ঋতু মীর : “Tolerance and patience should not be read as signs of weakness, they are signs of strength”
১।
রাস্তার এই পাশ থেকে দুই দুইটা বাস আসতে দেখে নাকে মুখে দৌড়াতে থাকে সত্যবতী। সারা দিনের সাজ সরঞ্জামে পূর্ণ হাত ব্যাগের মোটা ফিতা এক ভারী বোঝার মত ঘাড়ে চেপে আছে। ঘাড় ঘুড়িয়ে পিছন ফিরে বারবার বাসের অবস্থান দেখতে দেখতে ‘থামবে না দৌড়াবে’ এই দোটানায় বেসামাল দৌড়াতে শুরু করে সে। উঁচু নিচু রাস্তায় বেকায়দায় পা পড়াতে পাজরের রগে টান লেগে যায়। হাড়ের ক্রনিক অসুখ ব্যাক পেইনের ব্যাপারটাও সুযোগ পেয়ে সাতসকালে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। স্টপ সিগন্যাল বাটন কিছুটা অস্থিরতায় ঘন ঘন চাপ দিতে থাকে সত্যবতী। সময়ের বাস মিস হলে যে মহাবিপত্তি! সারা দিনের ছকবাধা কাজগুলো একের পর এক লম্বা শিকলে বাঁধা। কোন একটা থেকে পিছিয়ে যাওয়া মানেই হুমড়ি খেয়ে সব কাজেই মহা হুলুস্থুল লেগে যাওয়া! চোখের সামনে একপ্রকার নাকের ডগা দিয়েই একে একে দুইটা বাসই হুস হুস চলে যায়। এরপর পাক্কা পনের-বিশ মিনিট যে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে জানে সত্যবতী।
এইসব পরিস্থিতিতে আগের মত অক্ষম আক্রোশে বাসের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করেনা সত্যবতী। শান্ত মনে পরবর্তী বাসে উঠে বসে সে। চালকের আসন থেকে বাসের দরজা পর্যন্ত যাত্রীদের গিজগিজে ভিড়। স্কুল এবং অফিসগামী মানুষ থেকে শুরু করে শিশু, বৃদ্ধ, স্ট্রলার, ওয়াকার সবসহ চলাচলের জায়গাটায় এক বিশাল জটলা। বাস ড্রাইভার মুহুর্মুহু ‘please move back’ বলে বলে হাল ছাড়া নাবিকের চেহারায় হুইল ধরে বসে আছে। কোনমতে এঁকেবেঁকে ভ্যালিড মেশিনে টিকিট ট্যাপ করে সত্যবতী। বাসের দরজা জুড়ে জটলাটা গা, ঘামের বিচিত্র গন্ধে দমবদ্ধ লাগে সত্যবতীর। ‘নেমেই তো যাব একটু পর’ চেহারায় এই অভিব্যাক্তি সেটে, নিজের জায়গা থেকে না নড়ে মানুষগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। অথচ একটু এগিয়ে গেলেই যে পিছনে কিছুটা ফাকা জায়গা! সত্যবতীর পাশে উচ্চস্বরে ভিন্ন ভাষায় কথা বলছে একজন। কানের পাশে মাছির মত অচেনা শব্দ ভন ভন করে। হঠাৎ শিশুর তারস্বর চিৎকারে মাথা ধরে যায় সত্যবতীর। ছোট ছোট পা দিয়ে স্ট্রলার কাঁপিয়ে বেল্ট খুলে বন্ধন মুক্ত হতে চাচ্ছে অবোধ শিশু! স্ট্রলারের চাকা পায়ের আঙ্গুলে লাগাতে ব্যাথায় ককিয়ে উঠে সত্যবতী। শিশুর মা বুঝেও না বোঝার ভান করে সন্তানের অকারণ জিদ এবং আবদারে তাল মিলিয়ে চলে। মাথায় কালো পট্টি বাঁধা, প্যান্ট প্রায় হাঁটুর কাছে নামিয়ে পড়া যুবকটি ‘priyority seat’ দখল করে বসে আছে। চোখে মুখে আশপাশ উপেক্ষা আর অভ্রদ্রতার দুর্বিনীত ভঙ্গি। হাতে সেল ফোনের সাউন্ড স্পীকারে দিয়ে হাই ভল্যুমে গান শুনছে। ড্রাইভারের সিট লাগোয়া কাঁচে বড় লাল হরফে ‘zero tolerance’ লেখাটার দিকে তাকিয়ে সাথের কথাগুলো মনোযোগে পড়ে সত্যবতী। প্রতিদিন নানাভাবে যাত্রী দ্বারা গাড়ির চালকেরা বিভিন্ন ভাবেই লাঞ্ছিত হচ্ছে। বাসের চালক এসাল্ট বা হ্যরাসমেন্ট এর ক্ষেত্রে পাবিøক ট্রান্সপোর্ট পলিসি এখানে শুন্য বা zero! এই ক্ষেত্রে যে কোন অঘটনে আইন ড্রাইভারের পক্ষেই যাবে । এই যে ছেলেটা স্পীকার অন করে লারে-লাপ্পা গান শুনতে শুনতে অন্য সবার বিরক্তি ঘটিয়ে নির্বিকার যাচ্ছে এর বিহিত কি তা ভেবে পায় না সত্যবতী। শিক্ষক সুলভ মেজাজে বলে বসতে ইচ্ছে হয়- ‘তোমার পছন্দের গান শুনতে আমি কিন্তু বাধ্য নই’। সাত সকালে কাজে ছোটার মুখে এমন কিছুর মুখোমুখি হয়ে কাজে যাওয়ার স্পৃহাটাই যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। সারাদিন ছাত্র-পাঠ দেয়া-নেয়া চ্যালেঞ্জ সামলানো থেকে শুরু করে আরও কত কিছুই যে অপেক্ষা করছে স্কুলে। এই সময়ে ‘নেগেটিভ’ চিন্তায় এনার্জি খরচ করার মত নির্বুদ্ধিতা আর নেই ভেবে বাসের হাতল ধরে কাঠ কাঠ শক্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে সত্যবতী। tolerance & patience শব্দগুলো মনে মনে আউরে চলে। বাস থেকে নামার সময় পর্যন্ত অসীম এক ধৈর্য পরীক্ষা দেয় সত্যবতী। নির্ধারিত স্টপে এসে নামতে নামতে কানে আসে বাস ড্রাইভারের কঠিন কণ্ঠ- ‘turn off your speaker, headphone please!’
বাস থেকে নেমে একপ্রকার দৌড়েই ক্লাশে ঢোকে সত্যবতী। আজ ভীষণ দেরী হয়ে গেছে স্কুলে পৌঁছাতে। ব্যাগ, কাগজপত্র, জ্যাকেট, টুপি সব দুই হাতে স্তুপ করে সরাসরি ক্লাশেই ঢুকে যায় সত্যবতী। টেবিলের উপর দুই পা উঠিয়ে মহা আরামে সেল ফোনে মগ্ন ছেলেটা। পাশের মেয়েটিও একই ভাবে হাতের ফোনে ঝুঁকে আছে। ক্লাশের সবচেয়ে দুরন্ত ছেলেটা জানালার তাকে লম্বা টানটান হয়ে শুয়ে। বুকের উপর ছোট্ট ল্যাপটপ খোলা । দেখে আঁতকে উঠে সত্যবতী। এই না সব নিয়ে মেঝেতে ধুম করে পড়ে? ব্যাপার কি তোমাদের? ঘণ্টা পড়েছে অনেকক্ষন। এখনও নিজের জায়গায় বসনি কেন? আর এই যে তুমি! ডেস্ক থেকে পা নামিয়ে বস দেখি! কিছুটা হইচই করে মেজাজ দেখানো ভঙ্গিতেই কথা বলে সত্যবতী। সত্যবতীর দিকে একদণ্ড না তাকিয়ে নির্বিকার বসে থাকে ছেলেটা । তার কানে হেডফোন গোঁজা। হতাশ ভঙ্গিতে এক কানের হেডফোন টেনে নামিয়ে দেয় সত্যবতী। চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকায় ছেলেটা। মিস! আমাকে কি কিছু বলছ তুমি? না তোমাকে না, তোমার প্রেতাত্মা কে বলছি! মনে মনে বিড়বিড় করে সত্যবতী। পা নামিয়ে বস ডিয়ার! এক্ষুনি! এই সময়ে ভাইস-প্রিন্সিপাল কিন্তু ক্লাশ পরিদর্শনে বের হবে। আর সে যদি এইভাবে তোমাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে তাহলে নিশ্চয়ই খুশি হবে না। ক্লাশে এইভাবে বসাটা কিন্তু খুব disrespectful! ভিপির আবার আমাদের ক্লাশে আসার কি দরকার? তার কি আর কাজ নেই? ফা—–! শুনেও না শোনার ভান করে সত্যবতী। ভাষার এই চর্চাটা যেন এখন মুখের বুলি!
নিজের ভিতরে রাগের উত্তাপ পারদের মত লাফিয়ে চলে। পা নামিয়ে ঠিক করে বস! এক্ষুনি! গলার স্বর অসম্ভব স্থির করে সামান্য উঁচু স্বরে জোর খাটায় সত্যবতী। তুমি ইয়েলিং করছো কেন মিস? টেবিল বা মেঝেতে পা রাখায় পার্থক্য কি বল? আমার পা যেখানে খুশি রাখবো! আর জানতো! এই ভাবে বসতে আমি অনেক comfortable। স্থির ভঙ্গিতে ঠায় দাঁড়ানো সত্যবতী, চোখের ভাষায় দৃঢ় প্রত্যয়। অনুরোধ আর আদেশের পার্থক্যটা গলার স্বরেই স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয়। সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করার জন্য বাধ্য করতে হবে অবাধ্য বালককে। বয়ঃসন্ধির এই যুবককে নিয়ম মানার ফর্মুলা শিখাতে হবে অসীম সহিষ্ণুতায়। শিক্ষকতার মত মহান পেশাটা যে শতাব্দীর এই লগ্নে অন্ততঃ মসৃণ নয় তা হাড়ে হাড়ে উপলব্দি করে সে। সত্যবতীর চোখের দিকে তাৎক্ষনিক তাকিয়ে হুকুমের গুরুত্ব যাচাই করে ছেলেটা। গলার স্বরে বিচিত্র এক অনুরোধের ঢেউ খেলিয়ে বলে- তুমি একটু কষ্ট করে আমার পা দুইটা মেঝেতে নামিয়ে দাও না ম্যাম! প্লিস! কাল ‘সকার’ গেম খেলে আমার পায়ে প্রচণ্ড ব্যাথা হয়েছে। ছেলেটার কথার ধরণে মুহূর্তেই হেসে ফেলে সত্যবতী। কালক্ষেপণ না করে নিজের টেবিলের কাছে এসে দাঁড়ায়। গভীর মনোযোগে আজকের পাঠের বিষয়বস্তু আর উদ্দেশ্যগুলোতে চোখ রাখে সে। Learning skill, self regulation, self-coltrol, behaviour management, conflict management, anger management- শব্দগুলো একে একে উদাহরনসহ বিশ্লেষণ করে সত্যবতী। গোটা ক্লাশে পিন পতন এক নীরবতা। প্রচণ্ড ‘behaviour challenge’ এ ভরা ক্লাসটি একনজর দেখে নিয়ে আত্মতৃপ্তি আর স্বস্তির স্বর্গীয় অনুভুতিতে ভেসে যায় সত্যবতী। ওই তো ছেলেটা! পা নামিয়ে সুবোধ ভঙ্গিতে বসে পাঠের মনোযোগী এক শ্রোতা এখন! জানো জোনাকি! ‘only tolerance and patience can protect us from the destructive effects of anger and hatred। (চলবে)।
Ritu Mir, Teacher, Toronto District School Board, Toronto, ritu.mir@gmail.com