ভজন সরকার : (৮)
কত তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে আমরা মুখ ফিরিয়ে নিই। যাকে একদন্ড না ভাবলেও চলে না, তার ওপর অভিমান করি; কত কঠিন কথা আর নির্মম ব্যবহারের আঘাতে জর্জরিত করি। অথচ সেই মানুষটি যখন চিরদিনের জন্য চলে যায় না-ফেরার দেশে কিংবা নিশ্চিত যোগাযোগহীনতার অন্ধকারে; তখনো কি বোধোদয় হয়? হয়ত হয়।

ততদিনে সব শূন্যে মিলিয়ে গেছে, ততদিন অভিমানের মানুষটি নেই কিন্ত অভিমানটুকু পড়ে আছে, জমে আছে। সে পড়ে থাকা, জমে থাকা অভিমানটুকু সারাজীবন খামচে খামচে ধরে। অথচ এতটুকু সহজ হলেই কিন্ত সব কিছু ঠিক-ঠাক চলতো। কিন্ত ওই যে রাগ, ওই যে রিপুর তাড়না; কে তাকে থামায়? সে তো তখন নির্বোধের পাগলা ঘোড়া।

আবার মানুষ প্রতি মুহূর্তে মৃত্যু চিন্তা করলে এক মুহূর্তের জন্যেও কিন্ত শান্তি পেতো না; উদ্যমহীন জরাগ্রস্থ হয়ে ধুঁকে ধুঁকে পড়ে থাকতো অর্ধ-মৃত হয়ে। আবার জীবনের অস্থায়ী ও ক্ষণকালের অবস্থানকে মনে না করলেও কিন্ত বেঁচে থাকার সুখটুকুও অনুভব করতো না একেবারেই।

আর সব হিন্দু পরিবারে যা হয়,জন্মের পরেই জন্মক্ষণের সাথে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান মিলিয়ে কুষ্ঠি তৈরী করা হয়, আমার ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছিল। সে সময়ের ট্রিপল এমএ,এবং তর্কালঙ্কার এক অধ্যাপককে দিয়ে অনেক টাকা খরচ করেই করা হয়েছিল। আর সেখানেই যত বিপত্তি। পরবর্তীতে আরেক ডাবল এম এ, এবং বিদ্যালঙ্কার পণ্ডিত সে কুষ্ঠি দেখে আমার আয়ুর সীমা গণনা করে দিয়েছিলেন। তাই আমার বড়মার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তাঁর মৃত্যুর আগেই আমার মৃত্যু ঘটবে।

একদিকে আমার সুবিধে হয়েছিল অতিশয় আদর-আহ্লাদ; অন্যদিকে বিপত্তিও ছিল সারাক্ষণ এক কঠিন নজরদারি, যেন জেড ক্যাটাগরির নিরাপত্তা। যা হোক, আমার ঈশ্বর ও কুষ্ঠিভক্ত বড়মার কঠোর নিরাপত্তা বলয় ভেদ করে যমদূত আমাকে কুষ্ঠি-নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিজের কাছে নিতে পারেননি। যদিও অকালেই আমার মাতৃসমা বড়মা চলে গেছেন না- ফেরার দেশে।

তাঁর মৃত্যু সময়ে আমার বড়মা জেনে গেছেন আমার সাথে তাঁর দেখা হবে অচিরেই। অথচ আমি সে সময় পার করে আরো অনেক বছরই বেঁচে আছি। যদি আত্মার অবিনশ্বরবাদ কিংবা পরজন্ম কিংবা মোক্ষলাভে বিশ্বাসী হ’তাম তবে ভাবতাম আমার সেই নিঃসন্তান বড়মা তাঁর প্রাণের অধিক প্রিয় সন্তানের জন্য অপেক্ষা করছেন। যেহেতু সে বিশ্বাস আমার একেবারেই নেই, তাই আমি সে বিশ্বাসের বিশ্বাসী হয়ে এত তাড়াতাড়ি তাঁর সাথে মিলিত হ’তে চাই না। তর্কালঙ্কার-বিদ্যালঙ্কারের গণনাকে ব্যর্থ করে, যমের মুখে থুথু আর ছাই ছিটিয়ে বেঁচে যেহেতু আছি, তাই এত সহজে আর হাল ছাড়তে রাজি নই।

তাছাড়া চার্বাক দর্শন, যা বৈদিক শিক্ষা ও অধিবিদ্যার মুখোমুখী দাঁড়ানো একটি মতবাদ, যার বহুপ্রচলিত ও প্রচারিত একটি প্রবচন আছে, “ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কুতাঃ। অর্থাৎ আগুনে ছাই হওয়া দেহের পুনরাগমন কোথায়?”। তাই বেঁচে থাকা সময়েই সবকিছু শেষ করে যেতে হবে। যা করার যা দেখার তা এ জন্মেই সমাধান করতে হবে।

একটি কথায় আমি চিরদিনই বিশ্বাস ও আস্থা রাখি, এ পৃথিবীতে যত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণীই হোক না কেন, তারও একটি অন্তর্নিহিত শক্তি বা ক্ষমতা আছে। সে শক্তি বা ক্ষমতা প্রয়োগ করেই সে বেঁচে থাকে। তাই আর সবার মতো আমার আস্থাও সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র শক্তি বা ক্ষমতায়। নির্বোধের কাছে বেঘরে প্রাণ সঁপে দেয়াতে কোন গৌরব নেই বরং নির্বোধ-অর্বাচীনকে পরাজিত করে বেঁচে থাকাতেই আনন্দ ও জয়।

ধান ভানতে শীবের গীত গাইলাম। সব গানের তান সবার জন্য সাজানো থাকে না । কেবল সমজদারদের জন্যই কিছু কিছু গান। তবুও সমাজে আজকাল অনুভূতি নামক মনঃজাগতিক জিনিসটা কেমন গুরুচন্ডালি ভাষার মতো তীব্র ও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠছে যে এটা প্রকাশ করতেও গুরুচন্ডালি বাক্যবিন্যাসের প্রয়োজন পড়ে, তীক্ষ্ণ বাক্যবাণের প্রয়োজন পড়ে। তবুও নিজের অনুভূতি নিজের মতো করেই লেখা ভালো। অন্যের অনুভূতি অক্ষত রাখতে নিজে ক্ষত-বিক্ষত হ’তে হয়, নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করতে হয়। তবুও ইদানিং গাছ-নদী-পাহাড় নিয়ে লিখতেও ভয় হয়, কখন গাছ -পাথরের অনুভূতিতেও আঘাত লাগে। কখন লজ্জাবতী লতাও হাতে রামদা নিয়ে ঘাড়ে কোপ মেরে অনুভূতির ব্যথা কমায়।

এক্কেবারে ছোট্টবেলায় বাড়ি থেকে প্রতিদিন বাইরে যাওয়ার সময় বড়মা তুলসী গাছ থেকে একটি ইয়া মোটা-তাজা তুলসী পাতা তুলে কানের উপরিভাগে গুঁজে দিতেন। মাঝে মধ্যে হ’লেও সহ্য করা যায়; প্রতিদিন কাহাতক সহে। কানের আঘাতের কথা বাদই দিলাম, তুলসী গাছের আঘাতের কথা ত্লুতেই বড়মা বলতেন , “রাম রাম, এটা না করলে ঈশ্বর যে আঘাত পাবেন।”

সামলাও ঠ্যালা। কানে দিলে নিজের কানে আঘাত। আবার কানে না দিলেও ঈশ্বরের প্রাণে আঘাত। উভয় সঙ্কটই বটে!

তাই ইদানিং নিরপেক্ষ, অরাজনৈতিক ও অনুভূতিতে আঘাতহীন লেখা সত্যি মুস্কিলই বটে। এক পক্ষের কথা নিজের মুখে নিলেও প্রতিপক্ষ আঘাত প্রাপ্ত হোন। ইদানিং যেন বিভাজনের রেখাটি ক্রমশঃ দুর্ভেদ্য হয়ে উঠছে। পরিবার থেকে সমাজ, সমাজ থেকে দেশ, দেশ থেকে বিশ্ব কোথাও যেন সুস্থ স্বাভাবিক ধারা নেই, নিজস্বতা নেই। জোর করে হলেও আপনাকে এক পক্ষে ঠেলেই দেবে।

একটি জাতির অনুভূতি যখন কিছু নির্দিষ্ট মানুষের মত এবং বিশ্বাসের উপরই নির্ভর করবে, তখন বিষ্ময়করভাবে গোটা জাতি মুখে “বুড়ো আঙুল” ঢুকিয়ে মৌনব্রত পালন করবে এ ভরসায় যে, “নিজে অন্ধ হইলেই প্রলয় বন্ধ হইবে।” আসলেই হবে কি?

প্রলয় বন্ধ হবে কিনা জানি না, তবে আজ “হীরক রাজার দেশে”-র কথা বড্ড মনে পড়ছে। রাজাও এক সময় নিজের পতনের রশি ধরে প্রজার সাথে বলছে দড়ি ধরে মারো টান রাজা হবে খান খান। তার চেয়েও বেশী মনে পড়ছে বুয়েটের একটি ঘটনা।

আমরা যখন বুয়েটের ছাত্র তখন ইথুওপিয়া হ’তে কয়েকজন ছাত্র এসেছিল মেকানিক্যাল বিভাগে। প্রচন্ড দুর্ভিক্ষ পীড়িত দেশটির ছাত্রগুলোর অবস্থা জ্ঞান-গরিমাতেও তেমনি দুর্ভিক্ষপ্রবনই। কিন্তু অনুকরণ করার প্রচন্ড ইচ্ছা ছিল তাদের। তাই যা দেখত তাই বলবার এবং করবার চেষ্টা করত। প্রতিদিন সকালে নজরুল ইসলাম হলের সামনে সাত্তার মিয়ার দোকানে ছাত্ররা অর্ডার দিত, “সাত্তার মিয়া, একটা চিড়া দই তাড়াতাড়ি দাও।”

পাশে দাঁড়িয়ে এক ইথুওপিয়ান ছাত্র অর্ডার দিতো, “ একটা সাত্তার মিয়া, একটা চিড়া, একটা দই আর একটা তাড়াতাড়ি দাও।”

তাই আজকাল অনেকেই নিজের কথা না ব’লে অন্য সবার মতো অনুভূতিতে আঘাতহীন কথা নকল করেই যেন বলার চেষ্টা করছেন সর্বত্র। এমন এক সর্বগ্রাসী ধ্বসের মুখোমুখী যেন আমরা।

(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)