ঋতু মীর : ‘The positive thinker sees the invisible, feels the intangible and achieves the impossible’
১।
ওই যে থোকা থোকা সাদা মেঘের গা ছুঁয়ে উঁচু পাহাড়ের ঢালে ঘন সবুজ বন! ওই যেখানে পাইন, ইউক্যালিপটাস আকাশ সীমা ছাড়িয়ে আরও উঁচুর রহস্যময়তায় দোল খাচ্ছে! অপরাজিতা নীল আকাশে ওই যে থির ভাসমান লম্বা ডানার চিল! ওই যে পাহাড়ের গা লেপটে মিলেমিশে আছে ছন ছাওয়া কুটীর, জুম ফসলের ক্ষেত! ওইতো দেখা যায়! সত্যবতীর দৃষ্টি মুগ্ধতার আবীরে মাখামাখি, চোখে অপার কৌতূহলের চঞ্চলতা। ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষক সহকর্মী মিলে প্রায় বিশজনের একটা দল নিয়ে কলেজের শিক্ষা সফরে এসেছে সে। কাকরভিটা বর্ডারের ‘নো-ম্যান’স ল্যান্ড’ এ দাঁড়িয়ে একের পর এক প্রশ্ন করে যায়- এটা কি বাংলাদেশের সীমানায়? তাহলে আমাদের অংশ কতটুকু? ওখানে যাওয়া যায় কিভাবে? সত্যবতীর অবুঝপনা প্রশ্নে হেসে ফেলে পাশে দাঁড়ানো সহকর্মী। আকর্ষণীয় ব্যাক্তিত্ব, মার্জিত পোশাকে দীর্ঘ দেহ শ্যামল গড়ন সুপুরুষ! বন্ধুর মত সত্যবতীকে no man’s land এর বিপজ্জনক সীমানা থেকে আলতো টানে সরিয়ে আনে পাশে। হাসিটা পরম এক নির্ভরতার মত তাঁর ঠোঁট ছুঁয়ে আছে। বলে-ওটা ভারতের মেঘালয় রাজ্য! পাহাড়, বন, সমতল ঘেরা ল্যান্ডস্কেপে অপরূপ সুন্দর ভূস্বর্গ! বর্ডারের এখান থেকে কেবল ওইটুকুই দেখা যায়। প্রবেশের জন্য বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন আছে কিনা জানা নেই, তবে ট্রিপ প্ল্যানে সময়ে কুলালে অবশ্যই যাওয়া যেতে পারে। মোহাচ্ছন্ন মোহে ভূতগ্রস্তের মত দাঁড়িয়ে থাকে সত্যবতী। পজিটিভ মনোভাবে একরকম সন্তুষ্টির সুরেই বলে ওঠে- যাওয়া হোক বা নাই হোক, এখান থেকে যতটুকু দেখা যায় তাই বা কম কি? নাই থাকুক দখলদারিত্ব! নাই থাকুক অবাধ গমনের অধিকার! পৃথিবীর বিস্ময়কর এই স্বর্গীয় সৌন্দর্য চোখ ভরে উপভোগে কোন গøানি নেই, আঁজলা ভরে এই সুধা পানে নেই বঞ্চনা, নেই করুণা!
ক্লাশরুমের টেবিলে পানির গ্লাসটা রেখে নাটকীয় কায়দায় প্রশ্নটা ছুঁড়ে সত্যবতী-গøাসটিকে কে কিভাবে দেখছো? বিশাল গ্যালারীতে শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের ক্লাশে আজ উপস্থিতির হার গমগমে। নোট নিতে ব্যস্ত প্রতিটা কলম। উন্মুখ মুখ, সজাগ কান প্রশিক্ষণার্থী অনুসন্ধিৎসায় তাকায় টেবিলে রাখা পানির গ্লাসে। আজন্ম এক শিক্ষক সত্যবতী! জীবনের গল্পেই খুঁজে নেয় পাঠের উপকরণ। এ আবার কি প্রশ্ন? চাই সাজেসন, চাই প্রশ্নপত্রের প্রশ্ন! সত্যবতী তা দিয়ে দিলেই তো ঝামেলা চুকে যায়! হবু শিক্ষক প্রশিক্ষণার্থী গোস্বা মুখে অনিচ্ছার ভাব নিয়ে উত্তর দেয়- গ্লাসটি সম্পূর্ণ ভরা নয়, অর্ধেক শুন্য! পিছনে বসা তরুনী হাত তুলে মনোযোগ আকর্ষণ করে। ধীর, স্থির প্রসন্ন মুখ। আয়ত চোখদুটি বুদ্ধিদীপ্ত – আসলে গøাসটি পানিতে অর্ধেক ভরা! অন্তঃস্থল দেখে নেয়া চোখ সত্যবতীর! পায়ে পায়ে পিছনের সাড়ির সামনে দাঁড়ায় সে- তুমি অত্যন্ত ‘পসিটিভ’ (positive) বলেই গ্লাসের পূর্ণ অংশই প্রথমে তোমার নজরে পড়েছে। বাস্তবতা হল গ্লাসটির অর্ধেক ভরা এবং অর্ধেক খালি। নেগেটিভ চিন্তায় মানুষ অপূর্ণতা, শুন্যতাকেই আগে দেখে। কাকরভিটা বর্ডার থেকে ভারতের ‘মেঘালয়’ রাজ্য দেখার অভিজ্ঞতা, অনুভূতি সবিস্তারে বর্ণনা করে সত্যবতী। বুদ্ধর দর্শনের গভীরতাকে কেন্দ্র করে ধীরে এগোয় সে- Keep your thoughts positive because your thoughts become your words. Keep your words positive because your words become your behavior. Keep your behavior positive because your behavior becomes your habits. Keep your habits positive because your habits become your values. Keep your values positive because your values become your destiny। ক্লাসে পিনপতন নীরবতা। সত্যবতীর কণ্ঠে আত্মবিশ্বাসের দৃঢ়তা – ‘পসিটিভনেস’ মানুষের চরিত্রের বিশেষ গুন। পসিটিভ মানুষের সুখ, চাওয়া, পাওয়া, আনন্দ, বেদনাকে ঘিরে থাকে গ্রহণযোগ্যতা আর সমর্পণ। এরা প্রায়সই সুখী এই অর্থে যে, ‘কি নেই’ তা না ভেবে ‘কি আছে’ তাই নিয়ে অল্পতেই সন্তুষ্ট থাকে।
৩।
সত্যবতীর ছোট্ট বাগানে টিউলিপ ফুটেছে- একটাই মাত্র! টানা লম্বা শীতের পর বসন্তে বাগানে ফুল দেখে আদেখলাপনার যেন শেষ নেই তার। আহা! স্বামী কাজের জায়গা থেকে ফোন দিলে তবেই না জানায় এই সুখবর! আদিখ্যেতার আহ্লাদে টেক্সট মেসেজ রাখে – ‘আমাদের’ বাগানে ফুল ফুটেছে গো! ‘আমার’ বদলে ‘আমাদের’ শব্দটা অন্যরকম নিগুঢ় অর্থ বহন বলেই এই সামান্য খবরে ওপাশের তাৎক্ষণিক আনন্দটা এপাশেও টের পায় সত্যবতী । গত বছর বন্ধুসম সহকর্মী তার বাগান প্রীতিতে টিউলিপ নার্সারিতে নিয়ে গিয়েছিল। একগাদা আবর্জনা আর সোঁদা, পচা গন্ধ উপেক্ষা করে নিজ হাতে হাতড়ে, খুবলে খুজে বের করে ফেলে দেয়া ‘বাল্ব’। টরন্টোর বাইরে তার ফার্ম হাউস, ঘোড়া, কুকুর, বেড়াল আর নানাবিধ ফার্ন, ক্যাকটাস গাছ-গাছালীর ছবিতে, গল্পে মুগ্ধ হয় সত্যবতী। ‘এসবের কিছুই যে এখন আর আমার নেই’- দীর্ঘশ্বাস ফেলে সহকর্মী। শুনতে শুনতে ঢাকার আজিমপুরে বাবার বাড়ির স্মৃতিটা কষ্টের তীব্র শলাকার মত বুকের এফোঁড় ওফোঁড় বের হয়ে যায়। পুরানো বিশাল বাড়িটার চারপাশ ঘিরে নারকেল, আম, সুপারী, করমচা আর পেয়ারা গাছ। কাঁঠালি চাঁপা, কামিনী, গন্ধরাজ, বেলী, লিলি, গোলাপ, হাস্নাহেনার গন্ধে উন্মাতাল বাতাসে সোনালী গমের মত মসৃণ এক শৈশব ছিল সত্যবতীর। এই সব গল্পই সহকর্মীকে মন উজাড় করে বলে সত্যবতী। সেই বাড়িটাতে আর প্রবেশ অধিকার নেই, নিমের বিশুদ্ধ হাওয়া খেলে যাওয়া উত্তর দক্ষিণের লম্বা টানা বারান্দা নেই, বৃষ্টিতে ভেজার সেই ছাদ নেই, নেই পুরু দেয়ালের ঠাণ্ডা শীতল শোয়ার ঘর, বৈঠকঘর, কারুকাজ করা মেহগনি রঙ ভারী কাঠের আসবাব। এছাড়াও জন্মাবধি চেনা প্রিয়জনেরা আজ কোথাও নেই। দেশ নেই, স্বজন নেই, বন্ধুর বিশ্বাসের, নির্ভরতার হাতটা নেই। সত্যবতীর খুব চেনা বিশাল গ্যালারীর ক্লাসরুম নেই, প্রিয় শিক্ষার্থী নেই! নেই! কোথাও কিছু নেই! ছিঁড়ে খুঁড়ে যাওয়া মনের এই ভাবনাকে কখনোই প্রশ্রয় দেয় না সত্যবতী। Power of positive thinking এর মন্ত্রে দীক্ষিত সে! ভাবে, সবার সবকিছু থাকে না, সবকিছু সবসময় থাকে না! আনমনে তাকায় সত্যবতী! আঙিনায় দাঁড়ানো দেবশিশু! খেলাচ্ছলেই চলে এসেছে। নিস্পাপ মুখে ভুবন ভোলানো হাসি। চঞ্চল চোখে তাকিয়ে আছে ঝুলন্ত ‘চাইম’ এর দিকে। ঔৎসুক্যে শব্দের উৎস খুঁজছে। অনুভবে শব্দের মিষ্টি মূর্ছনা নিয়ে এলোমেলো পায়ে চলে যায়। তাকিয়ে থাকে সত্যবতী যতদুর দেখা যায় ওকে। এক মিশ্র অনুভুতির আছন্নতায় নিজেকেই বলে- train your mind to see the good in everything. Positivity is a choice. The happiness of your life depends on the quality of your thoughts!’ (চলবে)
Ritu Mir- Teacher, Toronto District School Board. Toronto.