ডঃ বাহারুল হক : মিহান এক অনিন্দ সুন্দর যুবকের নাম। নামটা শুনলেই মনে হবে মিহান বুঝি চীন দেশের হান বংশের কোন প্রতাপশালী নৃপতির আদরের দুলাল। আসলে কিন্তু তা নয়। মিহান বাঙালি মাতা মিতা আর বাঙালী পিতা হান্নানের বাঙালি ছেলে। জন্মের পর তার মা মিতা ও বাবা হান্নান তাদের নিজ নিজ নামের প্রথম অক্ষর দুটি মিলিয়ে পুত্রের নাম রেখেছে মিহান। মিহানের বিবাহ কার্য্য সম্পাদিত হয়েছে গত জুলাই মাসে। মিহানের বিবাহ নিয়ে আজ এ লেখা। বিবাহটা অন্য দশটা বাঙালি ছেলের বিবাহের মত হলে আমি লিখতাম না। বিবাহের মুল সুর একরকম হলেও এ বিবাহের রুপ-রস-গন্ধ-আমেজ-আবহ ছিল একেবারে অন্যরকম। প্রথমেই উল্লেখ করি মিহানের বিবাহটা ছিল একটা আন্তর্জাতিক বিবাহ। পাত্র পাত্রী দুই জন ভিন্ন দুই মহাদেশের, ভিন্ন দুই রঙের, ভিন্ন দুই ভাষাভাষী, এমন কি ভিন্ন দুই ধর্মের। মিহান প্রকৃতপক্ষে একজন বাঙালি অস্ট্রেলিয়ান। মিহানের পিত্রালয় অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ণ শহরে অবস্থিত। বহু বছর আগে মিহানের মা বাবা শিশু মিহানকে নিয়ে তাদের নিবাসভুমি চট্টগ্রাম থেকে পাড়ি জমিয়েছিলেন প্রাচুর্যে ভরা পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধের হীরণ্ময় দেশ অস্ট্রেলিয়া। সময় গড়ালো। শিশু মিহান শিশু থেকে প্রথমে কিশোর, তারপর বালক, সব শেষে বালক থেকে রুপান্তরিত হলো অনিন্দ সুন্দর এক যুবকে। মিহান লেখা পড়াও চালালো সুন্দরভাবে। সে আইনশাস্ত্রে লেখা পড়া সমাপ্ত করে আইন ব্যবসা শুরু করলো অস্ট্রেলিয়ায়। তারপরই আইন ব্যবসার সুত্র ধরে চলে গেল অস্ট্রেলিয়ার বাহিরে। এদেশ সেদেশ করে গেল পশ্চিম এশিয়ার এক আরব দেশ জর্ডানে। সেখানে যুবক মিহান একটু চপল হয়ে উঠলো। জার্মান মেয়ে লুইসার সাথে মিহানের সখ্যতা গড়ে উঠলো। মিহানকে লুইসার প্রচন্ড রকম ভালো লেগে গেল। মিহান আর লুইসা দুইজনে মিলে নতুন এক জীবনের স্বপ্ন দেখতে লাগলো। মেয়েরা স্বপ্ন দেখে ছেলেদের থেকে বেশি। লুইসার স্বপ্ন যেন অনেক অনেক বেশি। লুইসা বাঙালী মেয়ে হলে হয়তো জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী আফরীন হক- এর গাওয়া মনের গভীরে অজান্তে বীণ বাজানো সেই গানটি একা একা গাইতো-
“আমার স্বপন কিনতে পারে
এমন আমীর কই?
আমার জলছবিতে রঙ মিলাবে
এমন আবীর কই”?

আর মুহুর্তেই লুইসার মনে পড়ে যেত মিহানইতো তার কাঙ্খীত সেই আমীর যে তার সকল স্বপন ক্রয় করার জন্য প্রস্তুত। মিহান লুইসা দুইজন পরস্পর পরস্পর থেকে নানা ভাবে ভিন্ন হলেও তাদের স্বপ্ন কিন্তু এক। তাদের দুইজনের রঙ ধনুতে সমাবেশ ঘটেছে একই রকম সব রঙের। মিহান লুইসার সখ্যতা গভীর প্রেমে রুপান্তরিত হলো। এ সময় স্টেজে এসে হাজির হলো মিহানের মা বাবা। মিহানের মা বাবা দুজনই উদার মনের মানুষ। মানবিকতা, সত্য, আর -অন্তর্লোকের সৌন্দর্য্যের অনুপমতার প্রতি তারা বরাবরই ভীষণ রকম দুর্বল। কোন রকম কুপমন্ডতার বেড়া জালে তারা দুজনের কেহই কখনো আবদ্ধ হয়নি। তাদের কথা বার্তায় কোনদিন কাত্যায়নীভাব প্রকাশ পায়নি। তাদের চিন্তা চেতনা ত্রিলোক উদ্ভাসিত শীতল আলো দ্বারা থাকে আলোকিত। জীবন ধর্মকে, জীবনের অখন্ড বাস্তবতাকে তারা লৌকিক ধর্মাচারের সম্মুখে সাংঘর্ষিক হয়ে কখনো দাঁড়াতে দেয়নি। তাই তারা মিহানের আর লুইসার এক হয়ে যাওয়ার ইচ্ছাকে আনন্দ চিত্তে স্বাগত জানিয়েছে। তাদেরও বক্তব্য এই প্রেম তো সারা জীবন চলতে পারে না; এর একটা শুভ পরিনতির দরকার। বিয়েই হলো সেই পরিনতি। মিহানের মা বাবা লুইসার মা বাবার সাথে কথা বললো এবং নিজেদের অভিমত জানালো। লুইসার মা মিসেস ড্যাগমার ও বাবা মিঃ কার্পেন্টার যেন এরকম একটি প্রস্তাবের অপেক্ষায় ছিল। বাঙালী অস্ট্রেলিয়ান পাত্রের মা বাবা আর আর জার্মান পাত্রীর মা বাবা হৃষ্ট চিত্তে একান্তভাবে সিদ্ধান্ত নিল মিহান আর লুইসা বিয়ের মাধ্যমে এক সত্ত¡ায় রুপান্তরিত হবে এবং বিয়ে কবে কোথায় কিভাবে হবে সে সিদ্ধান্ত পরে নেয়া হবে। উভয় পক্ষ কথা বার্তা বলে সিদ্ধান্ত নিল বিয়ে জার্মানিতে কণ্যার পিত্রালয়ে অনুষ্ঠিত হবে। কথাবার্তার পরম্পরায় এ সিদ্ধান্তও গৃহিত হলো বিয়ের অনুষ্ঠান গুলো ধারাবাহিকভাবে হবে এবং শুরু হবে ১৩ জুলাই, ২০২২ সনে। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ণের অধিবাসি মিহানের মা মিতা পাকা সিদ্ধান্ত নিলেন তাদের প্রথম পুত্র সন্তান মিহানের বিয়েতে আগা গোড়া নিখাদ বাঙালিয়ানা বজায় রাখা হবে। মিতার এ কথায় মামা খালা চাচা ফুফুরা চোখ কপালে তুলে বললো- তা কি করে সম্ভব? তাদের প্রশ্ন- টেম্পারেট ক্লাইমেটের জার্মান মাটিতে কিভাবে তুমি সাবট্রপিক্যাল ক্লাইমেটের বাংলার মাটির এরোম্যাটিক গন্ধ ছড়াবে? কোথায় পাবে আর কারাই বা গাইবে সেই বিয়ের গান-
“লীলাবালি লীলাবালি
বড় যুবতী সই গো
বড় যুবতী সই গো
কি দিয়া সাজাইমু
তোরে”।

কেমন করে বাজাবে বিয়ের সানাই? কেমন করে কে সংগ্রহ করবে বাঙালী বিয়ের শত উপাদান? কিন্তু মিহানের মায়ের সেই এক কথা- “আমি পারবো, আমাকে পারতেই হবে”। মিতার মুখ থেকে বেরিয়ে এল সেই অমর বানী- “ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। আমার এই ইচ্ছা আমি বাস্তবায়ন করবো এবং উপায় আমি বের করবোই”। যারা মিতাকে চিনে তারা তার এই দৃড় বক্তব্যের উপর অনায়াসে আস্থা রাখলো। তারা জানে মিতা এক অসাধারন নারী। সংকল্পে, দৃড়তায়, সাহসে, নিষ্ঠায়, বুদ্ধিতে, আন্তরিকতায় তার মত নারী বাঙালি সমাজে খুবই কম। সে জার্মানিতে অনুষ্ঠিতব্য সব অনুষ্ঠানের শিরোনাম, অনুষ্ঠিত হওয়ার তারিখতো বটেই, অনুষ্ঠান সম্পর্কে বিস্তারিত লুইসার মা বাবাকে জানিয়ে দিয়েছিল এবং তাদের ফ্যামিলিকেও সেভাবে প্রস্তুতি নিতে একান্তভাবে সাহায্য করেছিল।

১৩ জুলাই ২০২২। বেশি দিন আর বাকি নাই। মিতা নেমে পড়লো তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষে। যা তা কাজ নয়। জার্মানির বার্লিন নগরীর উপকন্ঠে আইখষ্ট নামের জার্মান এক ভুমিকে মিহান-লুইসার বিয়ে উপলক্ষে এক টুকরো বাংলাদেশ বানানোর কঠিন এক কাজ\ প্রথমেই মিতা ঠিক করলো কি কি অনুষ্ঠান হবে জার্মানিতে। অনুষ্ঠানগুলো সম্পন্ন করতে কি কি লাগবে তার একটা তালিকা তৈরি করলো মিতা। শুরু হলো মিতার পক্ষ থেকে খোঁজ খবর নেয়া কোথায় কোন আইটেম পাওয়া যাবে। সব উপকরন থাকতে হবে এবং একটু বেশি থাকতে হবে, কারণ কোন কিছুর সর্ট পড়লে চট করে গিয়ে কিনে ফেলার কোন সুযোগ নাই। তার কাজে মন প্রান ঢেলে সহযোগিতা করতে মেলবোর্ণে মিতার সাথী হিসেবে আছে তার ছোট বোন আফরীন, ভাতিজি তূর্ণা, ক্যানবেরায় আছে মিতার দুই ভাদ্রবধু তামান্না, সাজিয়া, আর হান্নানের এক ভাদ্রবধু। ১৩ জুলাই ২০২২ সন। কেনা কাটাও শেষ। কি নাই এখন মিতার ভান্ডারে! শাড়ি, পায়জামা, পাঞ্জাবী, চুড়ি, ফিতা, আলতা, ক্লিপ, সেপটিফিন, ঘটি, বাটি, ডালা, জরি, কাজল, নেল পালিশ, ছাতা, টুপি, আয়না, শুরমা, কানের দুল, গলার হার, কোমরের বিছা, হোন্দা মেথি, মেহেদি, হলুদ, সব, সব। সব কিছু নিয়ে যাওয়া হবে জার্মানি। কে কে যাবে জার্মানি?

মিহানের আত্মিয় স্বজনের অভাব নাই এবং তারা আছেও পৃথিবীর নানা দেশে। জার্মানি যাওয়ার, জার্মানিতে অনুষ্ঠান উপভোগ করার জন্য আপনজনদের প্রায় সবাই মিতার পক্ষ থেকে নিমন্ত্রন পেয়েছিল। কিন্তু শরীর-স্বাস্থ্য, অর্থ এরকম নানাবিধ কারণে জার্মানি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া আপনজনদেরও সিংহভাগের পক্ষে সম্ভব হয়নি। জার্মানি যাওয়ার জন্য ঝটপট হৃষ্ট চিত্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো মিহানের এক খালা, তিন মামা আর এক চাচা। এক মামা যাবে আমেরিকার ডালাস থেকে বাকি সবাই অস্ট্রেলিয়া থেকে। এরা সবাই যাবে সপরিবারে। এরা যে শুধু উপভোগ করতে যাবে তা নয় জার্মানিতে মিহানের বিয়ের অনুষ্ঠান সুন্দরভাবে সম্পন্ন করার জন্য এদের উপস্থিতি মিতার একান্তভাবে প্রয়োজনও। মিহানের মা বাবা সহ যারা সপরিবারে জার্মানি যাবে তাদের ভাবনায় এলো অন্য একটা বিষয়। বিষয় হলো এই যে হাজার হাজার ডলার খরচ করে জার্মানি যাওয়া, কি করলে এই টাকার সর্বোৎকৃষ্ট রিটার্ন পাওয়া যাবে। সবাই চিন্তা করলো বারে বারে তো জার্মানি যাওয়া আসা অসম্ভব। অতএব বিয়ে উপলক্ষে জার্মানি যেহেতু যাবো লম্বা সময়ের জন্যই যাই। তাতে বিয়ের আনন্দের সাথে সাথে জার্মানি এবং জার্মানির আশে পাশের দেশ ন্যাদার্ল্যান্ডস, বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড গিয়ে বেড়ানোর আনন্দও উপভোগ করা যাবে। ভাবনার সাথে মিল রেখে তড়িৎ সিদ্ধান্ত নেয়া হলো সবাই সপরিবারে জার্মানিতে উপস্থিত হবে গায়ে হলুদের (এ বিয়ের প্রথম অনুষ্ঠান) চার দিন আগে। গায়ে হলুদের চার দিন আগে জুলাইর ৯ তারিখে সবাই জার্মানির বার্লিন পৌঁছে গেল। অস্ট্রেলিয়া থেকে মিহানের কয়েকজন বন্ধুও এ মিছিলে শরিক হলো। মিহানের ছোট ভাই নিহাল গেল আমেরিকার নিউ ইয়র্ক থেকে; আরেক ছোট ভাই শায়ান গেল তার কর্মস্থল পর্তুগাল থেকে। বার্লিনে ৯ জুলাই থেকে ১১ জুলাই পর্যন্ত নভোটেল হোটেলে মিহান রুম ভাড়া করে রেখেছিল। ফলে অতিথিরা বার্লিন বিমান বন্দর থেকে বের হয়ে সোজা চলে গেছে নভোটেল হোটেলে। ৯ জুলাই থেকে তিনদিন সবাই একত্রে ঘুরে ঘুরে বার্লিন দেখেছে। ১২ জুলাই সবাই চলে গেছে আইখষ্ট। লুইসার বাবা মিঃ কার্পেন্টার নদ নদী ফুল পাখি আর সবুজ বৃক্ষের ছবি সদা হৃদয়ে ধারন করেন। তাই মেয়ের বিয়ের জন্য ভ্যানু নির্ধারন করলেন বার্লিন থেকে একটু দুরে আইখষ্ট নামের পুরাতন একটা ছোট নগর। লুইসার বাবার পছন্দের আইখষ্ট মিহানেরও পছন্দ। আইখষ্টে লুইসার বাবা একটা রাজবাড়ি ভাড়া করেছেন যে বাড়িতে আছে ষোলটি বেডরুম সমেত একটি রাজভবন, সবুজ বৃক্ষ দিয়ে ঘেরা বিরাট আঙ্গিনা আর বড় একটা পুকুর। মিহানও রাজবাড়ির অদুরে আরেকটা বিরাট বাড়ি ভাড়া নিয়েছ তার বন্ধু স্বজনদের জন্য। মিহানের পক্ষের সবাই আইখষ্ট গিয়ে উঠলো মিহানের ভাড়া করা বিশাল বাড়িতে যদিও তারা জানতো বিয়ের মুল ভ্যানু রাজবাড়ি। মিঃকার্পেন্টার ও মিসেস ড্যাগমার তাদের স্বজনদের নিয়ে এলেন মিহানের ভাড়া করা বাড়িতে এবং উপস্থিত সকল অতিথির সাথে পরিচিত হলেন। রঙিন ছাতা আর হলুদ ফুল দিয়ে রাজবাড়ির আঙ্গিনায় ১২ জুলাই বিকালে তৈরি করা হলো বাহারি এক স্টেজ, হলুদ স্টেজ। ১৩ জুলাই রাজবাড়ির বিশাল আঙ্গিনায় হবে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান আর পরদিন অর্থাত ১৪ জুলাই বিয়ে হবে সে বাড়ির পুকুর পারে নির্মিত স্টেজে। রাতে মিতা এবং তার সাথীরা মিলে হলুদের ডালা সাজিয়ে ফেললেন। রাত পোহাতেই চলে এল ১৩ জুলাই। এই দিন সেই দিন যেই দিনের অপেক্ষায় ছিল সবাই। এই দিন সে দিন যেই দিন মিতা আইখষ্টকে রুপান্তরিত করেছে বাংলাদেশে, মিঃ কার্পেন্টারের জার্মান ফ্যামিলিকে রুপান্তরিত করেছে বাঙালি ফ্যামিলিতে। শিডিউল অনুযায়ী গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান শুরু হলো দ্বিপ্রহরে, বেলা ২:৩০ মিনিটে। মিহান আর লুইসাকে হলুদের সাজে সাজিয়ে হলুদ স্টেজে বসিয়ে দেয়া হলো। মিহানের পরনে সাদা পায়জামা পাঞ্জবী, পাঞ্জাবীর উপর নানা রঙে রঙিন কাপড়ের তৈরি একটা হাতা কাটা বেøজার। লুইসাকে পরানো হয়েছে হলুদ শাড়ি আর মাথা সহ তার গায়ে জড়ানো হয়েছে একটা লাল ওড়না। সে সময় আঙ্গিনায় বাজছে গান। সে গানের স্বরে পা মিলায় এবার হলুদের ডালা হাতে রাজভবনের সদর দরজা দিয়ে বের হয়ে এল বর পক্ষের সব অতিথি। এ সব অতিথিদের মধ্যে পুরুষরা পরেছে সাদা পায়জামা নীল পাঞ্জাবী আর মেয়েরা পরেছে গোলাপি শাড়ি। কনে পক্ষের মেয়েরা পরেছে বেগুনি শাড়ি ছেলেরা পরেছে সবুজ পাঞ্জাবী। তবে মিহানের মা বাবা আর লুইসার মা বাবার পরনে ছিল অন্যদের থেকে ভিন্ন রঙের পোশাক। মিহান ও লুইসার বাবার গায়ে ছিল হলুদ রঙের পাঞ্জাবী আর তাদের দুই মা পরেছে লাল রঙের শাড়ি। পোশাকের যে বৈচিত্র, চাক চিক্য, বাহার তা মিহানের মা মিতার চিন্তার ফসল। যেহেতু মিতার লক্ষ ছিল জার্মানদের বাঙালি বানিয়ে ছাড়বে ফলে জার্মানদের জন্য শাড়ি পাঞ্জাবী কেনার দায়িত্ব বর্তালো মিতার উপর। মিতা হৃস্ট চিত্তে শাড়ি পাঞ্জাবী নয় শুধু কাচের চুড়ি, আলতা ,ইত্যাদি হলুদের সাজের সব উপকরনও জার্মানদের জন্য ক্রয় করেছে নিজে ঢাকার বাজারে ঘুরে ঘুরে। মিহানের মা সাথে করে কণ্যা পক্ষের জন্য নিয়ে যাওয়া সব সামগ্রী ১২ জুলাই রাতে তুলে দিয়েছে মিসেস ড্যাগমারের হাতে। বাঙালির মত রঙিন শাড়ি আর রঙিন পাঞ্জাবী পরা সাদা সাদা জার্মানদের দেখতে অপুর্ব লাগছিল। নাচতে নাচতে হলুদের ডালা বিনিময় হয়ে গেলো দুই পক্ষের মধ্যে। মিহানদের পক্ষ থেকে ছিল ডালা ভরা নানা রকম মিস্টি। এসব মিস্টি এসেছে ঢাকা, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া থেকে; কিছু আবার বার্লিন থেকে কেনা। বর পক্ষের ডালার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয়, সবচেয়ে লোভনীয় ছিল মাছ মিস্টি ডালা। এ ডালায় ছিল মাছ আকৃতির বড় দুটো সন্দেশ। মাছ দুইটি একটা বড় ডালায় পাশা পাশি রেখে দেয়া হয়েছে কণ্যা পক্ষকে। কণ্যা লুইসার গায়ের রঙের মত সাদা রঙে বানানো হয়েছে মেয়ে মাছটা আর পুরুষ মাছটা ব্রাউন রঙের, মিহানের গায়ের রঙ। ডালা বিনিময়ের পর খাওয়া হলো হালকা নাস্তা। ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটায় বেলা ৩ টা। শুরু হলো সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্ব- গায়ে হলুদ পর্ব। এ পর্বে ফুটে উঠেছে খাঁটি বাঙালিয়ানা। সব উপকরণে ভরা লুইসাদের হলুদ ডালা দেখে বুঝার কোন উপায় নাই যে এরা বাঙালি নয়। এ পর্ব শুরু হলো উপস্থিত সকলের নৃত্যের মাধ্যমে। আকাশে আবীর ছড়ানো হচ্ছে আর সবাই নাচছে। ভুবন মোহন সে নাচ। অংশগ্রহনকারীদের নাচের ঠমকে চমকে পায়ের ধমকে সৃস্টি হয়ে গেল অন্য রকম এক পরিবেশ যা কেউ বিয়েতে আগে কখনো দেখেনি। সঙ্গীতের তালে তালে জার্মানদের নৃত্যের ছন্দ দেখে বাঙালিরাও অবাক। এর মধ্যে চলছে বর আর কণের গায়ে হলুদ মাখানো। জার্মানরা বাঙালিদের রঙের মোহ আর নৃত্যের ছন্দ দেখে মুগ্ধ। মিহানের খুশি যেন আর প্রানে ধরে না। সে লাফ দিয়ে তার মাকে জড়িয়ে ধরে বললো- “আম্মু, আমি জানতাম তুমি পারবে, সুন্দর হবে অনুষ্ঠান, কিন্তু এত সুন্দর করে পারবে, এত সুন্দর হবে এটা আমি ভাবিনি। এর চেয়ে আর বেশি সুন্দর কিছু হতে পারে না। ইউ আর গ্রেট, আম্মু; ইউ আর গ্রেট”! নাচে, গানে, বর কণের গায়ে হলুদ মাখাতে মাখাতে হয়ে গেল সঁন্ধা। এবার ডিনার, রাতের খাবার। এবারও সব বাঙালিয়ানা। ওয়েস্টার্ন কোন খাবারের চিহ্ন নাই। যেন ঢাকায় খানা হচ্ছে। খাবার সরবরাহ করেছে বার্লিনের এক বাঙালি রেষ্টুরেন্ট। সেই কাচ্চি বিরিয়ানি, বোরহানি, রোস্ট, রেজালা, কাবাব, ইত্যাদি, ইত্যাদি। রাত ৮ টা পর্যন্ত চললো গাল গল্প খাবার দাবার। রাত ৮ টায় সবাই ফিরে গেল যার যার ডেরায়। রাত পোহালো। এলো ১৪ জুলাই। এই দিন হয়ে গেলো মিহানের আর লুইসার বিবাহ। রাজবাড়ির বিরাট পুকুর পারে আগে থেকে বানানো বিরাট স্টেজে হয়ে গেলো বিবাহ অনুষ্ঠান। বিবাহ অনুষ্ঠানের পর কণ্যা পক্ষ থেকে পরিবেশন করা হলো দুপুরের খাবার। খাওয়া দাওয়া শেষ হওয়ার মাধ্যমে শেষ হলো মিহান আর লুইসার বহু আকাঙ্খিত বিবাহ অনুষ্ঠান। এখানে উল্লেখ করা দরকার আইখষ্টে মিহান লুইসার বিবাহ হয়েছে জার্মান বিবাহ আইন অনুযায়ী। মিহান লুইসা স্বামী স্ত্রী অনেক আগে থেকে। ২০২১ সনের নভেম্বর থেকে তারা দুইজন স্বামী-স্ত্রী। জর্ডানের রাজধানী আম্মান শহরে সে সময় মিহানের মা বাবা আর লুইসার মা বাবার উপস্থিতিতে ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী মিহান লুইসার বিয়ে হয়েছে যা বিবাহ অনুষ্ঠান সূচীতে আকদ হসেবে পরিচিত। অমোচনীয় সুখের স্মৃতি নিয়ে মিহান ছাড়া মিহানের মা বাবা সহ অনুষ্ঠানে আগতসব আত্মীয়-স্বজন আইখষ্ট ত্যাগ করলো ১৫ জুলাই সকালে। আইখষ্ট থেকে বার্লিন। বার্লিন থেকে কেউ বের হলো জার্মানির অন্যান্য শহর দেখতে, কেউ বের হলো ইউরোপের অন্য দেশে বেড়াতে, আবার কেউ বের হলো নিজ দেশের উদ্দেশ্যে। জার্মানির আইখষ্ট পড়ে রইলো, থাকবে, আর আইখষ্টের ভুমিতে থাকবে প্রজাপতির মত রঙ-পাগল একপাল বাঙালির পায়ের চিহ্ন।