মোস্তফা ইমরান রাজু, মালয়েশিয়া : ধর্ম, সংস্কৃতি, আবহাওয়া এমন অনেক কিছুই মিল রয়েছে মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যে। মুলত এই মিল থাকার কারণে মালয়েশিয়ায় এসে খুব সহজে-ই নিজেদের মানানসই করে নিতে পারে বাংলাদেশিরা। এছাড়া মালয় ভাষা আয়ত্ব করায় বাংলাদেশিরা বেশ পটু। অন্যান্য দেশের নাগরিকেরা এতো সহজে মালয় ভাষা আয়ত্ব করতে পারে না যত সহজে বাংলাদেশিরা পারেন। মালয় ভাষা আয়ত্ব করার ফলে ইংরেজি ভাষার খুব একটা প্রয়োজন হয় না। বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষায় দুর্বল বাংলাদেশীকর্মীরা মালয়েশিয়াকে বেছে নেয় অনেকটা এই ভাষার কারনেও।
এ ছাড়া খাবারের ক্ষেত্রেও রয়েছে বিশেষ মিল। মালয়রা সাধারণত ভাত, সবজি, মুরগি খেতে পছন্দ করেন। তবে ভাতের পরিমাণ কম এবং পানীয় জাতীয় খাবার ছাড়া চলেই না মালয়েশিয়ানদের। চা আর কফি’র নানা রুপ আর বৈচিত্র্য রয়েছে মালয়শিয়ায়। পানীয় জাতীয় প্রায় সবকিছুতে অধিক মাত্রায় বরফ খেতে পছন্দ করেন তারা।
এখানে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশীদের তাই খাবারে কোনো সমস্যাই হয় না। প্রত্যেকটি রেস্তোরাই ভাত, সবজি, চিকেন পাওয়াই যায়। এ ছাড়া সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গড়ে উঠেছে অনেক বাংলাদেশি রেস্তোরা যেখানে দেশের মতো প্রায় সব ধরনের খাবার পাওয়া যায়।
৬১ শতাংশ মুসলিম অধ্যুষিত দেশটিতে ধর্মীয় চর্চায় রয়েছে অবাধ স্বাধীনতা। ইসলাম চর্চায় মালয়েশিয়া বেশ এগিয়ে। মসজিদ, মাদ্রাসার পাশাপাশি স্কুলেও ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হয় খুব গুরুত্বের সঙ্গে। মালয় মুসলিমদের একটা বড় অংশ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে মসজিদে। প্রায় প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানে নামাজের জন্য নির্ধারিত জায়গা এবং নামাজ আদায়ের জন্য বিরতিও দেওয়া হয়। এমনকি মহাসড়কগুলো’র পাশে যাত্রীদের বিরতির জন্য সরকারিভাবে গড়ে তোলা হয়েছে পার্কিং, খাবারের দোকান, ওয়াশরুম এবং নামাজ আদায়ের জন্য পুরুষ ও নারিদের নির্ধারিত জায়গা। মুসলিম ছাড়াও মালয়েশিয়ায় বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা বসবাস করে আসছে সৌহার্দ্য, সম্পৃতির মাধ্যমে। এখানে বড়দিন, ঈদ, কিংবা পুজা সবউৎসবে-ই পুরো মালয়েশিয়া ঝলমলিয়ে ওঠে নতুন সাঁজে ।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর মালয়েশিয়া পর্যটকদের জন্য দারুন আকর্ষনীয়। পাহাড়, সমুদ্র আর সবুজ অরন্য সব মিলিয়ে মালয়েশিয়া রুপ, বৈচিত্রে অনন্য। বছরজুড়ে দেশটিতে বিদেশী পর্যটকে মুখরিত থাকে। সময় আর সুযোগ পেলে এখানে কর্মরত প্রবাসীরাও ছুটে যায় এসব জায়গা ঘুরতে। কম খরচে দর্শনীয় স্থান দেখার সুযোগ সম্ভবত মালয়েশিয়ার মতো খুব কম দেশে-ই রয়েছে।
মালয়েশিয়ায় আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা করছেন। তারা তাদের মেধা এবং যোগ্যতায় অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীদের পেছনে ফেলে খুব ভালো ফলাফলও করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আয়োজিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দেশের সংস্কৃতি উপস্থাপন করে নিয়মিত সুনাম অর্জন করে আসছে এসব শিক্ষার্থীরা। এসব কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলাদেশী অনেক শিক্ষকও রয়েছে যারা দীর্ঘদিন ধরে এখানে কর্মরত।
স্বাধীনতার পর মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশীদের বেশি বেশি আসা শুরু হয় নব্বই দশক থেকে। বর্তমানে প্রায় ১০ লাখ বাংলাদেশী নানা শ্রেনী পেশায় কর্মরত এখানে। এর মধ্যে অনেক তরুণ এখানকার মেয়ে বিয়ে করে ঘর বেঁধেছেন। মালয়েশিয়াতেই এদের পরবর্তী প্রজন্ম বেড়ে উঠছে মালয়েশিয়ান হিসাবেই। এ ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যে বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশিরা। বিশেষ করে মুদি খানার দোকান, রেস্তোরা ব্যবসায় পুরো মালয়েশিয়া জুড়ে রয়েছে বাংলাদেশিদের আধিপত্য। দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছেন এমন বাংলাদেশিরা মিলে এখানে গড়ে তুলেছেন ছোট, বড় কমিউনিটি। সময় আর সুযোগ পেলেই তারা পরিবার পরিজন নিয়ে মিলিত হয়, মেতে ওঠে দেশীয় সংস্কৃতিতে।
এ ছাড়া মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোমে’র সুযোগ গ্রহন করেছেন প্রায় ৫ হাজার বাংলাদেশী পরিবার। স্ব-পরিবারে দেশটিতে থাকার সুযোগ পেয়েছেন এসব সেকেন্ডহোমধারীরা।
নরম হৃদয়ের মালয়েশিয়ানরা বাংলাদেশীদের ভাই, বন্ধু, কিংবা আত্মার আত্মীয় হয়ে গেছে। সৌহার্দ্য, সম্প্রীতির মালয়েশিয়া তাই বাংলাদেশীদের জন্য স্বর্গরাজ্য।