সেরীন ফেরদৌস : পৃথিবী জুড়ে দুষ্প্রাপ্যতা, বড় বড় দেশগুলোর মজুদ প্রবণতা কিংবা রপ্তানিতে বাধা দেওয়ার খবর, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, নানারকম রাজনৈতিক-ক‚টনৈতিক দোলাচল কভিডের ভ্যাকসিন নিয়ে মানুষের মনে যে উৎকণ্ঠার জন্ম দিয়েছিল, ‘মিক্স ও ম্যাচ’ শব্দগুলো সেই উদ্বেগকে দূর করে দিয়ে উদ্বেলিত করতে শুরু করেছে। দেশে দেশে কভিডের ভ্যাকসিন কাজ করতে শুরু করলেও ভ্যাকসিন পাওয়া না পাওয়ার উৎকণ্ঠা মানুষকে আলোড়িত করেছে সবচেয়ে বেশি। এই উদ্বেগ থেকেই মানুষের মনে প্রশ্ন জেগেছেকোনো একটি কোম্পানির ভ্যাকসিন প্রথম ডোজ হিসেবে নিয়ে দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে অন্য কোম্পানির ভ্যাকসিন নেওয়া যাবে কি না! এই প্রশ্নটা মানুষের মনে জেগেছিল বেশি দিন নয়। এর উত্তরের জন্যও তাদের বেশি দিন অপেক্ষায় থাকতে হয়নি। গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল বলছে কভিডের ভ্যাকসিনের ‘মিক্স এবং ম্যাচ’ নিরাপদই কেবল নয়, কার্যকরও। একই ব্র্যান্ডের দুটি ভ্যাকসিনের চেয়ে ভিন্ন ব্র্যান্ডের ‘মিক্স এবং ম্যাচ’ অনেক ক্ষেত্রে অধিকতর কার্যকর বলেও গবেষণায় তথ্য পাওয়া গেছে। করোনার ভ্যাকসিন এসেছে বা ভ্যাকসিন কাজ করতে শুরু করেছে এই খবরের মতোই ভ্যাকসিনের ‘মিক্স ও ম্যাচ’ এর খবরটি মানুষকে সমান উদ্বেলিত করেছে।
ভ্যাকসিনের ‘মিক্স ও ম্যাচ’ নিয়ে নানা দেশের স্বাস্থ্য বিভাগ ইতিবাচক চিন্তাভাবনা করলেও আনুষ্ঠানিকভাবে গবেষণা করেছে যুক্তরাজ্য। স্পেন আরেকটি গবেষণা করলেও যুক্তরাজ্যেরটিই হচ্ছে সবচেয়ে বড় গবেষণা। চলতি সপ্তাহে আন্তর্জাতিক চিকিৎসাবিজ্ঞান সাময়িকী ‘ল্যানসেট’-এ যুক্তরাজ্যের গবেষণার ফল প্রকাশিত হলে সারা বিশ্বেই করোনা ভ্যাকসিনের ‘মিক্স ও ম্যাচ’ নিয়ে প্রবল আগ্রহ তৈরি হয়। এই গবেষণার সূত্র ধরেই কানাডা কভিড ভ্যাকসিনের ‘মিক্স ও ম্যাচ’-এর অনুমোদনের ঘোষণা দিয়েছে। ফলে দেশটি প্রথম ডোজ হিসেবে যাদের অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন দিয়েছিল তাদের দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে ফাইজার অথবা মডার্নার ভ্যাকসিন দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কেবল কানাডাই নয়, বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের জন্যই ভিন্ন ভিন্ন ভ্যাকসিনের ‘মিক্স ও ম্যাচ’ করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। ‘মিক্স ও ম্যাচ’ এর আগ্রহটা তৈরি হয়েছিল মূলত অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের সঙ্গে রক্ত জমাট বাঁধার সম্পর্ক নিয়ে অভিযোগ ওঠার পর। প্রথম ডোজ হিসেবে অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন নেওয়া মানুষ যদি কোনো কারণে দ্বিতীয় ডোজ নিতে না চায়, সেজন্য বিকল্প একটা ব্যবস্থা জরুরি হয়ে পড়েছিল। পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী ভ্যাকসিন সরবরাহের নানা প্রতিক‚লতাও মাথায় ছিল।
যুক্তরাজ্যের গবেষণায় ৫০ বছরের বেশি বয়সী ৮০০ জন স্বেচ্ছাসেবককে নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়। প্র্রথমে অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং পরে ফাইজার, আবার প্রথমে ফাইজার এবং পরে অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন দিয়ে তার কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়। প্রাথমিক ফলাফলে এই ‘ম্যাচ ও মিক্স’ কার্যকর এবং নিরাপদ বলে প্রমাণ পেয়েছেন গবেষকরা। ফাইজারের ভ্যাকসিনের প্রয়োগের সূত্র ধরেই গবেষকরা মডার্নার ভ্যাকসিনকেও ‘মিক্স ও ম্যাচ’-এর আওতায় নিয়ে আসেন। কারণ এই দুটিই হচ্ছে ‘এমআরএনএ’ ভ্যাকসিন। ইংল্যান্ড এবং স্পেনের গবেষণা ফাইজার ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং মডার্না ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার ‘মিক্স ও ম্যাচ’কে নিরাপদ বলে মত দিয়েছে। আবার কেউ চাইলে ফাইজার এবং মডার্নার ‘মিক্স ও ম্যাচ’ও করতে পারবে যেহেতু দুটি একই প্রজাতির ভ্যাকসিন। স্পেনের গবেষণা বলেছে, ‘মিক্স ও ম্যাচ’ একই ধরনের দুটি ভ্যাকসিনের চেয়ে বেশি অ্যান্টিবডি তৈরি করে। তবে তাদের গবেষণাটি এখনো সহকর্মী গবেষকদের দ্বারা পর্যালোচনা হয়নি।
স্পেনের গবেষণাটিতে ১৮ থেকে ৫৯ বছর বয়সী মোট ৬৭০ জন স্বেচ্ছাসেবক অংশ নেয়। তাদের মধ্যে ৪৫০ জনের প্রথম ডোজ ছিল অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং দ্বিতীয় ডোজ ছিল ফাইজারের। পরে এদের রক্ত পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে এদের রক্তে আইজিজি অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে প্রচুর পরিমাণে। আইজিজি অ্যান্টিবডির একটা প্রধান কাজ হলো মেমোরিসেল তৈরি করা। এই মেমোরিসেলগুলো করোনাভাইরাসকে শত্রæ হিসেবে স্মৃতিতে চিহ্নিত করে রাখে। পরবর্তী সময়ে আসল করোনাভাইরাস শরীরে প্রবেশ করা মাত্র মেমোরিসেল এদের চিনতে পারে এবং দেরি না করে দ্রæতহারে অ্যান্টিবডি তৈরি করা শুরু করে এবং শরীরের করোনা প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায়। দেখা গেছে, যারা শুধু অ্যাস্ট্রাজেনেকার একটি ডোজ নিয়ে বসেছিল তাদের রক্তে মেমোরিসেলের পরিমাণের চেয়ে ‘মিক্স ও ম্যাচ’ ভ্যাকসিন নেওয়া ৪৫০ জন স্বেচ্ছাসেবকের রক্তে আইজিজি অ্যান্টিবডি ৩০ থেকে ৪০ গুণ বেশি। শুধু তাই নয়, স্পেনের গবেষণাতে আরও দেখা গেছে যে, অ্যাস্ট্রাজেনেকার দুটি ডোজ যারা নিয়েছে তাদের চেয়ে ‘মিক্স ও মাচ’ ডোজ নেওয়া স্বেচ্ছাসেবকদের রক্তে করোনা নিষ্ক্রিয়করণে সক্ষম অ্যান্টিবডি ৭ গুণ বেশি পাওয়া গেছে। কানাডার প্রধান জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা ড. থেরেসা ট্যামের মতে, স্প্যানিশ গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য এই সুখবর দেয় যে ‘মিক্স ও ম্যাচ’ ভ্যাকসিন বরং আরও শক্তিশালী সুরক্ষা দিচ্ছে মানুষকে। ড. থেরেসা ট্যাম বলেছেন, ফাইজার এবং মডার্না একই ধরনের ভ্যাকসিন। ফলে এ দুটো যে অদলবদল করে নেওয়া যাবে, সেটা নতুন তথ্য নয়। ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং হেপাটাইটিস-এ ভ্যাকসিনের বেলায়ও অতীতে বহুবার এমন করা হয়েছে।
দুই ধরনের ভ্যাকসিনের ‘মিক্স ও ম্যাচ’ কতটা নিরাপদ তা নিয়ে সংশয় বা প্রশ্নের শেষ হয়নি। যুক্তরাজ্যের গবেষণার প্রাথমিক ফলাফলে ‘মিক্স ও ম্যাচ’-এর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ভ্যাকসিনের ‘মিক্স ও ম্যাচ’ প্রয়োগের ফলে ইমিউন প্রতিক্রিয়া, যেমন জ্বর, ক্লান্তি, মাথাব্যথা ইত্যাদি হবে এবং সেটি হবে সাধারণ সময়ের চেয়ে একটু বেশি তীব্র। ইউনিভার্সিটি অফ অক্সফোর্ডের প্রফেসর ডা. ম্যাথিউ স্ন্যাপ এ সপ্তাহেই বলেন, ইমিউন উপসর্গগুলো হালকা থেকে মাঝারি মাপের পাওয়া গেছে। তবে এই উপসর্গগুলো অতি অল্পসময় পরেই বিলীন হয়ে যায় এবং কোনো ক্ষতির আশঙ্কা নেই।
যুক্তরাজ্য, স্পেনের বাইরে কানাডা নিজেরাও ‘মিক্স ও ম্যাচ’-এর নিজস্ব একটি গবেষণা শুরু করেছে। এখন ১৮ বছরের বেশি বয়সী ১৩০০ স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে কানাডা ‘মিক্স ও ম্যাচ’-এর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসা বিষয়ে অত্যন্ত খুঁতখুঁতে কানাডা নিজেদের পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই ভ্যাকসিনের ‘মিক্স ও ম্যাচ’-এর অনুমোদন কীভাবে দিল? বিভিন্ন মিডিয়ায় দেওয়া কানাডার স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতামত থেকে এই বিষয়ে একটা পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়। কানাডার প্রখ্যাত ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক অ্যালিসন কেলভিন সিবিসি নিউজকে বলেছেন, ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এবং বাস্তবে পরীক্ষা করার পর যতটুকু তথ্য পাওয়া গেছে তাতে আমরা নিশ্চিত যে, ফাইজার এবং মডার্না একে অপরের পরিপূরক। এ দুটোকে ‘মিক্স ও ম্যাচ’ করলে কারও ক্ষতির আশঙ্কা নেই। এ দুটোর ইমিউন রেসপন্সও মোটামুটি একইরকম।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মানুষের শরীরের ইমিউন সিস্টেম বেশ কয়েক রকমের অ্যান্ডিবডি তৈরি করে রোগপ্রতিরোধ করে থাকে। একেকটি ভ্যাকসিন একেকভাবে সেই অ্যান্টিবডি তৈরিতে সাহায্য করে থাকে। কোনো একক ভ্যাকসিন সবধরনের অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারে না। সেই হিসেবে ভিন্ন ধরনের ভ্যাকসিন ভিন্ন ভিন্ন টাইপের অ্যান্টিবডি তৈরিতে সাহায্য করে করোনা প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারবে। এ প্রসঙ্গে আরও একটি ইস্যুতে মানুষের স্বস্তি ফিরে আসার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তা হলো, অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন গ্রহণকারী মানুষের এক অতি ক্ষুদ্র অংশের বেলায় বিরল প্রজাতির একধরনের বøাড ক্লটের ঘটনা ঘটেছে। কানাডায় দ্বিতীয়বার অ্যাস্ট্রাজেনেকা গ্রহণকারী ব্যক্তির ভেতরে বøাড ক্লটের ঘটনা ঘটেছে ৬ লাখ জনের ভেতর ১ জনের। মিক্স ও ম্যাচের এই সুযোগে সেই আশঙ্কারও অবসান ঘটতে চলেছে।
তবে ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ হোরাশিও ব্যাচ মনে করেন ‘মিক্স ও ম্যাচ’ বিষয়ে ট্রায়ালে অংশ নেওয়া ভলান্টিয়ারের সংখ্যা কোনো চূড়ান্ত মন্তব্য করার জন্য কম। সিবিসি নিউজকে তিনি বলেন, দেখেন অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের বেলায় ট্রায়ালে অংশ নিয়েছিল ৩২ হাজার ভলান্টিয়ার। সেই ট্রায়ালে রক্ত জমাট বাঁধার প্রার্শ¦-প্রতিক্রিয়ার কথা জানা যায়নি যতক্ষণ না মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ ভ্যাকসিনটি নিয়েছে। অন্যদিকে, ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর এবং ইনফেকশাস ডিজিজ স্পেশালিস্ট ডা. জেইন চাগলা, যিনি এই ট্রায়ালের সঙ্গে জড়িত নন, এক সাক্ষাৎকারে বলেন, মিক্সডোজের ভ্যাকসিন লম্বা মেয়াদে ঠিক কতদিন কাজ করবে কভিড প্রতিরোধে তা জোর দিয়ে বলার সময় এখনো আসেনি। তবে মিক্স ও ম্যাচ ভ্যাকসিন কভিড প্রতিরোধে সাফল্যের আভাস দিচ্ছে তা এখনই বলা চলে।
লেখক : কানাডায় কর্মরত নার্স ও প্রবাসী সাংবাদিক