অনলাইন ডেস্ক : বিশ্বব্যাপী মাঙ্কিপক্সের প্রাদুর্ভাব ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ভ্যাকসিনের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মোকাবেলায় কানাডা সরকারের কাছে মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভ্যাকসিন নেই। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, দেশে বর্তমান চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট সরবরাহের অভাব হতে পারে। এমনকি সরবরাহে ঘাটতির কারণে অনেক কানাডিয়ানকে দুই ডোজ টিকার বদলে এক ডোজ নিতে বলা হচ্ছে।
সংক্রামন রোধে বিভিন্ন দেশ দ্রæত আরো ভ্যাকসিনের চালান সংগ্রহ করছে। চাহিদার সাথে সাথে সরবরাহ বজায় রাখতে ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারকরাও যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিশ্বের ৭৫টির বেশি দেশে ১৬ হাজারের বেশি মানুষ এখন পর্যন্ত এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে বলে জানান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রোস আডানম গেব্রিয়াসিস।
কানাডায় এখন পর্যন্ত ৬০৪ জনের মাঙ্কিপক্স শনাক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে, দেশটির পাবলিক হেলথ এজেন্সি (পিএইচএসি)। এর মধ্যে কুইবেক প্রদেশে ৩২০ জন, অন্টারিওতে ২৩০, ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় ৪০, আলবার্টায় ১২ জন এবং সাসকাচুয়ানে দুজনের মাঙ্কিপক্স শনাক্ত হয়েছে। পিএইচএসি বলছে, প্রদেশ ও অঞ্চলসমূহ আক্রান্তদের বিভিন্ন উপাত্ত পর্যালোচনা করবে। মাঙ্কিপক্সের পেছনে দায়ী ভাইরাস নিয়ে ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও জিনোম সিকোন্স নিয়ে কাজ করছে ন্যাশনাল মাইক্রোবায়োলজি ল্যাবরেটরি। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, মাঙ্কিপক্স সংক্রামক রোগ, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
মাঙ্কিপক্স ভাইরাসের শনাক্ত বাড়তে থাকায় উদ্বেগ জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডবিøউএইচও)। ভাইরাসটি নিয়ে বিশ্বব্যাপী ‘জরুরি স্বাস্থ্য অবস্থা’ ঘোষণা করেছে সংস্থাটি। যে কোনো স্বাস্থ্য সঙ্কটে এটিই সংস্থাটির জারি করা সর্বোচ্চ জোরাল সতর্কতা।
শনিবার এই ইস্যুতে বৈঠকে বসে ডব্লিউএইচও-এর নীতি নির্ধারকরা। তারা মাঙ্কিপক্স প্রার্দুভাবটিকে পুরো বিশ্বের মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য হুমকি হিসেবে আখ্যায়িত করে। কর্তৃপক্ষ বলছে, মাঙ্কিপক্স সম্ভাব্য মহামারী ঠেকাতে বৈশ্বিকভাবে সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
মাঙ্কিপক্সের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কারিগরি প্রধান ডাঃ রোসামুন্ড লুইস সিবিসি নিউজকে বলেছেন, এই সংক্রমণ রোধ করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো উচিত। সিডিসির হাই কনসিকোয়েনস প্যাথোজেনস অ্যান্ড প্যাথলজি বিভাগের উপপরিচারক ডা: জেনিফার ম্যাককুইস্টিন বলেন, শিশুদের শরীরে মাঙ্কিপক্স শনাক্ত হওয়ায় বিস্ময়ের কিছু নেই। কিন্তু এখন পর্যন্ত সমকামী, উভকামী কিংবা পুরুষের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা পুরুষের বাইরে কেউ এতে আক্রান্ত হচ্ছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
ডেনিশ ফার্ম ব্যাভারিয়ান নর্ডিকের তৈরি টিকাগুলো ইইউতে গুটিবসন্ত মোকাবেলায় স¤প্রতি ব্যবহারের অনুমোদন পেয়েছে। ডাঃ রোসামুন্ড লুইস বলছেন, এগুলো মাঙ্কিপক্স ভাইরাসের বিরুদ্ধেও সুরক্ষা দেবে। তবে কথা হল, মাঙ্কিপক্সের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে পর্যাপ্ত মানুষ কি যথাসময়ে এ টিকা পাবে? এ বিষয়ে অবশ্য কিছু চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ আশাবাদী। তবে ভ্যাকসিন সরবরাহে ঘাটতির কারণে কানাডা সহ বিশ্বের বহু দেশে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ছে। পাশাপাশি এ ভাইরাসটি স্থায়ী হবে কি না সে বিষয়ে অনেকেই নিশ্চিত নন।
সা¤প্রতিক সপ্তাহে কানাডায় মাঙ্কিপক্স সংক্রামন বেড়ে যাওয়ায় ভ্যাকসিন প্রয়োগের পরিমানও বেড়েছে। অন্টারিও এবং কুইবেকের প্রধান শহরগুলোতে ২০ হাজারেরও বেশি ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে। কানাডায় মোট আক্রান্তের ৯০ ভাগই এ দুই রাজ্যের।
টরন্টোর একজন চিকিৎসক সিবিসি নিউজকে বলেছেন, এ ভাইরাসে আক্রান্ত নতুন রোগীরা চিকিৎসার চেষ্টা চালিয়ে গেলেও ভ্যাকসিনের চাহিদা কমতে শুরু করেছে। সেন্ট মাইকেল হাসপাতালের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ ড্যারেল ট্যান বলেছেন, সংক্রামন স্থিতিশীল হবে কি না, তা এখনই বলা সম্ভব না। এ মুহুর্তে ভ্যাকসিন সরবরাহ সীমিত বলে মনে হচ্ছে। এই প্রাদুর্ভাবকে থামানো না গেলে এটি “বিধ্বংসী” হবে, এবং ভাইরাসটি যৌন সংসর্গের মধ্য দিয়ে দীর্ঘমেয়াদে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে।
ভ্যাঙ্কুভারের পুরুষদের স্বাস্থ্য ক্লিনিক এবং বাথহাউসে ভ্যাকসিন বিতরণ করা হচ্ছে। এখানকার স্থানীয় কর্মকর্তারা সতর্ক করেছেন যে, চাহিদা ইতিমধ্যে ফেডারেল মজুদের মাধ্যমে সরবরাহ করা যোগানের চেয়ে অনেক বেশি। ভ্যাঙ্কুভার কোস্টাল হেলথ এর ডেপুটি চিফ মেডিকেল হেলথ অফিসার ডা: মার্ক লাইসিশিন জুলাই মাসের মাঝামাঝি সিবিসি নিউজকে বলেন, টরন্টো এবং মন্ট্রিলে আমাদের বড় প্রাদুর্ভাব ঘটেছে এবং তাই তারা প্রচুর পরিমাণে ভ্যাকসিনের জন্য অনুরোধ করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাঙ্কিপক্স বসন্তের একটি বিশেষ ধরন। সংক্রামক হলেও রোগীর সংস্পর্শে না এলে এই রোগ ছড়ায় না। বিভিন্ন বানর জাতীয় প্রাণীর মাধ্যমে এটি ছড়ায়। এ ছাড়া শ্বাসনালি, শরীরে তৈরি হওয়া কোনো ক্ষত, নাক কিংবা চোখের মাধ্যমেও অন্যের শরীরে প্রবেশ করতে পারে মাঙ্কিপক্স ভাইরাস।
জার্মানির টিকা বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটি একটি নির্দেশনা জারি করেছে। তাতে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তিরা আক্রান্ত ব্যক্তির কাছাকাছি গেছেন অথবা যাওয়ার সম্ভাবনা আছে, তারা যেন দ্রæত টিকা নিয়ে নেয়। মাঙ্কিপক্স স্মলপক্সেরই একটি ধরণ। ফলে চিকিৎসকেরা স্মলপক্সের টিকা নেওয়ারই পরামর্শ দিয়েছেন। তবে যেহেতু টিকা অপ্রতুল, তাই সকলকে টিকা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়নি, কেবলমাত্র যারা আক্রান্ত ব্যক্তির কাছাকাছি গেছেন, তাদেরকেই টিকা নিতে হবে। বয়স্কদের জন্যও টিকা নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
মাঙ্কিপক্স ছোঁয়াচে। যৌনমিলনের ফলেও এই রোগ সংক্রমিত হতে পারে। তবে করোনার মতো এটি কোনো প্যানডেমিক নয় বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে এই রোগটি নিয়ে অযথা উত্তেজনা ছড়ানোর প্রয়োজন নেই বলেও জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
করোনাভাইরাসের আতঙ্ক না কাটতেই ছড়িয়ে পড়া মাঙ্কিপক্স মোকাবিলায় এই ভাইরাসের টিকা বিতরণ শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এরই মধ্যে দেশটির রোগনিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থা (সিডিসি) মাঙ্কিপক্সের ১২ হাজার ডোজ টিকা বিতরণ করেছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম সিএনবিসি।
মাঙ্কিপক্সের বিরুদ্ধে এখনই ব্যাপক আকারে গণটিকা দেয়ার প্রয়োজন নেই বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইও)। তবে এ রোগের প্রাদুর্ভাব থাকা দেশগুলোতে এর বিস্তার নিয়ন্ত্রণে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। সূত্র : সিবিসি