কামাল কাদের : সারদা পুলিশ একাডেমী থেকে ট্রেনিং শেষ করে পুলিশ অফিসার রাহাত মির্জা দেশের বাড়ি ঢাকায় ফিরেছে। সারদা পুলিশ একাডেমী পুলিশের ট্রেনিং সেন্টার হিসাবে এক উজ্জ্বল নাম। ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত। তখনকার দিনে খোদ ইংরেজ সাহেবদের ট্রেনিংয়ের পাশাপাশি অভিভক্ত ভারতীয় নাগরীকরা যারা পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ পেত তাদেরকেও এক সাথে হাতে কলমে এই একাডেমিতে ট্রেনিং দেয়া হতো। আজও এর ব্যতিক্রম নেই। প্রথমে পাকিস্তান, পরে বাংলাদেশ হওয়ার পর সেই ঐতিহ্য এখনো অত্যন্ত সুনামের সাথে বজায় রয়েছে।

রাহাত মির্জা ঢাকার বাসিন্দা। ব্রিটিশ শাসনকালে ওর প্র-পিতামহ সুদূর পাঠান মুল্লুক হতে এই ঢাকা শহরে বসতি স্থাপন করেছিলেন। তাদেরই বংশধর এই রাহাত মির্জা। এখন পুরোপুরি বাঙালি। তাদের বর্তমান বাড়ি পুরানো ঢাকা বংশাল রোডে। ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে ইতিহাসে এম, এ, পাস করে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে অফিসার হিসাবে যোগ দিয়েছে। পুলিশ একাডেমী থেকে ট্রেনিং শেষ করার পর রাহাতের প্রথম পোস্টিং হলো মুন্সীগঞ্জে। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে রাহাত কে তার কার্য্যালয়ে হাজিরা দিতে হবে। সে ধীরে সুস্থে তার ব্যবহারিক প্রয়োজনীয় জীনিস পত্র গোছানো নিয়ে ব্যস্ত।

একদিন রাহাত কিছু জীনিস পত্র কেনাকাটা করে বাড়ি ফিরছিলো। পথে রমনা পার্কের সামনে কয়েকজন স্কুল পড়ুয়া যুবক তার সামনে এসে বললো, “ভাইয়া, আস সালামালায়কুম”।
“ওয়ালাইকুম সালাম” বলে রাহাত প্রতি উত্তর দিলো।
সালামের উত্তর দেয়ার পরও যুবকগুলি তার পথ রোধ করে দাঁড়ালো। রাহাত একটু বিরক্ত হয়ে যুবকদেরকে জিজ্ঞাসা করলো, “কি ব্যাপার, আমার পথ আটকিয়ে রাখছো কেন? এ কিরকম বেয়াদবী?”
যুবকদের মাঝে যে ছেলেটি লীডার টাইপের সে আবদারের সুরে বললো, “ভাইয়া বকশিস দেবেন না!”
“বকশিস আবার কিসের?” রাহাত অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো। “বাহ্, আপনাকে যে আমরা সালাম দিলাম সেই জন্যই তো বকশিস চাইছি।” ছেলেটির ব্যাখামূলক জবাব।
“আমি তো তোমাদের সালামের উত্তর দিলাম, এটা আবার কি রকম নিয়ম কানুন, বকশিস চাই,” রাহাত কিছুটা রেগে গিয়ে বললো। “ভাইয়া, আপনি কি ঢাকা শহরে নুতন এসেছেন?” ছেলেটির প্রশ্ন।
অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে রাহাত ছেলেটিকে পাল্টা প্রশ্ন করলো, “আমাকে দেখে তোমাদের কি তাই মনে হয়? সে যাই হোক, তোমাদের যা ইচ্ছে হয় আমাকে নিয়ে ভাবতে পারো, এখন আমার পথ ছাড়।” ছেলেটি কিছুক্ষণ মৌন থেকে বললো, “না, বলছিলাম কি, কিছু ছাড়ুন, আমাদের চা, বিস্কুট খেতে হবে তো!”
পরক্ষণেই রাহাত লক্ষ্য করলো ছেলেটি তার প্যান্টের ডান পকেট থেকে একটা ধারালো “পেন – নাইফ” বের করে ভয় দেখিয়ে বললো, “ভাইয়া, এটা দেখেছেন তো?”
“হ্যাঁ, দেখেছি, তাতে কি?” রাহাত রেগে জবাব দিলো।
“তাই বলছিলাম কি, ঝট-পট কিছু বের করে ফেলুন।”

রাহাত ভাবছে, দেশটার হয়েছে কি, দিনে দুপুরে ডাকাতি! প্রকাশ্যে বললো, “শোনো বাছাধন তোমাদের মতো বখাটে ছেলেদের কি ভাবে শায়েস্তা করতে হয় তা আমার জানা আছে এবং এ ব্যাপারে আমার ট্রেনিংও নেয়া আছে, তবে সে দিকটায় আমি যাচ্ছি না, বরং তোমাদের জন্য আমার করুণা হচ্ছে, এই ভেবে কেন যে তোমরা এ সমস্ত আইন বহির্ভূত কাজ করে বেড়াও তা সত্যিই ভাববার বিষয়। যাক, বেশি কথা বাড়িয়ে লাভ নাই। তোমাদের প্রতি আমার সমবেদনা রইলো, বিশটি টাকা দিলাম, তোমরা চা, বিস্কুট খেয়ে নিও। শুধু তোমাদেরকে এইটুকু বলতে চাই যে, নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে একটু চিন্তা ভাবনা করো, এখনো সময় আছে।”
“ভাইয়া, যাদের কোনো ভবিষৎ নাই, তাদের আবার ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তার কোনো প্রয়োজন আছে কি?”
কথাগুলি ক্ষোভের সাথে বলে সবাই দ্রæত রাহাতের সামনে থেকে সরে পড়লো।
বাড়িতে ফিরে রাহাত তার এক সাংবাদিক বন্ধুর সাথে ঘটনাটি নিয়ে সে রাতে ফোনে আলাপ করলো। প্রথমে ঘটনাটি শুনে বন্ধুটি হেসে উড়িয়ে দিলো। তারপর কিছুক্ষণ নীরব থেকে গম্ভীর হয়ে বললো, “বন্ধু, এ সমস্ত ঘটনা আজকাল নুতন কিছুই না। হর হামেশাই হচ্ছে এবং ভবিৎষতেও হবে। কারণটা হলো, আমাদের দেশে ক্ষমতাবান এবং রাজনীতিবিদগণ যতক্ষণ পর্যন্ত এ সমস্ত উদ্দেশ্যহীন যুবক -যুবতীদের জন্য কোনো সক্রিয় কর্মপন্থার ব্যবস্থা না করছেন ততক্ষণ পর্যন্ত এর কোনো সমাধান নাই, বরং দেশে আরো ভয়াবহ দুর্যোগ আসার সম্ভাবনাকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। এ সমস্ত কর্মহীন, উদ্দেশ্যবিহীন যুবক -যুবতীদেরকে এক শ্রেণীর কুচক্র মহল ওদেরকে নানা অপকর্মে ব্যবহার করে দেশের চরম সর্বনাশ ডেকে আনছে এবং ভবিষ্যতে আনবে।”

“তা হলে এর প্রতিকার?” রাহাতের উদ্বেগ জড়ানো প্রশ্ন।
“এর সহজ উপায় হলো, ওদের ভালো মন্দ নিয়ে ভাবা। বন্ধু, তুমি তো জান empty brain is devils workshop, আর আমাদের সরকারি অফিসারদেরও এ কথাটা বুঝা উচিত যে, public service is not a platform for personal or private gain।
কিন্তু বন্ধু, কজনে এ ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করে!”
রাহাত মির্জা বন্ধুর কথাগুলি শুনে সারারাত ভাবলো। তাহলে দেশের এই অবনতির জন্য সে একা কি করতে পারে? শুধু শুধু এই যুব সমাজকে সব দোষ দেয়া যায় না। ওদেরকে সুপথ দেখালে নিশ্চয়ই ওরা অনেকে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারবে।
পুলিশের চাকরির জীবনে প্রথম কার্যালয় মুন্সীগঞ্জে যোগ দেয়ার পরেই রাহাত মনস্ত করলো যে, সেখানকার বেকার যুব সমাজদের মধ্যে যতদূর সম্ভব শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে হবে, যাতে করে তারা যেন চতুর, স্বার্থবাদী রাজনৈতিক নেতা এবং অসাধু ব্যবসাহীদের মোহজালে না পরে।
এদিকে সে এও জানে, আমাদের দেশের লোক পুলিশের চাকরিকে সুনজরে দেখে না, তবুও এই পেশার মোহে চাকরি প্রার্থী জনসাধারণ দলে দলে লম্বা লাইন দিয়ে থাকে। কারণ একটাই, খুব তাড়াতাড়ী ধনী লোক হওয়া যায়। রাহাত ভাবে সে পারবে কি জনসাধারণের কাছে এই ভুল ধারণা ভাংগতে? চেষ্টা করতে ক্ষতি কি?

রাহাত মুন্সীগঞ্জে কাজে যোগদান করে প্রথমেই সেখানকার স্কুল, কলেজের ছাত্র, অভিবাবক এবং শিক্ষকদের সাথে মিলে ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যৎ কি ভাবে উন্নয়ন করা যায় সে বিষয়ে আলাপ, আলোচনা চালিয়ে যেতে লাগলো। সে ছাত্র-ছাত্রীদের এটা বুঝাতে সক্ষম হলো যে, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে সুশিক্ষার কোনো বিকল্প নাই। যতদূর সম্ভব রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করা। একমাত্র শিক্ষা জীবন শেষ করে প্রোয়জন বোধে রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করা। ছাত্র জীবনে সক্রিয় রাজনীতিতে অনর্থক সময় ব্যায় করলে স্বার্থবাদী নেতাদের উস্কানিতে উগ্রবাদী কোনো কাজে জড়িয়ে পড়তে পারে। পরিণামে কারাবাসও হতে পারে এবং জীবনের একটা অমূল্য সময় অযথা হারিয়ে যেতে পারে।
রাহাতের উপদেশ এবং গঠনমূলক কার্যকলাপের ফলে স্থানীয় যুব সমাজের মধ্যে আশার আলো ফুটে উঠলো। অচিরেই তাদের মাঝ থেকে অহেতুক রাজনৌতিক তৎপরতা কমে আসতে শুরু করলো। তার সাথে হর হামেশা ধর্মঘট, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, প্রভৃতি যে সমস্ত অসামাজিক কার্যকলাপ হতো সেগুলি অনেকাংশে হ্রাস পেলো। রাহাত নিজেকে নিজে সাধুবাদ জানালো এই ভেবে যে সে কিছুটা হলেও তার দায়িত্ব পালন করতে পেরেছে।
কয়েক বছর পর রাহাত বিভিন্ন জেলায় পুলিশ বাহিনীর বিভিন্ন শাখায় কাজ করার পর ঢাকা ডিভিশনের জেলখানার “চিফ ইন্সপেক্টর অফ জেল” পদবি নিয়ে ঢাকার হেড অফিসে স্থান্তরিত হলো। কাজটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন জেলখানায় ভিজিট করে সেখানকার কয়েদীদের সুবিধা অসুবিধার কথা লিপিবদ্ধ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রলায়ে পেশ করা। উদ্দশ্যে কারাগারের জেলার সাহেব জেলখানার নির্ধারীত নীতিমালা সঠিকভাবে পালন করছেন কিনা।
একদিন রাহাত নারায়ণগঞ্জের জেলখানা পরিদর্শনকালে লক্ষ্য করলো যে, খুনের দায়ে দণ্ডিত এক কয়েদী তাকে দেখা মাত্রই তার মাথা নত করে আত্মগোপন করার চেষ্টা করলো। ছেলেটির চেহারাটা দেখার মাত্রই তার কাছে চেন চেনা মনে হলো।

জেলখানা পরিদর্শন শেষ করে সে জেলার সাহেবকে জানালো যে, সে ২৮৩ নম্বর রুমের কয়েদীর সাথে একান্তে কথা বলতে চায়।
অনুমতি পাওয়া গেলো। প্রহরী কয়েদীকে তার রুমে নিয়ে আসলো। এদিকে ছেলেটি আঁচ করতে পেরেছিলো কেন তাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। রুমে ছেলেটি ঢোকার মাত্রই অনর্থক সময় নষ্ট না করে রাহাত ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করলো, “আমাকে চিনতে পারছো?”
“জী স্যার, চিনতে পেরেছি,” ছেলেটি সবিনয়ে উত্তর দিলো।
“মনে আছে কয়েক বছর আগে তোমাদেরকে কিছু মূল্যবান কথা বলেছিলাম? মনে হয় তুমি সেটার কোনো গুরুত্ব দাওনি, তা না হলে আজ তোমাকে এই অবস্থায় এখানে আমার দেখা হতো না।

এও শুনেছি বেশ লম্বা সময়ের জন্য তোমার শাস্তি হয়েছে।” রাহাত আরো কিছু বলার আগে ছেলেটি রাহাতকে থামিয়ে দিয়ে বললো, “স্যার, বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা, আমার এই অপরাধের জন্য সম্পূর্ণ ভাবে আমি দায়ী ছিলাম না। ঘটনাক্রমে অনিচ্ছাসত্বে আমি এর ফাঁদে পড়ে গিয়েছিলাম। “ছেলেটি রাহাত কে আসল কাহিনীটি জানাবার চেষ্টা করলো। “তুমি আমাকে কি বোঝাতে চেষ্টা করছো?” রাহাতের সোজা প্রশ্ন।
“স্যার, আপনি যদি আমায় আপনার কিছুটা মূল্যবান সময় দিন তাহলে আপনাকে আমার সব ঘটনা খুলে বললে হয়তো বা আমাকে ততটা ঘৃণা বা অবাঞ্ছিত মনে করবেননা।”
– ঠিক আছে, তুমি যা বলতে চাও বলো, আমি শুনছি। রাহাতের অনুমতি নিয়ে ছেলেটি শুরু করলো তার বেদনাদায়ক কাহিনী।

প্রথম যেদিন আপনার সাথে আমার অসংযতভাবে সাক্ষাৎ হয়েছিল সে দিন থেকেই আপনার মহামূল্যবান কথাগুলি আমার কানে সব সময় প্রতিধনী করা শুরু করে। মনে মনে সুবোধ ছেলের মতো শপদ নিলাম,আর নয়,তাই পাড়ার দুশ্চরিত্র ছেলেদের সাথে মেলা মেশা বন্ধ করে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে লেখা পড়ার দিকে মনোনিবেশ করলাম। আমার বাবাও আপনার মতো উপদেশ দিয়ে বলতো, “অপরাধ এবং অসামাজিক কাজ থেকে নিজেকে সব সময় দূরে সরিয়ে রাখতে চেষ্টা করবে। আইনের মার্ প্যাচে প্রায়ই নিরাপরাধ লোক অপরাধী বনে যায়, আবার সত্যিকারের অপরাধী লোক বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। তাই অনুসূরণ করে চলছিলাম স্যার! আমার কপালটাই খারাপ,তা নাহলে আপনি আমাকে এই পরিবেশে দেখবেন এটা ভেবে নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছি। ”
— ভাগ্যকে কেন দোষ দিচ্ছ,এটা তো তোমার কৃতকর্মের ফল।
— ব্যাপারটা মোটেই সত্যি নয় স্যার।
— তাহলে কোনটা সত্যি?
ছেলেটি একটু থেমে দম নিয়ে বললো, “খুলে বলছি স্যার। স্কুলের শিক্ষকরা প্রায়ই বলতো,আমি ছাত্র হিসাবে অনেক মেধাবী। কিন্তু লেখা পড়ার প্রতি আমার আলসেমি দেখে উনারা আশাহত। পাড়ার বখাটে ছেলেদের সাথে মিশে উচ্ছশৃখল জীবন বেছে নিয়ে ছিলাম, পরে আপনার উপদেশ বাণীতে আমার টনক নড়লো। পড়াশুনায় মনযোগী হয়ে উঠলাম। আমি তখন এচ, এস, সি, পড়ি আর আমার ছোট বোন এস,এস,সি পরীক্ষার জন্য তৌরী হচ্ছিলো। আমাদের পাড়ার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাহেবের একমাত্র অপদার্থ ছেলে মন্টু আমার বোনকে প্রায়ই সময়ে অসময়ে উত্যক্ত করে বেড়াতো। আমি এবং আমার বাবা এ ব্যাপারে সাবধান ও করেছিলাম। চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে বিষয়টি জানানো ও হলো। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। দিনকে দিন সে আমাদের পরিবারের প্রতিদিনের জীবনকে দুর্বিষয় করে তুললো। একদিন আমি আমার বোনকে নিয়ে রিক্সা করে বাড়ী ফিরছিলাম। সে সময়ে মন্টু তার সাঙ্গ – পাঙ্গ নিয়ে পাড়ার চা স্টলে বসে আড্ডায় মেতে ছিল। আমাদেরকে দেখে সে অনর্থক রিক্সাটাকে থামিয়ে দিয়ে কেতা -দুরস্ত কায়দায় একটা সিগারেট জ্বালালো। একটা সুখ টান দিয়ে মজা করার জন্য মন্টু আমার বোনের ওড়নাটা টেনে নিয়ে তাতে আগুন লাগিয়ে দিলো। এরকম অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি দেখে রাগে আমার সর্বশরীর জ্বলে উঠলো। ক্ষুধার্থ বাঘের মতো আমি ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আমাদের দুজনের মধ্যে খুব ধস্তা-ধস্তি হলো। গায়ের জোরে আমার সাথে সুবিধা করতে না পেরে সে এক পর্যায়ে একটা তীক্ষ্ন ছোড়া বের করলো। আত্মরক্ষার জন্য নিজেকে বাঁচাবার জন্য প্রানপন চেষ্টা করলাম। হিতে বিপরীত হলো, মন্টু নিজের ছোরাতে নিজেই ঘায়েল হয়ে গেলো। পথচারীরা মন্টুকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে গেলো আর এদিকে পুলিশ এসে আমাকে হাজতে বন্ধী করে রাখলো। বিচারে উপযুক্ত প্রমানের অভাবে এবং অদৃশ শক্তিশালী হাত থাকার ফলে আমার এই দীর্ঘ মেয়াদী করা ভোগ ঘোষণা করা হলো।”

কিছুক্ষন চুপ থেকে ছেলেটি বললো, “স্যার,নিশ্চয় এখন বুঝতে পারছেন,সব দশ আমার একার ছিলোনা, একটু ভদ্র ভাবে বাঁচতে চেয়ে ছিলাম,তা আর হলো না।” রাহাত সব শুনে বললো, “তুমি এখন একজন কনভিক্টেড অপরাধী। তবুও তুমি যদি চাও,আবার নুতন করে তোমার ভবিষৎ গড়ে তুলতে পারো এবং এ ব্যাপারে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি।”
“সেটা কি ভাবে?” ব্যগ্র হয়ে ছেলেটি রাহাতকে জিজ্ঞাসা করে।
— তোমাকে আবার পূর্ণ উদ্যমে পড়াশুনা আরম্ভ করতে হবে। পারবে কি?
— আপনার সহযোগীতা এবং আর্শীবাদ পেলে চেষ্টা করে দেখতে পারি। কিন্তু একটা প্রশ্ন রয়ে গেলো,এই কারাজীবনের পরিবেশে
সেটা কি সম্ভব?,
— কেন সম্ভব নয়! যদি মনের মধ্যে দৃড়তা থাকে আর থাকে জীবনে প্রতিষ্টিত হবার অদম্য সংকল্প, তাহলে অসম্ভবকে ও সম্ভব করা যায়। আমি তোমার হয়ে জেলার সাহেবের সাথে আলাপ করে তোমার পড়াশুনার সকল বন্দোবস্ত করে দিতে পারি।
— তবে তাই হোক স্যার, আমি রাজী।

কয়েক বছর পরে ছেলেটি সৎ আচরণের জন্য সাজা প্রাপ্ত নির্ধারীত সময়ের আগেই “প্যারোলে” জেলখানা থেকে মুক্তি পেলো। এরই মধ্যে সে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সোসিওলোজিতে বি,এ অনার্স পাশ করে এম,এ তে মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করলো। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সে ঢাকার একটি দৈনিক কাগজে দিনের বেলায় “ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট” হিসেবে যোগ দিলো এবং সেই সাথে সিটি ‘ল’ কলেজে এল,এল, বি ক্লাশে ভর্তি হলো। সবাই কে তাক লাগিয়ে সে এল,এল,বি পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে জাহাঙ্গীর নগর ইউনিভার্সিটিতে “ক্রিমনোলোজিতে” পি,এইচ, ডি করার জন্য মনোনীত হলো। সম্মানের সাথে পি,এইচ, ডি, ডিগ্রী অর্জন করে কয়েকজন পরউপকারী নাগরীকদের সাথে নিয়ে গরীব, অসহায় জনসাধারণের জন্য বিনা পয়সায় অথবা অল্প খরচে আইনী সাহায্যের সুযোগ করার জন্য “লিগ্যাল এইড সেন্টার” খুলে, সেখানে প্রধান লিগ্যাল অফিসার নিযুক্ত হলো। সে তার পিছনের জীবনকে মোটেই ভুলে নাই। তাই তো দেশের প্রতিটি শহরে এক্স-অপরাধীদের জন্য পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠাতা করে দেশে এক নবযুগের সূচনা করে বিজ্ঞ লোকদের মন -প্রাণ জয় করে নিলো। তার সাথে “ক্রিমিনোলজি” বিষয়ে নানা গবেষণামূলক প্রবন্ধ এবং ছাত্রদের আইনের বই -পুস্তক লিখে প্রচুর সুনামের অধিকারী হয়ে উঠলো। একজন বিপথগামী ছেলে সঠিক পথের পরামর্শ পেলে জীবনে যে অসীম কৃতকার্য হওয়া যায়, সে তারই জ্বলন্ত প্রমান হয়ে দাঁড়ালো। সরকার তার এই অভূতপূর্ব কর্মশীলতার জন্য দেশের সর্বোচ্চ খেতাব দিয়ে তাকে সম্মান জানালো।

পুলিশ অফিসার রাহাত মির্জার বয়স হয়েছে। স্বাস্থগত কারণে নিয়মীত সময়ের পূর্বেই অবসর নিয়েছেন। নাতি -নাতনীদের নিয়ে অবসর সময় ভালোই কাটছে। যেদিন টেলিভিশনের পর্দায় ছেলেটিকে দেশের প্রধান মন্ত্রীর কাছ থেকে পুরস্কারটি গ্রহণ করতে দেখলো,তখন সে নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিলোনা। অবশেষে ছেলেটি অসম্ভব কে সম্ভব করেছে। রাহাত মির্জা নিজেকে আজ অনেক গর্বিত মনে করছে এই ভেবে যে সে আকাশের মেঘের আড়াল থেকে তারকা খচিত এক খন্ড হীরা খুঁজে বের করতে পেরেছে বলে। এ যেন তার পুলিশ জীবনের সার্থকতার বহিঃ প্রকাশ। এ জীবন ধন্য হলো,খুশির আবেগে তার চোখ দুটি ভীজে উঠলো। শেষ
ই-মেইল: quadersheikh@gmail,com ইলফোর্ড, ইংল্যান্ড