হিমাদ্রী রয় : প্রাণীকুলের মধ্যে মানুষ জন্ম থেকেই স্নেহের কাঙ্গাল। তবে মানুষের স্নেহ-ভালোবাসার মধ্যে প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার যোগ থাকে। অথচ কিঞ্চিৎ স্নেহে একটি কুকুর মনিবের ভক্ত হয়ে যায় সারা জীবনের জন্য।
মানুষ অভিমান পুষতে পারে, বেদনা জানাতে পারে কুকুর/সারমেয় তা পারে না। কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে একটি কথা আছে, মানুষের চাইতে ইতর প্রাণীর প্রতি তাঁর দরদ ছিলো বেশি, তাঁর সাহিত্য কর্মে মহেষ নামের ষাড়ের অমর সৃষ্টি যেমন আছে তেমনি বাস্তব জীবনেও তাঁর একটি পোষা কুকুর ছিলো নাম ভেলু। যমুনা পত্রিকা অফিসে শরৎচন্দ্রের নিয়মিত সাথি। পুত্রবৎ ভেলুর মৃত্যুর পর শরৎচন্দ্র শ্রাদ্ধ করেছিলেন ঘটা করে। শনিবারের চিঠির সম্পাদক সজনীকান্ত দাস তার বিখ্যাত পত্রিকায় ছাপেন ‘ভেলুর নাই বিনাশ ভেলু হলো অবিনাশ’। তথ্যসূত্র- শরৎ সান্নিধ্যে ডঃ কালিদাশ রায়।
আমার ছোট বেলায়, আমাদের পরিবারে একদিন অযাচিত অতিথি হয়ে আসে এক কুকুর। আমাদের বাবা নিজের মধ্যাহ্নভোজন শেষে একে যতœ করে খাওয়াতেন এর নাম দিলেন সাধু। দুপুর বেলা আদর করে আওয়াজ দিতেন ‘কইরে সাউদ্ধা’ আর সাধু ঠিক ডাক শুনে লেজ নাড়াতে নাড়াতে আসতো খাবার খেতে। এ নিয়ে তখন আমার কোন কৌতুহল ছিলো না। আমার বড় বৌদি বলতো পূর্ব জন্মে কেউ ঋণী থাকলে পরের জন্মে এরা মনিবের বাড়ি পাহারা দিয়ে যায়। শুনে মনে মনে হেসেছি তবে অবিশ্বাস করে উড়িয়ে দেব এই শক্তিটা হারিয়ে ফেলেছিলাম বাবা মারা যাওয়ার পর। সাধুকে আর কোনদিন আর আমাদের বাড়ির সীমানায় দেখিনি।
ছবি দেখে জেনেছি হাচিকোর কথা। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিবিভাগের অধ্যাপক ‘হিদেসাবুরো উয়েনো’ প্রতিদিনকার মতই একদিন ‘শিবুরা স্টেশন’ হয়ে বাড়ি ফেরার পথে কুড়িয়ে পান সোনালী বাদামী বর্ণের ‘আকিতা’ প্রজাতির কুকুর। নামকরণ করেন হাচিকো। ধীরে ধীরে সে হয়ে অধ্যাপকের নিবিড় সময়ের অবলম্বন। হাচিকো প্রতিদিন সকালে বিদায় জানাতে মনিব অধ্যাপকের সাথে স্টেশনে আসত এবং দিনশেষে তার বাড়ি ফেরার সময়ে স্টেশনেই একটি নির্দিষ্ট জায়গায় অভ্যর্থনা জানাতে অপেক্ষা করত। একদিন অধ্যাপক তার বিশ্ববিদ্যালয়ে হঠাৎ মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে মারা যান। প্রতিদিনের মত সেদিনও হাচিকো তার মনিবের জন্য অপেক্ষা করছিলো স্টেশনে। কিন্তু তার মনিব সেদিন আর ফিরলেন না। বিশ্বস্ত হাচিকো জীবদ্দশায় তা বিশ্বাস করতে পারেনি যে তার মনিব আর কোনদিন আসবে না।
সেদিন থেকে টানা পরবর্তী নয় বছর নয় মাস পনেরো দিন সে প্রতিদিন একই সময়ে শিবুরা স্টেশনের একই জায়গায় বসে তার মনিবের জন্য অপেক্ষা করতে করতে মারা যায়। মৃত্যু ভালোবাসার শেষ সীমানা নয়।
কাছে থেকে দেখার জীবনে এমন অতি চেনাজানা এক ভালোবাসার নাম লাইসা। আমেরিকান স্টাফোর্ড শিয়ার প্রজাতির এই কুকুরটিকে ঘরে এনেছিল অরুণা, তখন তার বয়স ছিল এক মাস তিন দিন।
আট বছর তার সুখে, দুঃখে, শোকে, জীবন সংগ্রামে লাইসা ছিলো অরুণার নীল যমুনার জল, নিরালায় মমতার আশ্রয়স্থল। নিত্য এই শহরের বুকের মাঝে যার ঘুঙুর বাজে সেই অরুণা হায়দার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছে, গলা জড়িয়ে আসছিল তার পোষা লাইসার মৃত্যুতে।
ফোনের এপাশে গাড়ির স্টিয়ারিং এ বসা আমার মন যেন ক্ষান্তবর্ষণ বিষন্ন সট্যার নরম পলিতে ক্লান্ত চরণ। আমি অনুভব করছি অরুণার রক্তক্ষরণ। আমি দেখতে পাচ্ছি লাইসা চলছে মহাপ্রস্থানের পথে, দেবরাজ ইন্দ্র রথ থেকে নেমে এসেছেন অভ্যর্থনা জানাতে সেই প্রভূভক্ত প্রাণী কুকুরকে যে প্রাণীকে নিয়ে জেষ্ঠ পাণ্ডব স্বর্গে প্রবেশ করার জেদে অটল ছিলেন।
‘চলে গেলে আমারও অধিক কিছু থেকে যাবে আমার না-থাকা জুড়ে’
হিমাদ্রী রয় : সাংস্কৃতিক কর্মী, টরন্টো, কানাডা