Home কলাম মাইন্ড দ্যা গ্যাপ!

মাইন্ড দ্যা গ্যাপ!

ঋতু মীর : “Mind the gap – it’s the distance between
life as you dream it
and life as it is”

প্লাটফর্মে ঢুকেই থমকে দাঁড়ায় সত্যবতী! চারদিকে থিকথিকে ভীড়। নির্ধারিত সময়ে ট্রেন আসতে দেরী হচ্ছে আজ। প্রতিদিনের মত চকিতেই মানুষের মুখে দৃষ্টি ফেলে সত্যবতী-ইতস্তত ছড়ানো ছিটানো বেশির ভাগ যাত্রীর চোখে মুখেই কাজ ফেরত ক্লান্তির ধূসর ছায়া! বিশেষ মনোযোগে ঘুরে তাকায় সত্যবতী- ওই যে ছেলেটা এমনভাবে ছুটছে কেন? প্লাটফর্মের নিরাপদ সীমানায় বরাবর দাঁড়ায় সত্যবতী। আজ আরও কিছুটা ভিতরে সরে আসে নিজের অজান্তে। প্লাটফর্মের হলুদ লাইনের সীমানা অতিক্রমের আইনকে তোয়াক্কা না করা বয়ঃসন্ধির যুবক একেবেকে হাঁটছে একেবারে কিনার ঘেঁষে। চোখে মুখে তারুণ্যের উদ্ধত্য, তাচ্ছিল্য, অকারণ স্মার্টনেস! কিছুটা সাথে থাকা বন্ধুদের দৃষ্টি আকর্ষণ, কিছুটা হয়তোবা উপস্থিত যাত্রীদের মনোযোগ আকর্ষণের অশোভন চেষ্টা। লাঠি হাতে বয়স্ক মহিলা হাঁটুতে ভর দিয়ে বেঞ্চ থেকে চমকে উঠে দাঁড়ায়- বিস্ফোরিত চোখ সত্যবতীর! এই বুঝি ধাক্কা লেগেই যেত! এই বুঝি লাঠিসহ নিমেষেই ছিটকে পরে যেত সে! এই বুঝি তলিয়ে যেত মাঝখানের অন্ধকার গহ্বরে! অথচ কি নির্বিকার এই যুবক! বেশভূষায় স্কুলের ছাত্র বলেই মনে হচ্ছে। ভ্রæ কুঁচকে ওঠে সত্যবতীর। শিক্ষকের আজন্ম জহুরী চোখে সে যেন নিমেষেই পড়ে নেয় ছেলেটার মনের ভাষা। ক্লাশের চার দেয়ালের বেড়াজাল ডিঙিয়ে এসে গোটা দুনিয়াটাই এখন বুঝি তাঁর হাতের মুঠোয়। স্কুলের ধরাবাঁধা নিয়মকে বুঝি অবজ্ঞার আঙুল দেখিয়ে প্রমাণ করতে চায় ছেলে- দ্যাখো আমাকে! আমি ভয়হীন! আর আমার ইচ্ছাটাই চূড়ান্ত এবং সর্বশেষ সিদ্ধান্ত! সকাল থেকে এই বেলা পর্যন্ত ছাত্রছাত্রী সামাল দেয়ার ক্লান্তি সত্যবতীর সারা শরীর জুড়ে। এই মুহূর্তে এমন ঘটনা পর্যবেক্ষণেও যেন একরাশ উৎকণ্ঠা আর চরম বিরক্তি এসে ভর করে। পকেট থেকে পেন্সিল, ইরেজার, কলম যা আছে সব ছুঁড়তে থাকে ছেলেটা বিপরীত প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা সহপাঠীর দিকে। অতি উৎসাহী বন্ধুরা নিজেদের কলম, পেন্সিল সরবরাহ করে উচ্ছৃঙ্খলতায় ইন্ধন যোগায়। মাথায় বাঁধা কালো রুমাল এখন হাতের মুঠোয় দড়ির মত পাকানো। পেন্সিল বা কলমের মত ভারী নয় জিনিষটা যে ছুঁড়লেই অদ্ভুত কায়দায় পৌঁছে যাবে অন্য প্রান্তে। বিচিত্র অঙ্গভঙ্গিতে অন্যপ্রান্তে অজানা ভাষায় কথা বলে। এত বেপরোয়াভাবে ঝুঁকছে কেন ছেলেটা? আর একটু বেশি ঝুঁকলেই যে হালকা পাতলা শরীর ভারসাম্য হারিয়ে নীচে পড়তে পারে। বুকের মধ্যে অজানা আশঙ্কা ধুকপুক করে সত্যবতীর! যদি সত্যি কোন অঘটন ঘটে যায় এই মুহূর্তে? যদি সত্যি চোখের সামনে প্রাণ হারিয়ে বসে কেউ? বিপদসীমা লঙ্ঘন করে তারুণ্যের এই বেহিসেবী খেলা যে নিয়মভঙ্গের খেলা! এক মুহূর্তেই যে একটি পরিবারের সমস্ত সুখ, আনন্দ, আশা, প্রিয়জনের জন্য অপেক্ষা মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। সাবওয়ের তীক্ষ্ম আলো বিকট শব্দে পাতাল ফুঁড়ে সাপের মত এগিয়ে আসে। অস্থিরতায় ভিড় ঠেলে পায়ে পায়ে সে এগিয়ে যায় বগির দরোজার দিকে। বিভীষিকাময় দুঃস্বপ্নেও মনে মনে প্রার্থনা করে – আহা! জীবন যে বড় মূল্যবান! অপেক্ষারত প্রতিটা মানুষ যেন বাড়ির নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে যেতে পারে।

২.
উপচে পরা ভিড়ে বগীর আরেক প্রান্তে কোনমতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাঁকে- জোনাকি! খুব কাছের বন্ধু সে সত্যবতীর! বোধহয় জোনাকিও ফিরছে কাজ শেষে। ব্যস্ততায় দেখা সাক্ষাত হয় না নিয়মিত, তবুও প্রতিদিন কথা হয় তাঁদের। একঘেয়ে শুষ্ক জীবনে এই কথা বলাটা যেন ‘ভিটামিন’ এর মত! জানোতো! জোনাকিকে প্রায়শই ঠাট্টা করে বলে সত্যবতী। একটু আগের অস্থিরতার গল্পটা বলার জন্য মনটা আকুপাকু করে। অন্যপ্রান্ত থেকে জোনাকি ততক্ষণে ভীড় ঠেলে এগিয়ে আসছে তাঁর দিকে, উচ্ছ্বাসে ডাক দেয়- সত্য! মায়াভরা চোখে কর্মক্লান্ত মুখটায় তাকায় সত্যবতী। পাশে বসতে দেয়ার জায়গাটাও যে আজ নেই! একটু আগের ঘটনাটা বাসায় যেয়েই তুলবে না হয়! ঘটনার কার্যকারণ বিশ্লেষণের কথোপকথনে ভীষণ ‘কোয়ালিটি’ সময় বয়ে যাবে দু’জনের। হঠাৎ চমকে দিয়ে সপ্রতিভ তরুণ উঠে দাঁড়ায় সিট ছেড়ে- চোখের ভাষায় বিনয়ের নম্রতা। ভারী ব্যাগটা কাঁধে তুলে ইশারায় জায়গা দেখিয়ে দেয় জোনাকীকে- তুমি না হয় বস এখানে, কথা বল বন্ধুর সাথে, বলতে বলতে বাসায় যাও!

একটু আগে দেখা উচ্ছৃঙ্খল, দুর্বিনীত যুবকের সাথে তাকে মিলাতে পারে না সত্যবতী। জোনাকিও অসীম কৃতজ্ঞতায় তাকিয়ে থাকে। ট্রেন আর প্লাটফর্মের গ্যাপ, অন্ধকার আর বিশাল শুন্যতার ঘটনাটা আর মনে থাকে না সত্যবতীর। (চলবে)

‘মাইন্ড দ্যা গ্যাপ’- তিন শব্দের সমন্বয়ে এই বাক্যের অন্তনিহিত দার্শনিক অর্থটা ব্যাপক, বোধের অনুভবে গভীর। কেবল ট্রেন এবং প্লাটফর্মের মধ্যকার ব্যবধান নয়, এই শুন্যতা, এই গ্যাপ, এই স্পেস, এই অন্ধকারটুকু ছড়িয়ে আছে মানুষের সামাজিক বলয়ের চারপাশে। আমরা তার কিছু দেখি, কিছু দেখতে পাই না। মানুষ, সমাজ, তার সম্পর্ক, আবেগ, যুক্তি, সুখ, দুঃখ, ভালোবাসা এবং পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার অসঙ্গতিতে সৃষ্ট গ্যাপ বা শুন্যতার বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতায় তুলে ধরার প্রয়াসেই- ‘মাইন্ড দ্যা গ্যাপ’!

Exit mobile version