অনলাইন ডেস্ক : করোনা ভাইরাস মহামারীর কারণে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে বেশিরভাগ দেশ ব্যয় সংকোচননীতি গ্রহণ করায় চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরছেন বহু প্রবাসী শ্রমিক। তাদের মধ্যে কেউ চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ায় নতুন করে আর কাজে যোগ দিতে পারছেন না। আবার কেউ অবৈধভাবে থাকায় তাকে দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। কেউ আছেন আগেই সাজাপ্রাপ্ত, আবার কেউ ফিরে আসছেন স্বেচ্ছায়। হঠাৎ করেই এত বিপুলসংখ্যাক প্রবাসী শ্রমিক ফিরে আসায় একদিকে দেশ যেমন হারাচ্ছে রেমিট্যান্স তেমনি নতুন করে যোগ হচ্ছে কর্মহীন মানুষের বোঝা।
এ ছাড়া করোনা পরিস্থিতির আগে বিভিন্ন দেশে যাওয়ার জন্য যে এক লাখ শ্রমিক ভিসা পেয়েছিলেন, তাদের যাওয়াও একরকম অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় নতুন নতুন শ্রমবাজার খোঁজার তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এভাবে প্রবাসী শ্রমিকদের ফিরে আসার ঢল অব্যাহত থাকলে দেশের রেমিট্যান্স-আয়ে ব্যাপক প্রভাব পড়বে। তাই সরকারের উচিত হবে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে জরুরিভিত্তিতে আলোচনা শুরু করা, যেন তারা শ্রমিকদের ফেরত না পাঠায়।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সূত্র অনুযায়ী বর্তমানে এক কোটি ২০ লাখের বেশি বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২০ লাখ ৮৪ হাজার বাংলাদেশি রয়েছেন সৌদি আরবে। মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে আছেন ১৩ লাখ ৭০ হাজার বাংলাদেশি। এ ছাড়া ওমান, মালয়েশিয়াতেও ১০ লাখের বেশি বাংলাদেশি রয়েছেন। এর পর কাতার, কুয়েত, সিঙ্গাপুর, বাহরাইনেও রয়েছেন এ দেশের বহু মানুষ। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক কাজ করেন ইতালিতে।
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও বিমানবন্দর সূত্র বলছে, করোনা মহামারী শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ১৬ হাজার ৭৪২ অভিবাসী শ্রমিক দেশে ফিরেছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই ফিরেছেন চাকরি হারিয়ে।
আবার অনেককে বাধ্য করা হয়েছে দেশে ফিরতে। বেসরকারি সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (আরএমএমআরইউ) তথ্য অনুযায়ী, শতকরা ৭৮ শতাংশ অভিবাসী শ্রমিককে জোর করে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশই ফেরত এসেছেন মধ্যপ্রাচ্য থেকে। এর বাইরে মালদ্বীপ, নেপাল, ভুটান থেকেও প্রচুর বাংলাদেশি ফিরে এসেছেন।
এদিকে করোনার প্রভাব ও শ্রমিকদের ফেরত পাঠানো অব্যাহত থাকায় রেমিট্যান্স প্রবাহ অন্তত ২২ শাতংশ কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। মহামারী ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশি শ্রমিকদের ফেরত আনার জন্য সরকারকে তাগাদা দিচ্ছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো অবৈধ প্রবাসী শ্রমিকদের দেশে ফেরাতে বারবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করছে। সৌদি আরব, কাতার, কুয়েতসহ বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক করোনার কারণে চাকরি হারাতে পারেন বলে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
ফিরে আসা বা ফেরার অপেক্ষায় থাকা এ শ্রমিকদের নিয়ে চিন্তিত সরকারও। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বলছে, বিদেশ ফেরত কর্মহীন এসব মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি অথবা উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করে সরকার তাদের পুনর্বাসন করতে চায়। এ লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তারা যেসব দেশ থেকে ফেরত এসেছেন, সেখানে আবার যেন কাজে ফিরতে পারেন; সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মুনিরুস সালেহীন বলেন, ‘বিদেশ ফেরত শ্রমিকদের পুনর্বাসনে ব্যাংকঋণ নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংককে এ জন্য ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। এ ছাড়াও ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ তহবিলের মাধ্যমে ২০০ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, যা দিয়ে আগামী জুলাই মাস থেকে ঋণ দেওয়া শুরু হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, ‘ফেরত আসা শ্রমিকরা যেন আবার ওই দেশের কর্মস্থলে যোগ দিতে পারেন, সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তারা কাজে যোগ দিলে একদিকে রেমিট্যান্স আসবে অন্যদিকে দেশের বোঝা কমবে।’
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের যেসব কর্মী বিভিন্ন দেশে বৈধভাবে আছেন তাদের যেন ফেরত পাঠানো না হয়, তারা যেন সেখানে কাজ করতে পারেন-এটা নিশ্চিত করাই আমাদের প্রথম কাজ। এর জন্য যা দরকার সরকারের তা-ই করা উচিত। আমরা সরকারকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। আমাদের দ্বিতীয় লক্ষ্য-যেসব শ্রমিক ছুটিতে এসেছেন; কিন্তু ফিরে যেতে পারেননি, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তারা যেন কর্মস্থলে কাজে যোগ দিতে পারেন সে জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো। তৃতীয় লক্ষ্য-যাদের ভিসা আন্ডার প্রসেস অবস্থায় আছে তাদের পাঠানো। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বায়রার সদস্যভুক্ত ১ হাজার ৬০০ কোম্পানির মধ্যে এ পর্যন্ত ৩১২টির অধীনে ৮০ হাজার ভিসা প্রক্রিয়াধীন। এর বাইরে অনেক কোম্পানি এখনো তথ্য দিতে পারেনি। ওই হিসাব এক করলে এক লাখের বেশি ভিসা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, যেসব শ্রমিক ফিরে এসেছেন তাদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে; কিন্তু তারা হঠাৎ করে ওই টাকা দিয়ে দেশে কিছু করার মতো অবস্থায় হয়তো থাকবেন না। তাই আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে তাদের পুনর্বাসন করা, অর্থাৎ দেশি কোম্পানিতে চাকরির ব্যবস্থা করা; কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের কোম্পানিগুলোও বড় ধরনের লোকসানের মধ্যে পড়েছে। ফলে এসব কোম্পানিতে চাকরির সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে বিদেশ ফেরত শ্রমিকদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তাদের দক্ষ করে তুলতে দিতে হবে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ। বিশেষ করে তাদের কৃষিক্ষেত্রে উৎসাহিত করতে হবে। তা হলে ফিডব্যাক পাওয়া যাবে। এই শ্রমিকদের পরিশ্রমে অর্জিত রেমিট্যান্স দিয়ে আমাদের অর্থনীতির আকার এত বড় হয়েছে; কিন্তু তাদের এই দুর্দিনে আমরা যদি পাশে থাকতে না পারি- এটা হবে আমাদের বড় ব্যর্থতা। তবে সেটা শুধু সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই যার যার অবস্থান থেকে এসব শ্রমিকের পাশে দাঁড়াতে হবে।