অনলাইন ডেস্ক : স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় প্লাবিত দেশের ১১ জেলা। জেলাগুলো হচ্ছে ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, চাঁদপুর, কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এখন পর্যন্ত এ বন্যায় অন্তত ৫০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার পানিতে ডুবে ফেনীতে ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দু’জনের মৃত্যুর খবরও পাওয়া গেছে। বন্যায় এসব জেলার হাজার হাজার মাছের ঘের ও পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। তলিয়ে গেছে ফসলি জমি।
ফেনী, নোয়াখালি এসব অঞ্চলের অনেকে গরু-মহিষ, ছাগল এসবও ভেসে গেছে। ঘরবাড়ি সব গলা পরিমাণ পানিতে তলিয়ে গেছে। তাদের থাকার জায়গা নেই। অনেকে দূর-দূরান্তে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছেন। ফেনী ও কুমিল্লায় বিভিন্ন স্থানে সড়ক ও রেল পথ ডুবে যাওয়ায় যোগাযোগ ব্যাহত হচ্ছে। বন্যা দুর্গত এলাকায় খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। ডায়েরিয়া ও পেটের পীড়া রোগীর চিকিৎসায় হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা। দুর্গত এলাকায় বিদ্যুৎ নেই, ইন্টারনেট সংযোগ ব্যাহত হচ্ছে। সব মিলিয়ে বন্যাদুর্গত এলাকা মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি।
দেশের অভ্যন্তরে ও উজানে উত্তর-পূর্ব ভারতে টানা অতি ভারী বৃষ্টিপাত এবং ভারত থেকে তীব্র বেগে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে হঠাৎ বন্যা কবলিত হয়েছে দেশের দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল। গতকাল পর্যন্ত উভয় অঞ্চলে অতি বর্ষণ, উজানের ঢল এবং নদ-নদী, শাখা নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এ অবস্থায় চলমান ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটছে। ভারতের ত্রিপুরায় বন্যার চাপ সামলাতে ১৯৯৩ সালের পরে ৩১ বছর পর এবার ত্রিপুরায় পানি বিদ্যুৎ প্রকল্পের ডুম্বুর বাঁধের সবক’টি কপাট একযোগে খুলে দিয়ে বিনা নোটিশে ভারত পানি ছেড়ে দিয়েছে। এর ফলে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল আকস্মিক ও ভয়াল বন্যা কবলিত হয়েছে। যে কোন ভাটির দেশ যাতে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগাম সতর্কতা ও প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারে, এর জন্য আগেভাগে জানিয়ে বাঁধ-ব্যারাজের পানি ছাড়াই আন্তর্জাতিক নিয়ম বা কনভেনশন। কিন্তু ভারত কখনোই সেই নিয়মের ধার ধারে না। যথেচ্ছ বাঁধ-ব্যারাজ খুলে পানি ছেড়ে দেয়। যা নেহায়েৎ অমানবিক। এতে করে ভাটিতে ভাসছে বাংলাদেশ। প্রতিবেশী ভারতের এহেন নির্মম আচরণের প্রতিবাদে গত দু’দিনে রাজধানী ঢাকায় ছাত্র-জনতা বিক্ষোভ মিছিল করেছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও এ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে।
ভয়াবহ এই বন্যায় গতকাল পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে চট্টগ্রাম বিভাগে ফেনী, নেয়াখালী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, পার্বত্য খাগড়াছড়ি জেলা ও চট্টগ্রাম জেলার একাংশ এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলাসহ মোট ৮টি জেলা। এ ছাড়াও আরও ৩টি জেলায় বন্যা বিস্তার লাভ করেছে। ফাজিলপুর থেকে ফেনীর মধ্যবর্তী এবং কুমিল্লায় কয়েক জায়গায় রেললাইন ও রেলসেতু তীব্র ঢল-বানের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এতে করে ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট রেলপথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সবধরনের ছুটি বাতিল করে সার্বক্ষণিক (স্ট্যান্ডবাই) বন্যা এলাকায় থাকার নির্দেশ দিয়েছে। তাছাড়া মাঠ প্রশাসনকেও বন্যার্তদের পাশে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সরকার বন্যা কবলিতদের জরুরি উদ্ধার ও শুকনো খাবার বিতরণের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে। ফায়ার সার্ভিজ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর বিশেষ টিমও জরুরি ত্রাণ এবং উদ্ধার কার্যক্রমে সহায়তা করছে।
এদিকে ভারতের সিকিমে তিস্তার সর্বোচ্চ উজানভাগে প্রচ- ঢল ও বন্যায় তিন দিন আগে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের একটি বাঁধ ধসে গেছে। এর ফলে দেশের উত্তরাঞ্চলে বিশেষত রংপুর বিভাগ ফের বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা জানান, উত্তর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপ এবং বর্ষার বাহক মৌসুমী বায়ুর সক্রিয় প্রভাবে দেশের অভ্যন্তরে এবং উত্তর-পূর্ব ভারতে একযোগে অতি ভারী বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। আকস্মিক ও স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার এটি প্রধান কারণ।
আবহাওয়া পূর্বাভাসে জানা গেছে, মাঝারি থেকে ভারী ও অতি ভারী বৃষ্টিপাত আরও অন্তত ৪৮ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে। পাউবো’র বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সূত্রে গতকাল জানা গেছে, দেশের দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ৭টি নদ-নদী ১৪টি পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে ফেনী নদী একটি পয়েন্টে, হালদা নদী দু’টি পয়েন্টে, গোমতী নদী দু’টি পয়েন্টে, কুশিয়ারা নদী ৪টি পয়েন্টে, মনু দু’টি পয়েন্টে, ধলাই একটি পয়েন্টে, খোয়াই দু’টি পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তাছাড়া ফেনীর মুহুরী, কুহুয়াসহ বিভিন্ন শাখা ও উপনদী, খাল বন্যায় ফুলে-ফুঁসে উঠেছে।
দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় গতকাল দুপুরে এক তথ্য বিবরণীতে ৮ জেলায় ৪ লাখ ৪০ হাজার ৮৪০টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছে। এ সব জেলায় প্রায় ২৯ লাখ মানুষ ক্ষত্রিগ্রস্ত হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ৮ জেলা বন্যা আক্রান্তের কথা জানালেও এখন পর্যন্ত তা ১১ জেলায় বিস্তার লাভ করেছে। এসব জেলার ৫৩টি উপজেলা প্লাবিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩৬২টি ইউনিয়ন। তথ্য বিবরণীতে আবহাওয়া সংস্থাগুলোর বরাত দিয়ে বলা হয়, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও এর সংলগ্ন উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কমে আসতে পারে। এ সময় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার মনু, খোয়াই, ধলাই নদীগুলোর সংলগ্ন নি¤œাঞ্চলের বন্যাপরিস্থিতি প্রাথমিকভাবে স্থিতিশীল থেকে পরবর্তী সময়ে উন্নতি হতে পারে। মন্ত্রণালয় জানায়, বন্যায় পানিবন্দি বা ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য মোট ১ হাজার ৫৩৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মোট ৭৫ হাজার ৬৬৮ জন লোক এবং ৭ হাজার ৪৫৯টি গবাদি পশুকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য মোট ৪৪৪টি মেডিক্যাল টিম চালু রয়েছে। আর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বিতরণের জন্য মন্ত্রণালয় হতে এখন পর্যন্ত ১ কোটি ৮২ লাখ নগদ টাকা ও ১৩ হাজার ৬০০ টন চাল বরাদ্দ করা হয়েছে। ফেনী জেলায় বন্যা উপদ্রুত এলাকায় সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী উদ্ধার কাজে নিয়োজিত রয়েছে জানিয়ে মন্ত্রণালয় জানায়, সেনাবাহিনী থেকে ১৬০ জন সদস্য ৪০টি উদ্ধারকারী যান ফেনী জেলায় পাঠানো হয়েছে। এছাড়া একটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে। নৌবাহিনীর ৭১ জন সদস্য ও আটটি উদ্ধারকারী যান কাজ করছে। বন্যার সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো প্রতিবেদন তুলে ধরা হলো।
ফেনী থেকে মো: ওমর ফারুক জানান, ফেনীতে বন্যায় নেমে এসেছে মানবিক বিপর্যয়। পানিবন্দী লাখ লাখ মানুষ। তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও অভ্যন্তরীণ সব সড়ক। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে তিন উপজেলার বাসিন্দারা। ফেনিতে প্রবল বন্যায় শেষ হয়ে গেছে কৃষকের স্বপ্ন। নষ্ট হয়েছে ফসলি জমি, মাছের ঘের, পোল্ট্রি খামার। প্রাণে বাঁচতে হাজার হাজার মানুষের আকুতি। এমন পরিস্থিতিতে উদ্ধার অভিযানে নেমেছে সেনাবাহিনী, বিজিবি, কোস্ট গার্ড, ফায়ার সার্ভিসসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। ব্যক্তি উদ্যোগেও অনেকে নৌকা ও শুকনো খাবার নিয়ে উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছেন। পরিস্থিতির ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। ফেনীর ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া উপজেলায় বন্যার প্রভাব সবচেয়ে বেশি। এসব উপজেলার অধিকাংশ ঘরবাড়ি পানির নিচে। এ ছাড়াও ফেনী সদর, দাগনভূঞা ও সোনাগাজীতেও অসংখ্য মানুষ পানিবন্দি। জেলা শহরের মূল সড়কে কোমরপানি উঠে গেছে বিকালেই। অন্য উপজেলাগুলোতেও লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি। জেলা প্রশাসন দুর্গতদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা ও শুকনো খাবার পৌঁছে দিতে কাজ করছে। ভারী বৃষ্টি ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ভয়াবহ এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। গত ২০ আগস্ট রাতে ভারতের ত্রিপুরার ডিম্বুর হাইড্রোইলেক্ট্রিক বাঁধ খুলে দেয়ায় হঠাৎ মানবিক বিপর্যয় নেমে আসে কখনো বড় ধরনের বন্যার মুখোমুখি না হওয়া এসব মানুষের জীবনে।
নোয়াখালী থেকে এহসানুল আলম খসরু জানান, নোয়াখালীর সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। ২১ আগস্ট রাতে বৃষ্টি বন্ধ থাকার পর গতকাল ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত প্রবল বর্ষণে পানি বেড়ে গিয়ে মানুষ আরও দুর্ভোগে পড়েছে। শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। ডায়েরিয়া ও পেটের পীড়া রোগীর চিকিৎসায় হাসপাতাল গুলোতে চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা। তবে এখনো কোথাও কোনো মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। পানি বন্দী মানুষ চরম দুর্ভোগে আছে। রান্না ঘরের চুলায় পানি ওঠায় রান্না-বান্না হয়নি অনেক পরিবারের। নিম্ন আয়ের মানুষের বিড়ম্বনা সীমাহীন পর্যায়ে রয়েছে। নোয়াখালী জেলা ত্রাণ ও পূনর্বাসন কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন খাঁন ইনকিলাবকে বলেন, জেলায় ৯টি উপজেলার ৮৭টি ইউনিয়ন ও পৌরসভা আক্রান্ত হয়েছে। পানিবন্দি মানুষ প্রায় ১৯ লাখ ৮০ হাজার জন। ৩৮৮টি আশ্রয় কেন্দ্রে ৩৬ হাজার ১১৫ জন আশ্রয় নিয়েছে। পানিবন্দী এলাকায় ৮৮টি মেডিকেল টিম খাবার স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধ করন টেবলেট ও চিকিৎসা সামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রেখেছে।
লক্ষ্মীপুর থেকে এস এম বাবুল (বাবর) জানান, লক্ষ্মীপুরে জলাবদ্ধতার পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। ভারী বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় ক্রমশ পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। জেলার পাঁচটি উপজেলায় জলাবদ্ধতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। চার দিন ধরে বেশির ভাগ ঘরবাড়ি পানিতে নিমজ্জিত হয়ে আছে। পানিবন্দী হয়ে পরেছে জেলার ৬ লাখ মানুষ। গত কয়েকদিন ধরে টানা বৃষ্টিপাতের পানি নামতে না পারায় বাড়ির উঠান, মাঠ-ঘাট, পুকুর, জলাশয়, ফসলি ক্ষেত তলিয়ে গেছে। চরাঞ্চলে সব নলকূপ ডুবে যাওয়ায় বর্তমানে বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। অনেকেই রান্না বান্না করতে না পেরে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। গবাদি পশু নিয়েও বিপাকে পড়েছেন বন্যা দুর্গতরা। ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, পোল্ট্রি খামারি ও মাছচাষিরা। লক্ষ্মীপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বিল্লাল হোসেন জানান, চলমান বন্যা পরিস্থিতিতে জেলায় ১৭ হাজার ৫০০ পুকুর-জলাশয় ভেসে গেছে, চাষিদের বিভিন্ন প্রকার ছোট বড় অন্তত ৩ হাজার মেট্রিক টন মাছ বের হয়ে গেছে।এতে করে ৮ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ অবস্থা থাকলে তা বেড়ে দ্বিগুণ হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
সিলেট থেকে ফয়সার আমীন জানান, সিলেটে প্রবল বৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা ঢলে নদ-নদীর পানি দ্রুত বাড়ছে। ইতিমধ্যে কুশিয়ারা চারটি পয়েন্টে ছাড়িয়েছে বিপদসীমা। ইতিমধ্যে সিলেটের সাথে সারা দেশের ট্রেন চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এমন অবস্থায় সিলেটের ওপর দিয়ে ৬০ কিলোমিটার বেগে ঝড়ের আভাস দিয়েছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর। এছাড়া বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে বিভাগের দুই জেলা মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জে। এদিকে, ভারি বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে আগামী ২৪ ঘন্টায়। এ অবস্থায় আবারও বন্যার শঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। বাড়ছে সিলেটের বিভিন্ন পয়েন্টের নদ-নদীর পানি। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানিয়েছে, কুশিয়ারার চারটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সুরমার পানিও বিপৎসীমার কাছ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
কুমিল্লা থেকে সাদিক মামুন জানান, কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি আর ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে বিপদসীমা অতিক্রম করেছে গোমতী নদীর পানি। এতে গোমতী নদীর আশপাশের কুমিল্লা সদর, বুড়িচং, দেবিদ্বার, মুরাদনগরের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বাড়িঘরে পানি ঢুকে ঘর ছাড়া কয়েক হাজার মানুষ। ক্ষতি হয়েছে হাজার হাজার হেক্টর ফসল। ডুবেছে মহাসড়কের দুই কিলোমিটার সড়ক। নদীর পাড়ের মানুষজনকে আতংকিত না হয়ে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ। নদীর চরাঞ্চলের মানুষদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে কাজ করছে বিজিবি, স্থানীয় প্রশাসনসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এদিকে গোমতী নদীর পানি বেড়ে কুমিল্লা শহর রক্ষা বাঁধে ছুঁই ছুঁই করছে। বাঁধটি ভেঙে গেলে কুমিল্লা শহর ও আদর্শ সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। চরম আতঙ্কের মধ্যে কাটছে বাঁধ এলাকার মানুষজনের প্রতিটি মুহূর্ত। স্থানীয়রা জানান, পানিতে ডুবে যাওয়ায় নদীর পাড়ের কয়েক হাজার মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়েছে। এছাড়াও কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার বানাশুয়া, পালপাড়া, রতœাবতী, টিক্কারচর, জালুয়াপাড়া, বুড়িচং উপজেলার ভান্তি, শিমাইলখাড়া, পূর্বহুড়া, নানুয়ার বাজার, মিথলাপুর, গোবিন্দপুর, বাজেহুরাসহ ব্রাহ্মণপাড়া, মুরাদনগর, চান্দিনার বিভিন্ন স্থানে নদীর চরাঞ্চলের কয়েক হাজার একর সবজিক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে। এছাড়াও চৌদ্দগ্রাম, লাকসাম, নাঙ্গলকোট, মনোহরগঞ্জ উপজেলার অধিকাংশ এলাকা বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চৌদ্দগ্রাম অংশে রাস্তা ডুবে যাওয়ায় যানবাহন চলাচলে বিঘœ দেখা দেয়।
মৌলভীবাজার থেকে এস এম উমেদ আলী জানান, কয়েকদিনের অবিরাম বৃষ্টি ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে মৌলভীবাজার জেলার মনু ও ধলাই নদীর ১৩টি স্থানে বাঁধ ভেঙ্গে বন্যার পানি প্রবেশ করছে। পৃথকভাবে মনু প্রকল্পের বাঁধের ২টি স্থানে ভাঙ্গন দিয়েছে। বন্যার পানি প্রবেশ করে প্রায় তিন শতাধিক গ্রাম প্লাবিত করেছে। প্রায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী রয়েছেন। অস্বাভাবিক ভাবে নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলা শহরজুরে আতঙ্ক বিরাজ করছে। মনু নদীর বাঁধ ভেঙ্গে বন্যার পানি প্রবেশ করছে কুলাউড়া উপজেলার হাজিপুর, মিয়ারপাড়া, চকসালন। রাজনগর উপজেলার খাসপ্রেমনগর, একামধু, আদিনাবাদ, উজিরপুর ও কোনাগাও এলাকায়। অপর দিকে ধলাই নদীর বাঁধ ভেঙ্গে কলগঞ্জ উপজেলার ইসলাপুর ইউনিয়নের গংগানগর, মোকাবিল, মাধবপুর ইউনিয়নের হিরামতি, আদমপুর ইউনিয়নের ঘোড়ামারা ও রহিমপুর ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর বন্যার পানি প্রবেশ করছে। এসব এলাকার শতাধিক গ্রামের রাস্তাঘাট ও বাড়ি ঘর পানির নিচে তলিয়ে গেছে। জেলার ৪টি নদী মনু, ধলাই, কুশিয়ারা ও জুড়ী নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক সামছুদ্দিন আহমদ জানান, আউশ ধানের ক্ষতির পাশাপাশি সদ্য রোপন করা ৭ উপজেলায় আমন ধান ও সবজির ক্ষতি হয়েছে। তবে এই মুহূর্তে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা যায়নি।
চাঁদপুর থেকে বি এম হান্নান, গত কয়েকদিনের ভারী ও টানা বর্ষণে চাঁদপুর শহরের পাড়া মহল্লা ও বেড়িবাঁধ এলাকায় স্থায়ী পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে তলিয়ে গেছে বিভিন্ন বসত বাড়ি, জনগুরুত্বপূর্ণ সড়ক, কৃষি আবাদ, পোলট্রি খামার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও চাষকৃত মাছের ঘের। বিশেষ করে চাঁদপুরের নদীপাড় এলাকা ও বেড়িবাঁধের ভেতরে থাকা সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় চাঁদপুর পদ্মা-মেঘনা নদীর পানি বেড়েছে। জোয়ারের সময় পানির উচ্চতা ছিল ৩ দশমিক ৭ মিলিমিটার এবং ভাটার সময় ছিল ৩ দশমিক ৬ মিলিমিটার। এখনো বিপদ সীমার নিচে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। চাঁদপুর-চট্টগ্রাম রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। বন্যার কারণে ফেনীতে রেললাইন ডুবে যাওয়ায় পূর্বাঞ্চলীয় রেল বিভাগ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে খ, আ, ম, রশিদুল ইসলাম জানান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। নতুন করে আরও কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ৫টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভায় ৫ শতাধিক পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। হাওড়া বাঁধ ভেঙে নতুন নতুন এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। কৃষি জমি ও পুকুর তলিয়ে গেছে। আখাউড়া-আগরতলা সড়কের বিভিন্ন স্থানে পানি উঠছে। স্থলবন্দর এলাকায় পানি উঠায় ইমিগ্রেশন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এদিকে, বৃহস্পতিবার সকালে বন্যা দূর্গত এলাকা পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসক মোঃ হাবিবুর রহমান। এসময় দূর্গতদের মাঝে শুকনো খাবার চিড়া, গুড়, ওরস্যালাইন বিতরণ করা হয়। এসময় সেনাবাহিনী, পুলিশ, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
রাঙামাটি থেকে সৈয়দ মাহবুব আহমদ জানান, দেশের বৃহত্তর জেলা রাঙামাটির লংগদু উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চল দিয়ে বয়ে যাওয়া কাঁচালং নদীর শাখা নদীসহ কাপ্তাই হ্রদের পানিও বাড়ছে। ফলে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে নদীর তীরবর্তী ও হ্রদের পার্শ্ববর্তী কয়েকটি গ্রামের তিন শতাধিক পরিবার। অনেকেই তাদের শিশু, বৃদ্ধ ও গবাদি পশু উঁচু স্থানে সরিয়ে নিয়েছে। ক্লাসে পাঠদান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে স্থানীয় কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। তারমধ্যে রয়েছে একটি প্রাথমিক, একটি মাধ্যমিক ও একটি মাদ্রাসা।
চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ থেকে মামুনুর রশিদ পাঠান জানান, ফরিদগঞ্জে চারদিনব্যাপী টানা বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে এলাকার নি¤œাঞ্চলের কিছু কিছু আমন ধানের জমি। টানা বৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন শ্রমজীবী, দিনমজুর ও দৈনন্দিন কাজে বাইরে বের হওয়া মানুষ। দুর্ভোগে পড়েছে স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীরা। গাছপালা ভেঙ্গে পড়ায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়েছে পড়েছে লাখো মানুষ। পানি বৃদ্ধির কারণে বিপাকে পড়েছে মৎস্য চাষী ও পোল্টি খামারীরা।
কুমিল্লার তিতাস থেকে মো. আসলাম জানান, ভারতের ত্রিপুরা থেকে নেমে আসা পানিতে কুমিল্লা উত্তর গোমতীর পাড়ের ১০ গ্রাম প্লাবিত। পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। তলিয়ে গেছে গ্রামীণ সড়ক, ফসিল জমি ও মাছের ঘের। বনার্তদের সহযোগিতায় কাজ করছেন বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।
বরিশাল থেকে নাছিম উল আলম জানায়, ভাদ্রের পূর্ণিমার মরা কাটালে ভর করে গত কয়েক দিনের মাঝারী থেকে ভারী বর্ষণের সাথে বরিশালের সব নদ-নদীর পানি বিপদসীমার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২৩টি গেজ স্টেশনেই নদ-নদীর পানি বিপদসীমার ওপরে। ফলে রোপা আমন ও বীজতলাসহ অন্যান্য ফসলের প্রায় পুরোটাই পানি তলায় চলে গেছে। উজানের ঢলের সাথে ফুসে ওঠা সাগরের জোয়ার আর লাগাতর মাঝারী থেকে ভারী বর্ষণে বরিশাল মহানগরীর পুরোটাই পানির তলায়। এ অঞ্চলের অন্যান্য এলাকায়ও প্রায় একই চিত্র। চলতি খরিফ-২ মৌসুমে বরিশাল কৃষি অঞ্চলে যে ৮ লাখ ৮১ হাজার হেক্টর জমিতে আমন আবাদের লক্ষ্য রয়েছে, তার রোপনকৃত প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার হেক্টরের ধান প্রায় পুরোটাই প্লাবনের কবলে।
মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালা গত কয়েকদিন ধরেই বরিশালসহ সন্নিহিত এলাকা জুড়ে বৃষ্টি ঝড়াচ্ছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৬টার পূর্ববর্তি ২৪ ঘণ্টায় বরিশাল ও সিন্নিহিত এলাকায় ২২ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টি হলেও বুধবার সকালে তা ছিল ৭৫ মিলিমিটার। কিন্তু বৃহস্পতিবার সকাল ৭টার পর থেকে ঘনকালো মেঘ বরিশালে হালকা থেকে মাঝারী বৃষ্টি ঝড়িয়ে দুপুর ১২টার পরে তা প্রবল আকার ধারণ করে। তবে আগামী শনিবারের পর থেকে বরিশালে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা হ্রাস পাবার খবর জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর।
বরিশাল মহানগরীর বেশিরভাগ এলাকাসহ রাস্তাঘাটও সয়লাব হয়ে আছে। নগরের অভ্যন্তরসহ কির্তনখোলা নদীর সাথে সংযুক্ত খালগুলো জোয়ারের সাথে বৃষ্টির পানিতে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে। ফলে ড্রেন থেকে খাল হয়ে নদীতে পানি নামছে না। চরম বিপর্যয়ের কবলে গোটা নগরজীবন। নগরীর বহু বাড়ি ঘরে পানি প্রবেশ করায় অনেক বাড়িতেই গত কয়েকদিন চুলা পর্যন্ত জ্বলছে না।