ঋতু মীর : “Strong people don’t put others down,they lift them up”
১।
আত্মীয় আর বন্ধু-বান্ধব মিলে আট-দশজনের মিলিত আসরে সত্যবতীর ঘরের পরিবেশটা আজ আলাপচারিতায় মুখর, কোলাহলে সরগরম। সাজানো গোছানো ছিমছাম লিভিং রুমের কোজি কর্ণারে এক উষ্ণ আমেজ খেলা করছে। কিছুটা পারিবারিক এবং কিছুটা হাসি ঠাট্টার প্রসঙ্গে ঘরের আবহাওয়া সৌহার্দ্যময়। আপাতঃ দৃষ্টিতে প্রায় সবাই নিজ নিজ ‘comfort zone’ এ আছে ভেবে স্বস্তিতে হাসে সত্যবতী। যতজন অতিথি হলে প্রত্যেককে পূর্ণ মনোযোগ দেয়া সম্ভব ঠিক ততজন নিয়েই সত্যবতীর এই সান্ধ্য আয়োজন। কার কি বিশেষ খাবার পছন্দ বা আসক্তি সেই মত নিজ হাতের রান্না করা খাবার অতিথির সামনে তুলে ধরতে পারলেই সত্যবতী নিজেকে সার্থক মনে করে। সেন্টার টেবিলটা ধূমায়িত চাসহ পনির, চানাচুর, মুড়ি মাখা এবং নানাবিধ পার্টি মিক্সের জাঙ্ক-ফুড আয়োজনে ঠাঁসা। খাওয়া ঠিক নয় জেনেও শুরুটা যেন এই সব কুড়-মুড় খেয়েই আড্ডা জমে ওঠার ব্যাপারটা সহজ হয়। সদা স্বাস্থ্য সচেতন সত্যবতী। খাদ্য তালিকা নির্বাচনে নিজেকে এবং প্রিয়জনদের জাঙ্ক ফুড গ্রহণে কিছুটা ছাড় দিলেও ছোলা, নানাবিধ গ্রেইন এবং কাঁচা সব্জীর মিশ্রণে তৈরি সালাদ জাঙ্ক ফুডের সাথে টেবিলে দিতে কখনোই ভুল হয় না তার। বাসাটা যখন তার, লোকজনের সমাগম যখন তারই আমন্ত্রণে তখন অতিথির সামগ্রিক আনন্দ, খাতির যত্ন, স্বাস্থ্যের দায়িত্ব ভারটাও যে তারই উপর- জানে সত্যবতী!
২।
হাসি, কথা সবই স্বাভাবিকের চাইতে উচ্চগ্রামে চলছে। বাইরে থেকে নির্ঘাত তা শোনাও যাচ্ছে। যাক! তবুও নিজের বাসায় আসরের এই জমজমাট আড্ডা ভাবটা ভীষণ ভাল লাগে সত্যবতীর। একঝলকে প্রতিটা মুখে দৃষ্টি বুলায় সে। ওইপাশে বসে থাকা মানুষটার মুখ স্মিত হাসিতে উদ্ভাসিত। বসার ভঙ্গিতে রাজ্যের আলস্য। নিশ্চিন্ত, নির্ভার মুখের অভিব্যাক্তি দেখে মনে হয় পৃথিবীর কোন জটিলতা এই মানুষকে বুঝি কখনোই স্পর্শ করেনি। খুশি খুশি মনে চেয়ারের উপর পা তুলে বসে বাড়তি আরাম খোঁজে মানুষটা। সেই হাসি হাসি চোখ আর মুখের দিকে তাকিয়ে সত্যবতীর মনটা অপার্থিব স্নিগ্ধ আলোয় ছেয়ে যায়। হাতের বা পাশে ঘেঁষাঘেঁষি হয়ে যে বসে আছে সে সত্যবতীর স্বজাতি, অর্থাৎ স্ত্রী জাতি! অথচ সত্যবতীর মত আগল খোলা, ঝনঝনানি কথায় পারঙ্গম নয় মোটেই। ঠাণ্ডা পানির কলসের এক টেলকা ভাব তার পুরো অবয়ব জুড়ে। তাঁর কণ্ঠের নরম, নীচু স্বরের কথা ঘরের কোলাহলে ক্ষণেই মিলিয়ে যাচ্ছে। চকিতেই গভীর মনোযোগে তার মুখের পাশে কান পেতে সেই কথার মর্ম উপলব্ধি করে সত্যবতী। চোখে চোখে তাকিয়ে মুচকি হাসে সে। মানুষ সবসময় এত উত্তেজনাহীন নিরুত্তাপ থাকে কি করে ভেবে পায় না সত্যবতী। ঘরের আলোচনার প্রসঙ্গ কোন বিশেষ কিছুতে কেন্দ্রীভূত নয়। ক্ষতিহীন পরচর্চা থেকে শুরু করে ঘরকন্নার টুকরা টাকরা বিচ্ছিন্ন আলাপচারিতা জ্ঞানগর্ভ কোন প্রসঙ্গ নয়, শুধু নির্ভেজাল আড্ডার এক নির্মল আনন্দে টইটম্বুর। বেহিসেবী সময় তরতরিয়ে বয়ে চলে। আসরের আলোচনা এক সময় আজকের আন্তরিক আয়োজন, রান্নার প্রশংসা, সত্যবতীর পারসোনালিটির বিশেষ বিশেষ দিক নিয়ে মজা করায় তুমুল উত্তাল। অতিথি আপ্যায়নের খুঁটিনাটি ব্যস্ততায়ও সেই মজায় অংশগ্রহণে তৎপর হয় সত্যবতী। নিজেকে সবার সামনে নিজেই বিশ্লেষণ করে সত্যবতী। আকর্ণ হাসিতে মুখ ভাসিয়ে বলে- জানোতো! কথা সংক্ষিপ্ত করার প্রবণতা আমার মধ্যে কিন্তু একদম নেই। উপরন্ত একটা বলার থাকলে আমি ভাই দশটা বলি। আহা! কথা বলায়, নিজের মনের ভাব উজাড় করায় এবং সেই সাথে অন্যের মনের গহীন কন্দরে কথায় কথায় ঢুকে পড়া, সুখ, দুঃখ ভাগাভাগি করায় যে কি আনন্দ! কি আনন্দ! যে জানে কেবল সেই জানে গো! ‘তবে সত্য কিন্তু কখনোই একা ফিল্ড দখল করে মনোযোগ আকর্ষণকারী মক্ষীরানী হওয়ার ধান্দায় থাকে না এটা ঠিক’। ঠিক! ঠিক! সবার সম্মিলিত হাসির জোয়ারে ঘর ভেসে যায়। একঝাঁক সাদা পায়রার একসাথে উড়াল দেয়া শব্দের এক আনন্দ অনুভুতি যেন সত্যবতীর মনে ডানা ঝাঁপটায়। রান্না, ঘর সাজানো, আতিথেয়তার সাথে গান, লেখালেখি, কথা বলার আর্ট বিষয়ে স্বতঃস্ফূর্ত কিছু প্রশংসা সত্যবতীকে তারুণ্যময় লাস্যের এক টগবগে উচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে নেয়। বাহহ! পোঁতানো মুড়ির জীবনে একেই বোধ হয় ‘Charged’ হওয়া বলে!
৩।
ঘরের এক কোণে একটু দূরে বসে থাকা মানুষটার মুখে এঁটে থাকা আরোপিত গাম্ভীর্য দৃষ্টি এড়ায় না সত্যবতীর। বসার ভঙ্গিতে এক উন্নাসিক বিছিন্নতা। আসরে ‘আছি’ কিন্তু ‘নেই’ এমন একটা ভাব চোখের দৃষ্টিতে। আর এইসবের মধ্যেই নিজের দিকে মনোযোগ আকর্ষণের একটা সুক্ষ চেষ্টাও আছে। সত্যবতীর সজাগ ইন্দ্রিয় বলে- এই মুহূর্তে সত্যবতীকে নিয়ে ‘পজিটিভ’ আলোচনা মোটেই পছন্দ হচ্ছে না মানুষটার। শুদ্ধ উচ্চারণে বেশ জোর খাটানো কণ্ঠে এতক্ষণে কথা ছুঁড়ে দেয় মানুষটা। সত্যবতীর জীবন, আচরণ, পারসোনালিটির বৈশিষ্ট নিয়ে ফান করার ছলে সত্যবতীকে নীচু করার মানসিকতাটা যেন খুব স্পষ্ট। ছুঁড়ে দেয়া মন্তব্যে বাক্য আর শব্দ যোগের কৌশল প্রয়োগে ‘শ্লেষ’ ‘খোঁচা’ এবং পরিশেষে ‘স্ল্যাং’ও যুক্ত হয়। ‘প্রশংসা’ ‘ধন্যবাদ’ এর মত বিষয়গুলো যেন ভুলেও সত্যবতীর জন্য বরাদ্দ না হয় এমন এক মনোভাব মানুষটার মুখে সেঁটে থাকে। পাশে দাঁড়ানো সহধর্মীনি মহিলা স্বামীর কথার সমর্থনে শরীর কাঁপানো হাসিতে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে। মগজের তন্ত্রীতে হঠাৎ ভিন্ন এক অস্বস্তিকর আলোড়ন অনুভব করে সত্যবতী। বড় লজ্জার, অবমাননার, অসম্মান আর চিনচিনে ব্যাথার মত সেই আলোড়ন! মানুষটার কথায় কোথায় যেন সত্যবতীকে ‘put down’ করার একটা প্রছন্ন প্রবণতা আছে! ‘কবি’ এবং ‘কবিতা’ প্রীতি নিয়ে মিছরির ছুড়িতে অরুচিকর ‘অশ্লীল’ মন্তব্যে সত্যবতীর সামাজিক মান মর্যাদার অবস্থানকে প্রশ্নবোধক করার বিষম এক ইঙ্গিত আছে! সত্যবতীর মনটা মুহূর্তেই কালো মেঘের ছায়ায় ঢেকে যায়। একটু আগেই যে ফল্গুধারায় উৎসরিত হাসির গমকে তার শরীর কাঁপছিল এখন তা কেমন কুণ্ডলী পাকিয়ে গলার কাছে আঁটকে আছে। ঘরের বাতাসটা কেমন শ্বাসবন্ধ লাগে সত্যবতীর। অবরুদ্ধ অভিমানে আহত সত্যবতী নিমেষেই নিজেকে সামলে নেয়। আড্ডার নির্মল আনন্দ আবহাওয়া বিষাক্ত করার খেলাকে এই মুহূর্তে কিছুতেই আমল দেবে না সে। জোনাকি! জেগে আছো? ক্লান্ত স্বর সত্যবতীর। ঘটনার বর্ণনায় বিচক্ষণের মত বলে ওঠে জোনাকি- ‘Whoever is trying to bring you down is alreadz below to you’। নিজেকে জানো সত্য! মনে রেখো! কেউ যদি তোমাকে অভব্যতায় বিচার করে তবে জানবে সেটা তার নিজের অশুদ্ধ আচরণের প্রতিফলন। ‘How you make others feel about themselves, says a lot about you’ – এই যে মানুষ সবার সামনে অন্যকে অসম্মান বা নীচু করার চেষ্টা চালিয়ে নিজেকে সম্মানিত ভাবে, সে কিন্তু পরোক্ষে নিজেকেই নীচু করে, নিজেকেই অসম্মানিত করে। কেবলমাত্র ‘Insecure people put others down to raise them up’- স্বগতোক্তিতেই জোনাকির সাথে ফোনালাপ শেষ করে এবার ঘুমাতে যায় সত্যবতী। নিজের প্রতি বিশ্বাসে, ভালোবাসায়, মর্যাদায় নিশ্চিন্ত পরিপূর্ণ সেই ঘুম! (চলবে)।
Ritu Mir, Teacher, Toronto District School Board, Toronto, ritu.mir9@gmail.com