ঋতু মীর : “Sometimes ending bring the best new beginnings”
১।
‘মাইন্ড দ্যা গ্যাপ’-ছোট্ট এই বাক্যের অন্তর্নিহিত দার্শনিক অর্থটা ব্যাপক, বোধের অনুভবে গভীর। কেবল ট্রেন এবং প্লাটফর্মের মধ্যকার বিপজ্জনক ব্যবধান নয়, এই শুন্যতা, এই গ্যাপ, এই স্পেস, এই অন্ধকারটুকু ছড়িয়ে আছে মানুষের সামাজিক বলয়ের চারপাশে। সম্পর্কের মাকড়শা জালের বুননেই এই জীবন গতিময়। সম্পর্কহীন মানুষ আসলে অসম্পূর্ণ। আমাদের চারপাশ এখন বড্ড টলোমল। মায়া মমতার বন্ধনে আজ যেন এক অদ্ভুত শিথিলতা। সম্পর্ক যেন এখন কচুপাতায় জল। বিশ্বাস-অবিশ্বাস, ঘৃণা, প্রচার, প্রতিযোগিতার দ্বন্দ্বে প্রতি মুহূর্তেই পিছলে যাওয়ার শঙ্কায় শঙ্কিত। মানুষে মানুষে নিখাদ, নিঃশর্ত, সুকুমার ভালোবাসার ময়ূরপঙ্খী নৌকা প্রায়শই অচেনা গিরিখাদে দিশাহীন এঁকেবেঁকে চলে। অবশ্যম্ভাবী এক হতাশায় প্রতিমুহূর্তেু জন্ম হয় শূন্যতার। অনির্ণীত, ধোঁয়াশা সেই শুন্যতা ট্রেন আর প্লাটফর্মের মধ্যকার ব্যবধানের মত মানুষের সম্পর্কেও তৈরি করে সুক্ষ এক ‘গ্যাপ’। অন্তর্দৃষ্টিতে আমরা তার কিছু দেখি, আর অকারণ উদাসীনতায় অনেক কিছু দেখতে পাই না। মানুষ, সমাজ, সম্পর্ক, বিশ্বাস, ভালোবাসা, সুখ, দুঃখ আবেগ, যুক্তি এবং পারস্পরিক মানসিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট ‘গ্যাপ’ এবং শুন্যতার বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতায় তুলে ধরার প্রয়াসেই – ‘মাইন্ড দ্যা গ্যাপ’! কাহিনীর ‘সত্যবতী’ সম্পর্কের সাতকাহন গাইতে গাইতে নিজের চারপাশে সুক্ষ, অস্পষ্ট শুন্যতাগুলো পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতায় চিহ্নিত করে চলে। কখনো নিজের সাথে নিজের কথোপকথনে, কখনো ‘জোনাকি’ র সাথে। সত্যবতী চরিত্র বা কাহিনী বিশেষ কোন ব্যক্তির নয়। একটু গভীরে ভাবলে- চারপাশে অনেক ‘সত্যবতী’ মিশে আছে এই সম্পর্কের আদলে । মিশে আছে প্রেম, ভালোবাসার সাতকাহনে। মিশে আছে ক্ষোভে, হতাশায়, বঞ্চনায়, অসম্মানে, নিগ্রহের অপ্রকাশিত গল্পে। বেঁচে আছে ভয়ঙ্কর অন্ধকার সেই শুন্যতায় হোঁচট খেয়ে আবার উঠে দাঁড়িয়ে।
বাঙলা কাগজের সাথে আমার আত্মিক সম্পর্ক। সম্ভবত ২০০৭, ‘বঁধু হে, একা বসে থাকি!’ শিরোনামে লেখাটা নিয়ে প্রথম বাংলা কাগজের অফিসে গিয়েছিলাম। বাঙলা শব্দ টাইপের জন্য তখন অভ্র বা অন্য কোন ইউনিকোড জানা ছিলো না। সেক্ষেত্রে ‘বিজয়’ কি বোর্ডই একমাত্র ভরসা। হাতে লিখে বাংলা ফন্টে টাইপ করে লেখা প্রকাশ একপ্রকার অসম্ভব। বাংলা কাগজের চীফ এডিটর এবং প্রকাশক এম আর জাহাঙ্গীর। মিতভাষী, বিনয়ী, পরিমিত এবং আপাদমস্তক নির্ভেজাল, শুদ্ধ এই মানুষটিকে চিনে নিতে ভুল হয়নি। পাশে বসিয়ে নিজ হাতে বানান, ভাষা শুদ্ধ, ফরম্যাট ঠিক করে লেখা প্রকাশের ব্যবস্থা করেছিলেন। পরের সংখ্যাতেই লেখাটা প্রকাশের আনন্দ, পাঠক প্রতিক্রিয়া আজও আবেগে ভাসিয়ে নেয় আমাকে। এরপর যতবার দেখা হয়েছে- দুইহাত পেতে ‘লেখা কই’ বলে দাঁড়িয়ে গেছেন। আর প্রতিবার সামান্য আমি এক অসামান্য গৌরবে সম্মানিত হয়েছি। বাংলা কাগজের ২২ বছর পূর্তির মত বিনিময় সভায় একঝাক গুনী লেখক, কবি, প্রবন্ধকার, সাংবাদিক এবং কাগজ পরিচালনা কমিটির সসদস্যদের মিলনের অনবদ্য আসরটা ভীষণ স্মরণীয় হয়ে আছে। পরিচয় পর্বে হাস্যরসেই আলোচনার সূত্রপাত- ‘আজকাল কে আর কার লেখা পড়ে?’ এখন যে সবাই লেখক! এই প্রসঙ্গ উত্থাপনে বিচলিত হই না। বেশ জোরের সাথেই বলি- ‘আমি নিজেই আমার লেখার এক মনোযোগী পাঠক! লেখা প্রকাশের আগে প্রতিটা শব্দ, প্রতি লাইন বারবার পড়ে দেখি। আর প্রকাশের পর পাঠকের অবস্থানে নিজেকে দাঁড় করিয়ে আরও একবার পড়ি। লেখার ‘মান’ পত্রিকার ‘মান’ এবং বিশেষ করে ‘পাঠকের মান’- রক্ষার বিষয়ে আমি প্রশ্নাতীতভাবেই আপোষহীন। নিজের সমালোচনায় নিজের সাথে নিজেরই প্রতিযোগিতার খেলা চলে নিরন্তর। সেই খেলায় হারজিত, উত্থান পতনের অনাবশ্যক উৎকণ্ঠা নেই, দ্ব›দ্ব নেই, প্রত্যাশা নেই, প্রচারের ঢাকঢোল নেই। আমার ‘অর্জন’ সেখানেই। আর এই অসামান্য ‘অর্জন’ সম্ভব হয়েছে বাংলা কাগজের পেছনে থাকা প্রচার বিমুখ, নিভৃতচারী কিছু মানুষের নিরলস ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়। গুণমুগ্ধ অসংখ্য পাঠকসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিক সাধুবাদ জানাই। ধন্যবাদ বাংলা কাগজ!
৩।
মাইন্ড দ্যা গ্যাপ-এক দুই তিন করে পঞ্চাশটি এপিসোডে পৌঁছে গেছে। প্রতি সপ্তাহে পত্রিকায় প্রকাশের উপযোগী একটা লেখা তৈরি- অসম্ভব! লেখার জন্য একটানা নিরবিচ্ছিন্ন সময় কোথায়? এই বিভূঁইয়ে সারাদিনতো রুজি রোজগারেই চলে যায়। বাকি সময় সংসার ধর্ম, কুটুম্বিতা, সামাজিকতা আরও কত কি! দৃষ্টি আর বোধের অনুভবে যে সৃষ্টি- অক্ষর, শব্দ, বাক্যের মাধুর্যে গাঁথা জীবনের সেই গল্প। লেখা মাথায় ভন ভন ঘুরে, গভীর তলদেশ থেকে বুদ্বুদের মত ভেসে ওঠে, মিলিয়ে যায়, হারিয়েও যায়। ‘নবনীতা সেনের নোট বই’ এ উল্লেখিত মেয়ে লেখকদের লেখালেখির চ্যালেঞ্জ বিষয়টা মনের গহীনে প্রতিবাদী ঝড় তোলে। প্রায় বছরকাল ‘মাইন্ড দ্যা গ্যাপ’ কলামের সাথে পথ চলতে চলতে অনেক সময়েই নিজেকে প্রচন্ড ‘সিনিক’ মনে হয়েছে। গ্যাপ বা নেগেটিভ বিষয়ের স্পষ্ট অবতারণায় কখনো কলম থেমে চিন্তার ‘bolck’ তৈরি হয়েছে। চারদিকে দৃশ্যমান শুন্যতায় মাঝে মাঝেই অসহায়ত্বে আকণ্ঠ্য ডুবেও গেছি। তবে লেখার ‘উপাদানে’ ঘাটতি হয়নি কখনো। আর দিনরাত্রির এই সব উপাখ্যানের ফাঁক ফোঁকর গলিয়ে ‘মাইন্ড দ্যা গ্যাপ’ এক কমিন্টমেন্ট নিয়ে বাংলা কাগজের নিয়মিত এক কলামে দাঁড়িয়ে গেছে। ‘মাইন্ড দ্যা গ্যাপ’ শেষ পর্বের এই সময়ে দ্বিধাহীন বলি- যদিও লেখার চেয়ে পাঠেই আমার অনাবিল আনন্দ। তবে লেখার জগতের সাথে সম্পৃক্ততা এবং একটা মানসম্মত পত্রিকায় লেখা প্রকাশের ধারাবাহিকতা আমাকে অবিশ্বাস্য এক ‘কমিটমেন্ট’ এবং ‘আত্মবিশ্বাস’ জুগিয়েছে। অবশেষে, প্রিয় উক্তিতেই শেষ করি- “There is no real ending. It’s just the place where you stop the story” (সমাপ্ত)।
Ritu Mir, Teacher, Toronto District School Board, Toronto. ( ritu.mir9@gmail.com)