বনানী বাবলী : বাংলাদেশ এক সোনা ঝরাদেশ। এই সোনালী দেশের সবুজ শ্যামল অপরূপ রূপের সম্ভারে ছড়িয়ে আছে শ্যামলা বরণ মানুষ আর এই দেশের সবুজ মন। কত মুক্তিযোদ্ধা ঘুমিয়ে আছে এই বাংলার মাটিতে সেটা এখনো অজানা। কত শত মুক্তিযোদ্ধারা প্রকৃত তালিকা থেকে এখনো বহির্ভুত এবং আদৌ এই তালিকা হবে কিনা আগামীতে সেটাও আমাদের প্রজন্মের কাছে একটা প্রশ্ন। কিন্তু এই সূর্য সন্তানদের তির্যক আলোক ধাঁধায় ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছিলো পশ্চিম পাকিস্তানিদের এই বাংলাকে চিরতরে মুছে দেয়ার অপচেষ্টাকে। তারা অন্যায্যভাবে বাঙালির মুখের ভাষা, অন্যায্যভাবে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকভাবে বাংলার মানুষকে চেয়েছিলো এই পৃথিবী থেকে মুছে দিতে। এই দেশের সূর্য সন্তানেরা বাংলা মাকে ভালোবেসে রক্ষা করেছে। জীবনকে তুচ্ছ করে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর আজ আমরা তাঁদের খুঁজে ফিরি বিবেকের তাড়নায়। এইতো মাত্র কয়দিন আগে আমি জানলাম আমাদের বন্ধু লিঙ্কনের বাবা মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হক দেশের জন্য নিরন্তর কাজ করেছিলেন একাত্তরে। অনেক তথ্য মুছে গেছে কালের বিবর্তনে। তবুও যতটুকু সংগ্রহ করা গেলো ততটুকুই আজকের গল্পে তুলে ধরার চেষ্টা করছি পাঠকদের জন্য (তথ্যসূত্র ও ছবি সংগৃহিত: মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হকের সর্ব কনিষ্ঠ তনয় লিঙ্কন হক।)
মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হক জন্মগ্রহণ করেন ১৯২১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর তারিখে জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী গ্রামে এবং মরহুম আব্দুল আজিজ মোক্তারের প্রথম সন্তান ছিলেন তিনি। আট ভাইবোনদের মধ্যে যেহেতু তিনি সবচেয়ে বড় ছিলেন সঙ্গত কারণে তাঁর উপরেই ছিল সমস্ত পারিবারিক চাপ বা আশা একজন আদর্শ মানুষ হিসাবে ভবিষ্যতে পরিবারের দায়িত্ব নিয়ে তৈরী হওয়ার জন্য। বাল্য কাল থেকেই আব্দুল হক ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, বিনয়ী, এবং দেশপ্রেম চেতনায় উদ্বুদ্ধ। পিতামাতার ছায়ায় প্রগতিশীল পারিবারিক মূল্যবোধে শৈশবকাল উত্তীর্ণ করেন তিনি।
তিনি জে কে পি এম সরকারি বিদ্যালয়, শেরপুর এবং ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে অধ্যায়ন করেন। এর পর এখান থেকে পাশ করার পর আর্থিক অভাব অনটন সত্তে¡ও তাঁকে পরিবার থেকে কলিকাতাতে পাঠানো হয় শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জনের জন্য। তিনি ১৯৪৪ সালে কলিকাতার রিপন আইন কলেজ থেকে এম এ বি এল বি পাশ করেন এবং বিশেষ মেধা সহকারে তিনি উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। তারপর তিনি শেরপুর জেলায় ১৯৪৫ সালে আইন ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু ১৯৩৯ সালের শেষের দিক থেকেই ছাত্র জীবন থাকাকালীন সময়ে তিনি রাজনৈতিক জীবনে জড়িত হয়ে যান এবং ফলশ্রুতিতে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের জন্য কারাবরণ করেন। শুধু তাই নয় এই দেশপ্রেমিক ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের সময় অবধারিতভাবে পুনরায় আবার কারাগারে ফিরে যেতে হয় উত্তাল রাজনৈতিক কর্মকান্ডের কারণে। সামরিক জান্তাদের বিপক্ষে কাজ করাটাই ছিল তাঁর লক্ষ্য দেশ মাতাকে মুক্ত করার জন্য। একাত্তরে গোপনে এই সাহসী বীর চলে গেলেন বৌডাঙ্গা হয়ে ভারতের তুরা পাহাড়ে। তুরা হলো ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পশ্চিম গারো পাহাড় জেলায় অবস্থিত। সেখানে তিনি দলনেতৃত্ব দিতে শুরু করেন পূর্ব পাকিস্তানের থেকে আগত মুক্তিযোদ্ধাদের। এখানে তিনি নানা বয়সের এই মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন বিভিন্ন ভাগে অপেরেশনের যাওয়ার পূর্ব প্রস্তুতি হিসাবে। দীর্ঘ প্রায় নয় মাস তিনি অন্যান্য সহযোদ্ধাদের নিয়ে অক্লান্তভাবে কাজ করে যান। এই দুর্গম পাহাড়ে সেই সময় তাঁর সাথে ছিলেন একই গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার আব্দুল হাকিম। দীর্ঘ দিন যাবৎ এই তুরা পাহাড়ের ক্যাম্পে খাদ্য সংকট, দিবারাত্র অমানষিক পরিশ্রম এবং নানাবিধ প্রতিক‚লতা মোকাবেলার কারণে যুদ্ধ শেষে যখন তিনি স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন। তখন শারীরিক ভাবে অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু কোন প্রতিবন্ধকতার কাছে হার মানেন নাই এবং কাজ করে গেছেন অক্লান্ত চিত্তে এই মুক্তিযোদ্ধা। তারপর আনুমানিক নভেম্বরের শেষে ফিরে আসেন তিনি একদল যুদ্ধ ফেরত মুক্তি ফৌজদের নিয়ে। সেইদিন অগুনতি মানুষের প্রাণঢালা ভালোবাসা নিয়ে তাঁকে বরণ করা হয় নিজ গ্রামে। কিন্তু আপোষহীন এই আইনজ্ঞ ধীরে ধীরে রাজনীতি থেকে দূরে সরে যান কোন এক অপ্রকাশিত অভিমানে। তিনি মোসাম্মৎ আম্বিয়া বেগমের সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন ১৯৪৭ সালে এবং যিনি ছিলেন রত্ন গর্ভা। তিনি এই চিরসাথী, আপোষহীন আব্দুল হকের সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন। মোসাম্মৎ আম্বিয়া বেগম শেরপুর জেলার শ্রীবর্দী উপজেলার ভায়ডাঙা গ্রামের বনেদী পরিবারের মরহুম লতিফা খাতুন এবং কফিলউদ্দিন মোক্তারের সর্ব কনিষ্ঠা সন্তান ছিলেন।
ব্যক্তিজীবনে এই দেশ প্রেমিক স্বাধীনতার স্বপক্ষ দল আওয়ামী লীগের আদর্শে বড় করেন তাঁর ছয় সন্তানদের। পিতার পদাঙ্ক অনুসারে তাঁর জ্যৈষ্ঠ পুত্র ড: একরামুল হক (প্রাক্তন অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, মেরিন বায়োলজি বিভাগ এবং বর্তমানে কানাডা নিবাসী। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন মাত্র ২২ বছর।) এবং দ্বিতীয় পুত্র আজমল হক (একাত্তরে বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর) মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তাঁরা দুই ভাই চলে যান কোলকাতাতে পৃথকভাবে। মেঝো সন্তান আজমল ছিলেন অত্যন্ত সাহসী এবং দুরন্ত। পাকিস্তানি সৈন্যরা যখন বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা দখল করে তখন এই তরুণ মুক্তিযোদ্ধা ময়মনসিংহের খাগডহর পুলিশ ফাঁড়িতে অবস্থানরত পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যের রাইফেল কেড়ে নিয়ে তাকে গুলি করে পালিয়ে যান ভারতে এবং পরবর্তীতে তিনি সেখানে থেকেই অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মিশে যান দেশের কাজে। অনেকদিন যাবৎ তাঁর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
শুধু তাই নয় তাঁর চতুর্থ সন্তান ডাক্তার বেলাল হক পর পর দুইবার ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ছাত্রলীগ আসন থেকে বিপুল জনপ্রিয় ভোটে নির্বাচিত হন “মিলনায়তন সম্পাদক” পদে (আনুমানিক সাল ১৯৭৯-১৯৪০) এবং যেখানে অন্যান্য আসনগুলি ছাত্রদলের আয়ত্তে ছিল। ডাক্তার বেলাল শুধু রাজনীতি নয়, তিনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তাঁর খেলাধুলা, সংগীত এবং রাজনীতি ছিল অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তিনি ১৯৮১ সালে তদানীন্তন জাহেদুর রহিম স্মৃতি পরিষদ আয়োজিত রবীন্দ্রনাথ সংগীত প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন (এই প্রতিযোগিতার বর্তমান নাম জাতীয় রবীন্দ্রনাথ সংগীত সম্মেলন প্রতিযোগিতা)। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এই মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান, দেশের মেধা, জনসেবা কাজে নিয়োজিত ডাক্তার বেলাল যখন গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে যান, তখন তাঁর জন্য বর্তমান সরকারের কাছে সরকারি আদেশের পারমিট চাওয়া হয়েছিল চিকিৎসার প্রয়োজনে ভারতে নিয়ে যাওয়ার জন্য, কিন্তু সেটা তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায় নাই। অনেকদিন পরে রাজনীতির লাল ফিতার দৌরাত্ব অতিক্রম করে সেই সরকারি অনুমোদন যখন এলো তখন তিনি অভিমানে এক যন্ত্রনাময় জীবন ফেলে চলে যান না ফেরার দেশে।
সমাজসেবী, দেশপ্রেমী, অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হক ২০০০ সালের জানুয়ারির ২১ তারিখে জামালপুরের নিজ বাস ভবন থেকে না ফেরার দেশে চলে যান। জীবদ্বশায় দেখে গেছেন একের পর এক আপন জনের মৃত্যু আর স্বজন হারানোর ব্যাথা, অসহায় বোবা কান্নার সাথেই বুঝে গেছেন একা, সম্পূর্ণ একা। কিন্তু ছায়া দিয়ে গেছেন দেশের মানুষকে বিশাল বটবৃক্ষের মতো। তিনি যুদ্ধ পরবর্তীকালে কোন দল, ব্যক্তি বিশেষ বা রাজনীতির কাছে আপোষ করেন নাই। এই যোদ্ধা ছিলেন প্রচার বিমুখ এবং নীরবে দেশের কাজ করে গেছেন যতদিন বেঁচে ছিলেন। তিনি ১৯৭২ সালে বৃহত্তর ময়মনসিংহের আওয়ামী লীগের প্রথম সভাপতি এবং স্বাধীন বাংলাদেশের বার কাউন্সিলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) নানাবিধ আলোচনা বা আইনি পরামর্শ নেয়ার জন্য তাঁর আবাসিক বাসভবনে আসতেন প্রতিনিয়ত। পারিবারিক বন্ধু সৈয়দ নজরুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বর্তমান রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের সাথে ছিল ঘনিষ্ট সখ্য। বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সাথে পরিচয় থাকা সত্তে¡ও এই সূর্য সন্তান কারো কাছ থেকেই সুবিধা আদায় করেন নাই, চাটুকারিতা করেন নাই, ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধার করার কথা ভাবেন নাই। পরিণামে হয়তো তাই তিনি জীবদ্বশায় একটি পদক অথবা মরণোত্তর পদক কিংবা শেষ যাত্রায় একটি গান সেলুট অনুমোদন অর্জন করেন নাই। এই অসম সাহসী সূর্য সন্তান আব্দুল হক তৈরী করেছিলেন মুক্তি ফৌজ, দিয়ে গেছেন প্রতিদিন তাঁর আদর্শের বাণী স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বে, যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এবং স্বাধীনতা অর্জনের পরও থেমে যান নাই। তরুণ সমাজে রেখে গেছেন তাঁর আদর্শের অমৃত বাণী। সূর্যের আলোক বিচ্ছুরণের মতো প্রতিদিন তিনি ভালোবাসার মন্ত্র ছড়িয়ে গেছেন এই সোনা ঝরা দেশের মাটিতে এবং এক নক্ষত্র হয়ে এই দেশমাতাকে এখনো পাহারা দিয়ে যাচ্ছেন। অসীম ভালোবাসা এবং সেলুট, মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হক তোমাকে। বাংলার কোটি প্রাণে তোমরা জাগ্রত। চির স্মরণীয় হোক তোমাদের এই দেশমাতাকে ভালোবাসার আলোকধারা। জনমে জনম যেন গাইতে পারি তোমাদের জয়গান।
(বাংলাদেশ তোমারই জন্য পুস্তকের অংশ বিশেষ)
– টরন্টো, কানাডা