ফরিদ আহমদ
বাংলা সাহিত্যে মধুসূদনের যুগ অত্যন্ত স্বল্পকালীন একটা সময়। কিন্তু এই ক্ষণস্থায়ী সময়টাকে তিনি মুড়িয়ে দিয়েছেন মুঠো মুঠো মণিমুক্তো দিয়ে। মধুসূদনের আগে বাংলা কবিতা পড়ে ছিল মধ্যযুগে। তখন রাজত্ব চালাচ্ছিল সব প্রতিভাহীন এবং কল্পনারহিত পদ্যকারেরা। তিনিই একক প্রচেষ্টায় বিশাল এক ধাক্কা দিয়ে বাংলা কবিতাকে মধ্যযুগীয় পদ্যের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে এনে ফেলে দেন আধুনিকতার আঙ্গিনায়। এরকম দ্রোহী পুরুষ, উদ্ধত এবং আত্মম্ভর মানব, এরকম অবিশ্বাস্য প্রতিভাবান এবং পরাক্রমশালী কবি বাংলা সাহিত্যে আর জন্মায়নি। হয়তো আর জন্মাবেও না কোনো দিন। যে বিপুল পরাক্রম তিনি দেখিয়েছেন, সেটা দেখানোর জন্য অবশ্য বাইরে থেকে তাঁকে ঋণ করতে হয়েছে প্রচুর। সারা বিশ্বের রতœভাণ্ডার খুলে খুলে দেখেছেন তিনি, লুট করেছেন লাজলজ্জাহীন লুটেরার মত। যা কিছুকেই মনে হয়েছে মূল্যবান, সেটাকেই তিনি নিয়ে এসে জমা করেছেন বাংলার ভাঁড়ার ঘরে। সমৃদ্ধ করেছেন বাংলাকে অবিশ্বাস্য পরিমাণে, আবদ্ধ করেছেন অপরিমেয় ঋণের জালে।
বাকি বিশ্বই শুধু নয়, বাংলার নিজস্ব ভাণ্ডারের দীর্ঘ দিনের অব্যবহৃত রতœভাণ্ডারকেও আবিষ্কার করেছেন তিনি। চুপিসারে এগুলো পড়ে ছিল অনাদর এবং অবহেলায় ঘরের কোণে। গায়ে মেখে ছিল অযত্নের কাদামাটি। কারো চোখেই সেগুলো পড়েনি কখনো আগে। পরম যত্নে তিনি সেগুলোকে তুলে নিয়েছেন একটি একটি করে। পরিশ্রুত করেছেন আপন প্রতিভার দাবানলে পুড়িয়ে পুড়িয়ে।
তিনি মহাকাব্য লিখেছেন, সনেট লিখেছেন, বিয়োগান্ত নাটক লিখেছেন, লিখেছেন প্রহসনও। এসবের কোনোটা তাঁর আগে আর কোনো বাঙালি লেখক কিংবা কবি লেখেননি। তিনি সাহিত্য সাধনা করেছেন মাত্র ছয় বছর। অথচ এই স্বল্পকালকে বিশালত্ব এবং বৈচিত্র্যমুখিতায় ভরিয়ে দিয়েছেন তিনি। অমিত্রাক্ষর ছন্দের জনক তিনি। এর আগে বাংলা কবিতা পড়ে ছিলো ছন্দমিলের মিত্রাক্ষর ছন্দে। বাংলায় যে এরকম অভূতপূর্ব ছন্দ হতে পারে এবং সেই ছন্দে যে চিরস্থায়ী কাব্য রচনা করা যায় তা তিনি প্রমাণ করে দিয়েছিলেন তাঁর অমিত প্রতিভা দিয়ে। বাঙালির কান এই অশ্রুতপূর্বক ছন্দে অভ্যস্ত ছিলো না। বাংলা ভাষায় যে এর প্রয়োগ হতে পারে, সে যুগে কেউ তা বিশ্বাসও করতো না। এরকম একটি নতুন ছন্দকে ব্যবহার করে কাহিনিকে জিইয়ে রাখা সহজ কাজ ছিলো না। কিন্তু মধুসূদন সাফল্যের সাথে সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।
মেঘনাদবধকাব্য যখন তিনি লেখেন তখন বাংলা ছিল একটি অবিকশিত এবং অতি দুর্বল ভাষা। এটি ছিল ক্ষুদ্র একটি জনগোষ্ঠীর আঞ্চলিক ভাষা। মহত্তম ভাবপ্রকাশের জন্য অপর্যাপ্ত, অপরিশ্রুত এবং অনাদরণীয়। সমাজের চাষাভূষা মানুষের অবহেলিত ভাষা তখন সেটি। উঁচুমহলে এর কোন উচ্চবাচ্য ছিল না।
এরকম একটি অবিকশিত এবং হতদরিদ্র ভাষায় মেঘনাদবধকাব্য লেখা দুঃসাধ্যেরই নামান্তর। এর বাস্তবায়ন এক অসম্ভব কল্পনার নাম। কিন্তু সেই অসাধ্য সাধন তিনি করেছিলেন প্রবল জেদে এবং স্বভাবজাত একগুয়েমিতে। বাংলা সাহিত্যে সত্যিকারের মহাকাব্য রচনার অসম্ভব কল্পনাকে হাতের মুঠোর বাস্তবতায় পরিণত করেছিলেন অপরিমেয় প্রতিভার প্রখর ঝলকানিতে।
এর জন্য অবশ্য তাঁকে সৃষ্টি করতে হয়েছিল নিজস্ব ভাষা ও ছন্দ। মন্থন করতে হয়েছিল সমুদ্র এবং মহাসমুদ্র। সাগরতলে লুকায়িত বাংলার রত্নভাণ্ডার থেকে রত্ন আহরণের জন্য দক্ষ ডুবুরির মত ডুব দিয়েছেন তিনি। ছেঁকে ছেঁকে তুলে এনেছেন সব মণি-মাণিক্য। ভয়ডরহীন ডাকাতের মত হানা দিয়েছেন সমৃদ্ধশালী প্রতিবেশী সংস্কৃতের রত্নভাণ্ডারে। তারপর সেই লুণ্ঠিত রত্নরাজিকে মিশিয়েছেন বাংলার চলিতের সাথে সুদক্ষ কারিগরের সুনিপুণ কৌশলে। তারপরও যখন প্রয়োজন মেটেনি, নিজেই তৈরি করে নিয়েছেন নতুন নতুন সব প্রয়োজনীয় শব্দ।
বাংলা কাব্যের আসরে মধুসূদনের যাত্রা শুরু হয়েছিলো মহাসমারোহে, ঢাকঢোল, দামামা দুন্দুভি বাজিয়ে, মহা আড়ম্বরে এবং সদম্ভ আস্ফালনে। তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য দিয়ে এই সম্মুখ যাত্রার শুরু। ১৮৬০ সালে অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত এই কাব্য ছিল মহাযাত্রার গা গরম করা অনুশীলন। তিলোত্তমাসম্ভবের প্রস্তুতিপর্ব শেষ হবার পরে মধুসূদন ঝোলা থেকে বের করেন তাঁর সেরা কাব্যটিন, মেঘনাদবধ। শুধু মধুসূদনেরই নয়, এখন পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা কাব্যগ্রন্থ এটি।
এই কাব্যের কাহিনি পরিকল্পনায়, ছন্দ-নৈপুণ্যে এবং চরিত্রচিত্রণে মধুসূদনের প্রতিভা অত্যুজ্জ্বল মহিমায় উদ্ভাসিত। রামায়নের মূল কাহিনি থেকে আখ্যানটি নেওয়া, কিন্তু এর পরিকল্পনা ও আঙ্গিক রূপায়নে ইউরোপিয় সাহিত্যের বিপুল প্রভাব রয়েছে।
মধুসূদন সুস্পষ্ট সচেতনতায় পাশ্চাত্য কবিকূলের অনুসরণ করেছেন। হোমার, ভার্জিল, দান্তে, মিলটন, ট্যাসো দিয়ে অনুপ্রাণিত হয়েছেন তিনি। তারপরেও বলা যায় যে, বিস্ময়কর এবং প্রতিভার মৌলিকতার কারণে এই রচনা অনুকৃতি দোষে দুষ্ট হয় নি এবং এর উৎকর্ষও ক্ষুণ্ণ হয়নি কোনো অংশ। প্রতিভার মৌলিকতা ছাড়া, শুধুমাত্র অনুকরণ, অনুসরণ করে কোনো কবিই চিরজীবী হতে পারেন না। মধুসূদনের অপার প্রতিভার স্পর্শেই প্রাচ্য থেকে কাহিনি এবং প্রতীচ্য থেকে আঙ্গিক গঠন এবং অলংকরণ নেবার পরেও মেঘনাদবধ বাংলা সাহিত্যের এক নিজস্ব কালজয়ী কাব্যগাথা।
মেঘনাদবধ কাব্যে তিনি একটি অচিন্তনীয় এবং অভাবনীয় ব্যাপার ঘটিয়েছিলেন। রাম এবং রাবণের চরিত্র আমরা যেরকম করে জানি, তিনি সেটিকে উলটে দিয়েছিলেন স্পন্দিত স্পর্ধায়। বাল্মিকীর রামায়নে রাম সৎ, সাহসী, সত্যনিষ্ঠ এবং দয়াবান। রাবণ পাপীতাপী, অন্যায়কারী ও অত্যাচারী। কিন্তু মধুসূদনের মহাকাব্যে রাম ভীরু, শঠ, প্রতারক এবং দুর্বল চরিত্রের মানুষ। রাবণ সাহসী পুরুষ, স্নেহময় পিতা, প্রজাহৈতিষী। দেবতাদের চক্রান্ত ও কোপানলে পড়ে তিনি একজন বিরহী ও দুঃখী মানুষ। তিনি রামায়ন নির্দেশিত পথে না চলে রাক্ষস বংশের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হয়েছেন। তাঁর কাব্যে রাক্ষসেরা বীভৎস এবং ঘৃণ্য কোনো প্রাণী নয়, বরং আমাদের মতই আবেগ-অনুভূতিতে পূর্ণ মানুষ। রাবণ চরিত্রের জন্যই মেঘনাদবধ কাব্য করুণ রসের আধার হয়ে উঠেছে। মেঘনাদবধ অমিততেজী বিদ্রোহী রাবণের পরাজয়ের বেদনা কাহিনি। নিষ্ঠুর নিয়তি রাবণের সর্বনাশ করেছে, দেবতারা তাঁর বিরুদ্ধে হীন ষড়যন্ত্র করেছে। এর ফলে একের পর এক পরাজয়ের কলংকচিহ্ন যুক্ত হচ্ছে তার কপালে। তারপরও তার অনমনীয় এবং উদ্ধত পৌরুষ সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে বিপুল বিক্রমে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। মেঘনাদবধের রাবণ যেন মধুসূদন নিজেই। তাঁর জীবনেও এই একই ধরনের সুকঠিন সংগ্রাম এবং করুণ পরাজয়ের শোকগাঁথা লেখা রয়েছে। এই শোকগাঁথার জন্য অবশ্য অন্যেরা যতটুকু না দায়ী, তিনি নিজেও তার চেয়ে বেশি দায়ী।
মেঘনাদবধের পুরো কাব্য জুড়ে রয়েছে আলংকারিক ভাষার ছড়াছড়ি। নদী-গিরি, সন্ধ্যা-প্রভাত, উদ্যান-অট্টলিকার বর্ণনায় মধুসূদন ভাষার ঐশ্বর্যকে অকাতরে পাত্রে ঢেলেছেন। অলংকারের সৌন্দর্যে, ভাষার মাধুর্যে, অজগ্র শব্দ ব্যবহারে এবং ছন্দের অভিনবত্ব প্রয়োগের মাধ্যমে মেঘনাদবধ কাব্য খণ্ডকাব্যের খণ্ডিত পর্যায় অতিক্রম করে মহাকাব্যের বিশালতায় উঠে গিয়েছে। পাশ্চাত্য মহাকাব্যের অনুকরণে রচিত বলে এটা পাশ্চাত্যের মতোই বীররসাশ্রিত। কিন্তু পরাজিত রাক্ষস বংশের প্রতি প্রবল সহানুভুতিতে বীররসকে প্রধান রস হিসাবে তিনি রাখতে পারেননি পাশ্চাত্যের মতো। বরং, একে ছাড়িয়ে প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে করুণরসই। আগাগোড়াই হাহাকার মেশানো বেদনাবিধুর কাব্য এটি। করুণরস এবং বীররসের বাইরেও এখানে শৃঙ্গার রস, ভয়ানক, বীভৎস এবং অদ্ভুত রসেরও সমাহার ঘটেছে প্রাচ্যীয় কায়দায়।
হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় বলেছিলেন, “বঙ্গভাষায় ইহার তুল্য দ্বিতীয় কাব্য দেখা যায় না। নিবিষ্ট চিত্তে যিনি মেঘনাদবধ কাব্যের শঙ্খধ্বনি শুনিয়াছেন, তিনিই বুঝিয়াছেন যে বাংলা ভাষার কতদূর শক্তি এবং মধুসূদন কি ক্ষমতাসম্পন্ন কবি।” হেমচন্দ্র মহোদয়ের কথা সত্যি। এক মেঘনাদবধ কাব্য পাঠ করলেই বোঝা যায় কী এক অসীম সম্ভাবনাময় শক্তিধর ভাষা আমাদের এই বাংলা ভাষা। আমরা নিজেরা অক্ষম বলে ধরতে পারিনি এর অপার সৌন্দর্য এবং শক্তিমত্তাকে।