার করে উঠেছিল।
ক্রমশ নাজমা বিষণ্ণ হয়ে উঠতে লাগল। মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে রাশেদ দেখতে পেত নাজমা জেগে বসে আছে। অবাক হয়ে বলেছে, কী হয়েছে নাজমা?
কই? কিছু হয়নি তো।
তোমার ঘুম আসছে না?
আসছে।

বলেই নাজমা আবার কম্বল গায়ে শুয়ে পড়ল। কিন্তু সে জেগে রইল। অথচ সে ঘুমের ভান করতে লাগল। রাশেদ বলল, নাজমা সত্যি করে বলো তো তোমার কী হয়েছে?
কিছু হয়নি।
কোথাও বেড়াতে যাবে?
কোথায়?
চল মন্ট্রীয়ল যাই।চমৎকার শহর মন্ট্রীয়ল। তোমার ভালো লাগবে। হোটেল ভাড়া করে থাকব।
নাজমা বলে, না।
না কেন?
উঁহু, ভাল্লাগেনা।

ইদানিং নাজমার আচার-আচরণে কেমন যেন পরিবর্তন চোখে পড়ে! মনের পরিবর্তন ধরতে পারার মত অভিজ্ঞ চোখ তার নেই। রাশেদ ভাবতে থাকল এরকম সুন্দরী একটি মেয়ের অকারণে বিষণ্ণ থাকার একটিই কারণ থাকতে পারে-তার কোন প্রেমিক আছে। নাহলে তার বউ এত উদাসীন কেন? আবার ভাবে অন্য কোন সমস্যাও থাকতে পারে। হয়ত এত বড় টরন্টো নগরীতে গাঁয়ের মেয়ে নাজমার মন বসছেনা। একা থাকতে থাকতে হয়তো হাঁপিয়ে উঠেছে এখানে। কোথায় পার্কে যেতে চাইবে, শপিং মলে যেতে চাইবে, গুনগুন করে গান গাইবে, নতুন শাড়ি, গয়নাগাটি পরবে-কোথায় কী! সারাক্ষন মনমরা, নির্লিপ্ত, নিঃস্পৃহ। রাশেদের মন ভারী হয়ে ওঠে সন্দেহের বিষে।

দেশে থাকতে রাশেদ ভালই ছিল। সে কানাডা আসতে চায়নি। নাজমার পীড়াপীড়িতেই সে কানাডায় অভিবাসী হওয়ার আবেদন করে। চাকরির ব্যস্ততার মাঝেও দুমাস ঘরদোর বন্ধ রেখে পড়াশোনা করে আইয়েল্টস পরীক্ষায় ভাল স্কোর করেছিল। সে সুবাদে দ্রুতই কানাডায় পাড়ি জমাতে পেরেছিল।

‘কবির ভাই কানাডায় গিয়ে কত উন্নতি করেছে। দামি গাড়ি-বাড়ি সবকিছু করেছে। বাচ্চারা ভাল স্কুলে পড়াশোনা করছে। আর তুমি কি করছ এখানে? সারা জীবন শুধু পড়াশোনা আর অফিস নিয়ে থাকলে। এতদিনে একটা মাথা গোঁজার ঠাই হলনা আমাদের । আমার সিয়ামের ও বন্যার কী হবে? তোমার বয়স হয়েছে। আল্লাহ না করুন তোমার যদি কিছু হয়ে যায়? কোথায় গিয়ে ওরা দাঁড়াবে? কবির ভাই যেতে পারলে, আর দশ জন যেতে পারলে, তুমি কেন যেতে পারনা কানাডায়?’ একনিঃশ্বাসে কথাগুলো গড়গড় করে বলেছিল নাজমা।

ইন্সুরেন্স অফিসের কাজ করতে করতে রাশেদের মনের মধ্যে বারবার একটি ভাবনাই খচমচ করতে লাগল, মিসিসাগায় দীর্ঘদিন থেকে বসবাসকারি নাজমার চাচাকে কি একবার ফোন করে জানাবে যে, তার ভাতিজিকে পাওয়া যাচ্ছেনা। বউ চলে যাওয়ার পর প্রথমেই মনে হয়েছে মিসিসাগায় বসবাসরত নাজমার চাচা আবু হেনার কথা। কিন্তু চাচা সহজ সরল হলেও একটু একরোখা ধরনের মানুষ। কোন কারণে যদি মনে করে রাশেদই দায়ী, তার আদরের ভাতিজির দুঃখের কারণ সে-ই, তাহলে বিষয়টা আরো জটিল হবে, তার ভোগান্তি আরো বাড়বে।

গ্রামের মেয়ে হলেও পড়াশোনায় ভালই ছিল নাজমা। প্রথম বিভাগে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছিল। বাবা মতি মাস্টার স্থানীয় হাই স্কুলের গণিতের শিক্ষক। তার এক পুত্র আর এক কন্যা নাজমা। নাজমাকে তাঁর আরও লেখাপড়া শেখানোর ইচ্ছা ছিল। মতি মাস্টারের মাথায় ঢুকেছিল ঢাকায় বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি করা ছেলের সঙ্গে তার মেয়ের বিয়ে দিবেন। তাই যখন রাশেদের প্রস্তাব পেল তখন দশ বছরের বড় হলেও এরকম ভাল চাকরি করা একটা পাত্র হাতছাড়া করতে রাজি হল না। একরকম তড়িঘড়ি করেই প্রস্তাব লুফে নিল। নাজমাকে একনজর দেখেই রাশেদও দ্রুত বিয়ের সিদ্বান্ত নিয়েছিল। ফর্সা টুকটুকে রঙ, গড়ন-পেটন ভাল, মিষ্টি ধারালো মুখ, সব মিলিয়ে দারুণ রোমান্টিক চেহারা। গুছিয়ে কথা বলতে পারে। শুধু পড়াশোনাটা একটু কম। তা বেশি শিক্ষিতের দরকার নেই। বিয়ে নিয়ে রাশেদও ভেতরে ভেতরে একটু অস্থির হয়ে পড়েছিল। বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের জোয়াল তার কাঁধেই পড়েছিল। ও এর আগেও কয়েকবার বিয়ের উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু অসুস্থ মায়ের কড়া নিষেধ। ছোট দুবোনের বিয়ে না দিয়ে কোন অবস্থাতেই সে বিয়ে করতে পারবে না। ছোট বোনদের বিয়ে পার করতে করতে মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়েছে। তাই সে এবার আর দেরি করতে রাজী নয়। শেষে তার দূর সম্পর্কের এক খালা সন্মন্ধ আনল তার জায়ের ভাইএর মেয়ের সঙ্গে। রাশেদ মরিয়া হয়ে খালাকে বলল, ‘আপনি যা বলবেন তাই,। আমি কী বলব? মারও বয়স হচ্ছে, দেখার লোক নেই’ ইত্যাদি অজুহাতে যমুনা পার হয়ে জামালপুরে সরিষাবাড়িতে মেয়ে দেখতে গিয়েছিল। সেই মেয়েকে বিয়ে করে কপালে এত দুর্ভোগ থাকবে, কে ভেবেছিল!

টরন্টো নগরীতে চারিদিকে আনন্দের উপকরন ছড়ানো। কত জমকালো চোখ জুড়ানো শপিং মল, সুদৃশ্য সি এন টাওয়ার, সেন্টার আইল্যান্ড, হারবার ফ্রন্ট, শাড়ির দোকান, পার্ক, বিচ আরও কত কী? ছুটির দিনগুলোতে দুদিন বউকে নিয়ে কেনাকাটা করতে বড় বড় মল ঘুরতে বেরিয়েছিল রাশেদ। চলন্ত সিঁড়িতে নাজমা ভয় পেয়ে তার হাত চেপে ধরেছিল। নাজমার জবুথবু চলাফেরা আর বিস্মিত চাহনি দেখে মজা পেয়ে তার পাশে আরো স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করেছে সে। ছোট শর্টস পরা মেয়েগুলোকে ঘুরতে দেখে নাজমা হাঁ করে চেয়ে থেকেছে। দোকানগুলোতে হরেক রঙের জামাকাপড় দেখে দম আটকে গেছে যেন তার। রাশেদ ভেবেছে টরন্টো নগরীতে কত আজব আজব জিনিস ছড়ানো ছিটানো আছে। কিন্তু নাজমার কি কোন কিছুতেই মন ভরেনা? মন টানেনা কিছুই! কতদিন নাজমাকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে গেছে রাশেদ, কিন্তু সে সব কিছুতেই আড়ষ্ট।কেন যে সে আড়ষ্ট হয়ে থাকে তা রাশেদ বুঝতে পারে না। আসলে শুরু থেকেই তাদের সম্পর্কটার ছন্দ কেটে গিয়েছিল, সে ধরতে পারেনি।

বিয়ের সময় রাশেদ ঘটা করে অনুষ্ঠান করেনি। বিয়ের খবর শুনে কমল দা বলেছিল, ‘ বউকে যদি ঠিকমত কন্ট্রোলে রাখতে পারিস, তাহলে তোদের মত সুখী দম্পতি আর কেউ হবে না। বুঝলি কিনা, একটু চাপে রাখা আর কী! একটু শাসনে, সোহাগে রাখবি,’ বলে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসেছিল কমল দা।

কমল দা লেখালেখি না করলেও দারুণ বই পড়ুয়া মানুষ। কোন এক লেখকের উদৃতি দিয়ে বলল, ‘আসলে বিয়ে হল অনেকটা তিন-পায়ে দৌড়ের সমগোত্রীয়। বাঁধা পা দু’টো একসঙ্গে আগে ফেলতে হয়। এক ছন্দে দৌড়াতে পারলে দিব্যি দৌড়াবে, কোনও ঝামেলা নেই। যে যার মতো দৌড়াতে গেলেই হুমড়ি খাবে দু’জনেই। সুতরাং হয় নিয়ম মেনে পা ফেলে ছোটো, নয়তো দড়িটা খুলে ফেলে যে যার নিজের পথে হাঁটো।’ নতুন বিয়ের পরপরই এমন ভারি তত্ত্বকথা তখন রাশেদ বুঝতে না পারলেও এখন সে বুঝতে পারছে কত খাঁটি কথা তিনি তখন বলেছিল। কমলদা আরো বলেছিল, বিয়ে-মুদ্রার দুটি পিঠ, কে কখন কোন পিঠ দেখবে অনুমান করা কঠিন, বুঝলি রাশেদ।’

‘ধন্যবাদ, কমল দা, আপনার উপদেশ মনে রাখার চেষ্টা করব’ বলেছিল রাশেদ।
ঢাকার আরামবাগের মেসে পাশাপাশি ঘরে থাকত কমল দা। সরকারি একটি ছোট অফিসের কেরানি। খুব বাস্তববুদ্বিসম্পন্ন মানুষ। এখনো ফোনে প্রায়ই কথা হয়, স্কাইপ-এ মোলাকাত হয়। রাশেদের ঘর সংসার নিয়ে পরামর্শ দেয়। সঞ্চয়ের কথা বলে। একদিন কথায় কথায় কমলদাকে সে তার সন্দেহের কথা বলেছিল। কমলদার পরামর্শেই সে বউয়ের উপর স্পাইগিরী করা শুরু করল। অর্ধেক দিন অফিস করে একদিন আচমকা তার ফ্ল্যাটে ফিরে এল। বেশ কিছুক্ষণ দরজার কড়া নেড়ে কোন সাড়া না পেয়ে বেশ রাগ হল তার। পা টিপে জানালার কাছে গিয়ে উকি দিল। তবে ভেতরে কাউকে দেখতে পেলনা। কিন্তু নাজমা দরজা খুলছে না কেন? ভেতরে কেউ আছে নিশ্চয়। উত্তেজনা আর উৎকণ্ঠায় রাশেদ দরজার সামনে অপেক্ষা করছে। কোন দিক দিয়ে বের হবে, একটাই তো রাস্তা।
মিনিট পাঁচেক পরে নাজমা যখন দরজা খুলেছিল, রাশেদ চৌকাঠে দাঁড়িয়ে বিস্ময়াহত হয়ে বউকে দেখছিল। আটাশ বছরের চোখ ঝলসানো শরীর। একটা সায়া কোনওরকমে দাঁতে চেপে গায়ে একটা সবুজ তোয়ালে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার বউ। নিরাভরণ শরীরে ভয় ও অসহায়ত্ব মাখা দৃষ্টিতে তাকে আরও আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে।

বউয়ের উপর গোপন নজরদারি ক্রমশ বাড়িয়ে দিল। নাজমা ওয়াশরুমে ঢুকলে সে তার মোবাইল খুঁটিয়ে দেখত, কাকে সে ফোন করেছে। নানা অজুহাতে হঠাৎ হঠাৎ বাড়ি ফিরত। অনেক সময় নাজমা তার কারণ জানতে চাইত। তখন সে বলত মোবাইলটা ফেলে গেছি, ড্রাইভিং লাইসেন্সটা রেখে গেছি, আজ বস অফিসে আসেনি, শরীরটা ভাল নেই ইত্যাদি। যদিও সব অজুহাত নিজের কাছে হাস্যকর মনে হয় তার।

ঘরে ঢুকে চারিদিকে তাকিয়ে দেখত তার বউয়ের গোপন প্রেমিক কোন কিছু ফেলে গেছে কিনা-কোর্ট বা শার্ট, সিগারেটের প্যাকেট অথবা ব্যাবহিত অন্য কিছু। খাটের নিচে কেউ থাকতে পারে। অথবা ব্যালকনি দিয়ে পাইপ বেয়ে কেউ নেমে গেল কিনা তা সে অধীর উত্তেজনা আর আশঙ্কায় লক্ষ্য রাখে। সন্দেহজীর্ণ মনে প্রতিদিনই সে ভাবে আজই হয়ত নাজমাকে সে হাতেনাতে ধরতে পারবে।

অফিস থেকে ফিরে সাবওয়ে থেকে নেমে দোকান থেকে সিয়াম ও বন্যার জন্য চকোলেট ও মাফিন কিনল রাশেদ। সাবওয়ে থেকে বের হয়ে ক্রিসেন্ট টাউনের ওয়াকওয়ে অতিক্রম করে তার ফ্ল্যাটের দিকে তাকাতেই চমকে যায় রাশেদ। ব্যালকনির তারে কয়েকটি জামাকাপড় আর একটা ভেজা তোয়ালে ঝুলে আছে। সকালে তো তারটা ফাঁকাই ছিল! বাতাসের তোড়ে ফরফর করে উড়ছে তার ফুলপ্যান্ট, নাজমার সালোয়ার কামিজ পাশাপাশি। সুখী দম্পতির মতো। রাশেদ দীর্ঘ এক ঠান্ডা নিঃশ্বাস ফেলে। তাহলে কি নাজমা ফিরে এল? নাজমাই হবে। কারণ নাজমা চলে যাওয়ার পর সে তার ফ্ল্যাটের তালাচাবি বদলায়নি। তাহলে নাজমা হয়তো তার ভুল বুঝতে পেরেছে, তার মোহমুক্তি ঘটেছে, অথবা প্রাণপ্রিয় সন্তান সিয়াম ও বন্যার টানে ঘরে ফিরেছে। কে জানে?
বসার ঘরের দরজা বন্ধ ছিল, ঠেলা দিতেই খুলে গেল। ঘর পরিস্কার ঝক ঝক করছে। অথচ সকালে বের হওয়ার সময় সবকিছু অপরিষ্কার ও এলোমেলো হয়ে পড়ে ছিল মেঝেতে। এখন তা পরিপাটি করে গোছানো। রান্নাঘরে খুটখাট আওয়াজ হচ্ছে। সিয়াম ও বন্যার গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ঘরে ঢুকবে কি ঢুকবে না ভাবতে থাকে রাশেদ। যদি মিথ্যে হয় সব! যদি নাজমা না হয়ে অন্য কেউ হয়! সমাপ্ত
– টরন্টো, কানাডা