ঋতু মীর : ‘Saying ‘no’ can save you from life’s greatest pain’
১।
ইন্টারভিউর শেষ পর্বে পক্বকেশ প্রিন্সিপ্যাল স্মিত হাসিতে প্রশ্ন ছুঁড়ে সত্যবতীর দিকে-ওয়েল! তোমার এডুকেশন, অভিজ্ঞতা, ক্লাশ ম্যানেজমেন্ট, ইন্সট্রাকশনাল মেথড সর্বোপরি শিক্ষার্থীর disruptive, challenging behavior, crisis management-intervention, prevention এর মত বার্নিং ইস্যুর উল্লেখ, বাস্তব উদাহরণসহ সমাধান এবং প্রফেশনের প্রতি তোমার প্যাসন, পসিটিভনেস- সবই দারুণ ইম্প্রেসিভ! এই সবই তোমার Strength! শেষ প্রশ্নে জানতে চাই- তোমার ‘Weakness’ (দুর্বলতা) তোমার মতে যদি থাকে উল্লেখ করতে পারো কি? এমন প্রশ্নের জন্য তৈরি ছিল না সত্যবতী। এই জীবনে বহুবার ইন্টারভিউ বোর্ডের মুখোমুখি হয়েছে সে। প্রতিবার নতুন আঙ্গিকে ‘স্ট্রেস’ জাঁকিয়ে বসে শরীরে, মনে। ভাল লাগে না সত্যবতীর। শিক্ষক মানেই ‘মানুষ’ গড়ার কারিগর। শিক্ষকতা মানেই যে প্রতিনিয়ত ‘আপডেট’ হওয়া, মানুষের ‘মন’, ‘আচরণ’ এর মত সেনসিটিভ বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া এবং তাত্ক্ষণিক কাক্সিক্ষত, অনাকাক্সিক্ষত কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া! ইন্টারভিউ বোর্ডের এই প্রশ্নে বিদ্যুত খেলে যায় মগজে। অতিরিক্ত স্মার্টনেসে চেয়ারে টানটান দেহ সত্যবতীর। কণ্ঠ স্বরে নাটুকে ভঙ্গিমা, ক্যানাডিয়ান ইংলিশ উচ্চারণে ভারী জিহ্বাকে আয়ত্বে এনে কাক্সিক্ষত পদে নিজেকে ‘best candidate’ প্রমাণ, প্রতি প্রশ্নে ‘to the point’ উত্তর দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা- মনোযোগ আকর্ষণের এই সব কৌশলই যেন সে মুহূর্তে উধাও! মুহূর্তেই শরীরটা অদ্ভুত শিথিল সত্যবতীর। চিবুকে চকিত দৃঢ়তা, চোখে সজীব সরলতা। সময় ক্ষেপণ করে না সে। চোখে চোখ রেখে বলে- ইয়েস! দুর্বলতা! আছে বৈকি! ভীষণ দুই দুর্বলতা! প্রথমতঃ ওয়ার্ক প্লেস, হোম বা সামাজিক সম্পর্ক- জীবনের কোন ক্ষেত্রেই আমি ‘না’ এই জরুরি শব্দটার ডিপ্লোম্যাটিক ব্যবহারটা শিখিনি। আর এই ‘না’ বলতে না পারার কারণে ব্যাক্তিক জীবন এবং কর্মক্ষেত্র দুই স্থানেই প্রচণ্ড মূল্য দিতে হয়েছে।
Saying no means you know your limit, নিজের এই লিমিটকে ইগ্নর করে ‘ইয়েস’ বলা মানেই নিজের শরীর এবং মনের উপরে অতিরিক্ত চাপ নেয়া। দ্বিতীয় দুর্বলতা উল্লেখের আগে চোরা নিঃশ্বাস ফেলে সত্যবতী। মুখের উপর তিন জোড়া সন্তুষ্টির দৃষ্টি অসম্ভব নির্ভীকতায় তাকে উত্তরের জন্য প্রস্তুত করে। কণ্ঠস্বর আরেকধাপ উচ্চে নিয়ে শুরু করে সে- দ্বিতীয়তঃ পারফেক্সনিসম (perfectionism) – the wish for everything to be correct or perfect এর দাঁতাল ভূতটা আমার কাজ করার ক্ষমতায় এক বিরাট প্রতিবন্ধক। জব বা প্রফেশনের প্রশ্নে time management, responsibility, productivity, creativeness এবং আরও অনেক ক্ষেত্রেই ‘to be perfect’ মনোভাবের একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। টিচিং মানেই রিয়েল টাইম প্রেজেন্টেশন, পারফরমেন্স, ডেলিভারি ইত্যাদিসহ প্রচণ্ডভাবেই টাইম-বাউন্ড কিছু কাজ। শিক্ষকতায় ‘moment’ বা ‘মুহূর্ত’ বিষয়টি পানিতে ছুড়ে ফেলা ঢিলের মত। একবার ছুঁড়ে ফেললে আর ফেরে না। আমি প্রায়শই অনেক কাজে সময়ের অতিরিক্ত সময় দেই। As a result- ‘কর্মক্ষেত্র’, পরোক্ষে ‘সংসার’ এমনকি ‘সম্পর্ক’ রক্ষায়ও নিজের উপরে এক অদৃশ্য মানসিক চাপ তৈরি হয়। কখনো পিছিয়েও পড়তে হয়। To be honest- এই ‘vicious circle’ এর চক্রে ঘুরপাকই আমার সীমাবদ্ধতা, আমার দুর্বলতা! Excellent! প্রিন্সিপাল তাঁর লম্বা উষ্ণ হাত বাড়িয়ে বিদায় জানায়। প্রতিযোগিতার লম্বা লাইনের লড়াই শিরোপাটা আজ সেই ছিনিয়ে নিচ্ছে- বিশ্বাসের এই দৃঢ়তায় ধীর পদক্ষেপে সাক্ষাত্কার কক্ষ থেকে বের হয়ে আসে সত্যবতী।
২।
সেল ফোনটা বেজে চলে। কলার আইডির দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয় সত্যবতী। আপাদমস্তক সামাজিক সত্যবতী সদা বাকপ্রিয়। যে কোন প্রসঙ্গেই একটা বলার থাকলে দশটা বলে সে। ‘ফর্মাল’ বা ‘ফরমালিটি’ বিষয়টা নিজের ‘প্রফেশন ‘ ছাড়া আর কোথাও টানতে চায় না সত্যবতী। দোকান পাট বা পাব্লিক প্লেসেও সে নিজস্ব স্বতঃস্ফূর্ততায় প্রচণ্ড ‘ইনফরমাল’। আজ এই মুহূর্তে তার মনটা কেমন ভার ভার। কিছু দিন, কিছু সময় আছে স্মৃতিরা ডানা মেলে ভিড় করে আসে মনের আকাশে। সুখ দুঃখের কত শত মায়াবী স্মৃতি আনন্দে হাসায়, কষ্টে কাঁদায়। আর তখন অদ্ভুত নীরবতায় নিজের ছায়া ছায়া ঘরটায় নিজের মধ্যে ডুবে থাকতে ভাল লাগে সত্যবতীর। হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সত্যবতীর। প্রতিটা সম্পর্ক গুরুত্বে, অনুভুতির গভীরতায় তার কাছে এক ভিন্ন মাত্রা বহন করে।
অন্যমনে ফোনটা রিসিভ করে সত্যবতী। ওপাশের কণ্ঠে তারুণ্যের উচ্ছলতা, উচ্ছ¡াসে টগবগ, তুফানমেল ভাব। নিমেষেই চাঙ্গা হয় সত্যবতী। দাওয়াতের দিনক্ষণ, সময়, নির্ধারিত পোশাক, সাজগোজ এক নিঃশ্বাসে ঝরঝর করে বলে যায় ওপাশ। এই না সেদিন দেখা হোল সবার? রাতভর জমিয়ে আড্ডা, হাসি, হুল্লোড়, পছন্দের খাওয়া, পছন্দের সাজ, পছন্দের মানুষ, সেলফি, ক্ষতিহীন গীবত গেয়ে মহা মজা- সবই তো হোল! আনন্দের সেই রেশ স্মৃতির এ্যালবামে কত যত্নে গুছিয়ে রেখেছে সত্যবতী! এই সপ্তাহেই আবার কেন? এপাশে নীরব সত্যবতী। জানে কোন ‘অজুহাত’ ধোপে টিকবে না। জানে কি প্রচণ্ড ভালবাসায় অন্যকে আনন্দ দেয়ার জন্য যখন তখন হাজার টন ঝামেলা মাথায় তুলে নেয় ওপাশ। শাড়ী গয়না পরে বাসে ওঠার প্রশ্নই নেই সত্যবতীর! কাজ গোছানোর ফাঁকে সত্যবতীকে তুলে নিয়ে যাবে ছোঁ মেরে! শুধু রেডি থাকতে হবে সময় মত। উপলক্ষ্যটা সাবধানে জানতে চায় সত্যবতী। আসন্ন মাতৃত্বের শুভ চিন্তায় কারও ‘সাত মাস’ পালনের উত্সব। শুধু ‘মুখ চেনে’ এমন আসরে নিজেকে প্রচণ্ড বেমানান লাগে সত্যবতীর। কিন্ত অব্লিগেসনের এক দীনতায় ‘না’ শব্দটা কিছুতেই বলা হয় না। ইচ্ছা অনিচ্ছার দোলাচলে দাওয়াত কবুল হয়। চিরচেনা, চির আপন দাওয়াতের বাড়িটা ভীষণ অচেনা মনে হয় তার। গোটা বাড়ি জুড়েই এদিক ওদিক আনন্দের হাট। বিব্রত, খাপছাড়া, অনির্দিষ্ট কথোপকথনে, বোকা বোকা মুখে ‘সাত পালনের’ রিচ্যুয়ালগুলো নির্জীব শুন্যতায় দেখে সত্যবতী। চিরদিন খলবলে সত্যবতীর কথা হারিয়ে যায়। এত মানুষের ভিড়েও নিজেকে কি ভীষণ একা লাগে। মিশ্র অনুভুতির একরাশ অবসন্নতা, ক্লান্তি নিয়ে বাড়ি ফেরে সত্যবতী। জোনাকি! জেগে আছো? জানো! সময়, এনার্জি ড্রেইন এবং সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘boundary’ সেট করাটা জীবন চলায় খুব মূল্যবান। ভারসাম্য রক্ষায় নিজেকেই এর নির্ধারক হতে হয়। দেখো! ‘না’ বলতে না পারা এবং perfectionism এর অবহ ভারে আমার এই জীবন প্রায়শই কি ভীষণ ভারাক্রান্ত! জোনাকি! মনে রেখো- “no is a complete sentence, it does not require justification or explanation” (চলবে)।
Ritu Mir- Teacher, Toronto District School Board, Toronto. ( ritu.mir9@gmail.com)