ফরিদ আহমেদ : চন্দ্রকান্তিময় সৌন্দর্য নিয়ে জন্মেছিলেন তিনি। সে কারণেই কিনা কে জানে, তাঁর নাম দেওয়া হয়েছিলো চন্দ্রাবতী। ময়মনসিংহে জন্মেছিলেন তিনি। তাঁর জন্ম সাল সঠিকভাবে কেউ জানে না। ধারণা করা হয় ১৫৫০ সালে জন্ম হয়েছিলো তাঁর।
এই অপূর্ব সৌন্দর্যময় নারীটি বিদুষী একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। সেই সাথে ছিলেন বিশুদ্ধ একজন কবিও। বাংলা সাহিত্যের আদি বা প্রথম মহিলা কবিও বলা যায় তাঁকে। তাঁর আগে একজন মাত্র মহিলা কবির কথা জানা যায়। তবে তিনি সত্যি সত্যি ছিলেন কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এই কবির নাম রজকিনী রামমণি বা রামী ধোপানী। কবি চণ্ডিদাসের নিষ্কাম প্রেমের প্রেমিকা হিসাবে বিখ্যাত তিনি। রজকবালা রামী একজন কবি ছিলেন বলে কিছু আলামত পাওয়া যায়। তবে, এগুলো কোনোটা নিরঙ্কুশ সন্দেহ দূর করে পারে না তাঁর কবি হিসাবে অস্তিত্ব সম্পর্কে। আর তাছাড়া বাংলা সাহিত্যে এতজন চণ্ডিদাস আছে যে, ঠিক কোন চণ্ডিদাসের সাথে তিনি সম্পর্কিত ছিলেন সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া যায় না। রামী এবং চণ্ডিদাসকে নিয়ে এই অনিশ্চয়তার কারণে চন্দ্রাবতীকেই বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবির স্বীকৃতি দিতে বহু লোকে দ্বিধাহীন, সংকোচ বিহীন। চন্দ্রাবতী শুধু প্রথম মহিলা কবিই নন, সৃষ্টির মান এবং পরিমাণের দিক দিয়ে মধ্য যুগের সেরা মহিলা কবিও তিনিই।
ইতিহাস সংরক্ষণের বিষয়ে প্রবলভাবে উদাসীন আমরা। দূর অতীতের কথা বাদই দিলাম। নিকট অতীতেরও বহু কিছু ভুলে যাই আমরা সংরক্ষণের বিষয়ে আমাদের আলস্যের কারণে। আমরা বাঁচি বর্তমানে। অতীত নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই, ভবিষ্যৎ নিয়েও কোনো ভাবনা নেই। অথচ, এই তিনের সমন্বয় ছাড়া কোনো জাতিই অগ্রগতির দিকে এগোতে পারে না। মধ্য যুগের সেরা নারী কবিটিও আমাদের এই জাতিগত আলস্য এবং অতীতের প্রতি উদাসীনের কারণে হারিয়ে যেতেন। যেমন হারিয়ে গিয়েছে আমাদের বহু সম্পদই। সেটা হয়নি একজন পরিশ্রমী গবেষকের কারণে। তাঁর নাম চন্দ্রকুমার দে। ইতিহাসের ধুলো ঝেড়ে চন্দ্রাবতীকে আমাদের সামনে তুলে এনেছিলেন তিনি।
১৯১৩ সালে ময়মনসিংহের সৌরভ পত্রিকায় চন্দ্রকুমার দে নামের এক ব্যক্তি প্রাচীন কবি চন্দ্রাবতীর বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। প্রবন্ধের নাম “মহিলা কবি চন্দ্রাবতী”। এই প্রবন্ধ পড়েই দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর খোঁজ খবর নেওয়া শুরু করেন। সৌরভের সম্পাদক কেদারনাথ মজুমদার ছিলেন দীনেশচন্দ্রের পুরনো বন্ধু। তাঁর কাছে চন্দ্রকুমার দের বিষয়ে খোঁজখবর নেবার চেষ্টা করেন তিনি। তিনি দীনেশচন্দ্রকে জানান যে, “চন্দ্রকুমার একজন দরিদ্র যুবক, ভাল লেখাপড়া শিখিতে পারেন নাই, কিন্তু নিজের চেষ্টায় বাঙ্গালা লিখিতে শিখিয়াছেন।” তিনি আরও জানান, “তাঁহার মস্তিষ্কবিকৃতি হইয়াছে এবং তিনি একেবারে কাজের বাহিরে গিয়াছেন।”
চন্দ্রকুমারের হদিশ না পেয়ে দীনেশচন্দ্র সেন ময়মনসিংহের অনেক লোকের কাছে পল্লী গাথা বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। কিন্তু কেউ-ই সেগুলোর কোনো সংবাদ তাঁকে দিতে পারে নাই। কেউ কেউ আবার ইংরেজি শিক্ষার দর্পে বলে উঠেছে, “ছোটলোকেরা, বিশেষত: মুসলমানেরা, ঐ সকল মাথামুণ্ডু গাহিয়া যায়, আর শত শত চাষা লাঙ্গলের উপর বাহুভর করিয়া দাঁড়াইয়া শোনে। ঐ গানগুলির মধ্যে এমন কি থাকিতে পারে যে শিক্ষিত সমাজ তৎপ্রতি আকৃষ্ট হইতে পারেন? আপনি এই ছেঁড়া পুথি ঘাটা দিন কয়েকের জন্য ছাড়িয়া দিন।”
সৌভাগ্য যে দীনেশচন্দ্র সেন এই সব ইংরেজি শিক্ষিত দর্পকারীদের কথায় কান দিয়ে ছেঁড়া পুথি ঘাটাঘাটি বন্ধ করেননি। তিনি সেই ‘মস্তিষ্কবিকৃত’ যুবক চন্দ্রকুমার দে-র সন্ধান বের করেই ছাড়েন।
দুই বছর পরে কেদারনাথ মজুমদার চিঠি দিয়ে দীনেশচন্দ্র সেনকে জানালেন যে, চন্দ্রকুমার অনেকটা ভাল হয়েছেন এবং খুব শীঘ্রই কোলকাতা এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করবেন। তিনি আরও জানান যে তাঁর চিকিৎসা দরকার অত্যন্ত দরিদ্র মানুষ চন্দ্রকুমার দে। পড়ালেখা তেমন কিছু করেন নাই। গ্রাম্য পাঠশালাতে যেটুকু পড়ালেখা শেখা যেয় সেই টুকুই শিখেছেন। সেটা দিয়ে ভালো কোনো চাকরি জোগাড় করা যায় না। সংসার চালানোর তাগিদে তাই এক মুদির দোকানে কর্মচারী হিসাবে কাজ করতেন। কিন্তু, সেই চাকরিটাও তাঁর চলে যায় কাজে ঠিকমতো মনোনিবেশ না করার কারণে। পরে গ্রাম্য তহশিলদার হিসাবে কাজ করতেন। এই চাকরি সূত্রে তাঁকে নানা জায়গায় ঘুরতে হতো। ফলে, কৃষকদের সাথে অবাধ মেলামেশার একটা সুযোগ তৈরি হয়ে যায়। যার ফলে গ্রাম্য চাষাদের মুখে মুখে ফেরা নানা পাল গানের সন্ধান তিনি পেয়ে যান।
দীনেশচন্দ্র সেন তাঁকে দেখা করতে বলেছেন। তাঁর নিজেরও আগ্রহ আছে এ ব্যাপারে। কিন্তু, সমস্যা হচ্ছে, কোলকাতায় যাবার মতো পয়সাও তাঁর কাছে নেই। বউয়ের দুই একখানি রূপার অলংকার ছিল। সেগুলো বিক্রি করে চন্দ্রকুমার পথের খরচ জোগাড় করলেন। তারপর ময়মনসিংহ থেকে একদিন কোলকাতায় এসে দীনেশচন্দ্রকে প্রণাম করে দাঁড়ালেন। এ বিষয়ে দীনেশচন্দ্র সেন লিখেছেন, “রোগে-দুঃখে জীর্ণ, মুখ পাণ্ডুরবর্ণ, অর্দ্ধাশনে-অনশনে বিশীর্ণ, ত্রিশ বৎসরের যুবক, অতি স্বল্পভাষী। কিন্তু এই পাণ্ডুর যুবকই পল্লী জীবনের যে কাহিনী দীনেশচন্দ্রকে শোনালেন এবং ময়মনসিংহের অনাবিষ্কৃত পল্লী গাথার যে সন্ধান দিলেন, তাতে দীনেশচন্দ্রের তাঁকে প্রিয় থেকে প্রিয়তর বলে মনে হতে লাগলো।” কোলকাতায় তাঁরা থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। চিকিৎসারও দায়িত্ব নেওয়া হলো।
এমনিতেই নিজের গরজে, নিজস্ব ভালবাসার টানে ময়মনসিংহের পথে প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে প্রচলিত পালাগান এবং পুঁথি সংগ্রহ করছিলেন চন্দ্রকুমার দে। এটাই ছিলো তাঁর একমাত্র নেশা। আচার্য্য দীনেশচন্দ্র সেনের উৎসাহ পেয়ে তাঁর কর্মস্পৃহা আরও বেড়ে গেলো। এই গাথাগুলোকে সংগ্রহ করে করে তিনি পাঠাতে শুরু করলেন দীনেশচন্দ্র সেনের কাছে। পরে সেগুলোই সংকলিত হয়ে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়ে গেলো। আর মৈমনসিংহ-গীতিকা নামে এই গীতিকাগুলো পরিচিতি লাভ করে ফেললো।
‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ বাংলা সাহিত্যের এক অসাধারণ সম্পদ। চন্দ্রকুমার দে-র মতো নিবেদিতপ্রাণ সংগ্রাহক না থাকলে এগুলো হয়তো হারিয়ে যেতো বাংলার পথে প্রান্তরে। ভাগ্যক্রমে সেটা হয়নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, “বাংলা প্রাচীন সাহিত্যে মঙ্গলকাব্য প্রভৃতি কাব্যগুলি ধনীদের ফরমাসে ও খরচে খনন করা পুষ্করিণী; কিন্তু ময়মনসিংহ গীতিকা পল্লী হৃদয়ের গভীর স্তর থেকে স্বত উচ্ছ¡সিত উৎস, অকৃত্রিম বেদনার স্বচ্ছ ধারা। বাংলা সাহিত্যে এমন আত্ম-বিস্মৃত রসসৃষ্টি আর কখনো হয়নি।”
আসলেও সত্যি কথা। কৃত্রিমতা বিবর্জিত এই সব পালাগুলোতে রয়েছে সোঁদা মাটির ছোঁয়া। নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রাণ নিলেই তা থেকে ভেসে আসে পল্লী বাংলার জলো হাওয়ার গন্ধ। এর পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে আমাদের মূল ঠিকানা। এই নাগরিক জীবন নয়, আমাদের আসল শিকড় ওই পলিমাটিতেই গেঁথে আছে। হাজার হাজার বছরের সেই বন্ধনকে আমরা সাময়িকভাবে উপেক্ষা করতে পারি হয়তো, কিন্তু রক্তের টানকে অস্বীকার কোনো উপায় নেই।
‘মৈমনসিংহ গীতিকা’-র কারণে সংগ্রাহক হিসাবে চন্দ্রকুমার দে অমর হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু, অনেকেরই হয়তো জানা নেই যে তিনি নিজেও একজন সু-সাহিত্যিক ছিলেন। তাঁর সাহিত্যকর্ম জীবিত অবস্থাতে সেভাবে প্রকাশিত হয়নি। তাঁর মৃত্যুর পরে বাংলা একাডেমী তাঁর অগ্রন্থিত রচনার একটা সংকলন প্রকাশ করেছে। সেটার নাম হচ্ছে ‘চন্দ্রকুমার দে অগ্রন্থিত রচনা’। এটার সম্পাদনা করেছেন শামসুজ্জামান খান। তিনি এর ভ‚মিকাতে লিখেছেন, “এতদিন সাধারণভাবে ধারণা ছিল ‘চন্দ্রকুমার দে’ শুধুমাত্র একজন সংগ্রাহক। ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র সংগ্রাহক হিসাবে তাঁর খ্যাতি এতটাই ছড়িয়ে পড়ে যে, তাঁর অন্য পরিচয়ের বহুলাংশই ঢাকা পড়ে যায়। সা¤প্রতিককালে যাঁরা চন্দ্রকুমার দে সম্পর্কে নতুনভাবে খোঁজখবর করছেন তাঁরা লক্ষ্য করেছেন যে, চন্দ্রকুমার দে শুধুমাত্র একজন সংগ্রাহকই ছিলেন না। তিনি ছিলেন বাংলার লোকসাহিত্য এবং সংস্কৃতির একজন বিশিষ্ট ব্যাখ্যাকার ও তাত্তি¡ক। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, বিশেষ করে ময়মনসিংহের বিখ্যাত ‘সৌরভ সাময়িকী’তে তাঁর যেসব লেখা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তা অভিনিবেশ সহকার পাঠ করলে যেকোন সচেতন পাঠক এ সম্পর্কে নিশ্চিত হবেন।’
শুধু শামসুজ্জামান খানই না, চন্দ্রকুমার দে-র লেখনী বিষয়ে দীনেশচন্দ্র সেনেরও উচ্চ ধারণা ছিলো। তিনি এ বিষয়ে লিখেছেন, “তিনি (চন্দ্রকুমার দে) এখন এমন সুন্দর বাঙ্গালা প্রবন্ধ লিখিতে পারেন যে, আধুনিক উচ্চশিক্ষিত নব্য স¤প্রদায়ের মধ্যে সুলেখকগণের অনেকের সঙ্গেই তিনি বোধ হয় প্রতিযোগিতা করিতে সমর্থ।”