ফরিদ আহমেদ: অনেক আশা নিয়ে ছবিটাকে মুক্তি দিয়েছিলেন এর পরিচালক। এমন আশা অবশ্য সব পরিচালকই করেন। সেই আশা সবার পূরণ হয় না। কোনোটা সফল হয়, কোনোটা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ছবিটা চলছে কোলকাতার বনশ্রী প্রেক্ষাগৃহে। হল একদমই ফাঁকা। বাইরে দাঁড়িয়ে টেনশনে রুমাল কামড়াচ্ছেন দীর্ঘদেহী পরিচালক। এমনটা যে হবে, সেটা তিনি না বুঝলেও তাঁর ছবির সম্পাদক সাহেব আগেই বুঝেছিলেন। আগের দিন ট্রায়াল শো করার সময়ে অপারেটর খেঁকিয়ে উঠেছিলো এই বলে যে, ‘এটা একটা ছবি। এত খারাপ ছবি আমাদের প্রজেক্টরে আর ওঠেনি।’ রাতের পর রাত জেগে সম্পাদনা করার পরে এমন কথা শুনলে কেমন লাগে সেটা সহজেই অনুমেয়।

সময় গড়ানোর সাথে সাথে অল্প কিছু লোক জড়ো হলো। এদের মধ্যে একজন হচ্ছেন আনন্দবাজার পত্রিকার পঙ্কজ দত্ত। পরদিন তিনি পত্রিকাতে রিভিউ লিখলেন। সেই রিভিউতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলো ‘পথের পাঁচালী’ ছবি আর তাঁর পরিচালকের প্রতি এক রাশ মুগ্ধতা। বাংলা চলচ্চিত্রের পৃথিবীটাকে এক ঝটকায় পাল্টে দিয়েছিলো ‘পথের পাঁচালী’। ১৯৫৫-৫৬ সালে গোটা দশেক আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়ে যায়।

সেই পঞ্চান্ন সাল থেকে শুরু হয় সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র জীবন, শেষ হয় ১৯৯২ সালে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চলচ্চিত্রের জন্য কাজ করে গিয়েছেন। এর মধ্যে অর্জন করেছেন অনেক কিছুই। বাংলা চলচ্চিত্রেরই সেরা ব্যক্তিত্ব তিনি নন, ভারতীয় উপমহাদেশেরও সেরা চলচ্চিত্রকার তিনি।

বাঙালিদের মধ্যে অল্প যে ক’জন মহীরুহ আছে, তিনি তাদের মধ্যে একজন। বহুমুখী প্রতিভা ছিলো তাঁর। সাহিত্য সাধনা, ছবি আঁকা, সঙ্গীত, এমন নানা বিষয়ে তিনি ছিলেন একজন সৃষ্টিশীল মানুষ। জীবন শুরু করেছিলেন ছবি আঁকা দিয়ে। ওটাই ছিলো তাঁর পেশা। কিন্তু, সেখান থেকে সরে আসেন চলচ্চিত্রে। এর কারণ হিসাবে অভিনেতা সৌমিত্র চ্যাটার্জিকে বলেছিলেন যে, “দেখ, আমি যখন শান্তিনিকেতনের ছাত্র ছিলাম তখন একবার আমরা সারা ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ছবি আঁকতে গিয়েছিলাম। অজন্তা-ইলোরাও দেখলাম। দেখলাম সাহিত্য ও শিল্পে অসামান্য সৃষ্টি ভারতে ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে। কোনও দিকে আর শীর্ষে ওঠার তেমন সুযোগ নেই এটা আমি বুঝে ফেলেছিলাম। সেজন্য আমি এমন একটা শিল্প মাধ্যম বেছে নিয়েছি যেখানে নতুন কাজ করার জায়গা আছে, আমাদের দেশে সিনেমা নিয়ে এখনও বেশি কিছু হয়নি। সেই জন্যেই সিনেমা করছি।” তাঁর এই বক্তব্য থেকেই বোঝা যায় শীর্ষ পর্যায়ের কাজ করার জন্য কতোখানি ব্যাকুল ছিলেন তিনি।

পথের পাঁচালি করার দুই তিন বছরের মধ্যেই তাঁর সংস্পর্শে আসেন অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। পথের পাঁচালীর সিকোয়েন্স ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রের মূল চরিত্রের জন্য একজন অভিনেতা খুঁজছিলেন সত্যজিৎ রায়। তাঁর নিযুক্ত লোকেরা সৌমিত্রকে খুঁজে বের করে নিয়ে আসে তাঁর কাছে। সৌমিত্র তখন তরুণ একটা ছেলে। শিশির ভাদুড়ির সাথে নাটক করে বেড়ান। ‘অপুর সংসার’ সিনেমার অপু চরিত্রের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে আগমন ঘটে তাঁর।
অপুর সংসার মুক্তি পায় ১৯৫৯ সালে। সেখান থেকে শুরু করে দীর্ঘ চৌত্রিশ বছর সত্যজিৎ রায়ের সাথে কাজ করেছেন সৌমিত্র। তাঁর ভাষায়, “মানিকদার কাছ থেকে যা পেয়েছি তার জন্যেই বাকি আয়ুকালটা বাঁচা যায়Ñ কাজ করার প্রেরণা পাওয়া যায়।”

দীর্ঘ একটা সময় সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে অভিনয়ের কারণে তাঁর সম্পর্কে একটা ভালো ধারণা রয়েছে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। একেবারে তরুণ বয়স থেকে তাঁকে তৈরি করেছেন সত্যজিৎ রায়। ফলে, এই মানুষটার শুধুমাত্র কাজের জায়গা নয়, অনেক ব্যক্তিগত বিষয়ও তাঁর জানা আছে। সৌমিত্র এগুলো নানা সময়ে নানা পত্রিকাতে বিচ্ছিন্নভাবে লিখেছেন। তাঁর লেখা অন্য বই ‘অগ্রপথিকেরা’ কিংবা ‘চরিত্রের সন্ধানে’-ও সত্যজিৎ রায়ের প্রসঙ্গ এনেছেন। বিষয় হচ্ছে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর কাজের কারণে সত্যজিৎ রায়ের সাথে এমনই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত যে যে কোনো আলোচনায় সত্যজিৎ রায়কে টেনে আনা ছাড়া তাঁর অন্য কোনো উপায়ও থাকে না।

অন্য বইতে যেখানে তিনি সত্যজিৎ রায়কে খণ্ডভাবে এনেছেন, সেখানে তাঁর লেখা ‘মানিকদার সঙ্গে’ পুরোটা সত্যজিৎ রায়ের স্মৃতি দিয়ে মোড়া। সত্যজিৎ রায়কে খুব কাছে থেকে দেখা একজন শক্তিমান অভিনেতা এবং সুলেখকের হাত দিয়ে এই বই বের হয়েছে বলে পাঠকের পক্ষে তৃতীয় একটা অবস্থান থেকে সত্যজিৎ রায়কে দেখার সুযোগ তৈরি হয়ে যায়। এই সমস্ত মহীরুহদের জন্মগতভাবেই অপরিসীম মেধা থাকে, এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু, শুধু মেধা দিয়েই যে অনন্য উচ্চতায় যাওয়া যায় না। তার সাথে কঠোর পরিশ্রম এবং আত্মনিবেদন লাগে। সেটার একটা চিত্র আমরা দেখতে পাই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের এই বই থেকে।

সত্যজিৎ রায় কীভাবে কাজ করতেন, তাঁর চলচ্চিত্রের শিল্পীদের তিনি কীভাবে নির্বাচন করতেন, কীভাবে তাঁদের চরিত্রের জন্য তৈরি করতেন, এগুলো সবই পাওয়া যাবে এই বইতে।

আগেই বলেছি, সৌমিত্র যখন ‘অপুর সংসার’ করেন, তখনো তিনি ফিল্মে অভিনয় করেননি। সত্যজিৎ রায় নিয়মিত তাঁকে আমন্ত্রণ জানাতেন ‘জলসাঘর’ এবং ‘পরশপাথর’ ছবির শুটিং এ যাবার জন্য। উদ্দেশ্যে ছিলো এই নতুন অভিনেতাকে ফিল্মের শুটিং এর সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া, যাতে করে অপুর সংসার করার সময় অভিজ্ঞতার অভাবে না ভোগে। এর বাইরে স্ক্রিপ্ট নিয়েও দীর্ঘ আলোচনা করেছেন তিনি সৌমিত্রের সাথে। অপুর চরিত্র বুঝিয়ে দেবার জন্য আলাদা করে দুই পৃষ্ঠার নোটও দিয়েছিলেন অপুর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে।
এমন যতœ নিয়ে তৈরি করার পরেও ক্যামেরার সামনে প্রচুর স্বাধীনতা তিনি দিতেন শিল্পীদের। তাঁর যুক্তি ছিলো যে চরিত্রের জন্য যাঁকে তিনি নির্বাচন করেছেন, সেই চরিত্রটা বোঝার সক্ষমতা তাঁর আছে। ফলে, বেশি কর্তৃত্ব ফলিয়ে তাঁর স্বাভাবিক অভিনয়কে নষ্ট করতে চাইতেন না। এ প্রসঙ্গে সৌমিত্র লিখেছেন, সারাজীবনে মানিকদার ছবিতে আমি প্রাণ খুলে যথেষ্ট স্বাধীনতা নিয়ে অভিনয় করতে পেরেছি এবং সেটা সম্ভব হয়েছে তাঁরই জন্যে। সাধারণভাবে এ দেশের অনেকের ধারণা সত্যজিৎ রায় অতবড় পরিচালক, শুটিংয়ের সময় উনিই ডমিনেট করেন। আমার ক্ষেত্রে অন্তত বলতে পারি ব্যাপারটা ঠিক উল্টো হয়েছে।”
শুধু সৌমিত্রই নন, সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র ‘সীমাবদ্ধ’-তে মূল চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বরুণ চন্দ। তাঁরও অভিনয়ের কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিলো না। তাঁকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিলো এভাবে যে, “একজন নবাগত চলচ্চিত্র-অভিনেতা, যিনি প্রথমবার ক্যামেরার সামনে দাঁড়াচ্ছেন, তাঁকে উনি কীভাবে সামলাতেন বা, পরামর্শ দিতেন?”

এর উত্তরে বরুণ চন্দ বলেছিলেন, “পরামর্শ উনি একেবারেই দেননি। যখন একটি প্রধান চরিত্রে জন্য একজনকে বেছে নিতেন সত্যজিৎ, ভীষণভাবে নিশ্চিত থাকতেন যে তাকে দিয়েই হবে। উনি কিন্তু ছবি শুরুর আগে বলে দিয়েছিলেন, ‘বরুণ তোমাকে যখন আমি এই ছবিটার জন্য নিচ্ছি, ধরেই নিচ্ছি তুমি শ্যামলেন্দু চ্যাটার্জি-র চরিত্রটা বোঝো ও করতে পারবে। কিন্তু কখনো যদি মনে হয় তুমি যেটা করছ সেটা আমার গল্পের বা বক্তব্যের পরিপন্থী, তখন কিন্তু আমার কথামতো কাজ করতে হবে’। উনি কখনো ‘এমন ভাবে করো’, ‘এমন ভাবে বলো’, ‘এরকম ভাবে চলাফেরা করবে’ এরকম কিচ্ছু বলেননি। আমার সঙ্গে আলাপ পরিচয় হওয়ার পরও একবছর কেটে গেছে, তারপর ছবির কাজ শুরু। সবরকম ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন এক বছরেরও বেশি সময় ধরে।”

এর মানে এই না যে শুটিং এর সময়ে সত্যজিৎ রায় কিছুই বলতেন না। কোথাও কোনো ভুল ভ্রান্তি হলে ঠিকই সেটাকে পরিবর্তন করার জন্য বলতেন। সৌমিত্রের বর্ণনাতেও সেগুলো উঠে এসেছে। কাউকে যেমন প্রচুর স্বাধীনতা তিনি দিতেন, আবার কাউকে কাউকে একেবারে পুতুলের মতোও ব্যবহার করেছেন তিনি তাঁর ছবিতে।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মানিকদার সঙ্গে’ বইটা অত্যন্ত সুখপাঠ্য একটা বই। তিনি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। ভাষার উপর দখল তাঁর গভীর। অত্যন্ত ঝরঝরে ভাষা ব্যবহার করেছেন তিনি তাঁর বইতে। এ কারণে তরতর করে পড়ে ফেলা যায় বইটা। আমি যেমন এক বসাতেই শেষ করে ফেলেছি এটা। এতটুকু বিরক্ত লাগেনি কোথাও। বর্ষার আগমনে নদীতে যে স্রোত তৈরি হয়, সেই স্রোতে নৌকা ভাসিয়ে দিলে সেটা যেমন সাবলীলভাবে ভেসে যেতে থাকে, এই বইয়ের পাঠটাও সেরকম এক সাবলীল বিষয়। শুধু জানার জন্যেই না, আনন্দদায়ক পাঠের জন্যে হলেও এমন বই পড়া উচিত মাঝে মধ্যেই।