সেরীন ফেরদৌস : কভিড মহামারী ছড়িয়ে পড়ার এক বছরের মাথায় এসে কভিড আর ভ্যাকসিনের মধ্যে যেন নতুন এক প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। কভিডের হাত থেকে রেহাই পেতে বিজ্ঞানীরা ভ্যাকসিন নিয়ে এসেছেন। আর সেই ভ্যাকসিনের সঙ্গে লড়াই করতেই যেন কভিডও নিজেকে নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্টে রূপান্তরিত করে ফেলছে। করোনার প্রাথমিক স্ট্রেইনটির বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন তৈরি করা শেষ হতে না হতেই বিজ্ঞানীদের এখন নতুন ভ্যারিয়েন্টের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্রিয় হয়ে উঠতে হচ্ছে। বিজ্ঞানীরাও স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন যে, ভ্যাকসিন আর কভিড ভ্যারিয়েন্টের মধ্যকার প্রতিযোগিতাটা গুরুত্বপূর্ণ মোড় নিতে শুরু করেছে।
এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত ভ্যাকসিন পৃথিবীর সবাইকে যথাসময়ে দেওয়া যাবে কি যাবে না এ নিয়ে সমস্যা মোকাবিলা করার আগেই কভিডের নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্টগুলো পৃথিবীর মানুষের সামনে আরও বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে হাজির হয়েছে। গত এক বছর ধরে যে-সব পরিস্থিতিকে নিরাপদ মনে করা হতো বা যেসব প্রটোকল মানলে কভিডের সংক্রমণ থেকে রেহাই পাওয়া যাবে বলে ভাবা হতো, সেগুলোর অনেক কিছুই এখন বদলে যাচ্ছে। নিজেকে বদলিয়ে কভিড এখন স্বল্পতম সময়ে অনেক বেশি সংক্রমণ ছড়ানো এবং ক্ষতি করার সক্ষমতা নিয়ে হামলে পড়েছে। দেশভেদে দ্বিতীয় বা তৃতীয় ওয়েভ নামে পরিচিতি পাওয়া কভিডের নতুন ঢেউ বিভিন্ন দেশে নতুন করে অচলাবস্থা তৈরি করেছে। এখন পর্যন্ত আলোচনায় থাকা কভিডের নতুন ভ্যারিয়েন্টগুলো হচ্ছে ইউকে ভ্যারিয়েন্ট (বি ওয়ান ওয়ান সেভেন), ব্রাজিল ভ্যারিয়েন্ট (পি ওয়ান) এবং দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্ট (বি ওয়ান থ্রি ফাইভ ওয়ান)। ভারতের ডাবল মিউট্যান্ট ভাইরাস যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর খবর পাওয়া গেলেও এটি এখনো তেমন আলোচনায় উঠে আসেনি। কভিডের নতুন এই ভ্যারিয়েন্টগুলো এক বছর আগে বিস্তৃত হওয়া ভাইরাস থেকে আলাদা ও শক্তিশালী। ফলে কভিড নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অনেক হিসাবকেই পাল্টে দিচ্ছে নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট। কভিডের নতুন ভ্যারিয়েন্টগুলো নিয়ে গবেষকরা এখন পর্যন্ত যে সব তথ্য দিচ্ছেন তার প্রায় সবগুলোই উদ্বেগজনক। প্রথমত, নতুন ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত ব্যক্তি আগের চেয়ে অনেক বেশি সময় ধরে ভাইরাসটি ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। সাধারণভাবে এই ভাইরাস একজন মানুষের শরীরে প্রবেশ এবং নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার যে চক্র, তার ভেতরে নির্দিষ্ট কয়েকটি দিনেই তা ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা রাখত। কিন্তু মিউটেটেড ও শক্তিশালী ভাইরাসগুলো আরও বেশিদিন পর্যন্ত সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি বহন করে। শুধু তাই নয়, এগুলো আমাদের শরীরের কোষে আগের চেয়ে আরও সহজে প্রবেশ করতে সক্ষম। ফলে আগের চেয়ে এক ব্যক্তি থেকে আরও বেশি লোক আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়েছে। কভিডের নতুন ভ্যারিয়েন্টের অল্প ভাইরাসই মানুষকে বেশি কাবু করে ফেলছে। দ্বিতীয়ত, নতুন ভাইরাসগুলো আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর থেকে সংখ্যায় অধিক বের হচ্ছে এবং তা বাতাসেও বেশি সময় ধরে অবস্থান করার শক্তি অর্জন করেছে। তৃতীয়ত, নতুন ভাইরাসগুলো দ্রæততম সময়ে আগের চেয়ে বেশি দূরত্বে অন্যকে আক্রান্ত করে ফেলছে। ইউএস সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের এক গবেষণায় দেখা গেছে, অস্ট্রেলিয়ার একটি চার্চে একজন শিল্পীর গান শুনতে গিয়ে বেশ কিছু লোক আক্রান্ত হয়েছেন। এদের সবাই শিল্পীর ১৫ মিটার বা তার চেয়ে বেশি দূরত্বের মধ্যে অবস্থান করছিলেন। আর নিউজিল্যান্ডের আরেকটি ঘটনায় একটি কোয়ারেন্টাইন হোটেলের খোলা দরজার সামনে এক মিনিটের কম সময় অবস্থানকালে একাধিক ব্যক্তি আক্রান্ত হয়েছেন। চতুর্থত, নতুন ভ্যারিয়েন্ট অপেক্ষাকৃত তরুণদেরও সংক্রমণ করতে আগের চেয়ে বেশি পারঙ্গম। কানাডার প্রধান জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা থেরেসা ট্যম সিবিসি নিউজকে বলেছেন, ভ্যাকসিন এবং ভাইরাস ভ্যারিয়েন্টের মধ্যকার প্রতিযোগিতা এখন গুরুত্বপূর্ণ মোড় নিয়েছে। ভাইরাসটি এখন যে কোনো বয়সের মানুষকেই সংক্রমিত করতে সক্ষম। অসুস্থতাও আগের চেয়ে ভয়াবহ হতে পারে এবং মৃত্যুও আগের চেয়ে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস ডারটমাউথ-এর অধ্যাপক ইমিউনলজিস্ট এরিন ব্রমেজ গণমাধ্যমকে বলেছেন, এতদিন ভাবা হতো যে কাছের প্রিয়জনকে দেখতে যাওয়া, জিম করা বা কারও খাবার শেয়ার করা ততটা ক্ষতিকর নয়। কিন্তু এ কথা এখন আর বলা যাবে না। নতুন এ ভাইরাসগুলোর সংক্রমণের গতি তীব্রতম এবং আরও বেশি মৃত্যুঝুঁকিসম্পন্ন। অধ্যাপক ব্রমেজের মতে, বছরের ব্যবধানে কভিডের মূল ভাইরাসটি বারবার মিউটেট করে শক্তিশালী চেহারা নিয়েছে। ভ্যারিয়েন্ট যতই রূপ বদলাক বা শক্তি অর্জন করুক না কেন, বিজ্ঞানী, গবেষকরা সেটি মোকাবিলার জন্য দিনে-রাতে কাজ করে যাচ্ছেন। কানাডা ৩১ জন বিশেষজ্ঞ নিয়ে একটি টাস্কফোর্স তৈরি করেছে, যাদের কাজ হচ্ছে কোন ভ্যারিয়েন্ট কোন ভ্যাকসিনকে কীভাবে প্রভাবিত করতে পারে তা নিয়ে গবেষণা করা। এখন পর্যন্ত সবকটি ভ্যাকসিনই কভিডের ভ্যারিয়েন্টগুলোর বিপরীতে কার্যকর বলে গবেষকরা বলছেন। তবু পরিপূর্ণ নিশ্চিত হতে তারা কাজ করে যাচ্ছেন। কভিড মহামারী সৃষ্ট অচলাবস্থা থেকে মুক্তির পথ হিসেবে ভ্যাকসিনেই যেহেতু নির্ভর করা হচ্ছে ফলে ভ্যারিয়েন্টগুলোর গতিবিধির ওপর নজরদারিকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন গবেষকরা। কানাডার প্রধান জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা থেরেসা ট্যম সিবিসি টেলিভিশনকে বলেছেন, ভ্যাকসিন আর কভিড ভ্যারিয়েন্টের মধ্যকার প্রতিযেগিতাটা গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছে। ভ্যারিয়েন্ট তথা কভিডের ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণটা জোরদার করতে হবে। দেশে দেশে গবেষকরা, বিজ্ঞানীরা দিনে-রাতে সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছেন।
লেখক কানাডায় কর্মরত নার্স ও প্রবাসী সাংবাদিক