আতোয়ার রহমান : আর কতদিন এভাবে মেলামাশা করবে? চারিদিকে আমাদের নিয়ে কানাঘুষো হচ্ছে, লোকজন আজেবাজে কথা বলছে, পাড়ার বেশ কয়েকজন বাবার কাছে নালিশ করেছে, বলেছে মেয়ে সামলাও, সেসবের কি তোমার কানে কিছু যায়? অনেকদিন দিন তো হলো। বলি কি এর চেয়ে চল আমরা এখন বিয়েটা সেরে ফেলি। তুমি যদি এটা না কর, তাহলে আমি আর তোমার সাথে যখন তখন মেলামেশা করতে পারব না, ক্ষোভ মিশ্রিত স্বরে আসলামকে বলল সোমা।

আসলাম বিস্মিত হয়- সোমার বলার ধরনে। সোমার কথার ভঙ্গি শুনে পায়ের রক্ত মাথায় উঠল আসলামের। রাগটা ভিতরে পুষে রেখে আসলাম ঠান্ডা গলায় বলল, বিয়ের জন্য এতো অস্থির হওনাতো। আর কিছু দিন পরে হলে তাতে কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। আমাকে আর একটু গুছিয়ে নেওয়ার সময় দাও, নিজের পায়ে দাঁড়াতে দাও…। এইতো সবে মাস্টার্স পরীক্ষার ডেট হয়েছে। পরীক্ষা শেষে একটা চাকরি-টাকরি পেয়েই তোমাকে ঘরে তুলবো। এর মধ্যে তুমিও বিএ পাশ করে ফেলবে।

না আজ আমি তোমার কোন কথা শুনব না। আমি বাড়ি চলে যাচ্ছি। তুমি আর আমাকে যখন তখন ডেকো না। বিয়ে না করলে আমি আর তোমার সঙ্গে মেলামেশা করতে পারব না। তুমি যখন তখন ফোন দিয়ে বল, কলেজের সামনের সাইবার ক্যাফেতে আসো, বোটানিকাল গার্ডেনে আসো, মেট্রো ক্যাফেটেরিয়ায় আসো। আধা ঘন্টার মধ্যে। একটু দেরি হলেই রেগে গজ গজ করতে থাকো। অথচ একবার ভেবে দেখনা সবকিছু সামলে নিয়ে সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে তবে, তোমার সাথে দেখা করতে হয়।

আসলামের মাথায় যেন বাজ ভেঙ্গে পড়ল। রাগ তার ভেতরে উথলে উঠল। সোমার চোখে চোখ রেখে বলল, বিষয়টা এতো সোজা না, সোমা। তুমি কি মনে করছো আমার কাছ থেকে এত সহজে ছাড়া পাবে। তোমার সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি ও ভিডিও আমার কাছে আছে। তুমি আমার কথামতো না চললে ওগুলো ফেসবুকে ছড়াইয়া দিব, ভাইরাল করে দিব। তুমি তখন কোথাও মুখ দেখাতে পারবে? আসলাম কথা শেষ করে এক মুহূর্তের জন্য সরে গিয়ে দূরে তাকাল, তারপরে নিচের ঠোঁটটিতে কামড় দিয়ে সোমার দিকে তাকাল।

সে সুযোগ আর আমি তোমাকে দিব না আসলাম। ভেবোনা, অন্যান্য মেয়েদের মতো আমার বেলাতেও প্রেম-প্রেম খেলাটা কিছু দিন চালিয়ে তার পর সুযোগ মতো পিঠটান দেবে, মধু খেয়ে কেটে পড়বে, আরামের ঢেকুর তুলবে, সেই আইন নেই আর। সোমা আসলামের দিকে এক বার তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় চিবিয়ে চিবিয়ে বলল। এবার বুঝবে ভাইরালের কত ধানে কত চাল।

তুমি এসব কি বলছো? আমি অন্য মেয়েদের সঙ্গে প্রেম প্রেম খেলেছি, একথা তোমাকে কে বলেছে? চেঁচিয়ে উঠল আসলাম।
সোমা দ্বিগুণ উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, আমি সবকিছু জেনেই বলেছি। আমার কাছে সবকিছুর প্রমাণ আছে। প্রয়োজন হলে যথাস্থানে আমি তা উত্থাপন করব।
আসলামের মেজাজটা আবার একটু চড়ে গেল। না তুমি ভুল শুনেছো, বা তোমাকে কেউ ভুল বুঝিয়েছে। আসল কথা হল আমার সঙ্গে কারও প্রেম হলে, বা যাকে ভালোবাসি তার বিয়ে হয়ে যায় অন্য কারও সঙ্গে। বল এটা আমার দোষ?

ও, তাহলে তোমার সঙ্গে যে কারও প্রেম হলেই তার বিয়ে হয়ে যায়! এতদিন খেয়ে মধু, এখন সাজছ সাধু। তাহলে তো আমারও অন্য কারও সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাওয়ার কথা। কই আমার তো বিয়ে হয় না। কথাগুলো বলার সময় সোমার কণ্ঠস্বরে একটু ঝাঁঝ মিশে গেল।
আর তোমাকে আফসোস করতে হবে না। আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। বিয়ের প্রতিজ্ঞা করেই তো আমার সঙ্গে মেলামেশা শুরু করেছিলে। তবে এখন কেন বিয়ে করতে চাও না। তোমার আর কোন কথা আজ আমি শুনতে চাই না। তোমাকে আর সুযোগ দিয়ে ঝুকি নিতে আমি রাজি না।
এ তোমার বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে সোমা!
মোটেই হচ্ছে না।

আমি কার ছেলে তুমি জান না! তুমি নিশ্চই আমার ক্ষমতা সম্পর্কে, এলাকায় আমার চেয়ারম্যান বাপের টাকা, প্রভাব প্রতিপত্তি সম্পর্কে জান? গোটা প্রশাসন, পুলিশ আমার বাপের পকেটে। আর তুমি সামান্য একটা স্কুল মাস্টারের মেয়ে। তোমার মতো একটা মেয়েকে আমি ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখি। তুমি কি ভেবে দেখেছো বাইরের পৃথিবীতে তুমি আমাকে ছাড়া কতটা অসহায়!
ভালো করেই জানি। তাতে আমার কিছু আসে যায় না। তোমাকে আর আমাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবেনা। কোনও নারীকে ভালবাসার কথা বলে, বিয়ের কথা দিয়ে বিয়ে না করা মস্ত বড় ক্রাইম।হয় এখনই বিয়েটা রেজিস্ট্রি করো, নয়তো চললাম। লাল দেয়ালের ভেতরের ভাত খাওয়া কেউ ঠেকাতে পারবে না তোমার, সোমা ডেসপারেটলি বলল।
তীরের মত কথা গুলো আসলামের বুকে গিয়ে বিঁধল। আসলামের চোখ দুটো জ্বলে উঠতে গিয়েও কিরকম যেন ঠান্ডা মেরে গেল!

আসলাম সোমার কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়।
বলে, আর একটি বারের জন্য কি আমায় একটু চান্স দিতে পারা যায় না? দোহাই তোমার।
সোমা তীক্ষ্ণ গলায় বলে ওঠে, আর এসব নাটক করতে এসো না। রেহাই দাও আমায়। মনে রেখো আমি একটা রক্তমাংসের মানুষ।
আসলাম চুপ করে গেল।
হাতের মোবাইলটা মেঝেতে আছড়ে ফেলল আসলাম। সোমাকে বলল, তবে জেনে রেখো আমাকে যদি বাধ্য হয়ে তোমাকে বিয়ে করতেই হয়, তবে কোনদিন তুমি আমার মন পাবে না। তোমার ভোগান্তির শেষ থাকবে না।

এটা কি আমি সেই প্রেমিকের মুখ থেকে শুনছি যে আমাকে বলেছিল আমি কোন দিন তোমার একটি কথারও অবাধ্য হব না। তোমাকে আমি কোনো দিন ফুলের ছোঁয়াও দেব না। আসলামকে বলল সোমা।
আসলাম মাথা নিচু করে শুনল, কিছু বলল না।
আসলামকে শেষ পর্যন্ত বিয়েটা করে ফেলতেই হল। বিয়ে করবেনা করবে করেও শেষ পর্যন্ত বিয়ের পিঁড়িতে বসতেই হলো। আইনি ঝামেলায় যেতে চাইলনা। সে চিন্তা করলো আজকাল পুরুষের বিরুদ্ধে করা নারীর অভিযোগকেই সবার আগে আমলে নেয়। তার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। কাজেই জল ঘোলা করে লাভ নেই।

সোমা এতটা চাপ সৃষ্টি করবে, সে এভাবে ধরা খাবে তা ভাবতেই পারেনি। প্রথমে ভেবেছিল অন্যান্য বারের মতো এর বেলাতেও প্রেম-প্রেম খেলাটা কিছু দিন চালিয়ে তার পর সুযোগ মতো চম্পট দেবে। সোমা হয়তো তাদের গোপণ মেলামেশার ছবি ভাইরালের ভয়ে সমাজের কথা চিন্তা করে সবকিছু মুখ বুজে মেনে নিবে। কিন্তু রীতিমতো ফাঁসানো হল তাকে। বুঝতে পারলেও আর ফেরার কোনও উপায় নেই। এর আগে বহু বার অনেকের সঙ্গে এ রকম খেলা খেলেছে সে, তাই আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি ছিল না। কিন্তু হঠাৎ হলটা কী? হঠাৎ বোকাসোকা টাইপের সোমার এত সাহস এল কোথা থেকে? ঠিক বুঝে উঠতে পারল না আসলাম।
সোমাকে দেখে কোনও দিনই তেমন চালাক-চতুর মনে হয়নি, সহজ সরল মনে হয়েছে। আসলাম নিশ্চিন্ত ছিল, এ জিনিস বিয়ে পর্যন্ত টানতে অত তাড়াতাড়ি সাহস পাবে না সোমা। কিন্তু সব ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিয়ে গলায় বিয়ের ফাঁস ঝুলিয়ে দিল।
ফুলশয্যার রাতে সব কাজকর্ম মিটতে মধ্যরাত পেরিয়ে গেল। আসলাম ঘরে এসে খাটে বসার পর সোমা বলল, “তুমি খুশি হওনি?”

আসলাম জোর করে হেসে বলল, “তুমি আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আইনের ভয় দেখিয়ে আমাকে জোরকরে বিয়ে করলে, আর আমি খুশি হবো, এটা কেমনে ভাবতে পারলে? তুমি আমার চাহিদার ব্যাপারে উদাসীন। এ তো পুরোদস্তর বøাকমেইল! আসলামের চোখ গোল গোল।
“আর তুমি যে আমার সঙ্গে এতদিন প্রেমের অভিনয় করেছ, সেটা বøাকমেইল নয়? একটা মেয়ের ভালবাসার মূল্য, বিশ্বাসের মূল্য, এ সব তুমি বোঝো? তোমার সম্পর্কে ভালোভাবে যাচাইবাছাই না করে, অন্দধভাবে বিশ্বাস করে ভুল করেছিলাম।
আমি জানতাম তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে-টিয়ে টিকবে না। কারণ তোমার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আমার নিজের মিল নাই। তবু আমি জেনেবুঝেই আইনের ভয় দেখিয়ে তোমাকে বিয়ে করেছি, কেন জানো? তোমাকে শিক্ষা দেব বলে। তোমার চরিত্র সম্পর্কে জেনে যে আঘাত আমি পেয়েছিলাম, সেই আঘাত আমি তোমায় ফিরিয়ে দেবৃ তবে অন্য ভাবে। তখন তুমি বুঝবে কেমন লাগে।

মানে? কী করতে চাও তুমি? বিস্ময় কাটাতে পারছে না আসলাম।
তুমি আমাকে ভাল না বাসলেও আমি কিন্তু তোমাকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালবেসেছিলাম। আজও বাসি। কারণ ভালবাসাটা আমার কাছে ঠুনকো ব্যাপার নয়। কিন্তু একতরফা ভালবাসার মূল্য তো আমি পাব না। তাই বলে ভেবনা এই জীবন শেষ করে দিব। তোমার সামনে মরে তোমাকে আমার ভালবাসার অঞ্জলি দিয়ে যাব। যদি মিনিমাম বিবেক থাকেৃ এক দিন তোমার আফসোস হবেৃ হবেই।
হুমকি দিচ্ছৃ না অভিশাপ? আসলাম জোর করে হাসার চেষ্টা করে।
“কোনওটাই নয়। আমি হুমকিৃ অভিশাপ এ সবে বিশ্বাস করি না। আমি ভাগ্যে বিশ্বাস করিনা, কর্মে বিশ্বাস করি। একজন মেয়ে হিসেবে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মতো, নিজের মতো করে বাঁচতে পারার মতো, স্বসন্মানে সমাজে বেঁচে থাকার মতো পড়াশোনা, শিক্ষা আমার আছে। তোমাকে ছাড়া আমি ভালভাবেই চলতে পারব। সে আর্থিক সঙ্গতি আমি অর্জন করতে পারব। আমাকে নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবেনা। কারো ভরসায় থেকে নিজেকে ঘরের কোনায় বন্দি করে রাখার মতো মেয়ে আমি নই। তোমাকে মুক্তি দিচ্ছি। আমাকে ভালোবাসার ভাণ করে অভিনয় করার জন্য আর সময় নষ্ট করতে হবে না।

আসলাম কোন কথা বলে না, মাথা নিচু করে থাকে।
তার পর সোমা নিস্তেজ গলায় বলল, আমি দুর্বল মেয়ে না যে তোমার ওপর প্রতিশোধ নেব। যদিও আজ থেকে তোমার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক থাকবে না, তবুও একজন মানুষ হিসেবে বলছি, ভাল থেকোৃ আমি চললাম। বাকিটা তোমার কর্মফলই নির্ধারণ করবে।
আসলাম ভাবলেশহীনভাবে সোমার চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। লেখক : গল্পকার