ধভজন সরকার : (২)
কে যেন বলেছিলেন (হয়ত কবি জয় গোস্বামী), অধিকাংশ মানুষ একটা সময় বোঝেন যে, জীবনটা এখন আর তার হাতে নেই। জীবনের আনন্দ ও বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা প্রাত্যহিক কিছু নিয়মের বাতাবরণে আবদ্ধ হয়ে গেছে। জীবন চলে গেছে নিয়ম মাফিক কিছু রুটিনের হাতে। সকাল হচ্ছে। ঘড়ি জাগিয়ে দিচ্ছে। সময় টেনে নিয়ে যাচ্ছে নিত্যকর্মের ঘূর্ণাবর্তে। সকাল থেকে দুপুর। দুপুর থেকে বিকেল। বিকেল থেকে রাত। আবার সকাল –দুপুর-বিকেল-রাত। এর মধ্যেই বেছে নিতে হচ্ছে নিজের কাজ। অথচ নিজের কাজ বেছে নিতে নিজের ভাল লাগাটি যেন আর নেই। উপভোগ নেই। বেঁচে থাকার আনন্দ নেই। জীবন যাপন আছে। কিন্তু সে যাপিত জীবনে নিজের ইচ্ছের কোন প্রতিফলন নেই।
অথচ এক সময় প্রত্যেকটি মানুষই নিজের নিজের মতো করে জীবনটা কিন্তু বেছে নেন। স্বপ্ন থাকে- একান্ত নিজের মতো করে গড়া একটি স্বপ্ন; হয়ত স্বপ্নসৌধের ব্যাপ্তি কারও কারও আকাশচুম্বী থাকে না। কিন্তু স্বপ্নহীন কোন মানুষ নেই। আবার স্বপ্নের উচ্চতম স্থানে পৌঁছেছেন সে রকম মানুষও নেই। অর্থ্যাৎ চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যে একটা ব্যবধান থাকেই; যার অন্য নাম অতৃপ্তি। অনেকে বলেন, সৃষ্টির সাথে অতৃপ্তির একটি বিরাট যোগসূত্র আছে। অন্যকথায় প্রত্যেকটি সৃষ্টির সাথে থাকে স্বপ্নভংগের বেদনা।
এ প্রসংগে জার্মান লেখক ফ্রানৎস কাফকার ( ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দ- ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দ) কথা মনে পড়ে। কাফকার খুব একটা পাঠকপ্রিয়তা আমাদের সময়ে ছিল না। ইংরেজিতে কিছু অনুবাদ ছিল। কিন্ত সবই বিদ্য কিংবা সাহিত্যাংগনের সংশ্লিষ্টজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ । আমার মনে পড়ে না, আশি কিংবা নব্বই দশকে কাফকার কোন রচনার বংগানুবাদ পাওয়া যেত।
যা হোক, কাফকার রচনায় কিন্তু মানুষের এরকম স্বপ্নের পর স্বপ্ন কিংবা স্বপ্নভংগের পর স্বপ্নভংগের কথা আছে। আছে মানুষ হয়ে ওঠার গল্প। উপন্যাসের পর উপন্যাসে। পাতার পর পাতায়। নিজস্ব ডায়রিতে। সে রকম একটি উপন্যাসে “ডি ফেরভান্ডলুং”।
“ফেরভান্ডলুং” জার্মান শব্দ, ইংরেজি অর্থ “মেটামরফোসিস”, বাংলায় “রূপান্তর”। উপন্যাসের নায়ক “গ্রেগর সামসা” এক ভোরে ঘুম ভেঙ্গে বুঝতে পারলেন, তিনি এক বিকট আকৃতির পোকায় রূপান্তরিত হয়েছেন। সেদিন ভোর থেকেই শুরু হ’লো সমাজে তাঁর নতুন পরিচয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। মাত্র একদিন আগে “গ্রেগর সামসা” সমাজের কাছে, পরিবারের কাছে মানুষ ছিলেন। এক রাতের ব্যবধানে শুধুমাত্র অবয়বে পোকায় রূপান্তরিত হয়েছেন ব’লে “ গ্রেগর সামসা” কে কেউ মানুষ ব’লেই গন্য করছে না। কাফকা প্রশ্ন করেছেন, একজন মানুষ কি,কেন এবং কোন কারণে মানুষ হিসেবে সমাজে পরিগনিত হন? কে তাকে মানুষ হিসেব গড়ে তোলে? সেখানে নিজের ইচ্ছে, নিজের ভাল লাগা কিংবা নিজের জীবন যাপনের নিজস্ব স্বাধীনতার মূল্য কতটুকু?
যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম- জীবনের আনন্দ, বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা, প্রাত্যহিক কর্ম সম্পাদনের রুটিন এবং একটি শৃংখলিত চারপাশ। গতকালের মতো আজকের দিনে সে সূর্যটি উঠেছিল ও ডুবে গেল; আগামী কালকেও সে সূর্যটি উঠবে এবং ডুবেও যাবে। কিন্ত যে আমি এই উদয় ও অস্তের সাক্ষী হয়ে রইলাম কালকে এবং আজ, দু’টো দিনের আমি কি একই আমি? কালকের স্বপ্ন হয়ত আজকে স্বপ্নভংগের বেদনায় বিদ্ধ; আগামীকাল হয়ত পাওয়ার আনন্দে ঋদ্ধ হবে সে স্বপ্নটি।
ভাবতেও অবাক লাগে এ সব কথাগুলো কত সহজ ক’রে ব’লে গেছেন কাফকার মতো রবীন্দ্রনাথও। কিন্ত রবীন্দ্রনাথ নয়, আজ আমার মনে পড়ছে আমাদের কবি জীবনানন্দ দাশের একটি কবিতার কথা।
“যেখানে আকাশে খুব নীরবতা,শান্তি খুব আছে,
হৃদয়ে প্রেমের গল্প শেষ হলে ক্রমে ক্রমে যেখানে মানুষ
আশ্বাস খুঁজেছে এসে সময়ের দায়ভাগী নক্ষত্রের কাছে:
সেই ব্যাপ্ত প্রান্তরে দুজন; চারিদিকে ঝাউ আম নিম নাগেশ্বরে
হেমন্ত আসিয়া গেছে;-চিলের সোনালি ডানা হয়েছে খয়েরি;
ঘুঘুর পালক যেন ঝরে গেছে- শালিকের নেই আর দেরি,
হলুদ কঠিন ঠ্যাং উঁচু করে ঘুমাবে সে শিশিরের জলে;
ঝরিছে মরিছে সব এই খানে বিদায় নিতেছে ব্যাপ্ত নিয়মের ফলে।”
সময়ের দায়ভাগী যে নক্ষত্রটিও একদিন মরে গেছে পরিবর্তনের ব্যাপ্ত নিয়মের ফসলে, সেই ঝরে যাওয়া হারিয়ে যাওয়া সময়কে সাথী করেই আমরা যেন বেঁচে থাকি। অথচ এক সময় বেঁচে থাকা হয়ে দাঁড়ায় এক নিয়মরক্ষার রুটিন। কিন্তু সেখানে স্বপ্ন থাকেই। জীবনের বাউন্ডারি আছে; স্বপ্নের নেই। সেই অসীম স্বপ্নের মধ্যেই আমাদের সবার প্রাত্যহিক ঘর-গেরস্থালী।
(৩)
সকাল থেকেই তুষারপাত হবে সে চিন্তা মাথায় ছিল ব’লেই হয়ত মধ্যরাতের একটু পরেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। বিছানায় এপাশ ওপাশ করার বদলে নিচে নেমে এলাম। ড্রইং রুমের পর্দাটা টেনে দিতেই আমার চন্দ্রমুখী জানালাটা পূর্ণচন্দ্রের আলোতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। বাড়ির পেছনের ছোট্ট উঠোনে মাইনাস তাপমাত্রায় ফ্যাকাসে হয়ে ওঠা ঘাসগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ন্যাড়া গাছগুলো ডালের কঙ্কাল শর্রী জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দূরের বাড়ির ছাদেও বরফের লেশমাত্র নেই। ঝকঝকে আকাশে তারার মেলা। মাঝে মাঝে সাদা সাদা থোক থোক মেঘের ভেলা। পূর্নিমার চাঁদের আলো মেঘপুঞ্জকে আলোর মালাতে সাজিয়ে দিয়েছে আজ রাতে। কে বলবে ক’ঘন্টা পরেই পেঁজাপেঁজা বরফের তুলোতে চারিদিক ভেসে যাবে?
প্রকৃতি বড় বিচিত্র উত্তর মেরুর এ দেশগুলোতে। নিমিষেই বিশাল পরিবর্তন। ঝা চকচক সকালটি হয়ত বৃষ্টি কিংবা তুষারপাতে ভিজে একাকার হয়ে ওঠলো দুপুরে- দেখা গেল বিকেলটি আবার রাঙা হয়েছে উজ্জ্বল গোধূলী আলোয়। রাতের প্রথম প্রহরের বালি-জ্যোৎস্নার মৃদু অন্ধকার মধ্যরাতেই ভরে গেল নিকশ কালোতে। আবার দেখা গেল পরের দিনের ভোরের আকাশ ভ’রে আছে মুখভারকরা মেঘে। পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেয়ার এমনি সব তাড়া যেন সবখানে। প্রকৃতির কাছ থেকে মানুষের এ এক বিরাট শিক্ষা! অথচ আমরা ক’জনেই বা শিক্ষা নেই প্রকৃতির কাছ থেকে।
জীবন অনিত্য। বড় চঞ্চল ও অস্থির জীবনের মুহুর্তগুলো। এক খরস্রোতা বহতা নদীর মতোই যেন জীবনের বাঁকগুলো। এক শান্ত সৌম্য প্রবাহের পরেই হয়ত ধেঁয়ে আসছে কোনো উত্তাল ঢেউ। নিস্তরংগ স্থবির জীবনের পরের ক্ষণগুলোতে কী অপেক্ষা করছে হয়ত আমরা কেউ-ই জানি না। এ রকম সহস্র অজানা এবং অযূত অনিশ্চয়তা নিয়েই নিরন্তর-নিরবধি চলছে আমাদের জীবন; এই মুহুর্তের চন্দ্রালোকিত রাত কিংবা কিছুক্ষণ পরেই জেগে উঠবে বরফের আচ্ছাদনে ঢাকা যে দিনটি- আমাদের প্রত্যেকের জীবন যেন ঠিক তেমনি।
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, ওন্টারিও)