মুরশাদ সুবহানী : গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান,
নাই দেশ- কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,
সব দেশে, সব কালে, ঘরে- ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।
সব মানুষের, সাম্যের, নবজাগরণের, দ্রোহ-বিদ্রোহের, প্রেমের, অসা¤প্রায়িক চেতনার, চারণ কবি কাজী নজরুল ইসলাম। যত গুণবাচক বিশেষণ আছে সব তাঁর নামের সাথে জুড়ে দিলেও মনে হবে কম করে বলা হ’ল। কোথায় নেই তিনি।
তিনি যুগকে অতিক্রম করেছেন। যুগ স্রষ্টা মহান ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।খুব সল্প সময়ে তিনি আমাদের বাংলা সাহিত্যে যা দিয়েছেন, তা তুলনাহীন।
“প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিলো ১৯১৪ সালে। ভারতবর্ষে তখন আকাশ বাতাস তোলপাড় করা স্বদেশী আন্দোলন আর সন্ত্রাসবাদের যুগ চলছে। স্বদেশী মানে, আমরা এ দেশের মাটিতে জন্মেছি, এইতো আমার স্বদেশ। আর স্বদেশের জন্য সংগ্রাম করে যারা তারাই স্বদেশী।”
ভারতবর্ষে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন অবসান করাই ছিল স্বদেশী আন্দোলনের মূল লক্ষ্য।
‘মাস্টারদা সূর্যসেন, ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী- এদের পাশাপাশি গান্ধীজীর স্বদেশী আন্দোলন। এই হচ্ছে সেই অগ্নিগর্ভ যুগ।
এই আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছিল জনগণ। এই সময়
‘শিয়ারশোল রাজ স্কুলের এক শিক্ষক- তার চোখ পড়েছিলো বুদ্ধিদীপ্ত, তরুণ, দরিদ্র ছাত্র কাজী নজরুল ইসলামের উপর
এই শিক্ষক রাজনীতি, বিপ্লব, স্বাধীনতা, দেশের জন্য যুদ্ধ- এ সমস্ত চিন্তা ও বোধ ধীরে ধীরে ছড়িয়ে দিচ্ছেন কাজী নজরুল ইসলামের মধ্যে।’
১৯১৭ সালে একদিন নজরুল রানীগঞ্জ রেলস্টেশনে ঘুরতে গেলেন। দূর পাল্লার ট্রেন এসে থেমেছে। কামরা ভর্তি লোক, তরুণ বয়েসি। হাঁক উঠলো প্ল্যাটফর্ম থেকে- “বন্দে মাতরম, দেশ মাতৃকার বন্দনা করি। দেশের জন্য যুদ্ধে যাচ্ছি।” রক্ত নেচে উঠলো নজরুলের। পড়ে রইলো টেস্ট পরীক্ষা, ম্যাট্রিক পরীক্ষা। যোগ দিলেন তিনি বাঙালী পল্টনে। ঊনপঞ্চাশ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্টে। চলে গেলেন যুদ্ধে।
“বাঙালি পল্টন বা ৪৯তম বেঙ্গলী রেজিমেন্ট প্রথম মহাযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮) বাঙালিদের নিয়ে গঠিত হয়। সে সময়ে এটিই বাঙালিদের প্রথম সামরিক সংগঠন। বাঙালি পল্টনের সৈনিক ছিল প্রায় ছয় হাজার সদস্যের বেশি। এই পল্টনের সৈন্যদের ইরাক অঞ্চল বা মেসোপটেমিয়াতে যুদ্ধের জন্য করাচি সেনানিবাস থেকে প্রেরণ করা হত।”
‘এখানে তিনি প্রথমে ল্যান্স নায়েক পরে হাবিলদার পদে উন্নীত হয়েছিলেন। আর এখানেই তিনি অবসর সময়টা দারুণ ভাবে কাজে লাগাতে পেরেছিলেন। প্রচুর লেখাপড়া, গান শেখা, বাজনা শেখা এবংফারসি ভাষায় দক্ষতা অর্জন তিনি এখানেই করেছিলেন।’
প্রথম মহাযুদ্ধ ১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই ইউরোপে শুরু হয় এবং ১১ নভেম্বর ১৯১৮ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। প্রথম মহাযুদ্ধ শেষে নজরুল কলকাতায় ফিরে এলেন ১৯২০ সালে।
এরপর বাংলা সাহিত্যে, এদেশের সাংবাদিকতার জগতে, বাংলা গানে ঝটিকার বেগে যেন এক আগন্তুক এসে প্রবেশ করলেন।’ প্রথম মহাযুদ্ধ শেষে কাজী নজরুল ইসলাম কলকাতায় এসে ৩২ নং কলেজ স্ট্রীটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে থাকতেন। তাঁর সাথে থাকতেন এই সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ মুজাফ্ফর আহমদ। প্রথমে শিয়ারশোল রাজ স্কুলের শিক্ষক কাজী নজরুল ইসলামের মাথায় রাজনীতি, স্বদেশী আন্দোলনের ধারণা দিয়ে ছিলেন। এরপর নজরুল চলে যান সৈনিক হিসেবে যুদ্ধে। ফিরে এসে, রাজনীতিবিদ মুজাফ্ফর আহমদ’র কারণে তিনি বৃটিশ বিরোধী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি হয়ে ওঠেন রাজনীতিক ও কবি।
বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে মিছিলে, মিটিং যোগ দিয়েছেন, তাঁর রচিত গান গেয়ে মানুষকে আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
ধূমকেতু পত্রিকায় ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯২২ সংখ্যায় নজরুলের কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ প্রকাশিত হয়। এই কবিতা প্রকাশিত হওয়ায় ৮ নভেম্বর পত্রিকার ওই সংখ্যাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। একই বছর নজরুলের যুগবানী প্রবন্ধগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং এ দিন তাঁকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। ১৯২৩ সালের ৭, জানুয়ারি নজরুল বিচারাধীন কারা বন্দী হিসেবে আত্মপক্ষ সর্মথনে এক জবানবন্দী প্রদান করেন; তৎকালের চীফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিষ্ট্রেট সুইনহোর আদালতে। এই জবানবন্দীর মধ্যে দ্রোহ-বিদ্রোহের রূপ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠে। কাজী নজরুল ইসলামের অকুতোভয় এই জবানবন্দী রাজবন্দীর জবানবন্দী হিসেবে বাংলা সাহিত্য বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে।
নজরুল যখন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে (১৯২৩ সালের ২২ জানুয়ারী) বন্দী জীবন অতিবাহিত করছিলেন কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বসন্ত গীতিনাট্য গ্রন্থটি কাজী নজরুল ইসলামকে উৎসর্গ করেন ‘এই কথা জানার পর বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম খুব আনন্দিত হন এবং তিনি সেই আনন্দে কারাগারে বসেই ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ কবিতাটি লেখেন।’ কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রায় ৪০ বছর পরে বাংলা সাহিত্য জগতে এসেছেন, কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তবে দুই কবির মধ্যে হৃদিক ও ভক্তি-স্নেহের সম্পর্ক ছিল।
গীতাঞ্জলির সব গান তাঁর মুখস্ত ছিল। “কাজী নজরুল ইসলাম ও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের শরৎকালে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের তৎকালীন সচিব কবি সুধাকান্ত রায় চৌধুরীর ভাই নিশিকান্ত রায় চৌধুরী সেই স্মৃতি স্মরণ করে ‘আমার কৈশোর স্মৃতিতে নজরুল’ প্রবন্ধে বলেছেন- ‘তবু যতদূর মনে হয়, তিনি হয়তো ড. শহীদুল্লাহ সাহেব হবেন। তিনি কবি গুরুকে বলছিলেন-ট্রেনে আসতে আসতে কাজী সাহেব আপনার গীতাঞ্জলির সব কটা গান আমাকে গেয়ে শুনিয়েছেন। কবিগুরু বললেন, ‘তাই নাকি? অদ্ভুত স্মৃতিশক্তি তো। আমার গীতাঞ্জলির গান সব তো আমারই মনে থাকে না।’ নজরুল-জীবনী গ্রন্থে সংকলিত-নিশিকান্ত রায় চৌধুরীর ‘আমার কৈশোর স্মৃতিতে নজরুল’ প্রবন্ধে শান্তিনিকেতনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের পারস্পরিক কথোপকথন, তাদের পরস্পরের কবিতা আবৃত্তি ও গান শোনার উল্লেখ রয়েছে। পারস্পরিক কথোপকথন এবং ভক্তি-স্নেহ দুই কবির আন্তরিকতা ও সুসম্পর্কের ইঙ্গিতবাহী।
এ কথা সবাই জানেন, ১৯২২ সালের ১২ আগষ্ট নজরুল ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশ করেন। ধূমকেতু সপ্তাহে দুইবার প্রকাশিত হত। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় সশস্ত্র বিপ্লববাদের আর্বিভাব ঘটে। এই পত্রিকাকে আর্শীবাদ করে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখে ছিলেন, ‘কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু। আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।” রবি ঠাকুরের এই বাণী পত্রিকার প্রথম পাতার শীর্ষে লেখা থাকতো।
যিনি বিদ্রোহী তিনি বিপ্লবী। কাজী নজরুল ইসলাম বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন উৎখাত করে তৎকালে ভারতবর্ষে এক শ্রেণী বৈষম্যহীন, সাম্য ও অসা¤প্রদায়িক রাষ্ট্র- সমাজের স্বপ্ন দেখেছেন। তিনি লিখেছেন, গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান/যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।’
কাজী নজরুল ইসলাম, দ্রোহ-বিদ্রোহের, প্রেমের, অসা¤প্রায়িক চেতনার কবি।
বিদ্রোহী কবি, লিখলেন, বল বীর –
বল উন্নত মম শির!/শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!
বল বীর –
মহা-বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত/আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না-
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না –
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত/ আমি সেই দিন হব শান্ত।’
যখনই অনাচার-অত্যাচার, ধর্মে ধর্মে অধর্মের কার্য তখনই হুংকার দিয়ে উঠবে কাজী নজরুল ইসলামের লেখা।তাঁর লেখা সদা জাগ্রত হয়ে আছে।
১১ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ এই মহান ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৩তম জন্ম বার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক: (সাহিত্যের সেবক, অ্যাডভোকেট, জজকোর্ট পাবনা, বাংলাদেশ) ফ্লোরিডা, ইউএসএ প্রবাসী।
[তথ্যসূত্র: মাকসুদা হালিম, কাজী নজরুল ইসলাম একটি সংগ্রামের নাম, উইকিপিডয়া, জাকিয়া রহমান, ক্রোড়পত্র: রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল এবং এই লেখকের নজরুল বিষয়ক প্রকাশিত দুইটি প্রবন্ধ]