সোনা কান্তি বড়ুয়া : কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঊনবিংশ শতকে জন্মগ্রহণ করে বিংশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত দেখে সংখ্যালঘু নির্যাতন উপশমে তুখোড় ‘ঘরে-বাইরে’ (রচিত হলো) ছোটগল্প লিখেছিলেন:। ‘ঘরে-বাইরে ‘ছোটগল্পের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে সংখ্যালঘু জীবনের এই অস্তিত্বের সংকটের আবহমান বেদনার অনুভব। মূলত ঊনবিংশ শতকের বাংলার সমাজজীবনের মধ্যে থেকেই কবিগুরুর চেতনার উন্মেষ এবং তাঁর সমসাময়িক বঙ্গসমাজের চালচিত্রের আবহাওয়ার মধ্য দিয়েই তাঁর সাহিত্যের উদ্বোধন। ইতিহাস ও বিশ্ব সভ্যতায় ধর্মান্ধ রাজনীতিতে সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতির সংকট! সংখ্যালঘু নির্যাতন উপশমে বিশ্বমৈত্রীর সব ধর্ম নিয়ে হৃদয়সরণি থেকে বইয়ের রাজপথে সর্ব জীবে দয়া এবং অহিংসা পরম ধর্ম আবহমান বেদনার অনুভব।
হিন্দু রামায়নের সেই রাজা রাম এবং সেই রাজধানী অযোধ্যা (from Bangkok 40 kilometers) থাইল্যান্ডে কেন? আমি বাংলাদেশ হযরত শাহজালাল ঢাকা আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট থেকে থাইল্যান্ড বা শ্যামদেশের রাজধানী ব্যাঙ্কক সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্টে গিয়ে দেখলুম বাংলা ভাষার জনক গৌতমবুদ্ধ বিরাজমান। বৌদ্ধ প্রধান দেশ থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক মহানগরীর বিখ্যাত রাজকীয় এমারেল্ড (মরকত মনি) বুদ্ধ মন্দিরের চারিদিক জুড়ে আছে দশরথ জাতকে রামকীর্তির অভিনব চিত্রশালা। আজকের থাইল্যান্ডের মহারাজা Vajira Longkorn হচ্ছেন দশম রাম।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দু জাতিকে শিক্ষা দিয়েছিলেন:
“সেই সত্য যা রচিবে তুমি, / ঘটে যা, তা সব সত্য নহে,
কবি, তব মনোভূমি, / রামের জন্মস্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।”
মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলামের ও দৃঢ় উচ্চারণ, ‘গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছুই নাই/নহে কিছু মহীয়ান। “বৌদ্ধ ও হিন্দুদের কান্না বাংলাদেশে এখনও থামেনি! অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের মতে “ধর্মহীন বিজ্ঞান খোঁড়া, বিজ্ঞানহীন ধর্ম অন্ধ।” কুমিল্লায় কোরান অবমাননার রাজনীতি গুজব ছড়িয়ে হিন্দুদের উপর চলছে ভয়াবহ সা¤প্রতিক হামলা। বৌদ্ধ ও হিন্দুদের এই অস্তিত্বের সংকটের মধ্য দিয়ে সেই সা¤প্রতিক হামলা ভয়কে মাড়িয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছিল। কোরআন নিয়ে রামুর বৌদ্ধ বিহার ও কুমিল্লা দূর্গাপূজায় ধ্বংসযজ্ঞ এই বিষয়টার মধ্যে যে সা¤প্রদায়িক বিদ্বেষের মশলা আছে তা জনমানসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সংক্রমিত! বাংলাদেশে রাজনীতি কোরআন নিয়ে হিন্দুদের ধর্মে হস্তক্ষেপ করেছে’ গত ১৩।১০।২০২১ ইং তারিখে! কোরআন নিয়ে মুসলমান রাজনীতি রামুর বৌদ্ধ বিহারে ধ্বংসযজ্ঞ করেছে ৯ বছর অতিবাহিত হলেও মামলার বিচার এখনো শুরু হয়নি। তাই মুসলমান রাজনীতি বাংলাদেশে কুমিল্লায় দূর্গাপূজা পন্ড করার লক্ষ্যে হিন্দুদের ওপর সা¤প্রদায়িক হামলা চালাচ্ছে!
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নিয়ে উগ্র সা¤প্রদায়িক গোষ্ঠী কর্তৃক ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে পটুয়াখালীতে মানব বন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল ১১টায় পটুয়াখালী প্রেসক্লাবের সামনে জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে এ কর্মসূচী পালন করা হয় (Daily Jaijaidin dated 01 December 2020)। পৃথিবীর সকল মানুষ মুসলমান বা একটা ধর্মের মানুষ হলে কি সকল সমস্যার সমাধান হবে? বিশ্বমৈত্রীতে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি নিয়ে সা¤প্রদায়িকতার দেয়াল ভেঙে হৃদয়সরণি থেকে সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতির উপর ভরসা রেখেছেন বঙ্গসমাজের কবি, সাহিত্যিক ও লেখকগণ । ইসলাম ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করায় ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের তদানিন্তন গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বাঙালি জাতির বাংলা ভাষা বলা ও লেখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন! প্রসঙ্গত: বাংলাদেশের একজন প্রসিদ্ধ আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার মতে “রাজনৈতিক দল দিয়ে সা¤প্রদায?িকতা বুঝতে চাওয়া বন্ধ করা দরকার। হত্যা, ধর্ষণ, লুট করছে যারা তারা ক্রিমিনাল। এসব ফৌজদারি অপরাধ। সকল নাগরিকের জান, মালের হেফাজত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব, সেটি করার জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে বাধ্য করুন। তা না হলে নিজেরাই প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। আত্মরক্ষার অধিকার আইনেই স্বীকৃতি দেয়া আছে।”
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত নটীর পূজা ও চন্ডালিকায় গৌতমবুদ্ধ নারী জাতির পরম মঙ্গলময় হল এবং সংখ্যালঘু জীবনের এই অস্তিত্বের সংকটে লেখক গোলাম মুস্তাফা, লেখক হুমায়ুন আহমেদ এবং বাংলাদেশের ধর্মান্ধ লেখকগণর লেখায় পূজনীয় গৌতমবুদ্ধ নারীবিদ্বেষী কেন? ধর্মান্ধ রাজনীতি বাংলাদেশে অনেক বিহারী ও রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে ধর্মকে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে এবং সংখ্যালঘু নির্যাতনের হেনস্থা দেশত্যাগের হুমকি! এবং গৌতমবুদ্ধ সম্পর্কে কটূক্তি করে হুমায়ুন আহমেদ ‘পাঠকদের বিভ্রান্ত করতে লিখেছেন, “যশোধারার স্বামী (জগজ্জ্যোতিগৌতমবুদ্ধ) দরজায় দরজায় ঘুরতে লাগলেন (৩৬) পৃষ্ঠা) । আমরা এখন আছি গৌতমবুদ্ধের দেশে।” বৌদ্ধগণ পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের ধর্মান্ধ রাজনীতিকে কাঠগোড়ায় দাঁড় করিয়েছেন!
গৌতমবুদ্ধ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের যথার্থ মূল্যায়ন, “যিনি সর্বভূতকে আপনারই মতো দেখেন এবং আত্মাকে সর্বভূতের মধ্যে দেখেন, তিনি প্রচ্ছন্ন থাকেন না। আপনাকে আপনাতেই যে বদ্ধ করে সে থাকে লুপ্ত; আপনাকে সকলের মধ্যে যে উপলব্ধি করে সেই হয় প্রকাশিত। মনুষ্যত্বের এই প্রকাশ ও প্রচ্ছন্নতার একটা মস্ত দৃষ্টান্ত ইতিহাসে আছে। বুদ্ধদেব মৈত্রীবুদ্ধিতে সকল মানুষকে এক করে দেখেছিলেন।” (শিক্ষার মিলন প্রবন্ধ)!”
জঙ্গি হিন্দুত্ববাদীদের গভীর ষড়যন্ত্র থেকে মুক্তি পেতে (কলকাতার দেশ ৪ মে, ২০০১ পৃ: ১০) ভারতীয বৌদ্ধদের অক্লান্ত প্রয়াসের ফলে মহাবোধি মন্দির উদ্ধারের দাবীদে অনশন, অবস্থান, মিছিল, ধর্ণা ইত্যাদি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কর্মসুচি রুপায়ন চলতে থাকে বছরের পর। বৌদ্ধদের তিরুপতি বালাজী মন্দির এবং পুরীর জগন্নাথ মন্দির হিন্দু রাজনৈতিকগণ দখল করার পর গৌতমবুদ্ধকে হিন্দু রাজনীতির ভগবান বা অবতার বলে বৌদ্ধধর্মকে হিন্দু রাজনীতি তিলে তিলে কিডন্যাপ করেছেন। “শক্তি মরে ভীতির কবলে / পাছে লোকে কিছু বলে।” In 1195 A. D. ভারতীয় বৌদ্ধগণের অস্তিত্ব সমূলে ধ্বংস করতে রাজা বল্লালসেনের মহামন্ত্রী হলায়ুধ মিশ্র আরবের শেখকে তোয়াজ করে “শেখ শুভোদয়া” বইটি রচনা করেছিল। ভারতে একমাত্র বুদ্ধগয়ার মহাবোধি মন্দিরে হিন্দু নেতাগণের ষড়যন্ত্রে ম্যানেজম্যান্ট কমিটির (Chairman only the Hindu person/ no Buddhist person) এ আইন মনুষ্য সৃষ্ঠ অথচ মনুষ্যত্ব বিরোধী। সর্বগ্রাসী হিন্দুধর্ম (BALLAL SEN destroyed Buddhism in Bengal and India) শক্তিশালী অনার্য সভ্যতাকে আয়ত্ত করে নিজের কুক্ষিগত করেছিলেন। বিশেষতঃ কুমারিল ভট্ট, শংকরাচার্য প্রমুখের নেতৃত্বে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পূনরুত্থান আন্দোলন আরম্ভ হয়েছিল । এ সময়ে (11 and 12th century A. D.) বৌদ্ধ সমাজের বুদ্ধিজীবিগণ নিস্তেজ হয়ে পড়েন এবং রিক্ত সর্বশান্ত হয়ে তাঁরা ধীরে ধীরে ভারতবর্ষ হতে তিব্বত ও আসামের দিকে সরে পড়েছেন।
সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতিতে কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা বিদ্রোহী’ কবিতার শতবর্ষ ও সমাজ চেতনার বাস্তবতা! বাংলা সহিত্যে কাজী নজরুলের অসা¤প্রদায়িকতা বাঙালি জাতিসত্তার যেমন সর্বশ্রেষ্ঠ রূপকার, তেমনি শ্রেণী বৈষম্য, নির্যাতিত, নিপীড়িত, মজলুমের আহাজারি, অসাম্য, দারিদ্র্যতার নির্মম কষাঘাত থেকেই নজরুল কিশোর বয়সেই দেখেন বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫) ও বঙ্গভঙ্গ রদ (১৯১১) আন্দোলন। অর্থাৎ একটি সংগ্রামী সময়ে তার জন্ম (১৮৯৯) ও শৈশব-কৈশোর এবং যৌবন অতিক্রান্ত হয়েছে। অর্থাৎ ‘বিদ্রোহী’ কবিতার রচনাকাল ছিল সারা পৃথিবীর জন্য অস্থির সময়। তা ছাড়া ভারতীয় উপমহাদেশে স্বাধীনতার জন্য তখন ঘরে ঘরে দুর্দমনীয় আন্দোলন চলছে। দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য ধর্মমত নির্বিশেষে সর্বস্ব ত্যাগে প্রস্তুত। প্রতিটি মানুষই যে বীরযোদ্ধা, অসম-সাহস ও শৌর্য-বীর্যের অধিকারী এ-বোধ তখনই সৃষ্টি হয়েছিল তার। আত্মসচেতন কবির মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল অদম্য সাহস। চিরস্পৃহা সৃষ্টি হয়েছিল, নিপীড়িত-নির্যাতিত, শোষিত-উপেক্ষিত বঞ্চিত মানুষের ব্যথা-বেদনামুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার। যে-কারণে তিনি মানব সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ হয়ে ওঠেন নিজে নিজেই। অন্তরাত্মার এই অব্যক্ত অভিপ্রায়ই তাকে অসাধারণভাবে আন্দোলিত করেছিল। আর তখনই ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মতো এমন কালজয়ী কবিতা সৃষ্টি হয়। কবি চণ্ডীদাস বলেছেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য/তাহার উপরে নাই।’ মানুষের মানবিক ক্ষমতার কথাই উচ্চারিত হয়েছে এখানে যা বুদ্ধের দর্শনেরও কথা।’
ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকায় বৌদ্ধ হত্যাযজ্ঞের মর্মান্তিক রোমহর্ষক ঘটনা এবং আনন্দবাজার পত্রিকার (সম্পাদকীয়, ২২ আগষ্ট, ১৯৯৩) মতে, “রামায়নের আদি হিসাবে তাঁহাদের কেহ কেহ প্রাচীনতর ভারতীয় কাহিনীর যথা: “দশরথ জাতক” (জাতক নম্বর : ৪৬১) এর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়াছেন। … সেই উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা কেমন করিয়া ভুলিয়া গেলেন যে, একদা রাশি রাশি বৌদ্ধ ধর্মস্থান ধ্বংস করিয়া একদিন গড়িয়া উঠিয়াছিল রাশি রাশি হিন্দু মন্দির। তাঁহারা কি জানেন, হিন্দুর কাছে অতি পবিত্র পুরীর মন্দিরের প্রাক্ ইতিহাস সম্পর্কে কানিংহাম কিংবা রাজেন্দ্রলাল মিত্রের কী অভিমত? তাই বলিতেছিলাম, অযোধ্যা একটি বৃহৎ প্রশ্ন বটে, কিন্তু নিতান্তই মনগড়া এক নির্বোধ প্রশ্ন।”
“ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মাধ্যমে এ কথা আমরা বলতে পারি যে, রামায়ন নামে যে সমস্ত গ্রন্থ সমগ্র ভারতবর্ষে প্রচলিত রয়েছে সবই হল কাল্পনিক ও ভিত্তিহীন মনগড়া রচিত। সেগুলির কোন পুরাতাত্তি¡ক কিংবা ঐতিহাসিক প্রমাণও নাই। তামিলনাড়ুতে জন্ম গ্রহণকারী ভারতের বিখ্যাত সমাজ বিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদ ও লেখক পেরিয়ার রামস্বামী নায়করের লিখিত সুপ্রসিদ্ধ পুস্তক ‘সচ্চী রামায়ন’ বা সত্য রামায়ণ গ্রন্থে তিনি এ সমস্ত খোলাখুলিভাবে উল্লেখ করেছেন। তখন ভারতের ব্রাহ্মণ সমাজ উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদ হাইকোর্টে পুস্তকটিকে বন্ধ করতে এবং লেখকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে মামলা করা হয়েছিল। সে মামলার নাম্বার ছিল- ৪১২ / ১৯৭০। মামলা চলেছিল ১৯৭০-৭১ সালে। এ মামলা গড়িয়ে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টে মামলা চলেছিল ১৯৭১ হতে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত। এর মধ্যে মামলার আপীল চলেছিল। ইহার নাম্বার ছিল ২৯১/১৯৭১। (হিন্দু মন্দিরে নারিকেল ফষটানোর রহস্য, by the Buddhist Monk ড. বরসম্বোধি ভিক্ষু)!”
আজও ভারতীয় টিভি চ্যানেলে বিজয় সিংহের শ্রীলঙ্কা জয় দেখানো হয়নি। থাইল্যান্ডে সেই রাজা রাম এবং সেই রাজধানী অযোধ্যা কেন? ইতিহাস তো ছেলের হাতের মোয়া নয়। ২৬০০ বছর পূর্বে শ্রীলংকার মহাবংশ এবং দ্বীপবংশ শীর্ষক ঐতিহাসিক গ্রন্থদ্বয়ের মতে রাজা বিজয় সিংহ বাঙালি ছিলেন । হিন্দুরা বৌদ্ধধর্ম গ্রহন না করে বা বৌদ্ধ ধর্মালম্বী না হয়ে হিন্দু রাজনীতি গৌতমবুদ্ধকে হিন্দু বানিয়ে গোলে মালে আধুনিক সমাজের চোখে ধূলো দিচ্ছেন।” রাজধানী অযোধ্যায় সরযু নদীর তটে বসে পুষ্যমিত্র শুঙ্গের রাজকবি বাল্মিকী বৌদ্ধ ‘দশরথ জাতক’ অবলম্বনে ‘রামায়ণ’ কাব্য লেখেন (100 B,C,)! সে সময় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি পি. এন. ভাগবতী, বিচারপতি বি. আর. কৃষ্ণা আইয়ার ও বিচারপতি মুর্তজা ফাজিল আলী এ তিন বিচারপতির বেঞ্চ ১৯১৬৯ / -১৯৭৬ সালে রায় প্রদান করেন। তাঁরা রায়ে উল্লেখ করেন যে- ‘ সত্য রামায়ণ পুস্তকে যা লিখা হয়েছে, তাতে কোন ভুল প্রমাণিত হয়নি এবং সমস্ত কিছু তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে উপস্থাপন করায় পুস্তকের বৈধতা রয়েছে। সুতরাং, সত্য রামায়ণ পুস্তক একটি প্রমাণিত বৈধ গ্রন্থ।’
মানবাধিকারের অস্তিত্বের আলোকে বাবরি মসজিদ আলোকিত মানবতার প্রতিশ্রæতি এবং সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে “আল্লাহ উপনিষদে” রচিত হলো: “আল্লো জ্যেষ্ঠং শ্রেষ্ঠং পরমং, পূর্ণং ব্রহ্মানং অল্লাম। রাম মন্দির আন্দোলনের উত্তাল ঢেউয়ের মাথায় ১৯৯২ সালে ৬ই ডিসেম্বর প্রায় দুই হাজার অপাপবিদ্ধ মানুষ হত্যা করা হয়েছিল লালকৃষ্ণ আডবাণী সহ হিন্দু রাজনীতিবিদের বকওয়াস রাজনীতির জন্যে। হিন্দু রামায়নের অযোধ্যা কান্ডের (অধ্যায়) বত্রিশ নম্বর শ্লোকে বুদ্ধকে (যথাহি চৌর স তথাহি বুদ্ধ, তথাগতং নাস্তিকমত্র বিদ্ধি) চোর বলে গালাগাল করার পর সেই মহাকাব্যটি কি বৌদ্ধ জাতকের আগে রচিত?
লেখক হুমায়ুন আহমেদ ২০১০ সালে বৌদ্ধধর্মের ভাবমূর্তিকে ক্ষুন্ন করার উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ‘রাবনের দেশে আমি ও আমরা’ বইটি লিখেছেন। লেখকের মতে, “এখন আছি গৌতমবুদ্ধের দেশে। যেখানেই চোখ যায় শুধু বুদ্ধমূর্তি (পৃষ্ঠা ৩২)।” বাংলাদেশের স্বাধীনতার কাছে পরাজিত ধর্মান্ধ রাজনীতি! লেখক হুমায়ুন আহমেদ স¤প্রতি তার শ্রীলঙ্কার ভ্রমন কাহিনী নিয়ে বিশ্বাসঘাতকমূলক কথার অবতারনায় শ্রীলঙ্কার ওয়ার্লড হেরিটেজ ‘সিরিগিরিয়ায় ভারতের অজন্তা গুহার অস্পরাকে অনুসরন করে আঁকা শিল্পসমূহকে লেখক হুমায়ুন উলঙ্গ মেয়েদের মূর্তির মিথ্যাদৃষ্ঠি মনে নিয়ে’ নানা অশ্লীল শব্দে গৌতমবুদ্ধের ভাবমূর্তিকে ক্ষুন্ন করতে বুদ্ধ সম্পর্কে অনেক কটূক্তি করেছেন (পৃষ্ঠা ৩৬)।
গৌতমবুদ্ধ তাঁর ভিক্ষুসংঘকে উপদেশ প্রসঙ্গে দশরথ জাতক সমাধান করতে গিয়ে বলেছেন, “তখন (পূর্ব জন্মে) শুদ্ধোধন রাজা ছিলেন দশরথ মহারাজা, মহামায়া ছিলেন সে মাতা, রাহুলমাতা (গোপা) ছিলেন রাজকুমারী সীতা, আনন্দ ছিলেন রাজপুত্র ভরত, সারীপুত্র ছিলেন রাজপুত্র লক্ষন, বুদ্ধ পরিষদ সে পরিষদ, আমি (বুদ্ধ) ছিলাম সে রাম পন্ডিত ( দশরথ জাতক নম্বর ৪৬১, জাতক অট্টকথা, পালি টেক্সট সোসাইটি, লন্ডন)।” হিন্দু রাষ্ট্রশক্তির ব্রাহ্মণ সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ (খৃষ্ঠ পূর্ব ১ম শতাব্দী)সহ চক্রান্তকারীরা বিভিন্ন হিন্দু জঙ্গীদের সাথে কঠনীতি (diplomacy) করে উপমহাদেশে বৌদ্ধ হত্যাযজ্ঞে বৌদ্ধ ধর্ম এবং বৌদ্ধ ধর্মের মুল গ্রন্থ বৌদ্ধ ত্রিপিটককে নিশ্চিহ্ন করে হিন্দু ধর্মকে মহিমান্বিত করতেবৌদ্ধ জাতক থেকে রামায়ন ও মহাভারত (১) বেতাল পঞ্চবিংশতি (২) পঞ্চতন্ত্র, এবং (৩) কথাসরিৎসাগরের উৎস!
ব্রাহ্মণ সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ প্রতারণা করে মগধে (বিহার State) মৌর্য বংশের রাজধানী পাটলীপুত্রে (পাটনা) সম্রাট অসোকের বংশজ মৌর্য বংশের সর্বশেষ বৌদ্ধ সম্রাট বৃহদ্রথকে হত্যা করেছিল (100 B.C.) পুষ্যমিত্র শুঙ্গ মগধের সিংহাসন অধিকার করে নিজেকে রাজা ঘোষিত করেছিলেন। তাঁর নির্দেশে ধ্বংসকৃত বৌদ্ধ বিহার সমূহের হাজার হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষুদের হত্যা করা হয়েছিল। ব্রাহ্মণ রাজা পুষ্যমিত্র শুঙ্গ বৌদ্ধদের উপর ভয়ানক অমানুষিক অত্যাচার করেছিলেন। হিন্দু রামায়নের অযোধ্যা কান্ডের (অধ্যায়) বত্রিশ নম্বর শ্লোকে বুদ্ধকে (যথাহি চৌর স তথাহি বুদ্ধ, তথাগতং নাস্তিকমত্র বিদ্ধি) চোর বলে গালাগাল করার পর সেই মহাকাব্যটি কি বৌদ্ধ জাতকের আগে রচিত?
পুষ্যমিত্র শুঙ্গ নিজের রাজধানী পাটনা হতে স্থানান্তরিত করে প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ স্থান সাকেতে নিয়ে গিয়েছিলেন। সাকেতে রাজধানী পরিবর্তন করে ইহার নতুন নাম করণ করেন ‘অযোধ্যা।’ অর্থাৎ যা বিনা যুদ্ধে অধিকার করা হয়েছে। অ+যুদ্ধ>অযুদ্ধ> অযুদ্ধা>অযোধ্যা। পুষ্যমিত্র শুঙ্গ ঘোষণা করেছিলেন যে, যে কোন ব্যক্তি যদি গেরুয়া বস্ত্রধারী বৌদ্ধভিক্ষুদেরকে হত্যা করে মস্তক কেটে আমাকে এনে দিতে পারে, তাকে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কৃত করা হবে। লোভে প্রলুব্দ হয়ে ব্রাহ্মণ্য পন্থী লোকেরা সমগ্র দেশের নিরস্ত্র নিরীহ বৌদ্ধ ভিক্ষুদেরকে নির্বিচারে হত্যা করতে শুরু করল এবং রাজধানী অযোধ্যায় কাটা সর বা মাথা আনতে লাগল।
স্যর এডউইন আর্নল্ড-এর (Editor of TIME, London) লেখা, দ্য লাইট অব এশিয়া’ বষ গৌতমবুদ্ধের জীবনী। স্থান, লন্ডন। কাল, ১৮৭৯। মোট ৫,৩০০ লাইনের এই কাব্যগ্রন্থ। শব্দসংখ্যা ৪১ হাজার। তাঁর (স্যর এডউইন আর্নল্ড) লেখা, সদ্য প্রকাশিত ‘দ্য লাইট অব এশিয়া- দ্য পোয়েম দ্যাট ডিফাইন্ড দ্য বুদ্ধ’ নিছকই বুদ্ধজীবনের সারাৎসার নয়, একের পর এক মননবিশ্ব জয় করার সঙ্গে সঙ্গে বইটির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গিয়েছে যে সব টুকরো ইতিহাস, সমাজ, দেশ ও চেতনা! আবার অন্য দিকে ভারত বা এশিয়ার বাইরেও আন্তর্জাতিক স্তরে গৌতম বুদ্ধকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ‘দ্য লাইট অব এশিয়া’-র অবদানকে আজ অস্বীকার করা অসম্ভব।’ পাত্র, দ্য লাইট অব এশিয়া।
বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ঝড় ওঠে ব্রিটেনে। ক্রমশ তার আঁচ পড়তে থাকে আমেরিকা এবং ইউরোপের অন্যান্য রাজ্যে। ছড়াতে থাকে গোটা বিশ্বেই। ‘এই কাব্যগ্রন্থ বিশ্বের ১১ জন বিখ্যাত সাহিত্যিককে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছে, তাঁরা বার বার ফিরে এসেছেন বইটির কাছে। এই ১১ জনের মধ্যে আবার পাঁচ জন নোবেলজয়ী- রুডইয়ার্ড কিপলিং, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ডবিøউ বি ইয়েটস, ইভান বুনিন, টি এস এলিয়ট। বাকি ছ’জনের মধ্যে রয়েছেন লিয়ো টলস্টয়, ডি এইচ লরেন্স, হর্হে লুই বর্হেস, হেরম্যান মেলভিল-এর মতো নাম!’ ১৮৮৬ সালের জানুয়ারিতে স্যর এডউইন আর্নল্ড-এর পষটনা হয়ে পৌঁছেছিলেন কলকাতায়। দক্ষিণেশ্বরকে কেন্দ্র করে তখন কলকাতায় কৌতূহল, বিশ্বাস-অবিশ্বাস এবং ভক্তির জোয়ার-ভাটা। সেবারই কলকাতায় এসে আর্নল্ড দেখেন স্টার থিয়েটারে ‘দ্য লাইট অব এশিয়া’ অবলম্বনে গিরিশ ঘোষের নাটক, ‘বুদ্ধদেব চরিত’। নাটকের জন্য মূল কবিতাটি অনুবাদ করেছিলেন গিরিশ ঘোষ। তাঁকে সহায়তা করেছিলেন ঝধিসর বিবেকানন্দের (নরেন্দ্রনাথ দত্ত)১
সাহিত্যিক আবুল ফজলের মতে “অবিশ্বাস্য সাধনা আর দীর্ঘ আত্মনিবিষ্ট ধ্যানে মহামানব বুদ্ধ এ মহাসত্যের উপলব্ধিতে পৌঁছেছেন যে, সব প্রাণই মূল্যবান, সব প্রাণই পবিত্র। প্রাণ-হনন এক গর্হিত কর্ম। সর্ব জীবে দয়া, অহিংসা পরম ধর্ম, – এমন কথা আড়াই হাজার বছর আগে সত্যই অকল্পনীয় ছিল।” মানুষের মানবীয় গুণ ও শক্তির সদ্ব্যবহারের উপর বেশি গুরুত্বারোপ করেছেন বুদ্ধ। পৌরনীতিতে ধর্মান্ধ রাজনীতির এই অস্তিত্বের সংকটে সংখ্যালঘু নির্যাতন উপশম বিষয়ে পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন করেছেন বাংলাদেশের জনতা। মানবতাবাদ চিন্তাকে অগ্রাধিকার দিয়েই মানবসমাজকে এগিয়ে যেতে হবে সামনের দিকে; সমাধান করতে হবে মানুষের সব সমস্যার।
সেলিনা হোসেন মতে, “চর্যাপদেই বাংলার শিকড়! ভুসুকু আজ বঙ্গালি ভৈলি…
ভুসুকু পাদের এই চর্যাপদই চিনিয়ে দিয়েছিল বাংলা ভাষার শিকড় চর্যাপদে, সংস্কৃতে নয়। চর্যাপদের সেই কবিরা কেবল মানুষের জীবনচর্চা ও জীবনচর্যাকেই চর্চার দোঁহায় ঢালেননি, মানুষের জীবনের অধিকার রক্ষার প্রেরণাও দিয়েছেন। এই সবই একজন, এবং অন্যদেরও, মহামানবদের কথাই বলে দেয় ‘ জগতের সকলের ভাল হোক!”
লেখক সোনা কান্তি বড়ুয়া (Bachelor of Arts, University of Toronto), সাবেক সভাপতি, বাংলা সাহিত্য পরিষদ, টরন্টো, খ্যাতিমান ঐতিহাসিক, কথাশিল্পী, বিবিধগ্রন্থ প্রনেতা প্রবাসী কলামিষ্ঠ, লাইব্রেরীয়ান, বিশ্ববৌদ্ধ সৌভ্রতৃত্ব পত্রিকার সহ সম্পাদক এবং জাতিসংঘে বিশ্ববৌদ্ধ প্রতিনিধি!