অনলাইন ডেস্ক : মঙ্গলবার দিনভর ভোট গণনার শেষে ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট সুস্পষ্টভাবে বিজয়ী হয়েছে বলে দাবি করলেন ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এদিন রাতে দিল্লিতে বিজেপির সদর দপ্তরে দলের নেতাকর্মীদের সামনে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘বিজয়ের এই মুহূর্তে আমি দেশের জনগণকে ধন্যবাদ জানাই। সেই সঙ্গে ধন্যবাদ জানাই এনডিএর সব সঙ্গীকে।’

নরেন্দ্র মোদির এই দাবির ভিত্তি হলো, বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট এনডিএ দেশের মোট ৫৪৩টি লোকসভা আসনের মধ্যে অন্তত ২৯২টিতে হয় জিতেছে বা এগিয়ে আছে।

অন্যদিকে বিরোধী শিবিরের প্রধান জোট ইন্ডিয়া পেতে চলেছে ২৩২টির মতো আসন।

সরকার গড়ার জন্য প্রয়োজনীয় গরিষ্ঠতা পেতে হলে অন্তত ২৭২টি আসনে জেতা জরুরি। এনডিএ সেই ‘ম্যাজিক সংখ্যা’ অতিক্রম করে গেছে বলেই নরেন্দ্র মোদি দাবি করছেন তারা ‘পরপর তৃতীয়বার জনগণের আশীর্বাদ’ পেয়েছেন এবং সরকার গড়তে যাচ্ছেন।

তবে এখানে একটি বড় জটিলতা আছে।

এনডিএর ২৯২টি আসনের মধ্যে বিজেপি এককভাবে পেতে চলেছে ২৪০টির মতো আসন। অর্থাৎ আলাদা দল হিসেবে তাদের আসন গরিষ্ঠতার চেয়ে প্রায় ৩০-৩২টি কম হতে যাচ্ছে।সুতরাং সরকার গড়ার জন্য বিজেপির জোটসঙ্গীদের সমর্থন প্রয়োজন হবে। আর ঠিক এখানেই চন্দ্রবাবু নাইডুর নেতৃত্বাধীন তেলুগু দেশম পার্টি (টিডিপি) বা নীতিশ কুমারের নেতৃত্বাধীন জনতা দল ইউনাইটেডের (জেডিইউ) ভূমিকা খুব বড় হয়ে উঠতে পারে।

ভোটের আগে বিজেপির সঙ্গে নির্বাচনি আঁতাত ও আসন সমঝোতা করলেও টিডিপি বা জেডিইউ যে ভোটের পরও তাদের সঙ্গেই থাকবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বা তাদের একসঙ্গে থাকার কোনো বাধ্যবাধকতাও নেই।

এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েই এনডিএকে ভাঙিয়ে সরকার গড়ার পাল্টা চেষ্টা চালাতে পারে ‘ইন্ডিয়া’ জোটও। বস্তুত এদিন বিকেলে ইন্ডিয়া জোটের প্রধান দল কংগ্রেস সেই সম্ভাবনার কথা নাকচও করেনি। বুধবার দিল্লিতে ইন্ডিয়া জোটের শরিকরা এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে বৈঠকে বসছেন বলেও স্থির হয়েছে।

ফলে ভোটগণনা শুরু হওয়ার পর প্রায় ১৪-১৫ ঘণ্টা অতিক্রান্ত হলে দেশের সবগুলো লোকসভা আসনে ফলাফলের প্রবণতা হয়তো জানা হয়ে গেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কারা সরকার গড়বে সেই প্রশ্নটার উত্তর অনেক ‘যদি’ ও ‘কিন্তু’র ওপর নির্ভর করছে।

চন্দ্রবাবু ও নীতিশকে নিয়ে রহস্য
এই পটভূমিতে ভারতের নির্বাচনী চালচিত্রে সহসা খুব গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠেছেন জেডিইউ নেতা নীতিশ কুমার ও টিডিপির নেতা এন চন্দ্রবাবু নাইডু। ঘটনাচক্রে তাদের দুজনেরই ঘন ঘন রাজনৈতিক সঙ্গী বদল করার খুব পুরনো ইতিহাস আছে।

সবশেষ ফলাফল অনুযায়ী জেডিইউ ১২টি আসনে ও টিডিপি ১৬টির মতো আসনে হয় জিতেছে বা এগিয়ে আছে। ফলে এই দুই দলের ২৮ জন এমপির সমর্থন পেলে বিজেপি জোটের গরিষ্ঠতা পাওয়া নিয়ে কোনো সমস্যা থাকে না।এরা ছাড়াও অবশ্য বিজেপির সঙ্গে আরো কয়েকটি ছোট ছোট শরিক দল আছে। তবে তারা কেউই চারটি বা ছয়টির বেশি আসন পায়নি।

ভারতে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা অনেকেই মনে করছেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে চন্দ্রবাবু ও নীতিশ—দুজনই হয়তো রাজনৈতিক দরকষাকষি করার চেষ্টা চালাবেন। বিজেপিকে বা উল্টোদিকে কংগ্রেসকে সমর্থন করলে তার বিনিময়ে তারা কী কী পেতে পারেন, সেটাও হয়তো বাজিয়ে দেখার চেষ্টা হবে তাদের পক্ষ থেকে।

বস্তুত অন্ধ্র ও বিহারের (যথাক্রমে চন্দ্রবাবু ও নাইডুর রাজ্য) জন্য ইতিমধ্যে হাজার হাজার কোটি টাকার বিশেষ অর্থনৈতিক প্যাকেজের দাবি উঠেছে।

লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত অন্তত নীতিশ কুমার বা চন্দ্রবাবু নাইডু—কেউই প্রকাশ্যে অন্তত কোনো বিবৃতি দেননি বা ফলাফল নিয়ে তাদের প্রতিক্রিয়াও জানাননি। ফলে তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে জল্পনা আরো বেড়েছে।

ইতিমধ্যে সন্ধ্যায় দিল্লিতে খবর রটে যায়, ইন্ডিয়া জোটের পক্ষ থেকে এনসিপি দলের একটি গোষ্ঠীর নেতা ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ শারদ পাওয়ার না কি ইতিমধ্যেই নীতিশ ও চন্দ্রবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের সমর্থন চেয়েছেন। কিন্তু পরে শারদ পাওয়ার নিজেই এ খবর অস্বীকার করে জানান, তার সঙ্গে ওই দুজনের কোনো কথাবার্তা হয়নি।

কংগ্রেস এখন কী করবে?
বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র শরিকদের মধ্যে যারা সবচেয়ে বেশি আসন পেয়েছে, সেই কংগ্রেস কিন্তু এ কথা একবারও অস্বীকার করেনি যে তারাও জোটের পক্ষ থেকে সরকার গড়ানোর দাবি জানাতে পারে।মঙ্গলবার বিকেলে দিল্লিতে ২৪ নম্বর আকবর রোডে এআইসিসি সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী ও দলের সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে—দুজনেই বরং ইঙ্গিত দিয়েছেন, ইন্ডিয়া জোটের অন্য শরিকদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করেই তারা এ ব্যাপারে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন।

সংবাদ সম্মেলনে রাহুল গান্ধীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, এনডিএ (বর্তমান আকারে) যদিও গরিষ্ঠতা পেয়ে গেছে, সেই জোটের একাধিক শরিক কিন্তু আগে কংগ্রেসেরও রাজনৈতিক সঙ্গী ছিল। সেই পরিপ্রেক্ষিতে কংগ্রেস কি বিরোধী আসনে বসার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে না কি তারাও সরকার গড়ার জন্য চেষ্টা চালাবে?

জবাবে রাহুল গান্ধী বলেন, ‘আমরা আমাদের ইন্ডিয়া জোটের অন্য শরিকদের সঙ্গে শিগগিরই আলোচনায় বসব। আমার ধারণা সেই বৈঠক আগামীকাল (বুধবার) অনুষ্ঠিত হবে। এই প্রশ্নগুলো নিয়ে সেখানে আলোচনা হবে এবং এর উত্তর খোঁজা হবে। আমরা আমাদের জোট শরিকদের মর্যাদা দিই এবং তাদের মতামত না নিয়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’

আরো নির্দিষ্ট উত্তরের জন্য চাপাচাপি করা হলে রাহুল গান্ধী শুধু বলেন, ইন্ডিয়া জোট এ ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত নেবে তারাও সেই অনুযায়ীই চলবেন।

তবে একই প্রশ্নের জবাবে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গের জবাব ছিল আরো ইঙ্গিতপূর্ণ। কারণ তার কথায় আভাস ছিল, কংগ্রেস এখন ‘নতুন রাজনৈতিক সঙ্গী’ খোঁজার চেষ্টা করবে। হিন্দিতে প্রশ্নের জবাব দিয়ে খাড়গে বলেন, ‘যতক্ষণ না আমরা জোটের শরিকদের সঙ্গে এবং নতুন শরিকদের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করছি…যে কিভাবে আমরা একযোগে কাজ করতে পারি ও গরিষ্ঠতা পেতে পারি, ততক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমি যদি এখনই সব কৌশল ফাঁস করে দিই, তাহলে প্রধানমন্ত্রী মোদি তো সতর্ক (‘হুঁশিয়ার’) হয়ে যাবেন!’

ফলে কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বের কথাবার্তা থেকে আভাস মিলেছে, তারা আপাতত সব রাস্তাই খোলা রাখতে চাইছেন এবং রাষ্ট্রপতির কাছে সরকার গড়ার দাবি জানানোর সম্ভাবনা নাকচ করে দিচ্ছেন না।

ইন্ডিয়াকেই ‘সাহায্য করবেন’ মমতা
এদিকে ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জানিয়েছেন, তিনি বিরোধীদের ‘ইন্ডিয়া’ জোটের সঙ্গেই আছেন।

এদিন তিনি বলেন, ‘আমি অবশ্যই ইন্ডিয়াকে সাহায্য করব…ওখানে আমার অনেক বন্ধু আছে। আমি চেষ্টা করব যাতে মোদিকে ক্ষমতা থেকে হঠাতে পারি।’

এর আগে ভোটের মাঝপথে তিনি আচমকাই বলেছিলেন, বিরোধী জোট যদি জেতার মতো অবস্থায় চলে আসে তাহলে তিনি ইন্ডিয়াকে ‘বাইরে থেকে’ সমর্থন করে দেবেন।

তখন থেকেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল, তৃণমূল কংগ্রেস কি আদৌ ইন্ডিয়ার শরিক? কিংবা নির্বাচনের পরে কি তারা আদৌ ইন্ডিয়ার অংশ থাকবে?

প্রসঙ্গত, পশ্চিমবঙ্গ হলো এমন একটি রাজ্য যেখানে ইন্ডিয়া জোটের প্রধান শরিকদের মধ্যে কোনো নির্বাচনী সমঝোতা হয়নি। রাজ্যের ৪২টি আসনেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে কংগ্রেস ও বামপন্থীদের জোট প্রার্থী দিয়েছিল। কেরালাতে আবার কংগ্রেস ও বামপন্থীরা পরস্পরের বিরুদ্ধেও লড়েছে। অথচ ‘ইন্ডিয়া’ জোট গঠনের সময় মমতা ছিলেন সবচেয়ে সক্রীয় শরিকদের একজন। তিনি বহুবার প্রকাশ্যেই দাবি করেছেন, এমন কী ‘ইন্ডিয়া’ নামটিও না কি তার মাথা থেকেই প্রথম বেরিয়েছিল।

এখন মঙ্গলবার রাতে এসে দেখা যাচ্ছে, ইন্ডিয়া জোটের মূল শরিক দলগুলোর মধ্যে তৃণমূল সম্ভবত তৃতীয় শক্তিশালী দল হতে যাচ্ছে। তারা যদি শেষ পর্যন্ত ২৯টি আসন পায়, তাহলে তৃণমূলের অবস্থান হবে কংগ্রেস (৯৯) ও সমাজবাদী পার্টির (৩৭) ঠিক পরই।

ফলে এখনকার বিরোধীরা যদি সরকার গঠনের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে দাবি জানানোর সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে তৃণমূলকে অবধারিতভাবে তাতে একটা সক্রিয় ভূমিকা নিতেই হবে।

জোটে তিনি আসলে আছেন কি নেই, তা নিয়ে গত বেশ কয়েক মাস ধরে রীতিমতো ধোঁয়াশা রাখার পর ভোটগণনার দিন সন্ধ্যায় এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশেষে স্পষ্ট করে দিলেন, তার দলের সমর্থন ইন্ডিয়াই পাবে।