ঋতু মীর : “Fallen leaves will tell you the story of abandoned love”
১।
কিছুই ফেলতে পারেনা সত্যবতী! তার এক বেডরুমের ছোট্ট পাখির বাসায় সংসারের প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় অনেক কিছুই আর জায়গা হতে চায় না। শ্যাম এবং কুল দুইই রাখার মত এদেশ আর স্বদেশ থেকে বয়ে আনা সব প্রিয় জিনিষই সংকুলানের দুঃসাধ্য সাধে এধার ওধার করেও রাখার সুবন্দোবস্ত করে উঠতে পারেনা সত্যবতী। ‘ফেলেই দেব’ এমন জিনিষ জড় করার পরেও কি এক মায়ায় আবার তুলে নিয়ে ব্যবহার করতে থাকে সত্যবতী। জানো জোনাকি! এখানে আসার আগে সাজানো গোছানো সংসারের কত কিছু ফেলে আসতে হয়েছে! কি করুন মনের সেই অবস্থা! সেই বার্মা টিকের সুদৃশ্য মেহগনি রঙ গোল ডাইনিং টেবিলটা বার বার ছুঁয়ে পরখ করেছিলাম। বেশ মনে আছে-কাঠের পেলব মসৃণ রঙে যেন খাবার বা পানি পড়ে নষ্ট না হয় সেজন্য ঠিক সাইজ মত কাঁচ খুঁজতে কত হন্যে হয়েছিলাম আমি। শুনলে তুমি হাসবে জোনাকি! কাঁচটা জোগাড় হওয়ার আগে ওই টেবিলে কাউকে বসতেই দেইনি। আর জানো? টেবিলের কাঁচটা যতেœ ধুয়ে মুছে এত ঝকঝকে করে রাখতাম যে একটু দূর থেকে দেখলে ‘কাঁচ আছে কি নেই’ বলে প্রায়ই দৃষ্টিভ্রম হত আমার। মায়ায় গড়া মায়াবতীর সংসারে পুরনো ট্রাঙ্ক, মরচে পড়া কৌটাও যেন ফেলতে কত কষ্ট। প্রিয় সব বই, প্রিয় লেখক, প্রিয় কবি, পাতায় পাতায় রাখা সুগন্ধি লেবু পাতা- বাছাই করা, ফেলে দেয়াতো সহজ নয় জোনাকি! সেই কবে কুড়িয়ে পাওয়া কাঁচপোকার রঙিন পাখা, কোন এক মাহেন্দ্র ক্ষণে প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে কুড়ানো ঝিনুক, বিচিত্র পাথর, দেয়ালে টাঙ্গানো মাটির মূর্তি মুখ, কাঠের সুক্ষ কারুকাজে দক্ষিন ভারতীয় তিন পায়ার হাল্কা সাইড টেবিল, সখে কেনা স্যুভেনির সব কিছুই প্রতিদিনের পরিচর্যায় কেমন নতুন দেখাতো। সবচেয়ে কষ্টে পড়েছিলাম পুরনো চিঠ্রি ঝাঁপিটা খুলে। প্রতিটা চিঠিই যেন এক একটা সম্পর্কের হীরক খনি। প্রতিটা চিঠির প্রতি পাতায়, প্রতি শব্দে সুখ, দুঃখ প্রেম, ভালবাসার গল্পের এক শক্ত বুনট। বল জোনাকি! কাকে পেছনে ফেলে যাবো বা কাকে সাথে নিয়ে যাব বিভূঁইয়ে অথবা কোথায় কার কাছে রেখে যাবো জীবনের এই সব অমুল্য ধন? মনে আছে সেদিন সুখ দুঃখের স্মৃতি রোমন্থনের অলস অবসাদে আমার সারাদিন গেছে চিঠির ঝাঁপিতে। আর ছবি? সেই কি কম ভুগিয়েছে আমাকে? অর্ধেকের বেশি সময় পার করা জীবনে স্মৃতির রঙিন মুহূর্ত ধরে রাখা ভারী ভারী এ্যালবামগুলো কি সের দরে বিক্রি করে দেয়া যায়? আহা! রেশন মাপা ওজনের সুটকেস গোছাতে ‘রাখি না ফেলি’ এই দোটানায় মানসিক সঙ্কটের দুরমুশ সময়গুলো কি ভয়ঙ্কর কষ্টেই না গেছে!
২।
প্রবাস জীবন শুরুর অধ্যায়টা যেন বড় লেজে গোবরে হয়ে যায় সত্যবতীর কাছে। মফস্বলের অবাধ উন্মুক্ত পরিবেশে সোনালী কৈশোর কাটানো সত্যবতীর প্রবাসের স্বল্প আঁটসাঁট জায়গা ভীষণ দমবদ্ধ লাগে। বাস্তুহারা হওয়ার বাস্তবতায় টের পায় এখানে থাকার বা মাথাগোঁজার ঠাই যোগাড় করা এবং বাড়তি ‘স্পেস’ ম্যানেজ সবটাই ‘ডলার’ উপার্জনের সাথে নির্ভরশীল। এখানে আসার পর ‘সেয়ার হোম’ এ মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করতেই কি হিমশিম অবস্থা তার। স্পষ্ট মনে আছে- শুরুর দিকে basement এ বাসা দেখতে গিয়ে কেমন হাঁসফাঁস করে বের হয়ে এসেছিল সত্যবতী। অন্যের অন্দরমহলের খানাখন্দ পার হয়ে নিজের থাকার জায়গায় পৌঁছুতে গিয়ে প্রথমেই ধাক্কা খায় মনে। কি সর্বনাশ! প্রতিদিন তাহলে এভাবেই অন্যের চোখের সামনে দিয়ে নিজের ব্যাক্তিগত সীমানায় প্রবেশের অধিকার পেতে হবে তাকে? এক চিলতে ঘুপচি মত অন্ধকার জায়গায় নানা জিনিষ ডাম্প করে রাখা। মাথার উপরের উচ্চতায় ছোট জানালায় একবিন্দু মেঘলা আকাশ দেখা যাচ্ছে। সূর্যালোক প্রবেশের সুযোগ ওই জানালায় আদৌ আছে কিনা ভেবে পায়না সত্যবতী। একপাশে কোনমতে দুইজন মানুষের থাকবার ব্যবস্থা করা। রান্নাঘর এবং বিশেষ করে বাথারুম অন্যের সাথে ‘সেয়ার’ করার বিষয়টা ‘প্রাইভেসী’ রক্ষায় কতটা মর্মান্তিক হতে পারে ভেবে হুড়মুড় করে বাসাটা থেকে বের হয়ে আসে সত্যবতী। স্বামীর চোখে হতাশার ছায়া, কপালে শ্রান্তির ঘাম চিকচিক করে। সত্যবতী দেখে আর ভিতরে উৎকণ্ঠায় কুলকুল করে ভাঙ্গে। দেশে উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া বাবার তৈরি খোলামেলা এপার্টমেন্টটা ওই মুহূর্তে কি ভীষন পিছনে টানে তাকে। উত্তর দক্ষিনে হাওয়া খেলা বারান্দা, প্রশস্ত শোওয়ার ঘর, বাথরুম, রান্নাঘর সব যেন সত্যবতীর কথা চিন্তা করেই বানিয়েছিল বাবা। দ্যাখো জোনাকি! সময়ের এই প্রান্তে আমার এক বেডরুমের এপার্টমেন্টের ছোট্ট সংসারে দুইজনের মাথা গোঁজার জন্য আবশ্যকীয় সব আছে। কিন্তু সেই পরিসর যে কতটা সীমিত, কতটা বাহুল্য বর্জিত! যততুকু না হলে নয় ঠিক তততুকুই যেন! নিজভূমে স্বদেশীআনা নিয়ে মাথা ঘামানোর কোন প্রয়োজন ছিলোনা। এখানে শাড়ী মানেই বাঙ্গালিয়ানা বজায় রাখার অদম্য এক উচ্ছ্বাস। সেই সাথে আনুসঙ্গিক আরও কিছু জিনিষ- দুই ফিতায় পা গলানো হাই হিল স্যান্ডেল, বাহারী চুরি, জুয়েলারী, কপালে রঙ মেলানো টিপ যে শীতের দেশের যান্ত্রিক জীবনে হুটহাট অনাবিল আনন্দ বয়ে আনে তাকি আর কিছুতে পাই? কিন্তু এই বারো হাত লম্বা প্রিয় পোশাক, সেই সাথে আনুষঙ্গিক আয়োজনে এখন না পারি নিজেকে সম্পূর্ণ আবৃত রেখে চলতে না পারি বর্জন করতে। জোড়া জোড়া উইন্টার বুট, গুষ্টির মোজা, স্কার্ফ, টুপি আর আবহাওয়ার গতি বুঝে গায়ের মধ্যে ‘লেয়ার’ এর অত্যাচারগুলো ঠিক মতো হাতের কাছে থরে থরে রাখার পর সখের, ঐতিহ্যের বাঙ্গালিয়ানা যে কিছুটা অব্যাবহৃত ‘ডাম্প’ অবস্থায়ই পড়ে থাকে। তবুও ফেলবো ভেবেও কিছুই ফেলা হয় না। ফেলতে পারিনা জোনাকি! মন ঠিকই হাত বাড়ায় চেনা সুগন্ধে, চেনা শাড়ীর ভাজে, চেনা সব পুরনো জিনিষে। আপাতঃ দৃশ্যত হয়তো টাল করে রাখা সেই সব জিনিষ কিন্তু আলুথালু অবহেলায় রাখা নয় কোনমতেই। শোন জোনাকি! চাওয়া পাওয়ার মানদণ্ডে আমি এক অতি সাধারন।
অনেক দুঃখে ফোটা সূর্যমুখীর মত রোদের একটু আভাসেই ঝলমলে আনন্দে অনেক খুশি এই আমি। এখানের এই ছোট্ট বাসস্থান নিয়ে এ আমার কোন আক্ষেপ বা অভিযোগ নয়, এ নয় কোন হতাশা বা বঞ্চনার উপাখ্যান, এই কাহন নয় কোন কষ্টের দীর্ঘশ্বাস। এই জীবনে যখন যতোটুকু ছিল তাকেই যতেœ, পরিচর্চায় দৃষ্টিনন্দন রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা ছিল আমার।
শুধু কি ফেলে দেব আর কি রাখব-এই সিন্ধান্তে আমি যে সত্যিই আজ বড় দ্বিধান্বিত জোনাকি! একটা বাগানে কত রকম ফুলের সমারোহ সম্মিলিত এক সৌন্দর্যে বাগানকে আলোকিত করে রাখে তাইনা? মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কও যে তেমনি এক ঐশ্বরিক নিয়মে ঘুরপাক খায়। বিশ্বাসে, ভালোবাসায় প্রতিটা সম্পর্কই যে ইউনিক। ঠিক বাগানের প্রতিটা ফুলের মতই উপযুক্ত পরিচর্যায় প্রতিটা সম্পর্ককেই জীবন্ত রাখতে হয়। জিনিষের ক্ষেত্রে abandone বা ফেলে দেয়ার সিন্ধান্ত যত সহজ, মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের প্রশ্নে সেই বর্জন কিন্তু তত সহজ নয় জোনাকি। জিনিষের প্রতি ভালোবাসা, আসক্তি, মোহ এবং আবেগ মানুষের স্বাভাবিক আচরণ। কিন্তু ‘সম্পর্ক’ যে এই সব ছাড়িয়ে আরও গভীর উপলব্ধিতে মোড়ানো এক স্বর্গীয় অনুভুতির নাম। এক অলিখিত আছোঁয়া সংবিধানের নিয়মে সম্পর্ক গড়ে উঠে, গভীর হয়। অথচ মাঝে মাঝেই আমরা সম্পর্কের রাস্তাটাকে দু’পায়ে মাড়িয়ে, অবহেলায় দলিত মথিত করে চলে যাই। কখনো নিজে ‘পরিত্যক্ত’ হই, কখনো অন্যকে ‘পরিত্যক্ত’ করে পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে বাধ্য হই। “Abandonement is a wound that never heals!” জোনাকি! জোনাকি! কোন সম্পর্ক থেকে বাধ্যতামূলক ‘প্রস্থান’ বা ‘পরিসমাপ্তি’ -বড় কষ্টের এই বর্জন! এই বিসর্জন! এ যেন শুধুই শেখার পরীক্ষা- সঠিক সময়ে, সঠিক সম্পর্ক বেছে নেয়া, ধরে রাখার অবিনশ্বর কোন ক্ষমতার পরীক্ষা। এ শুধুই জীবনের সঞ্চিত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ‘হীরা ফেলে কাঁচ’ না ‘কাঁচ ফেলে হীরা’ বেছে নেয়ার সঠিক সময়োপযোগী সিন্ধান্ত। সেই কবিতাতেই ফিরে যাই আবার- ‘কেননা জীবন এত ধৈর্যময় গবেষণাগার, বিশাল কয়লার খাঁজে হীরা রেখে সে বলে- বেছে নে।’ (চলবে)।
Ritu Mir, Teacher, Toronto District School Board, Toronto, ritu.mir9@gmail.com