ঋতু মীর : “Peace begins when the expectation ends”
১।
গাড়িটা ধুম করেই ব্রেক কষে বাসার গলির ঠিক উল্টো মুখে থেমে পড়ে। পিছনের সিটে বসা সত্যবতী এতক্ষণ অন্যের গাড়িতে চড়ার বিব্রত বিড়ম্বনায় একরকম কাঁচুমাচু হয়েই বসে ছিল। গাড়ির চালক মালিকের আজ্ঞাবহ দাস। মালিক যখন জলদ গম্ভীর স্বরে, বিরক্তি ভরা মেজাজে ‘এখানেই থামাও’ ‘ও ঠিক চলে যেতে পারবে’ বলে আদেশের ঘোষণা দিয়ে বসলেন তখন তো আর গাড়িতে বসে থাকার যুক্তি নেই। শঙ্কিত চোখে ঢাকার রাস্তার ট্র্যাফিক জ্যাম আর গিজগিজে ভিড়ের জনস্রোতে তাকিয়ে থাকে সত্যবতী। লরী, ট্রাক, ট্যাক্সি থেকে শুরু করে রিক্সা এমনকি ঠেলাগাড়িও নিজস্ব কায়দায় এলোপাথাড়ি ছুটছে। রাস্তা ক্রস করে উল্টা দিকের গলি ধরে কিছুদুর হাঁটলেই সত্যবতীর বাসার আঙ্গিনা। যদিও পায়ে হাঁটা দূরত্ব কিন্তু রাস্তা পার হওয়া এবং পথচারী উপেক্ষা করে প্রায় গা ঘেঁষে তীব্র গতিতে রিক্সা চলাচলের কারণে গলি পর্যন্ত পায়ে হেঁটে বাসা পর্যন্ত পৌঁছানো যেন সত্যবতীর জন্য এক কঠিন পরীক্ষা। এই তো সেদিন বাসার সামনে সরু রাস্তায় মুদির দোকানের সামনে রিক্সা ছেড়ে প্রয়োজনীয় কেনাকাটায় দাঁড়াতেই অবিরাম ঘণ্টি বাজানো রিকশাটা চাকায় শাড়ির আঁচল প্যাঁচিয়ে সত্যবতীকে হ্যাঁচকা টানে কিছুদূর নিয়ে ফেলে। পড়ে যেতে যেতে উঠে দাঁড়ানো সত্যবতী আর্ত চিৎকারে বøাউসের কাঁধের কাছের সেফটিপিন থেকে ছিঁড়ে ফুঁড়ে বের হওয়া আচলটা হাতে টেনে ধরে। আরেকটু হলে বোধহয় বারো হাত শাড়ীর কুঁচিতেই টান পড়তো। কি কাণ্ড ! পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বিশেষত রিক্সার উপর শতভাগ নির্ভরশীল সত্যবতী এইসব অযাচিত ঝামেলা এড়াতে বরাবর বাড়ির দোরগোরা পর্যন্ত রিক্সা নেয়ার পক্ষপাতী। রিক্সায় উঠে বসার আগে চালকের সাথে ভাড়া, বাসার গলি এবং ঠিক কোন পর্যন্ত যেতে হবে তাই নিয়ে দেনদরবার যেন নৈমিত্তিক ব্যাপার। রিক্সাওয়ালার সাথে সত্যবতীর কথোপকথনের আদ্যপান্ত বর্ণনায় তার স্বামী প্রায়শই ঠাট্টায় হাসে। এত বিস্তারিত বলার কি আছে? রাস্তায় পরিস্থিতি বিবেচনা করে চললেই তো হোল! না হোল না! অসহিস্নু বিরক্তিতে ভ্রæ কুঁচকে তৎক্ষণাৎ স্বামীর কথার প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে সত্যবতী। অফিসে মহিলা সহকর্মীর দুই শিশু পুত্রসহ রাস্তার জ্যামে আঁটকে থাকা, এক পর্যায়ে রিক্সা থেকে নামতে বাধ্য হওয়া এবং রাস্তা পার হতে গিয়ে রিক্সার সামনের চাকা দুই হাতে থামানোর চেষ্টায় প্রায় হিঁচড়ে ছেঁচড়ে যাওয়ার গল্পটাতো স্বামীকে কালই সবিস্তারে বর্ণনা করলো। রিক্সাওয়ালা যখন সত্যবতীকে গলির রাস্তার উল্টা মুখে ‘এইহানে নামেন’ বলে ঘাড় তেড়া করে গ্যাঁট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে তখন তো আর আসমান থেকে সোনার শকটে চড়া রাজপুত্র সত্যবতীকে উদ্ধারে এগিয়ে আসবে না! রাগে দুঃখে নিজের মনেই গজর গজর করে সত্যবতী। নিরাপদে বাসায় পৌঁছানোর উৎকণ্ঠায় ভোগা সত্যবতী স্বামীর প্রতি এক অবুঝ অভিমানে গুমরে মরে। সামর্থ্য, যোগ্যতার প্রশ্নে নিজের সামাজিক অবস্থানগত দিকটা তার মনে এক হীনমন্যতার জন্ম দেয়। চলাচলের জন্য নিজস্ব যানবাহন যে জীবনের এই প্রবল গতির ব্যস্ত সময়ে মানুষের জন্য আর বিলাসিতা নয় মোটেই। হায়! সত্যবতীই বুঝি কেবল এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত!

২।
হঠাৎ ব্রেক কষার যান্ত্রিক শব্দ ভাবনার মাকড়সা জাল থেকে ছিন্ন করে বাস্তবে আছড়ে ফেলে সত্যবতীকে। ট্রাফিক নিয়ম উপেক্ষা করে গাড়িটা রাস্তার একপাশে থামতেই তারস্বরে পেছনের যানবাহন হর্ন বাজিয়ে চলে। নিজের দিকে গাড়ির দরজা খোলার নিরাপত্তা বিষয়টা তড়িৎ নিশ্চিত হয়ে সতর্কতায় বাইরে পা রাখে সত্যবতী।

বিপরীত দিকে যানবাহনের বিশাল স্রোত ধেয়ে আসছে। এই মুহূর্তে ঠিক কতটা সময়ে রাস্তাটা টপকে পার হয়ে যেতে পারবে ভেবে তল পায় না সত্যবতী। এতো সত্যবতীর ভাড়া মিটিয়ে ওঠা রিক্সা নয় যে বাসার দোরগোরায় না পৌঁছা পর্যন্ত সে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকবে। গাড়ির চালক এক করুণা মিশ্রিত বিস্মিত চোখে সত্যবতীকে দেখে। হয়তো সত্যবতীর সাথে গাড়ির অন্য আরোহীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থানের ফারাকটা ঠিকঠাক আঁচ করার চেষ্টা করে। কারও কাছ থেকে কোন ‘সুবিধা’ নেয়ার অভ্যাস বা প্রবণতা সত্যবতীর ধাতে নেই। অন্যের অসুবিধা তৈরি হতে পারে এমন ভাবনার সাথে তার নিজের মানসিক খুঁতখুঁতানি মিলেমিশে ‘ভধাড়ঁৎ’ নেয়ার ব্যাপারে বরাবর তার প্রবল অনীহা। সেই রাস্তায় সহজে হাঁটতে চায় না সত্যবতী। এই পথে সত্যবতীর বাসা পড়বে ভেবেই না আগপাছ বিবেচনা না করেই আজ কেমন অবলীলায় গাড়ির আশ্রয়ে উঠে বসেছিল সে। আত্মীয় পরিজনের সাথে ঘরোয়া খুচরা আলাপে যাত্রার সময়টা ভালো কাটবে সেই লোভটাও কাজ করেছিল। তাছাড়া রিক্সার ঝাঁকুনি, বারবার চালককে সাবধান করার খিস্তি খেউর থেকেও কিছুটা মুক্ত থাকা যাবে। বিষাদের অবসাদে মনটা ভার হয়ে যায় সত্যবতীর। জিহ্বার তরলে তিতা তিতা স্বাদ গলার কাছে জমে থাকে। অন্যমনস্ক মনে পায়ে পায়ে বাসার দিকে হাঁটে সে। রিক্সা নয়, নিজের পায়েই শাড়ীর কুঁচি জড়িয়ে হোঁচট খায় বারবার। সদা সতর্ক সত্যবতী সড়ক নিরাপত্তা, নিয়মের বিষয়টা যেন আজ আর কিছুতেই মাথায় নিতে পারে না। কিছুটা বিক্ষিপ্ত এলোপাথাড়ি হাঁটে। বাসার দূরত্ব অনেক নয়, তবুও হাঁটার পথটা ফুরায় না সত্যবতীর। Inferiority complex এর দাঁতাল এক ভুত তার মগজ জুড়ে বসে থাকে।
এক সুক্ষ অপমান বোধের ধিকি ধিকি আগুন চোখে জ্বালা ধরায়। বাসায় পৌঁছে চোখে মুখে ঠাণ্ডা পানির ঝাঁপটা দেয় সত্যবতী। কাপে ধুমায়িত চায়ের কুণ্ডলীর দিকে তাকিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করে- ঘটনাটা কি অতিরঞ্জিত করে ভাবছে সে? গাড়ি দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়নি বলেই কেন নিজেকে অপমানিত মনে হচ্ছে? মানুষের মান-অপমান, সম্মান-অসম্মানের উথান পতন কি সত্যিই অন্য মানুষের আচরণ বা ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল? রিক্সাওয়ালা যখন মাঝপথে নামিয়ে দেয় তখন কি সে অপমানিত হয়? তা নয়তো আসলে! পরিস্থিতি মোকাবেলা করার চেষ্টাই কি করে না সে? আজ তাহলে আত্মীয় বলেই কি সম্পর্কের খাতিরে খুব বেশি প্রত্যাশা ছিল সত্যবতীর? প্রতিদিনই তো রাস্তার এই ঝুট ঝঞ্জায় পড়তে হয় তাকে। চলাচলে এই সব প্রাত্যাহিক সমস্যার আশু সমাধান কি আদৌ আছে? কাউকে অভিযুক্ত করার যুক্তিই বা কোথায়? জোনাকি! জোনাকি! দ্যাখো!

এগুলো মেনেই কিন্তু প্রতিনিয়ত সাবধানতায় পথ চলছি। আজ তাহলে ক্ষণিক অসুবিধার ব্যাপারটা এত বড় করে দেখছি কেন বলতো? সত্যবতীর ক্ষেপে যাওয়া চিৎকারের স্বর এখন শান্ত, স্তিমিত। তার মেজাজের পারদটা ঠিক মত বুঝে নিয়ে মুখ খোলে জোনাকি। আসলে সত্য! আমরা অনেক সময়েই অন্যের সুবিধা অসুবিধার দিক এবং ব্যাক্তি, পরিস্থিতিকে না বুঝেই নিজ আচরণের ক্রিয়া, প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে ফেলি। ধর! তোমার অসুবিধার বিষয়ে যদি তুমি শুরুতেই খোলামেলা হতে তাহলে হয়ত ব্যাপারটা এমন হতোনা। ভেবে দেখো! আসলে অন্যের কাছে ‘ফেভার’ নেয়ার বিষয়ে তুমি প্রচণ্ড egoistic তাই না! সেই সাথে অন্যের প্রতি তোমার ‘expectation’ এর ব্যাপারটাও কিন্তু তোমাকে এক্ষেত্রে পূর্ণমাত্রায় দখল করে আছে। শোন সত্য! ‘don’t blame people for dissapointing you, blame yourself for expecting too much from them’। তবে আমি এটাও বলবো যে, গাড়ির মানুষটিরও কিন্তু তোমার প্রতি উপকার মনোভাবে, বিচক্ষণতায়, সহযোগিতায় তোমার পরিস্থিতিকে সামাল দেয়ার চেষ্টা করা উচিৎ ছিল। নিজের জন্য যা প্রযোজ্য বা মঙ্গলজনক অন্যের ক্ষেত্রেও তা বিবেচনায় রাখলেই কিন্তু সম্পর্কে শুন্যতার জন্ম হয় না। এইসব ভেবে আর কষ্ট পেওনা সত্য! কোন কোন সময় pain is certain, কিন্তু suffering is optional! এবার চলতো রিক্সায় কোথাও ঘুরে আসি! (চলবে…)
Ritu Mir- Teacher, Toronto District School Board, Toronto. (ritu.mir9@gmail.com)