Home কলাম মাইন্ড দ্যা গ্যাপ!

মাইন্ড দ্যা গ্যাপ!

ঋতু মীর : “Don’t use social media to impress people; use it to impact people”

১।
স্টাফ লাউঞ্জে ঢুকে চারদিকে চোখ বুলায় সত্যবতী। মনের গুপ্ত প্রত্যাশা মত রুমটা বেশ ফাঁকা ফাঁকাই আজ। অফ বা প্রিপারেসন পিরিয়ডে ডিপার্টমেন্টের গায়ে গায়ে লাগা স্পেসে না বসে সবসময় স্টাফ রুমে ঢু দিয়ে ফাঁকা জায়গা সন্ধান করে সত্যবতী। নির্জন কোণ পেলেই জায়গা দখল করে ঘড়ি দেখে অন্তত দশ মিনিট ফোনে বাংলায় কথা বলে নেয় সে। খুব জরুরী না হলে ওই সময়ে ক্লাশের লেসন প্রিপারেসনের কোন কাজে হাত দেয়না সত্যবতী। দেশে কাছের মানুষদের সাথে কথা বলার সময়টা খাপে মিলে গেলে এক সুখের নহর বয়ে যায় মনে। নিজের ভাষায় কথা বলার সুখ একটা বিশাল প্রাপ্তির আনন্দে বিভোর করে রাখে সত্যবতীকে। কাজের জায়গায় আশেপাশে অন্য ভাষা এমনকি নিজের দেশের কারও সামনেও খোলা স্বরে বাংলায় কথা বলতে খুব সঙ্কোচ বোধ করে সত্যবতী। এক্ষেত্রে কথা বলার সুযোগ না থাকলে সেলফোনে ফেসবুকের একান্ত স্পেসটাতে ডুবে যায় সে। শিথিল ভঙ্গিতে হাতের বড় ব্যাগটা কাউচে ছুড়ে গা এলিয়ে বসে সত্যবতী। কাগজ পত্র, ফাইল, পানির বোতল, টিফিন বাক্স, উইন্টার জ্যাকেট সহ চার সিটের বড়সড় সোফাটার পুরোটাই তার জিনিষে ছড়াছড়ি। সারাদিনের জন্য কাজে বের হওয়া মানেই যেন গোটা সংসারটা কাঁধে বহন করা। কোন একটা কিছু বাড়ীতে ফেলে আসলে সেই জিনিষটাই যেন অতি আবশ্যকীয় প্রয়োজনে পরিণত হয়। এইতো সেদিন ভ্যাসলিনের ছোট্ট কৌটাটা ব্যাগ থেকে বের করে আবার ব্যাগে রাখতে ভুল হওয়ার খেসারত প্রায় সারাদিন ধরেই দিতে হোল। সামান্য জিনিষের অভাবে যেন মহাবিপত্তি ঘটে যায় সত্যবতীর। হাতের আঙ্গুল, ঠোঁট শুকিয়ে চড়চড়! এইসব পরিস্থিতিতে তার স্বামী প্রায়শই তির্যক মন্তব্যে হাসে- তোমরা দেখি পোঁটলা না বেঁধে চলতেই পারো না! স্বামীর কথায় একটু অকারণ রাগ দেখায় সত্যবতী। চড়া সুরে ঝাঁঝালো উত্তর দেয়- বুঝবে কি! কবেই বা আমার অবশ্য প্রয়োজনগুলো টাকা আনা পাইয়ের হিসাবে বুঝেছো বল! কথার পিঠে কথার এমন অনাবশ্যক অম্ল-ঝাল ঠোকাঠুকির শুরুতেই স্বামী বেচারা রণভঙ্গ দেয়। নিজের চারপাশে ছড়ানো ছিটানো জিনিষ দেখে অসময়ে হানা দেয়া এইসব স্মৃতিতে একা একাই হাসে সত্যবতী। মহাকাজে ব্যস্ত এমন ভঙ্গিমায় সেলফোনটা হাতে তুলে নেয়। আশেপাশে কেউ নেই তা নিশ্চিত হতে স্টাফ লাউঞ্জের চারদিকে চোখ বুলাতেই হালকা পাতলা গড়নের সুদর্শন যুবককে বসে থাকতে দেখে সত্যবতী। যাহ! আজ যে দেশ, জোনাকি, বাংলা কথা সবই ভেস্তে গেলো! রোমন্থনের অন্যমনস্কতায় মূল্যবান সলিড সময়ের দশ মিনিটই বুঝি রসাতলে গেল আজ। এখন তাহলে অবধারিত ফেসবুক দেখবে সে! নানা মুখ, নানা খবর, ছবি, শুভেচ্ছা, সাফল্য গাঁথা, একান্ত ব্যাক্তিক কিছু সুখ দুঃখের বয়ানের খবর যেন জালে জালে বিছানো। ক্লিক, স্ক্রল করতে করতে দশ মিনিট নয়, ঘণ্টা চলে গেলেও হয়তো টের পাবেনা সত্যবতী। অভ্যাসগত কৌতূহলে ছেলেটার হাতে ধরা বইটার নাম দূর থেকেই এক ঝলকে দেখে নেয় সত্যবতী। পোশাকের পারিপাট্য আর চেহারায় শান্তশিষ্ট নিপাট এক ভদ্রলোক। ক্ষণিক পর্যবেক্ষণে একটা মানুষকে ‘read’ করার শক্তিশালী ক্ষমতায় সত্যবতী মনে মনে ছেলেটাকে রুচিশীল ব্যাক্তিত্বের এক ‘ভালোমানুষ’ বলে রায় দিয়ে বসে। সেলফোনটা হাত থেকে ত্বরিতে ব্যাগের গহ্বরে চালান করে। কোনরকম ভণিতা ছাড়াই ছেলেটার কাছাকাছি চেয়ার টেনে বসে সত্যবতী-হাতের বই প্রসঙ্গেই কথা শুরু করবে না হয়!

২।
কতদিন শিক্ষকতায় আছো তুমি? ছেলেটার প্রশ্নে চটুল হাসে সত্যবতী। দ্যাখো! আমার শিক্ষকতা জীবনের দীর্ঘ ইতিহাসের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ শুনে যে মনে মনে তুমি আমার বয়সটা পরিম্পা করতে বসবে তা কিন্তু জানি! সত্যবতীর স্বতঃস্ফূর্ত মজা করা স্বীকারোক্তিতে আগহে তাকায় ছেলেটা। তোমার তুলনায় আমি কিন্তু এই ফিল্ডে একেবারে নবজাত শিশু! সদ্যই চাকরী পেয়েছি। আমার বিষয়ের হাই ডিমান্ডের কারণে শিক্ষক প্রশিক্ষণে কোন কোয়ালিফিকেশন ছাড়াই ঢুকে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। পরে অবশ্য ডিগ্রি, সার্টিফিকেট নিয়েছি। সব মিলিয়ে আমার চাকরীর বয়স, অভিজ্ঞতা, শিক্ষাগত যোগ্যতা তোমার তুলনায়! ছেলেটার কথায় চমৎকৃত হয় সত্যবতী। তাতে কি! জানোতো! শিক্ষক মাত্রই জন্মায় না, তৈরি হয়! তোমার সামনে লম্বা সময়। ছাত্রদের শেখাতে শেখাতে একজন শিক্ষকও কিন্তু প্রতিনিয়ত শিখে চলে। কথায় কথায় জমে ওঠে কথোপকথন। এক প্রসঙ্গ থেকে আরেক প্রসঙ্গের সুত্র ধরে ধরে সময়টা পালতোলা এক নৌকার ছন্দে বয়ে চলে। বাংলায় প্রিয়জনের সাথে কথা বলতে না পারার হতাশাটা কেটে যায় সত্যবতীর। কি পড়ছিলে এতক্ষন? বইয়ের দিকে ইশারা করে সত্যবতী। সোশ্যাল মিডিয়া, ইন্টারনেট, ইউটিউব বিশেষত ফেসবুক ব্যাপক ব্যবহারের ব্যাপ্তি এবং মানুষের জীবনে এর ইতিবাচক, নেতিবাচক প্রভাব বিষয়ে একটা গবেষণা মুলক রিসার্চ রিভিউ। ফেসবুক শব্দটা কানে যেতে আলোচনায় ঝাঁপিয়ে পড়ে সত্যবতী। আচ্ছা! তোমার কি মনে হয়না যে ফেসবুক আমাদের জীবনে একটা অপরিহার্য উপাদানে পরিণত হয়েছে? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে প্রযুক্তির আবিস্কারের এই দিকটাতে আমি কিন্তু খুব পসিটিভ। সোশ্যাল নেটওয়ার্কের অনেক মুল্যবান, ভালো দিক রয়েছে। জানো! আমার হারিয়ে যাওয়া বাল্যবন্ধুকে ফেসবুকে আবিস্কার করে আমি যে কতটা আপ্লূত হয়েছিলাম! ফেসবুকের দেয়াল (wall) আমার একান্ত নিজস্ব এক স্পেস। কাউকে জবাবদিহিতা ছাড়াই এই স্পেস ব্যবহারের স্বাধীনতাটা আমি ব্যাক্তিগত ভাবে যথেষ্ট উপভোগ করি। ফেসবুকের সমর্থনে একটানা কথা বলে চলে উচ্ছসিত সত্যবতী। আর ‘সেলফি’ ব্যাপারটা তো ফাটাফাটি! আহা! মনের অনুভুতির সুক্ষ কারুকাজ সেলফির ফ্রেমে বন্দি করে ফেসবুকের প্লাটফর্মে দেয়া এবং কমেন্ট, লাইক সহ আরও কত কি ইন্সট্যান্টলি পাওয়ায় এক নির্ভেজাল আনন্দ আছে কিন্তু! বিনা আয়াসে পাওয়া সেই সুখ, সেই অনুভুতি কেমন জানো কি? ছেলেটা অনেকক্ষণ ধরেই নীরব শ্রোতা। হাতের খোলা বইটা বন্ধ করে স্মিত হাসিতে মুখ ভাসিয়ে বলে-শোন ! আমার কোন ফেসবুক একাউন্ট নেই। প্রতিদিন ফেসবুকে বিচরণ করে অর্থহীন সময় ব্যয় করার সময় আমার হাতে নেই। সেই অর্থে তোমারও কি সেই সময় আছে সত্যবতী? তুমি যে সব পসিটিভ দিকের কথা তুলেছো ভেবে দেখেছো এই সমস্ত কিছু ছাপিয়ে এর নেতিবাচক প্রভাবটা কত বেশি? “facebook is where hypocrisy, falseness, double standards, rumors and depression meet up for coffee”। ফেসবুকের প্রতি বিতৃষ্ণা ভরা অবহেলার হাসি ছেলেটার মুখে। সত্যবতীর চোখে হাজার প্রশ্ন ভিড় করে। সোশ্যাল মিডিয়ার ইতিবাচক গল্পতো এখনও শেষই করেনি সে। জানো তুমি! এইতো সেদিন মরণাপন্ন এক বন্ধুর চিকিৎসার জন্য রাতারাতি ফান্ড রেইজ করে একটা দুর্দশাগ্রস্থ পরিবারকে বাঁচিয়ে ছিল ফেসবুকে একটিভ অন্যান্য বন্ধুরা এবং তা কিন্তু সম্ভব হয়েছিল একমাত্র ফেসবুক নেটওয়ার্ক প্লাটফর্মের কল্যানে। ফেসবুকের সমর্থনে এক আত্মতৃপ্তির হাসি খেলে যায় সত্যবতীর মুখে।

৩।
তোমার কথার যুক্তির উপর শ্রদ্ধা রেখেই বলছি সত্যবতী- আমরা আসলে ফেসবুকের কল্যাণমূলক ব্যাবহারের পরিবর্তে এর অপব্যাবহারটাই বেশি করছি। “Some people need to realize that face book is a social network, not a diary”- আমি যে প্রবন্ধটা পড়ছি সেখানে এই ব্যাপারে সুন্দর বিশ্লেষণ আছে। মানুষ নিজের ব্যাক্তিগত সাফল্য, আনন্দ, সুখ, অনুভুতিসহ সম্পর্কগত সমস্যাকে সবার সামনে তুলে ধরে নিজেকে প্রকাশ করতে চাইছে। প্রকারান্তরে অন্যের সমর্থন পাওয়ার একটা আকাঙ্কা, দৃষ্টি আকর্ষণের প্রত্যশাকে নিজের অজান্তেই মনে ধারণ করছে। যখনই সেই প্রত্যাশা অপূর্ণ থেকে যাচ্ছে তখনই সামাজিক সম্পর্কে জটিলতা ত্রৈী হচ্ছে। অন্যের সাফল্য গাঁথা, সুখ, আনন্দ বা বেদনার খবর আরেকজনের জন্য সত্যিই কি কোন ‘মেসেজ’ বয়ে আনছে বল? বরং ঈর্ষা, স্ট্রেস, বিরোধ, প্রতিযোগিতা, করুণার মত বিষয়গুলো মানুষকে গিলে খেতে চাইছে। May my enemies live long life to see my success- ফেসবুক কালচার দেখে মনে হয় আমাদের মানসিকতা বোধহয় সেই পথেই হাঁটছে। ব্যাক্তিগতভাবে I don’t mind if others don’t like me, after all, I’m not a facebook status! কৌতুকের ছটায় ঝকঝক করে ছেলেটার চোখ। আর ফেসবুকের তথাকথিত ‘ফ্রেন্ড’ তালিকা? ধরে নিলাম হাজার জনের বন্ধু তালিকা নিয়ে তুমি ফেসবুকে বেশ পপুলার এবং একজন গর্বিত সদস্য। ভেবে দেখোতো! এই তালিকাভুক্ত কয়জনকে তুমি হৃদয়ের উত্তাপে অনুভব কর? কয়জনের ভালো, মন্দ, সাফল্য বা প্রকৃত সুখের খবর রাখা সম্ভব হয়? অনাবশ্যক তথ্য, ছবি আপলোড, মাউস ক্লিক, স্ক্রল, ‘মন্তব্য’ ‘লাইক’ বা ‘ইমটিক’ কাউন্ট করতে করতে কি তোমার স্বার্থপর, অর্থহীন সময় বয়ে যায় না? জানো সত্যবতী! আমার প্রকৃত বন্ধু সংখ্যা হাতে গোনা কয়েকজন। তাঁদের প্রত্যেকের সাথে আমার পাজরে পাজর মিলানো হৃদয়ের সম্পর্ক। আমাদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ, একটা শ্রদ্ধা, বিশ্বাস এবং নির্ভরতার সম্পর্ক অটুট আছে। সেই অর্থে আমি নিজেকে ভাগ্যবান, সুখী মনে করি। বিমুগ্ধ বিস্ময়ে ছেলেটার বুদ্ধিদীপ্ত মুখে তাকিয়ে থাকে সত্যবতী। তাইতো! সুখের প্রকৃত রাস্তা অনুসন্ধানে মানুষ কতই না বিভ্রান্ত! ভালোকে গ্রহন এবং মন্দকে বর্জন করার কৌশলটা বুঝি সে ক্রমশঃ হারিয়েই ফেলছে। প্রতিনিয়ত ফেসবুকের মাকড়শা জালের সুক্ষ সূতায় আঁটকে সময়কে হেলায় বয়ে দেয়ার মূল্যটা শোধ দেয়ার সময় আসলেই সে পাবে কি? বিষয়টা নিয়ে ভীষণ ভাবছি আমি! জোনাকি!! (চলবে)।
Ritu Mir, Teacher, Toronto District School Board, Toronto, ritu.mir9@gmail.com

Exit mobile version