ঋতু মীর : “The greatest sacrifice is when you sacrifice your own happiness
for the sake of someone else”
১।
ক্লাশে পা রাখতেই অল্পবয়সী মেয়েটার দিকে চোখ পড়ে সত্যবতীর। একেবারে অচেনা, এর আগে কখনোই স্কুলে দেখেনি তাকে। হাল্কা পাতলা স্বাস্থ্যে মাঝারী গড়ন। সাদামাটা পোষাকে, শান্ত শিষ্ট চেহারায় একঝলকেই তাকে নিপাট এক ভালোমানুষ মনে হয় সত্যবতীর। সত্যবতীর দিকে হাত বাড়িয়ে নিজের নাম বলে মেয়েটি। উষ্ম আন্তরিকতায় নিজের ক্লাশে তাকে স্বাগতম জানায় সত্যবতী। স্পেশাল এডুকেশন ক্লাশের চেহারা স্কুলের মেইন স্ট্রীমের অন্যান্য ক্লাশের তুলনায় পুরোপুরি আলাদা। ছোট গ্রুপ শিক্ষার্থী নিয়ে সংখ্যাটা সর্বচ্চ দশজনে সীমাবদ্ধ। Self contained এই সব ক্লাশ শিক্ষক, সাপোর্ট স্টাফ, লাঞ্চ রুম সুপারভাইজার এবং প্রয়োজনে ইয়থ ওয়ার্কার, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, স্পিচ এন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট, নার্সসহ প্রায়শই লোকজনে জমজমাট থাকে। স্পেশাল নিড ক্লাশ মানেই এই সব যজ্ঞতজ্ঞসহ কিছু চ্যালেঞ্জ প্রতিনিয়ত মোকাবেলা করা। আপাতঃ একজন মানে দশ জনের সমান পরিবেশে ছাত্র- শিক্ষক, সাপোর্ট স্টাফ এবং অন্যান্যদের স্ট্রেস বা উত্কণ্ঠা যেন নিত্যসঙ্গী। সবকিছুর সাথে সমন্বয় করে ক্লাশ চালিয়ে নিতে মাঝে মাঝেই হাঁপিয়ে পড়ে সত্যবতী। বাড়তি সতর্কতায় চোখ কান খোলা রেখে নিরাপদে দিনটাকে মিনিংফুল করে নিতে পারলে দিনশেষে প্রচণ্ড এক সার্থকতাও কাজ করে মনে। আজ সকাল সকাল ক্লাশে ঢুকে নিজের অজান্তেই ভ্রূ জুড়ে চিন্তার ভাজ পড়ে সত্যবতীর। সাপোর্ট স্টাফের একজন নিশ্চয়ই আজ স্কুলে আসেনি। বদলি কাজের সাপ্লাই কর্মী হিসেবেই এই মেয়েটা তাহলে। স্পেশাল নীড শিক্ষার্থীর সাথে কাজ করার একটা বড় শর্তই হল ক্লাসরুম এবং শিক্ষার্থী সম্পর্কে ভালোভাবে ওয়াকিবহাল থাকা। প্রতিটা শিক্ষার্থী গত্বাঁধা কিছু নিয়মে, এক মানুষে, রিপিটেসনে ভীষণ ভাবে টাইপড। নতুন কিছু তাদের সামনে আসা মানেই transition, behavior থেকে উদ্ভূত সমস্যা মোকাবেলার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে কাজে নামা। আজ এই মুহূর্তে এমন কিছুর মুখোমুখি সত্যবতী। অপরিচিত এই মুখ দেখে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভালোমন্দ মিলিয়ে তাত্ক্ষণিক যে প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে তা সামাল দিতে সত্যবতী হয়ত আজ দম ফেলার ফুরসত্ই পাবে না। তড়িত হাতে টেবিলে কাগজপত্র গোছাতে গোছাতে আড়চোখে মেয়েটার দিকে অকারণ আস্থাহীনতার দৃষ্টি রেখে চমকে ওঠে সত্যবতী। সর্বনাশ! এযে ভরা সময়ের পোয়াতি!

২।
শোন! একটু সাবধানে কাজ করবে কেমন! নিজের ভিতরে কি এক মাতৃস্নেহের অনুভবে পায়ে পায়ে মেয়েটার দিকে এগিয়ে যায় সত্যবতী। শিক্ষার্থীরা ক্লাশে পৌঁছানোর আগেই মেয়েটাকে গোটা ক্লাশের সামগ্রিক ধারণা দেয়াটা জরুরি বলে মনে হয়। শোন! আমার এই ক্লাশ ভীষণভাবে structured এবং অধিকাংশ শিক্ষার্থীই বেশ high functioning এবং independent। কোনরকম সাপোর্ট ছাড়াই আলাদা ডেস্কে ইনডিপেন্ডেন্টলি কাজ করার সমস্ত ব্যবস্থা রাখা আছে। লার্নিং লেভেল, লার্নিং স্টাইল অনুযায়ী যার যার রুটিনও আলাদা। দ্যাখো! এখানে মর্নিং সার্কেল প্লেস, এখানে বই পড়ার quiet space, এখানে কম্পিউটার, এখানে art and craft, puzzles, games, এই- এইখানে লাঞ্চ টেবিল- সযত্নে সাজানো নিজের সাম্রাজ্য বর্ণনায় এক সাবলীল ভঙ্গি সত্যবতীর, সেই সাথে যেন কিছুটা যেন গর্বিতও সে। শিক্ষার্থী এচিভমেন্ট, সাকসেস, সাপোর্ট স্টাফ, টীম টিচিং, টীম স্পিরিট সব মিলিয়ে তার ক্লাশ ইতিমধ্যে স্কুলের successful, best class এর তালিকাভুক্ত। এই গ্রুপের সাথে কাজ করার পসিটিভ এক মোটিভেশনে দিনরাতের সিংহভাগ সময় ক্লাশের উন্নতি চিন্তায় ঢেলে দেয় সত্যবতী। Teaching is an art– সুচারু পরিকল্পনায় এই শিল্পকে রঙ তুলিতে সাজিয়ে পরিপূর্ণ করে তোলার দায়িত্ব যে শিক্ষক হিসেবে তার কাঁধেই। সত্যবতীর দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসে মেয়েটা- আমি শুনেছি তোমার ক্লাসের কথা। এসেও তাই দেখছি। আমার কোন অসুবিধা হবেনা বলেই মনে হচ্ছে। নিজ ক্লাশের প্রশংসা এক অদ্ভুত ভাললাগায় সত্যবতীর কান মন ছুঁয়ে যায়। প্রসন্ন মনে মেয়েটিকে নিয়ে ক্লাশের কোণে রাখা সেলফের দিকে আগায় সত্যবতী। পেট মোটা কিল্প ফাইল থেকে নিজ হাতে চার পাঁচ জন শিক্ষার্থীর সেফটি প্ল্যান (safety plan) বের করে মেয়েটার সামনে রাখে সে। অফিসে এই সব ফর্মালিটি কিছুটা হয়েছে জেনেও ক্লাসে নতুন হিসেবে মেয়েটাকে বিষয়টা বুঝিয়ে দেয়াটা শিক্ষক হিসেবে নিজের কর্তব্য বলে মনে করে সত্যবতী। চোখের ইঙ্গিতে behavior risk, triggersগুলো পড়ে দেখতে অনুরোধ করে। আস্থার স্বরে বলে- আমার কোন শিক্ষার্থীই intentionally aggressive বা behavioural নয়, তবুও মনের গতিবিধি এবং সময়ের প্রেক্ষাপটে কে কি আচরণ করবে তার অনেক কিছুই আগে ভাগে অনুমান করা কঠিন। intervention, prevention, safety measureগুলো চোখ বুলিয়ে সাক্ষর কর প্লিস। মেয়েটার হাতে কলম ধরিয়ে সত্যবতী বলে- নিজেকে নিরাপদে রেখে কাজ করবে কেমন! আমি তো আছিই! ক্লাশের সবচেয়ে শান্তশিষ্ট শিক্ষার্থীর দায়িত্ব মেয়েটিকে বুঝিয়ে দিয়ে এতক্ষনে লম্বা দম নেয় সত্যবতী।

৩।
উপদ্রপহীন, নির্ভেজাল সকাল ক্লাশের নিজ ছন্দে বয়ে যায় । সত্যবতীর ভিতরে ঠাসা উৎকণ্ঠার ভাবটা এখন অনেক স্তিমিত। লাঞ্চের সময়ে স্টাফ লাউঞ্ছে আর ঢোকে না সত্যবতী। মেয়েটার সাথে ক্লাশেই লাঞ্চে বসে যায়। বিকাল এবং আগামীকালের প্রোগ্রাম নিয়ে খেতে খেতেই কথা বলে নেবে সে। তোমার বেবী ডেলিভারির সময়তো মনে হয় খুব কাছেই তাইনা? সত্যবতীকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটি বলে-this is not my baby! স্বভাবজাত শান্ত হাসিতে মেয়েটার সারা মুখ উদ্ভাসিত। পেটের উপর স্নেহের হাত আলতোভাবে রাখা। not mine! ‘এ আমার নয়’! মেয়েটি অবিবাহিত শুনে বিস্ময়াভিভূত সত্যবতী রুদ্ধ আবেগে থমকে যায়। নিজ জঠরে সন্তান ধারণ করে আসন্ন মাতৃত্বের মুখে দাঁড়িয়ে এ কোন কথা বলছে মেয়েটা? সত্যবতীর প্রশ্ন ভরা কৌতূহলী চোখে স্থির দৃষ্টি রাখে মেয়েটা। ধীরে ধীরে বলে তার খুব প্রিয় বান্ধবীর জন্য সন্তান ধারণ করেছে সে। আশ্চর্য হয়ে শোনে সত্যবতী- সারোগেট (surrogate) মা হিসেবে সে কোন পারিশ্রমিক বা অর্থ নেবেনা বান্ধবীর কাছ থেকে। সন্তান ধারণে অক্ষম বান্ধবীকে সে নারী জীবনের মহা মুল্যবান উপহারটা এভাবেই দিতে চায়। আরও জানায়- বান্ধবী এবং তার স্বামীর হাতে একটা সুস্থ, সবল ছোট্ট প্রাণ তুলে দেয়ার সেই মহালগ্নের জন্য অপেক্ষা করছে সে। তুমি কি সত্যিই পারবে নিজ সন্তান, নিজের শরীরের অংশকে এভাবে শর্তহীনভাবে দিয়ে দিতে? নিশ্চয়ই পারবো!

সেই ব্রতেই ব্রতী আমি! আমি তো আমার শিশুর কাছে অচেনা দুর্বোধ্য দূরত্বের কিছু নই। এই যে নয় মাস আমি তাকে নিজের মধ্যে ধারণ করছি, তার নাড়ীর স্পন্দন আমার নাড়ীতে, তার হৃদপিন্ডের ধুকধুকানি আমার এই হৃদয়ে প্রতিনিয়ত ধুকধুক করছে। মাতৃত্বের এই প্রথম অভিজ্ঞতাটা আমার সারা জীবনের অমুল্য স্মৃতি। এ কখনোই বিলীন হবার নয়। আমি কেবল মাতৃত্বের ‘অধিকার’ নামের জায়গাটা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছি। আর শোন! শুধু জন্ম দিয়ে মায়ের পরিচয়, অধিকার প্রতিষ্ঠা করলেই কি মা হওয়া যায়? যে মানুষটি মনে প্রাণে আমার সন্তানের লালন পালন, ভবিষ্যত গড়ায় নিজেকে মানসিক এবং শারিরিক ভাবেও তৈরি করেছে, প্রস্তুতি নিচ্ছে তার অধিকার, তার অবদান কি অস্বীকার বা উপেক্ষা করা যায়? তাছাড়া আমিতো আমার বান্ধবীর পরিবারের অংশ হিসেবেই নিজেকে ভাবি। দুই দুইজন মায়ের উপস্থিতিতে আজ আমার অনাগত সন্তান কত ভাগ্যবান দ্যাখো! সত্যবতীর ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া ফ্যাকাশে মুখে তাকিয়ে মেয়েটি বলে- আমার প্ল্যান হল পরের বছর নিজের সংসার গড়বো এবং যথাশীঘ্র সন্তান ধারণ করব। ক্লাশ থেকে বের হয়ে যাওয়ার আগে ঠাট্টার ছলে, কৌতুকে মুখ ভাসিয়ে মেয়েটা বলে- হয়ত তখন তোমার ক্লাশে আবার আসবো, আমার দেহে থাকবে আরেকজন অনাগত। যে আমার একান্ত অধিকারে, আমার সন্তান পরিচয়ে জন্ম নেবে। একা ঘরে গোলাকৃতি এক্যুরিয়ামের গতিহীন বদ্ধ জলে বর্ণালী মাছের পিছলে যাওয়া বুদবুদ তরঙ্গে নিমগ্ন চোখ রেখে অসমবয়সী মেয়েটার কথাই ভেবে চলে সত্যবতী। সংসার ধর্মে কত কি যে শিক্ষনীয় আছে! শোন জোনাকি! ‘Life’s most persistent and urgent questions is, ‘what are you doing for others?” ত্যাগের মহান গল্প অনেক পড়েছি, আজ অন্যের জন্য ত্যাগের এই গল্প, এই ঘটনা কি ভীষণ নাড়া দিয়ে গেলো আমাকে। এই যে জীবনের এতটা পথ পাড়ি দিয়েছি- ত্যগের, মহিমার এমন গল্প কি একটাও অভিজ্ঞতার ঝুলিতে সঞ্চিত হয়ে সমৃদ্ধ করেছে আমাকে? গভীর নিঃশ্বাসে, স্বগতোক্তিতে নিজেকেই যেন বলে সত্যবতী- “True love is selfless. It is prepared to sacrifice’!
Ritu Mir, Teacher, Toronto District School Board, Toronto, ritu.mir9@gmail.com