মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।

এগার.
আমি আমার বাল্যকাল কাটিয়েছি অটোয়ায় কিন্তু আমি বেড়ে উঠেছি মন্ট্রিয়লে। ১৯৮৪ সালে বাবার সাথে আমি আর আমার ভাইয়েরা অটোয়া ত্যাগ করি। ঐ বছরটা আমাদের জীবনে এক বিরাট পরিবর্তন এনে দিয়েছিল। বাবা তাঁর জীবনের দীর্ঘ বরফ আচ্ছাদিত পথ পাড়ি দিয়েছিলেন এবং যখন এক নতুন লিবারেল নেতা পার্টিকে নেতৃত্ব দেবার জন্য সামনে আসলেন তখন বাবা রাজনীতি থেকে অবসরের সিদ্ধান্ত নিলেন। আমি আমার বন্ধুদের নিরাপত্তা বলয় আর চিরচেনা জায়গা ছেড়ে এক নতুন শহরের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। সেই সময় আমার মা অটোয়াতে থেকেই তার নতুন সন্তান প্রসবের দিন গুনছিলেন। নভেম্বরে আমার ভাই কাইল এর আসার সময় হয়ে গিয়েছিল।

সেই সময়টা ছিল কুইবেকে ‘লা সভরেইনতিস’ এর চরম কার্যকলাপের দিনকাল, দৃঢ় প্রতিজ্ঞা আর হতাশার দোলাচলের সময়। কয়েক বছর আগেই পার্টি কুইবেক এর সার্বভৌমত্বের প্রস্তাব গণভোটে বাতিল হয়েছে। গণভোটে পরাজয়ের পর পার্টি কুইবেকের নেতা রেনে লেভেস্ক তার বক্তৃতায় সকল সার্বভৌমত্ববাদীদের নিজ দাবি আদায়ের প্রতি অবিচল থেকে সামনে এগিয়ে যেতে বলেছেন। পরের বছর পার্টি কুইবেক ভোটারদের ক্রম বৃদ্ধির অনুপাতে কুইবেককে শাসন করার যে ক্ষমতা লাভ করে তা সেই সার্বভৌমত্বের বিতর্ককে আরো চরমভাবে জিইয়ে রেখেছিল। ১৯৮৪ সালে আমার বাবা কানাডার সংবিধানকে স্ব বৈশিষ্ট্যে বজায় রাখতে সফল হন, তখন মি. লেভেস্ক সেই অর্জনকে ‘লম্বা সব ছুরির রাত’ হিসেবে অ্যাখায়িত করেন এবং এটা মানতে নারাজ হন। সেই সময় তিনি প্রকাশ্য বক্তৃতায় বলেন, অন্যান্য প্রদেশগুলো কুইবেকের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে আর এর মূলে আছেন আমার বাবা। কিন্তু আসলে মি. লেভেস্ক এর সাথে কোনো বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়নি বরং তাঁকে কৌশলে পরাজিত করা হয়েছিল। যাহোক, এ বিষয়গুলো এ বইয়ের বিষয়বস্তু নয়। ইতোমধ্যে ইংরেজী ভাষাভাষীরা দলে দলে কুইবেক ছাড়তে শুরু করছিল এবং দুই পক্ষের মধ্যেই ভাষার অধিকারের বিষয়টা এক চরম বিতর্কের বিষয় হিসেবে কাজ করছিল।

অটোয়ায় থাকতেই বাবার মূল্যবোধ ও চিন্তা চেতনার প্রভাবে আমরা এসব বিষয়গুলোর মধ্য দিয়ে আমাদের দিন পার করেছি। আমরা এখন যখন আমার বাবার বাড়ী মন্ট্রিয়লে থাকার জন্য গেলাম তখন আমাদের দৃষ্টি সেই জায়গার ব্যাপারে অনেক বেশি প্রসারিত ছিল। আমার সারা জীবনে আমার পরিবারের সবার সাথে এই দুটো ভাষাতেই কথা বলতে হয়েছে। বিশেষ করে বাবার সাথে সব সময় ফরাসী ভাষায় কথা বলতাম। অটোয়ায় থাকতে ফরাসী ও ইংরেজ হিসেবে যে দ্বৈত পরিচয় আমার ছিল সেটা আমার কাছে খুবই স্বাভাবিক লাগতো। এই পরিপ্রেক্ষিতেই আমি ‘কলেজ জ্য-দে-ব্রেবিউফ’ এ পড়াশুনা শুরু করি। বাবাও সে স্কুলে পড়েছিলেন। পড়াশুনার ব্যাপারে স্কুলটার খুব নামডাক ছিল। কুইবেকের এমন রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে আমি সেখানে ভর্তি হয়েছিলাম। এই সব কিছু মিলিয়ে অর্থাৎ হঠাৎ করেই ক্লাসের সব নতুন নতুন পড়াশুনার চাপ এবং আমার সহপাঠী ও শিক্ষকদের ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ ও প্রবণতা আমার আশপাশ ও বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে আমার মধ্যে এক নতুন দৃষ্টিভংগির জন্ম দিয়েছিল।

আমার বাবা আমাকে ঐ গল্পটা বলতে ভালোবাসতেন যেটা তাঁর কানাডার প্রধানমন্ত্রী হবার কিছুদিন পরই ঘটেছিল । বাবা বলে যেতেন, কিভাবে অটোয়াতে তাঁর ক্লাসের তিরিশ বছর পুনর্মিলনীর ব্যবস্থা তিনি করেছিলেন। বাবা এই ধরনের কাজে খুবই আনন্দ পেতেন, এবং যখন প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকরা বাবার আমন্ত্রণে এসেছিলেন, তখন ২৪ সাসেক্স এর দরজায় দাঁড়িয়ে তাদের সবাইকে সম্ভাষণ জানানোর সময় বাবা এক ধরনের সাফল্যের আনন্দে মেতে উঠেছিলেন। নিঃসন্দেহে এটা ছিল তাঁর জীবনের এক পরম সাফল্যের গল্প। বাবার সেই সব পুরানো বন্ধু আর শিক্ষকরা যখন দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকছিলেন তখন বাবা তাঁর বিজ্ঞানের অধ্যাপককে দেখে গভীর শ্রদ্ধায় তাঁর সামনে এসে মাথা নুয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। একেবারে চর্মসার বৃদ্ধ ধর্মপ্রাণ মানুষটি তখন তাঁর শিক্ষকতা জীবনের শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছিলেন। বাবার সেই অধ্যাপক তখন বাবার একেবারে কাছে এসে বাবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভালোভাবে লক্ষ্য করে প্রবল বিশ্বাসের সুরে বলেছিলেন, ‘ট্রæডো, তুমি কি জানো, আমি এখনো মনে করি একজন পদার্থবিদ হিসেবে তুমি আরো অনেক বেশী সফল হতে পারতে।’

মন্ট্রিয়লের ব্রেবিউফ স্কুল। কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ও তাঁর পিতা কানাডার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডো এই স্কুলের ছাত্র ছিলেন।

ব্রেবিউফ এ যে সব বিষয় লক্ষ্য করা যেতো তা হচ্ছে, সেখানে সব কিছুর ওপরে ছিল লেখাপড়া। রাজনীতি এবং অন্য সব কিছু ছিল তার পরে। সেই তিরিশের দশকের দিকে একজন ছাত্রকে পরিমাপের প্রধান মাপকাঠি ছিল সে পড়াশুনায় কেমন। একজনের রোল এক, দশ না তেরো, এই বিচারে একজনকে মাপা হতো। তখন মনে করা হতো, তুমি যদি জীবনে উন্নতি করতে চাও তাহলে তোমাকে ক্লাসে প্রথম হতে হবে। আমার তেরো বছর বয়সে আমি যখন সেখানে ভর্তি হয়েছিলাম তখন পূর্বের সেই কঠোর চিন্তা ভাবনাটা অনেকটা ঢিলে হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তখনো সেটা এমন একটা জায়গা ছিল যেখানে বাবা-মায়েরা তাদের ছেলেদের (সেখানে নীচের স্তরে মেয়েদের পড়ার ব্যবস্থা ছিল না) কঠোর কঠিন ক্ল্যাসিকাল পড়াশুনা শেখার জন্য পাঠাতেন। এমনকি তুমি যদি প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করতে তাহলে তোমার প্রথম দেখাতেই মনে হতো ওটা একটা কঠিন শৃংখলার আর বড় কিছু ভাবার একটা জায়গা। সেই প্রাচীন গ্রীক স্থাপত্যের আদলে তৈরী পাথরের লম্বা কলামের ব্রেবিউফ’কে দেখে কোনো স্কুলের পরিবর্তে একটা আদালত ভবন বলে মনে হতো। প্রধান ফটকের ওপরে পাথরের তৈরী ক্রুশবিদ্ধ যীশুর এক বিশাল মূর্তি স্মরণ করিয়ে দিতো খ্রীস্ট ধর্মের চেতনা থেকে এই প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছে। তবে আমার ভর্তি হবার দুই বছর পর থেকে ব্রেবিউফ এক অসা¤প্রদায়িক স্কুলে পরিণত হয়েছে।

আমি আমার প্রথম পরীক্ষায় ভালোই করেছিলাম। সত্যি বলতে কি আমি এত ভালো করেছিলাম যে, স্কুলের কর্তপক্ষ ধরেই নিয়েছিল যে আমি আমার বাবার মতই অসম্ভব ভালো ফলাফল করবো এবং বাবার মতই আমি নিরবিচ্ছিন্নভাবে ক্লাসে সবচেয়ে ভালো করবো। আমার কাছে বিষয়টা কিছুটা হতাশাব্যঞ্জক মনে হতো কারণ ওখানে এই অসম্ভব ভালোত্বের মাপকাঠি ছিল পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর। ব্রেবিউফ এ ভর্তি হবার সময় যে সমস্যাটা দেখা দিলো তা হচ্ছে, আমি কোন ক্লাসে ভর্তি হবো, সেকেন্ডারী ওয়ান না সেকেন্ডারী টু’তে। এই দুটো ছিল গ্রেড সেভেন আর গ্রেড এইট এর সমতূল্য। আমার বয়স বিবেচনা করে এবং অন্টারিও ও কুইবেকের পড়াশুনার যে পদ্ধতি তাতে সে মুহূর্তে ওটা পরিস্কার হচ্ছিল না কোনটা আমার জন্য যথোপযুক্ত হবে।

বাবা ভাবছিলেন, আমি সেকেন্ডারী ওয়ান এর ক্যারিকুলাম এ একেবারে আনন্দ পাবো না, তারপরও আমি ওখান থেকেই শুরু করতে চাচ্ছিলাম। এর অবশ্য দুটি কারণ ছিলো। প্রথমটা ছিল, আমার মনে হচ্ছিল আমি যদি ঐ ক্লাসে ভর্তি হই তাহলে আমি খুব সহজেই ল্যাটিন স্রোত অর্থাৎ ঐ পড়াশুনা পদ্ধতির সাথে একাকার হতে পারবো যেটা ওপরের ক্লাসে ভর্তি হলে সম্ভব নাও হতে পারে। ল্যাটিন হয়তো অনেকের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় ছিল না, কিন্তু আমার কাছে ওটা ছিল ইতিহাস আর রোমাঞ্চপূর্ণ এক ভাষা। বাবা ব্রেবিউফ এ পড়ার ফলেই তিনি তার কৈশোর থেকে চমৎকার সুন্দরভাবে ওই ভাষায় কথা বলতে পারতেন। তার এই ভাষা-দক্ষতার ফলে চল্লিশের দশকে তিনি যখন কাঁধে একটা ব্যাগ নিয়ে পৃথিবী ভ্রমণে বের হয়ে গিয়েছিলেন তখন এই ল্যাটিনই তাঁকে তাঁর বিশ্বভ্রমণকে সহজ করে দিয়েছিল। তিনি যখন মধ্য এশিয়া বা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ভ্রমণে ছিলেন তখন কোথায় খাবেন বা কোথায় থাকবেন – এ বিষয় সম্পর্কে সঠিক তথ্যের জন্য বাবা যে কৌশল অবলম্বন করতেন তা হচ্ছে, তিনি কোনো স্থানীয় গির্জায় গিয়ে পাদ্রীর সাথে ল্যাটিন ভাষায় কথা বলে সব কিছু জেনে নিতেন। বাবার এই কৌশল তার ভ্রমণে বিশেষ কাজে দিতো।

স্কুল বয় জাস্টিন ট্রুডো

আমার দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কারণটি ছিল তা হচ্ছে, ব্রেবিউফ এ আমি যদি নীচের ক্লাস থেকে শুরু করি তাহলে আমি এই নতুন সামাজিক পরিবেশের বিভিন্ন বিষয়গুলো একেবারে শুরু থেকে নিজের মধ্যে ধারণ করে সামনের দিনগুলোতে এগুতে পারবো। বন্ধুত্ব বা দলাদলি পরের বছর থেকে শুরু হতে পারে। তবে এমন এক নতুন জ্ঞানগর্ভ পরিবেশে একেবারে নতুন একজন হয়ে সামনে এগুনোই আমার মধ্যে কোনো রকম জড়তা বা লজ্জা কাজ করেনি। বিশেষ করে আমার নামের শেষ অংশটার জন্য। ফলে আমি সেকেন্ডারী ওয়ানেই ভর্তি হলাম। আমার এই সিদ্ধান্তের ফলে অনেক জায়গাতেই আমাকে ব্যাখা দিতে হয়েছে যে শাসার সাথে আমার বয়সের পার্থক্য দুই বছর হওয়া সত্বেও কেন সে আমার চেয়ে মাত্র এক ক্লাস নীচে পড়াশুনা করে।

আমার প্রথম কয়েক সপ্তাহে ব্রেবিউফ এ আমি যাদের সাথে পরিচিত হয়েছি তারা আমাকে এত প্রশ্ন করতো যে ব্যাপারটা আমার কাছে রহস্যময় মনে হতো। তাদের ঐ সব প্রশ্ন শুনে আমার মনে হতো, কুইবেকের চলতি ভাষা সম্পর্কে আমার ধারণা একেবারেই ছিল না। অন্টারিও’র ফরাসী পরিবেশে বেড়ে উঠলেও আমরা বাড়ীতে যে ধরনের ভাষা ব্যবহার করতাম তা ছিল একেবারে কেতাদুরস্ত। আমাকে আমার সহপাঠিরা প্রথম যে প্রশ্ন করেছিলো তা হচ্ছে, আমি কি একজন ‘বল্লি’? ঐ শব্দটার কাছাকাছি অর্থ ছিল ‘মস্তিস্ক’। আর কিছু জন আমার স্বাভাবিক ইংরেজী শুনে অপমানের সুরে আমাকে ‘বøক’ বলে ডাকতো। ওটা বলে তারা বুঝাতো চাইতো আমি আমি ভালোভাবে কথাবার্তা চালাতে পারিনা। আমি তাদের এমন অভিযোগ বা অপমানের প্রচেষ্টা দেখে তাদের দিকে তাকিয়ে শুধু একটু কাঁধটা ঝাঁকাতাম এবং তাদের সামান্যতম বুঝতে দিতাম না যে তারা যে আমাকে ক্ষ্যাপানোর চেষ্টা করছে তা আমি বুঝতে পারছি। তাদের এই আমাকে ক্ষ্যাপানোর প্রক্রিয়ার শুরুর কয়েকদিন পর আমার মনে হলো তারা ধরেই নিয়েছে আমি তাদের ক্ষ্যাপানোর ধরনটা ধরতে পারছি না অথবা আমি তাদের ক্ষ্যাপানোটাকে একেবারে পাত্তা না দিয়ে অতি চালাকের সাথে তাদের বুড়ো আংগুল দেখিয়ে দিচ্ছি।

শেষ পর্যন্ত আমার মনে হয়েছিল, যদিও গাড়ী চালিয়ে অটোয়া থেকে মন্ট্রিয়লে যেতে দু’ঘন্টারও কম সময় লাগে কিন্তু এই দুই শহরের মধ্যে যে সাংস্কৃতিক ফারাক তার দূরত্ব এক আলোকবর্ষের কাছাকাছি হবে।

যে বিষয়গুলো আমার সহপাঠিদের মধ্যে এত বেশী আগ্রহ তৈরী করতো সেগুলো অটোয়ায় থাকতে আমাদের পরিবারের মধ্যেও ছিল। কিন্তু এই প্রথম আমি এমন কিছু মানুষের মাঝে থাকা শুরু করলাম যারা প্রতিদিনই এমন বিষয় নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে থাকতো। তাদের এমন মনোভাব পরিপূর্ণভাবে বুঝতে আমার একটু সময় লেগেছিল।

মাঝে মধ্যে স্কুলের সহপাঠিদের কিছু আচরণ একেবারে ব্যক্তিগত পর্যায়ে চলে আসতো। কিছু ছাত্র আমার বাবা-মা’র বিচ্ছেদ নিয়ে এমন রসালো কথা বলতো যে আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারতাম না। তারা সাধারণত কোনো ট্যাবলয়েড পত্রিকার কোনো মুখরোচক কাহিনী তুলে ধরতো। আমি অটোয়ায় থাকতেই মাঝে মধ্যে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতাম। সেখানেও আমি সেই কিন্ডারগার্ডেন থেকে একদল বন্ধুর মাঝে বেড়ে উঠেছি। তবে তারা আমার প্রতি অনেক ভালোবাসা দেখতো। একেবারে প্রথম জীবনের বন্ধুরা সাধারণত বড় পোলাপানদের মতো এত বেশী নিষ্ঠুর হয় না। হোব্বেসিয়ান চিন্তাধারার পোলাপান নতুন কোনো কিছু বা নতুন কাউকে পেলে সেটা নিয়ে খেলতে বেশ মজা পায়। স্কুলটাতে সেটার একটা চর্চা ছিল। একদিন একটা বড় ছেলে আমার সামনে এসে চট করে আমার হাতের মধ্যে এডাল্ট ম্যাগাজিনে বের হওয়া আমার মা’র একটা আপত্তিকর ছবি গুজে চলে গেলো।

আমার বিশ্বাস করতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল, আমি আগে কখনও ঐ ছবিটি দেখিনি। আমি জানতাম না যে আমার মা’র এমন ছবি থাকতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই এমন ছবি দেখে আমি মানসিকভাবে খুবই কষ্ট পাচ্ছিলাম। তখন আমি এটাও জানতাম, ওটা আমার জীবনের খুবই কঠিন এক সময়। আমার মনে হচ্ছিল আমি যে সত্যিই এ বিষয়টায় কষ্ট পাচ্ছি বা মুষঢ়ে পড়চ্ছি তা যদি ঘুণাক্ষরেও কাউকে জানতে দিই তাহলে ব্যাপারটা গোটা স্কুলে জানাজানি হয়ে যাবে। আর তখন প্রায় সবাই আমাকে দেখলেই এ বিষয় নিয়ে কানাঘুষা শুরু করে দিবে। সেজন্য আমি তাকে একেবারে কোনোভাবে পাত্তা দিলাম না এবং এমন ভাব দেখালাম যে এ বিষয়টা আমার কাছে কোনো ব্যাপারই নই। আমার এই ভাব দেখে ঐ ছোকরাটা কিছুটা নিরাশ হয়ে আমার কাছ থেকে চলে গেলো।

ব্রেবিউফ স্কুলে আমি শিখেছিলাম, কেউ যদি ব্যক্তিগত কোনো ব্যাপারে আঘাত দেওয়ার জন্য বিভিন্ন ছুতো খুঁজে বেড়ায়, তাহলে আবেগের বশবর্তী হয়ে সেটার প্রতুত্তর দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। বলার অপেক্ষা রাখে না, আমার এই কৌশলটা আমি বিগত বছরগুলোতে ব্যবহার করে এসেছি।
(চলবে)…
মনিস রফিক : চলচ্চিত্রকর্মী, টরন্টো, কানাডা